১২

মীরা প্রথমটা আলাপ পরিচয়ে একটু অন্তমনস্ক ছিল, নূতন পরিচয়ের জড়িমাটা লাগিয়াছিল একটু, চৌকাঠ ডিঙাইয়া বহিরঙ্গনে পা দিতেই কিন্তু তাহার মনটা যেন নূতন আবেষ্টনীতে একেবারে সাড়া দিয়া উঠিল। চলিতে চলিতে মাঝখানটিতে দাঁড়াইয়া পড়িয়া একবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিক চাহিয়া লইয়া বলিল, “কি সবুজ শৈলেনবাবু, সবুজে যেন চোবান! এবার বুঝতে পেরেছি আপনি কিসের টানে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছেন।”

বাড়ির দিকে না গিয়া ডান দিকে তরুলতায় জড়ানো ছোট চাঁপা গাছটার কাছে চলিয়া গেল, পুষ্পভরা লতার একটা ডগা তুলিয়া ধরিয়া বলিল, “কি চমৎকার ফুল! কি ছোট্ট! কি রাঙা…কি নাম এর? বিলিতি ফুল নাকি—আর, পাতা কি চমৎকার—চিরুনির মত।”

বলিলাম, “না, বিলিতি হ’তে যাবে কেন? একেবারে দিশী। তরুর অন্তত চেনা উচিত।”

হাসিয়া তরুর পানে চাহিলাম।

মীরা রহস্যটা বুঝিতে না পারিয়া অম্বুরীর পানে চাহিল, অম্বুরী বলিল, “একেই তরুলতা বলে, তাই বলছেন ঠাকুরপো।”

নামের এই মিলে মীরার মুখটা একরকম বিস্ময়মিশ্রিত হাসিতে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। ওদিকে তরু আরও সংকুচিত হইয়া উঠিয়াছে। মীরা কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার লতার একবার তরুর পানে চাহিয়া বলিল, “কি আশ্চর্য শৈলেন বাবু!—এই তরুলতা?”

একটু নালিশের সুরে বলিল, “আপনি জানতেন অথচ বলেন নি আমাদের—” মীরা আবার ছেলেমানুষ হইয়া পড়িয়াছে; কোন কিছুতে অভিভূত হইয়া পড়িলে উহার এই অবস্থা হয়। জানিলেও এ সম্বন্ধে আমার বলিবার কি ছিল?

হঠাৎ অম্বুরীর পানে চাহিয়া বলিল, “আমি যাবার সময় কতকগুলো চুরি ক’রে নিয়ে যাব। মা যে কী ভীষণ আশ্চর্য হ’য়ে যাবেন! কিছু বলতে পারবেন না কিন্তু আপনি, আমার ভয়ংকর ভাল লেগেছে।”

অম্বুরী বলিল, “বলব বৈকি, শুধু এক কড়ার না বলতে পারি।”

মীরা একটু থতমত খাইয়া প্রশ্ন করিল, “কি?”

অম্বুরী তরুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “আপনার তরুলতাটি আমায় দিয়ে যাবেন; আমারও বড্ড ভাল লেগেছে। সত্যি কি চমৎকার!”

সকলের হাসিতে তরু আরও সংকুচিত হইয়া পড়িল। মীরা হাসির পরেই গম্ভীর হইয়া বলিল, “এটা কিন্তু ঠিক হল না।”

এবার অম্বুরী একটু থতমত খাইয়া গেল। কোথাও আধুনিক ভদ্রতার ত্রুটি হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া মীরার চেয়েও অপ্রতিভ ভাবে প্রশ্ন করিল, “কি?—কি কি হয়নি?”

মীরা বলিল, “আমি আসতেই আপনি– এস ভাই বলে আমায় ডেকে নিলেন! এরই মধ্যে কিন্তু সুর বদলে ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ করে বসেছেন!’

অম্বুরী যেন আশ্বস্ত হইয়া বলিল, “এই কথা?”

মীরা বলিল, “এই কথা বটে, তবে সামান্য কথা নয়, কেন না ঐ স্নেহভয়ে ছোট ক’রে যে ডেকেছিলেন তারই জোরে আমি মনে মনে একটা সম্বন্ধ ঠিক ক’রে ফেলে ছিলাম।”

তাহার পর তরুর পানে চাহিয়া বলিল, “বাঃ, তরুর দিদি আছে আমার নেই,—আমার হিংসে হবে না?”

