বেশি নয়, সব মিলাইয়া হদ্দ ঘণ্টা তিনেক লাগিল, যেন কোথা হইতে কোথায় আসিয়া গিয়াছি, অন্য এক দেশ, অন্য এক যুগও যেন।

অনিলদের বাড়িটা একটা পাড়ার ভিতর দিয়া গিয়া একেবারে শেষের দিকে পড়ে। কাঁচা সরু গলি ছাড়িয়াই বাঁ-দিকে অনিলদের বাড়ির বাইরের উঠান দেওয়াল দিয়া ঘেরা, ইটে মাঝে-মাঝে নোনা ধরিয়া গিয়াছে। দেওয়ালের মাঝখানটার একটা চৌকাট আছে, কিন্তু দরজা নাই।

ভিতরে গিয়া দাঁড়াইলাম। চাপা, সবুজ দুর্বা ঘাসে উঠানটা ভরা, তাহার একটু বাঁয়ে ঘেঁষিয়া পায়ে পায়ে তৈয়ারী সরু পথটা ভিতর-বাড়ির দিকে চলিয়া গিয়াছে। ডান দিকটায় একটু আগাছার জঙ্গল, কচু, আশ্‌-শ্যাওড়া, ভাট! তাহাদের উপর ছায়া ফেলিয়া একটা নোনার গাছ ফলে নুইয়া গিয়াছে। একপাশে একটা ছোট চাঁপার গাছ, গা বাহিয়া কতকগুলা তরুলতা উঠিয়াছে, সরু সরু টকটকে রাঙা ফুলে ভরিয়া রহিয়াছে।….হঠাৎ কি করিয়া জানি না, মীরাদের অতি-পরিচ্ছন্ন, সুসংযত বাগানের ছবিটা মাথায় যেন একবার উঁকি মরিয়া গেল।

একেবারে ভিতরে গেলাম না। কিসের যেন একটা ঘোর লাগিয়াছে মনে হইতেছে সব রসটুকু নিংড়াইয়া পান করিতে করিতে অগ্রসর হই। রাস্তা দিয়াও আসিয়াছি যেন স্বপ্নে চলিয়া। পাশের বাড়িতে খানকতক বাসন ঝন্‌ঝনিয়া পড়িয়া যাওয়ার শব্দ হইল! সঙ্গে সঙ্গে একটা মুক্ত কণ্ঠের তিরস্কার, “ওলো বিয়ে হ’লে ছ-ছেলের মা হ’তিস্—এই কাজের ছিরি?”

একটু কানে বাজে; বিশেষ করিয়া তাহার, দীর্ঘ ছ’টা মাস যে কলিকাতার বাহিয়ে পা দেয় নাই, আর শেষের তিনটা মাস কাটাইয়াছে বালিগঞ্জের এক সুসভ্য ব্যারিস্টার-ভবনে। কিন্তু একটা ছবি খুব স্পষ্ট হইয়া ওঠে, নিতান্তই বাংলার ছবি। বড়, অনূঢ়া ঝিউড়ী মেয়ে—খিড়কির পুকুর থেকে বাসনের গোছা মাজিয়া বাঁ-হাতে সাজাইয়া লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল—অসাবধানতা—মায়ের শাসন—সব তিরস্কারেই আজকাল একটু বিয়ের কথা মিশান—বিয়ের কথায় লজ্জা—না হওয়ার জন্য বোধ হয় মনের অন্তস্তলে কোথাও একটি তপ্তশ্বাস… রৌদ্রক্লান্ত মুখটি আরও একটু রাঙিয়া উঠিয়াছে…

দ্বিপ্রহরের স্তব্ধ পল্লী আবার নিঝুম হইয়া পড়িল।

অগ্রসর হইয়া বাড়ির ভিতর-দুয়ারের কাছে আবার একবার দাঁড়াইয়া পড়িতে হইল। যদিও একটু ভয় হইতেছে বাহির হইতে বা ভিতর হইতে কেহ আসিয়া পড়িলে ব্যাপারটা দেখিতে বেশ মানানসই হইবে না; কিন্তু জানাশোনা লোক —এ ভরসাটাও আছে সঙ্গে সঙ্গে। আসল কথা, বাংলার রূপটি সব মিলিয়া এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়া উঠিতেছে, এমন কিছুই করিতে মন সরিতেছে না যাহাতে সে রূপটি চকিত, ত্রস্ত হইয়া মিলাইয়া যায়। কে ‘অন্নদা-মঙ্গল’ পড়িতেছে, খুবই সম্ভব অম্বুরী—ছন্দের একঘেয়ে বিলম্বিত সুর ভাসিয়া আসিতেছে —

অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে।

পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটনীরে॥

সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী।

ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি॥

ঈশ্বরীরে জিজ্ঞাসিল ঈশ্বরী পাটনী।

একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি॥

পরিচয় না দিলে করিতে নারি পার।

ভয় হয় কি জানি কে দিবে ফেরফার॥

ঈশ্বরীকে পরিচয় করেন ঈশ্বরী।

বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি॥

কি রকম একটা আবেগে আমার চোখ যেন ভিজিয়া আসিতে চাহিল। বহু বৎসর পরে অনেক দূরের কোন এক প্রবাস হইতে যেন ফিরিয়া আসিয়াছি। ধমনীর সমস্ত রক্ত যেন সাড়া দিয়া উঠিল; ঠিক এই আমার নিজের ভূঁই। যুগ যুগ  ধরিয়া এখানে দেবতায়-মানুষে লীলার খেলা হইয়া আসিয়াছে, তাই বহু যুগের সহজ-অভিজ্ঞতার দাবীতে এখানে মানুষ বিশ্বাস করে, দেবতা ছলনা করিয়া পাটনীকে ডাকিয়া খেয়া পার হইল, আলতা-রাঙা পায়ের স্পর্শে সেঁউতি সোনা করিয়া দিয়া পারণী-মূল্য দিয়া গেল। বুঝিতেছি, কলিকাতা এ দেশের গায়ে একটা পরগাছা—তার আকাশ-বাতাস, রাস্তা-ঘাট, মানুষ সব সমেত একটা পরগাছা কলিকাতা। আজ সকাল পর্যন্ত এই চারিটা বৎসর আমি এইখানে ব্যয় করিয়াছি! কী সব শ্রীহীন বাড়ি—শাসনক্লিষ্ট বাগান—মিস্টার রায়—মীরা…কি সব অনাত্মীয়—কোন্ দেশের—কত দূরের…

মাঝে মাঝে একেবারে অন্যমনস্ক হইয়া যাইতেছি, মাঝে মাঝে আবার অম্বুরীর সুর জাগিয়া উঠিতেছে—টানাটানা—অলস মধ্যাহ্নের সঙ্গে লয়ে মেশান—

বসিলা নায়ের বাড়ে নামাইয়া পদ।

কিবা শোভা নদীতে ফুটিল কোকনদ॥

পাটনী বলিছে মাগো বৈস ভাল হ’য়ে।

পায়ে ধরি’ কি জানি কুম্ভীরে যাবে ল’য়ে॥

ভবানী বলিছে তোর নায়ে ভরা জল।

আলতা ধুইবে পদ কোথা থুই বল্॥

পাটনী বলিছে মাগো শুন নিবেদন।

সেঁউতি উপরে রাখ ও রাঙাচরণ॥

হুঁশ হইল, বেশি দেরী হইয়া যাইতেছে। “অনিল আছিস?”—বলিয়া আমি ভিতরের উঠানে গিয়া দাঁড়াইলাম।

উঠানের ডান দিকে টানা রক, তাহার পরেই ঢাকা বারান্দা, দুয়ার খোলা। বারান্দার মেঝেয় মাদুর পাতিয়া অঙ্গুরী উবুড় হইয়া শুইয়া বই পড়িতেছে, পাশে অনিলের মা একটা বালিসে মাথা দিয়া এদিক ফিরিয়া শুইয়া আছেন। মাঝখানে কোলের মেয়েটি নিদ্রিত। অনিলের ছেলে দুই হাতের মধ্যে চিবুক রাখিয়া মা’র মুখের পানে চাহিয়া বসিয়া আছে।

প্রথম ডাকে ধ্যান ভঙ্গ হইল না কাহারও। তখন চলিতেছে—

সোনার সেঁউতি দেখি পাটনীর ভয়।

এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়॥

“খোকা!” বলিয়া আবার ডাকিলাম আর একটু জোরে।

অম্বুরী হুড়মুড়িয়া উঠিয়া একবার আমার পানে চাহিয়াই এক গলা ঘোমটা টানিয়া বাঁ-হাতে ভর দিয়ে বসিয়া রহিল। অনিলের মায়ের গলাটা বার্ধক্যের হেতু কাঁপিয়া গিয়াছে, কালা মানুষ, দৃষ্টিও ক্ষীণ হইয়া গিয়াছে; একটু টানিয়া প্রশ্ন করিলেন, “থামলে কেন বৌমা, কি হ’ল?”