একটা প্রীতির রস যেন সবার মনটাকে ভিজাইয়া তুলিতেছে।

অম্বুরী বলিল, “আমি ভেবেছিলাম পাড়াগেঁয়ে মানুষ—মস্ত একটা ভুল হ’য়ে গেছে কথাটা বলে, তাই…”

মীরা বিপন্নভাবে বলিল, “তবুও মনে করবেন—মস্ত একটা ভুল হয়নি? পাড়া-গেঁয়েদের বোঝান শক্ত দেখছি তো!”

আবার একটা হাসি উঠিল।

আর একটু দেখিয়াই মারা বলিল, “চলুন ভেতরে যাই, যেখানে দাঁড়াচ্ছি কিন্তু নড়তে ইচ্ছে করছে না অনিলবাবু। আর কে কে আছেন বাড়িতে?”

অনিল বলিল, “ঠিক তো, চলুন ভেতরে! ভেতরে শুধু আমার মা আছেন আর। আপনাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, দুই গেঁয়োতে মিলে আমরা কি ভুলটাই ক’রছি দেখুন সেই থেকে!”

হাসিতে হাসিতে আমরা ভিতরে আসিলাম। রকের এক দিকটার অনিলের মা সানু আর খুকীকে লইয়া একটা মাদুরের উপর বসিয়া আছেন। পাশেই আর একখানা মাদুরের উপর একটা শীতলপাটি বিছানো, আগন্তুকদের জন্য। অম্বুরীর অতন্দ্রিত চেষ্টায় বাড়িটা সর্বদাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, আজ যেন আরও ঝকঝকে তকতকে। যা মিনিট পাঁচ-ছয় হাতে পাইয়াছিল, তাহাতেই সে ছেলেমেয়ে থেকে আসবাবপত্র পর্যন্ত সবতাতেই ত্বরিতে তাহার যাদুস্পর্শটুকু দিয়া বাহিরে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। প্রশংসা হইবে জানিয়াই আগেভাগেই বলিয়া রাখিল, “এই তোমার দিদির গেরস্থালি ভাই, আপন জেনে যদি একটু আনন্দ পাও। আগে একটু বসে জিরিয়ে নাও। তারপর হাত-পা ধুয়ে ফেল। আমি ততক্ষণ একটু চা ক’রে ফেলি…ঝি! নাইবার ঘরে জল-তোয়ালে …”

ঝি রকের পাশে বিমূঢ়ভাবে দাঁড়াইয়া ছিল, বলিল, “দিয়েছি জল।”

মা নুতন মানুষের সঙ্গে প্রবেশ করিতেই খুকী চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, সানু মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চক্ষু বড় বড় করিয়া বলিল, “ঠব্বনাশ! কলকাটা ঠেকে সবাই এসেছেন খুকু, ঠভ্য হয়ে বসটে হয়।”

তাহার কাণ্ডখানা দেখিয়া সবাই হাসিয়া উঠিলাম। মীরা ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া অনিলের মায়ের চরণস্পর্শ করিয়া প্রণাম করিল, তরুও অনুকরণ করিল। অনিলের মা উভয়ের চিবুক স্পর্শ করিয়া হাতটা ওষ্ঠে ঠেকাইলেন! বলিলেন, “এস মা, এইমাত্র এলে?”

মীরা খুকীকে কোলে লইতে লইতে বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আবার এই মাত্র চলে খেতে হবে।”

বৃদ্ধা একটু শঙ্কিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, “ওমা! কেন?”

মীরা খুকীকে বুকে চাপিয়া এবং সানুর হাত ধরিয়া পাটির উপর বসিতে বসিতে বলিল, “আপনার বৌ আমাদের এক মিনিট বসিয়ে তার পরেই পা ধুইয়ে আর সঙ্গে সঙ্গেই চা খাইয়ে, বিদেয় ক’রে দিতে চান।”

আবার হাসি উঠিল। অম্বুরী বলিল, “না ভাই, ঘাট হয়েছে, তোমার যখন যা খুশি কর। ঐগুলো তো সব সারতে হবে, যত দেরি কর ততই আমার লাভ।”

খানিকক্ষণ ধরিয়া বেশ গল্প জমিয়া উঠিল—কেন্দ্র খোকা-খুকী, পাড়ার খানিকটা পরিচয়, খানিকটা কলকাতার প্রসঙ্গ। এক সময় রাগিলও মীরা আমার উপর, বলিল, “অনিলবাবুর যে খোকা-খুকী আছে, একথা ঘুণাক্ষরেও আমায় জানতে দেননি, পুতুল নিয়ে আসতাম তাহ’লে, এখানে আর কি পাওয়া যাবে? –বলিয়া ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দশটা টাকা বাহির করিয়া, অনিল-অম্বুরী আপত্তি করিবার পূর্বেই সানুর দুই হাতে দিয়া মুঠাটা বন্ধ করিয়া দিল। তাহার পর তরুর দিকে চাহিয়া বলিল, “ওঠ তরু, দিদির বাড়ি ঘর-দোর ভালো ক’রে দেখে আসি; উনি নিজে দেখাবেন না।”

মীরা ক্রমেই মুক্তভাবে জায়গাটার সঙ্গে মিলিয়া যাইতেছে। ওরা তিনজনেই উঠিয়া গেল, আমরা বসিয়া রহিলাম। ঘর-দুয়ার দেখিয়া ছাদে গেল, কিছু বেশিক্ষণ কাটাইল সেখানে। মাঝে মাঝে এক-একটা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কানে আসিতেছে—মীরার মুখের; চারিদিকের আবেষ্টনীর প্রশংসা—কোন একটা গাছের লতার, কোনও ফুলের। উপরে গিয়া তরুরও মুখ খুলিয়াছে। তরু বলিতেছে, “আজ সকাল বেলা এলে হ’ত দিদি, এক্ষুণি তো চলে যাবে…”

সময়ের অল্পতার কথাই উহাকে অন্তরে অন্তরে ব্যাকুল করিয়া তুলিয়াছে।

একটু পরে উহারা নামিয়া আসিল। অম্বুরী বলিল, “এইবার ভাই ঠাট্টাই কর আর যাই কর, শুনছি না। মুখ হাত ধোও গিয়ে; আমি ততক্ষণ চায়ের যোগাড় দেখি। কত দূর থেকে এসেছ বল দিকিন! আর এই রোদ্দুরটা গেছে তো মাথার ওপর দিয়ে?”

মীরা বলিল, “না, আপনি চা করলে চলবে না দিদি, দাঁড়ান আমি মুখ-হাত ধুয়ে এক্ষুণি আসছি।”

অম্বুরী বলিল, “বাঃ, আর আমি খারাপ চা করি নাকি? জিজ্ঞেস কর বরং ঠাকুরপোদের।”

মীরা স্নানাগারে যাইতে যাইতে ফিরিয়া বলিল, “ঠাকুরপো প্রভৃতি যাঁরা খুশি হবার জন্যেই সর্বদা তোয়ের হ’য়ে রয়েছেন তাঁদের খুশি করা শক্ত নয়। আমার কিন্তু বিশ্বাস পাড়াগেঁয়েরা যেমন কথা বলতে ভুল করে তেমনি চা করতে মোটেই পারে না। ভাই নিজে ক’রে খাব।” বলিয়া হাসিয়া চলিয়া গেল।

ফিরিয়া আসিয়া মীরা আমাদের বলিল, “আপনারা এবার একটু ওপরে যান। রান্নাঘরের মধ্যে রান্নার নুন্-মসলা খুঁটিনাটি নিয়ে আমাদের একটু ঝগড়াঝাঁটি হ’তে পারে, আমরা চাই না যে পুরুষে দেখে সেটা।”

অনিল উঠিতে উঠিতে বলিল, “ঝগড়াঝাঁটি হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই বিচার-সালিসী প্রভৃতির জন্যে পুরুষের থাকা প্রয়োজন।”

মীরা বলিল, “মাফ করবেন, আপনারা দূরেই থাকুন; ব্যারিস্টারের মেয়ে—বিচার-সালিসীতে আপনারা কতটা সাহায্য করেন আমার খুবই জানা আছে।”