খোকা প্রথমটা ভয়ে, পরে বিস্ময়ে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া আমার পানে চাহিয়া ছিল, হঠাৎ উল্লসিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “ওমা, শৈল টাকা! কি ঠব্বনাশ!”

“পারলে চিনতে?”—বলিয়া আমি হাসিতে হাসিতে গিয়া রকে উঠিলাম। বলিলাম, “তোমার মা অত শিগ্‌গীর চিনবে অবশ্য আশা করি না।”

অম্বুরী ঘোমটা তুলিয়া দিয়া উঠিল দাড়াইল।—“ঠাকুরপো! … ওমা, ঠাকুরপো এসেছেন।”

আমি গিয়া পায়ের ধূলা লইয়া বলিলাম, “জেঠাইমা, আমি শৈলেন।”

বৃদ্ধা উঠিয়া বসিয়া আমার চিবুক স্পর্শ করিয়া হাতটা চুম্বন করিলেন। বলিলেন, “ওমা দেখ! আজ সকাল থেকেই বাঁ চোখটা নাচছে, তোমায় বললাম না বৌমা—কিছু একটা সুখবর আছে—হয় কেউ আসবে, নয়…”

অম্বুরী বলিল, “আমারও তো কাল রাত্তিরে হাত থেকে ঘটিটা পড়ে গেল বললাম—‘রেতের কুটুম চাঁড়ালের বাড়ি যা’…উঃ, কতদিন আসনি যে ঠাকুরপো!”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “আসবার আঁচ পেয়েই কাল রাত্তির থেকে তুমি যে রকম অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেছ, অম্বুরী, তাতে…”

এখানে একটা কথা না বলিয়া রাখিলে ঠিক হইবে না। অনিল আমার চেয়ে বছরখানেকের বড়, একটু বেশিই হইবে; তাই অম্বুরী যখন নূতন আসিল ‘বৌদি’ বলিয়া শুরু করিয়াছিলাম। অনিল সে-বন্দোবস্তটা স্থায়ী হইতে দিল না। বলিল, “চিরটা কাল বয়সের একটু খাতির না ক’রে দিব্যি ইয়ারকি মেরে এলি, আজ ওর ওপর ভক্তিতে আমায় দাদা ক’রে তুলবি সেটি হবে না। ও রইল আমাদের দু-জনের মাঝখানে, যেমন ছিল সদু। যা নাম দিয়ে মুখ দেখেছিলি তাই বলে ডাকতে হবে; শপথ দেওয়া রইল।”

অম্বুরী আমার বিদ্রূপে লজ্জিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “শোন কথা! তুমি আসছ কি আমি জানি?”

অনিলের মা বলিলেন, “তারপর, আছিস কেমন শৈল? প্রায়ই জিগ্যেস করি অনাকে, বলে…”

অম্বুরী শাশুড়ীর কথাটা লইয়া অনুযোগের সুরে বলিল, “বলে, আর চিঠি দেয় না বেশি, বড়লোকদের বাড়িতে পড়ায়—বড়লোকের মেয়েকে (অম্বুরী একটা কটাক্ষপাত করিল)– আমাদের সবাইকে ভুলে গেছে—বলবেই তো, কেন বলবে না বল?… কি আর এমন অন্যায় বলে?”

অনিলের মা আমার পক্ষ লইয়া বলিলেন, “তাই কি পারে গা ভুলতে?—কাজের ভিড়…”

আমি অম্বুরীর দিকে আড়ে চাহিয়া বলিলাম, “তা নয় হ’ল, কিন্তু যে বলে এ-সব কথা সে কখন আসবে বল তো? তার উকিলের সঙ্গে মেলা বকাবকি ক’রে কি হবে?”