আবার একটা হাসির উচ্ছ্বাসের মধ্যে আমরা বিভক্ত হইয়া গেলাম।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক উপরে থাকিতে হইল। মীরা যে একটা রন্ধনযজ্ঞ লাগাইয়া দিয়াছে তাহা উপর হইতে বেশ টের পাইতেছি। একবার সিগারেট লইবার জন্য নীচে নামিয়া দেখি মীরা শাড়ির আঁচলটা বাঁ-কাঁধ দিয়া ঘুরাইয়া আনিয়া কোমরে জড়াইয়া পাকা গিন্নীর মত একটা খুন্তি লইয়া কড়ায় প্রবল বেগে কি একটা সঞ্চালিত করিয়া যাইতেছে। অম্বুরী বোধ হয় লুচি বেলিতেছে; পিঠের উপর খুকী। কাজের সঙ্গে কি একটা হাসির কথা চলিতেছে যেন। রকটার দক্ষিণ দিকে একটা জামরুল গাছের তলায় রান্নাঘরটা। উহারা দুইজনেই আমার দিকে পিছন ফিরিয়া আছে। ভাল করিয়া দেখিতে না পাইলেও বেশ টের পাওয়া যায়, গৃহিনীপনার এই নূতন কাজে ঘরের তরল অন্ধকারের মধ্যে মীরার একটা নূতন রূপ ফুটিয়াছে। এলো-খোপারা গেরো আলগা হইয়া গিয়াছে, ব্লাউজের বাঁকা ছাঁটের উপরে অনাবৃত স্কন্ধের খানিকটা দেখা যায়—অধচন্দ্রাকারে মাঝখানটিতে চেনহারের সোনা চিক্ চিক্ করিতেছে। সুডৌল অনাবৃত হাতটি শখের রন্ধন-কার্যে যতটা দরকার তার চেয়েও একটু বেশি, চঞ্চল, তাহাতে একটু যেন ছেলেমানুষির ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে।

যতটুকু না দেখিয়া পারা গেল না দেখিয়া লইয়া সিগারেট লইয়া উপরে চলিয়া গেলাম। অনিল ওদিককার আলসের উপর একটু অন্যমনস্ক হইয়া বসিয়াছিল, প্রশ্ন করিল, “দুষ্মন্তবৃত্তি শেষ হ’ল?”

বলিলাম, “দেখছিস সিগারেট আনতে গিয়েছিলাম; চোখ নেই তোর?”

অনিল বলিল, “আমি তারও বেশি দেখতে পাচ্ছি; তিনটে চোখ আছে।”

একটু মৌনতাপ্ৰবণ হইয়া পড়িয়াছে অনিল, সিগারেট ধরাইয়া কয়েকটা টান দিয়া প্রশ্ন করিলাম, “ভাবিস্ কি?”

অনিল যেন একটা ঘোর থেকে জাগিয়া উঠিল, বলিল, “যা ভাবছিলাম তোকে আর সে-কথা বলা চলবে না।” এবং সঙ্গে সঙ্গেই সে-প্রসঙ্গটা অগ্রসর হইতে না দিয়া বলিল, “আশ্চর্য শৈল, আশ্চর্য এই মেয়েছেলেদের ক্ষমতা—মীরা এইটুকুর মধ্যে কি নিশ্চিহ্নভাবে মিশে গেছে দেখছিস্?”

আমি বলিলাম, “সে অম্বুবীর গুণ।”

“সেটা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু আমার মনে হয় মীরা এর মধ্যে আরু একজনকে বেশি ক’রে পেয়েছে।”

আমি একটু কৌতূহলী দৃষ্টিতে চাহিতে বলিল, “তোকে।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “আমি রান্নাঘরে রান্না করছি না অনিল, তোর কাছে রয়েছি।”

অনিল বলিল, “মীরার কাছে তুই রান্নাঘর থেকে নিয়ে বাইরের চৌকাঠ পর্যন্ত এই জায়গাটা ছেয়ে রয়েছিল শৈল, তাই এখানকার মাটি, এখানকার গাছপালা, এখানকার মানুষ যাদের সঙ্গে তুই রয়েছিস্, ওর কাছে এত মিষ্টি হ’য়ে উঠেছে। এর মধ্যেও আর একটা কথা রয়েছে, অবশ্য আমার আন্দাজ, কিন্তু ভুল আন্দাজ নয়।”

প্রশ্ন করিলাম, “কি?”