অম্বুরী ঈষৎ হাসিয়া মুখ ঘুরাইয়া লইল; অনিলের মা-ই উত্তর দিলেন, “অনার সেই বাধা সময়, ছ’টা কুড়ির গাড়ি, বাড়ি আসতেই সন্ধ্যে।”

কেমন যেন তন্ময় হইয়া গিয়াছি। দাঁড়াইয়া আছি, এক হাতে সুটকেস, এক হাতে খোকার জন্য কেনা সন্দেশের ছোট তিজেলটা; ভুলিয়া গিয়াছি…দেওয়া হয় নাই তখনও, না-দেওয়ার জন্য থোকা উৎসাহের মুখে আড়ষ্ট হইয়া থামিয়া গিয়াছে। হঠাৎ একবার তাহার লোলুপ দৃষ্টির প্রতি নজর পড়িতেই মনে পড়িল বলিলাম, “দেখো। … খোকা আয়, খাবার নে, ভুলেই গেছি! কত বড় হয়েছিস রে তুই!…ওর জিবের আড়টা এখনও যায়নি দেখছি যে…”

অম্বুরী হাসিয়া বলিল, “না, কবে যে যাবে তাও জানিনে, চার পেরিয়ে পাঁচে পড়বেন এবার। এখন কথার মাত্রা হয়েছে—‘ঠব্বনাশ’… শুনলে তো? তুমি আসতেই… কাকা বাড়ি এলে ‘সর্ব্বনাশ’ বলতে আছে বোকা ছেলে? প্রণাম করতে হয় না কাকাকে? সন্দেশের হাঁড়ি তো দু-হাতে বাগিয়ে ধরেছ যাত্রার দলের হনুমানের মতন…

শাশুড়ী  হঠাৎ স্নেহের তিরস্কারে বলিলেন, “ওমা, কাণ্ডটা দেখ! শিশুকে বলছ, নিজের ভুলের হিসেব আছে?”

বধু ভীত-বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিল। শাশুড়ী বলিলেন, “বসতে বলেছ, শৈলকে? মুয়ে আগুন, আমিই বা কাকে বলছি? বুড়ো হ’য়ে ভীমরতি হয়েছে, এবার যেতে পারলেই হয়…”

“ওমা, সত্যিই তো”– বলিয়া অম্বুরী অপ্রতিভ হইয়া তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে গিয়া একটা মাদুর লইয়া আসিল, সামনে চৌকির উপর বিছাইয়া দিতে দিতে বলিল, “আর তাও বলি—ঠাকুরপোকে নাকি কুটুমের মত ‘আসুন–বসুন’ বলে খাতির করতে হবে? বয়ে গেছে আমার।”

চিবুকটা হঠাৎ একটু সামনে বাড়াইয়া দিয়া একটু বেপরোয়া ভাব দেখাইয়া বলিল, “আমার বাপু বড্ড আহ্লাদ হয়েছে, ভুলে গেছলাম, পারিনি খাতির করতে! ঠাকুরপো রাগ করে, ভাজের হাতের ভাত চারটি বেশি ক’রে খাবে।”

বসিয়া জুতা খুলিতে খুলিতে হাসিয়া বলিলাম, “তুমি যে সত্যিই চাঁড়ালের বাড়িতে ব্যবস্থা করনি, এই ঢের খাতির, কি বলুন জেঠাইমা?”

অম্বুরীও তাঁহাকেই সালিশী মানিল, একটু অভিমানের সুরে বলিল, “সেই থেকে ঐ এক কথা ধরে বসে আছেন, রাত্তিরে হাত থেকে ঘটি পড়লে ঐ কথা বলতে হয় না মা? রেতের কুটুম যে চোর।”

জেঠাইমা হাসিয়া বলিলেন, “আহা, তুই আসবি তা কি জানত বেচারী? এমন দিন যায় না যেদিন শৈল-ঠাকুরপোর কথা একবার না বলে– আর আসে না, ভুলে গেছে খোকাকে এত ভালবাসত…”

অম্বুরী ত্রুটি সারিতে লাগিয়া গিয়াছে। আমার জামা, চাদর, জুতা, সুটকেস ভিতরে রাখিয়া দিয়া অনিলের চটিটা পায়ের কাছে বসাইয়া চলিয়া গেল।

অনিলের মা তাঁহার সেই ছোট করিয়া ছাটা চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালাইতে চালাইতে বলিলেন, “কত কথা যে একসঙ্গে ভিড় করে আসছে, কোন্‌টা যে আগে জিগ্যেস করব—বিয়ের কিছু ঠিকঠাক হ’ল শৈল?”