“মীরা ভেবেছিল—অন্তত মীরার বোধ হয় একটা সন্দেহ ছিল, তুই নেই এখানে! সত্যিই একটা ছুতো ক’রে কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিস্ কোথাও। মীরার দোষ নয়, দেবকন্যাও ভালবাসলে এ-সন্দেহ করত, মীরা তো মানুষ। তোকে দেখে মীরা বর্তে গেছে।”

বলিলাম, “তার তো কৈ কোন লক্ষণ দেখলাম না!”

“তোর মোটা দৃষ্টি দেখতে পাস্‌নি; ঐখানেই তো মীরার জিত। ও বরং তোর সঙ্গেই সবচেয়ে কম কথা কয়েছে, তোর দিকে সব চেয়ে কম দেখেছে, কিন্তু ঐ সবই হচ্ছে লক্ষণ। দেখিস, ও যা কিছু এখানে করবে, তোকে বাইরে যতটা সত্ত্বর বাদ দিয়ে করবে। শৈল, মেয়েরা সত্যিই শক্তির অংশ;—ওরা একই সঙ্গে, একই সময়ে খুব কাছে আর খুব দূরে থাকতে পারে। আমরা পুরুষেরা জড় একটা পাথরের চাঁইয়ের মত যদি কাছে থাকি তো না ঠেলে দিয়ে দূরে চলে যেতে চাই না, দূরে থাকি তো টেনে না নিলে কাছে আসবার ক্ষমতা নেই—একটা চেতনা-শক্তির নিগ্রহ বা অনুগ্রহের নিতান্তই অধীন, কপালে যেটা যখন জোটে…”

অম্বুরী আসিয়া বলিল, “মীরা একটু চা খাবার জন্যে ডাকতে পাঠালে।”

অনিলকে বলিলাম, “ওঠ, কপালে আাপাতত অনুগ্রহ দেখা যাচ্ছে।”

অনিল উঠিতে উঠিতে বলিল, “আমার মনে হয় নিগ্রহ—দু-ঘণ্টা ধরে দু-জনে যে রকম খেটেছে দেখছি তাতে গুরুতর একটা কিছু না দাঁড় করিয়ে ছাড়েনি।”

প্রায় চার ঘণ্টা ধরিয়া সমস্ত বাড়িটাতে একটা উচ্ছ্বাসের তরঙ্গ তুলিয়া রাত প্রায় আটটার সময় মীরা চলিয়া গেল। অম্বুরী আমাদের এবং পরে উহাদের নিজেদের এবং রাজু ও ড্রাইভারের আহারাদির পর কাছের দু-একটা বাড়ি হইতে মীরাকে একটু ঘুরাইয়া আনিল। তাহার পর সকলে মোটরে তুলিয়া দিয়া আসিলাম। বিদায়ের সময় মীরা অম্বুরীর হাতটা ধরিরা আমার পানে চাহিয়া বলিল, “তখন বলেছিলাম, বুঝতে পেরেছি কিসের টানে আপনি এখানে পালিয়ে এসেছেন, এখন বুঝছি কাদের টানে। এই দুটো টানের প্রভাব কাটিয়ে আবার আসছেন তো শৈলেনবারু?”

ফিরিবার সময় সবাই চুপ করিয়া রহিলাম। বাড়ির বহিরাঙ্গনে আসিয়া অম্বুরী বলিল, “একটা কথা বলব ঠাকুরপো? বলেই ফেলি, পেটে কথা থাকে না এ বদনাম তো আমাদের আছেই। মীরা বললে, শৈলবাবুকে বলো না দিদি আমার ভয় হয়েছিল উনি বোধ হয় একটা ভুল ঠিকানা দিয়ে দেশে চলে গেছেন, কেন না কলকাতা বোধ হয় ওর ভাগ লাগে না। তুমি নিশ্চয় পাঠিয়ে দিও দিদি, না হ’লে তরুর ভয়ানক ক্ষতি হবে।”

অনিল আড়চোখে একবার আমার মুখের পানে চাহিল।