খোকা কখন অদৃশ্য হইয়াছে কেহ টের পায় নাই, হঠাৎ হাঁড়ি কোলে পাশের ঘর থেকে বাহির হইয়া প্রশ্ন করিল, “মা কটা ঠাব?”

অম্বুরী ওদের শোবার ঘর থেকে পাখা আনিতে গিয়াছিল, পাখা-হাতে বাহির হইয়া আসিয়া গালে হাতে দিয়া বলিল, “ওম্মা! আদ্দেক হাঁড়ি খালি ক’রে এখন জিগ্যেস ক’রতে এসেছে—ক’টা খাব? দে হাঁড়ি, বড্ড শক্ত পেট কিনা…”

আমি উঠিয়া খোকাকে টানিয়া কাছে লইলাম। হাঁড়ি থেকে দুইটা সন্দেশ বাহির করিয়া বলিলাম, “তুমি দু হাতে দুটো নাও খোকা। নাও অম্বুরী, খোকার হাড়ি তুলি রেখে দাও। খোকার হাড়ি থেকে যদি একটাও চুরি যায় তো তোমার কি করব বল তো খোকাবাবু।”

খোকা একবার চকিতে মায়ের দিকে চাহিয়া আমার কোলে আর একটু ঘেঁষিয়া বলিল, “ডাডার নাক কেটে ‥”

অঙ্গুরী ধমক দিতে থামিয়া গেল। আমি হাসিয়া উঠিলাম, অনিলের মাও মুখ টিপিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। অম্বুরী ঘরের তাকে হাঁড়ি তুলিয়া রাখিতে রাখিতে বলিল, “শুনলে তো? ঐ সব শেখায় বসে বসে। নিজেরা খেদা বোঁচা, আমার দাদার বাঁশিপানা নাকের হিংসেতেই গেল সব—”

গোড়ার প্রথম বিস্ময় আর আনন্দের ঝোঁকে যেটুকু ত্রুটি হুইয়াছিল। অম্বুরী চরকির মতঃঘুরিতে লাগিয়া গেছে। এবার আওয়াজ আসিল উঠানের ও-কোণ থেকে, তাহার পর রান্নাঘর থেকে…জেঠাইমা বলিতেছেন, “আমার কথার তো উত্তর দিলি না শৈল, চুপ ক’রে থাকলে শুনব কেন? একটা বিয়ে-থা কর এবার, বৌমার পাশে তোর বৌকে দেখে যেতে পারলে আমার কোন দুঃখ থাকবে না; তোকে তো কখনও আলাদা ক’রে দেখিনি, আমিও না, তোর জেঠামশাইও না…”

বেশ লাগিতেছে। চারিদিকের সঙ্গে বৃদ্ধার অলস অবান্তর কথাগুলা এমন মিলিয়া যাইতেছে! এখানকার ভাষাগুলোও সবার কি রকম হাল্কা স্বচ্ছ! যেন মনের কন্দর হইতে সোজা বাহির হইয়া আসিতেছে। আমার মুখের ভাষাও যেন বদলাইয়া গেছে, মাপিয়া-জুখিয়া, সাজাইয়া বলিবার কোন দরকার নাই।

খোকা মুখে সন্দেশ বোঝাই করিয়া, আমার মুখের পানে উল্টাইয়া চাহিয়া বলিল, “আমারও বিয়ে হবে শৈল টাকা, ডেলে বুড়ির ঠংগে, না ঠাম্মা?—এট্টু বড় মাছ—”

সকলে হাসিয়া উঠিয়া থামিয়া গেল।

আমি বলিলাম, “সেইটেই আগে দরকার; তুমি তাড়াতাড়ি সন্দেশটা খেয়ে নাও তাহ’লে।…অম্বুরীর পাশে দাঁড়াতে পারে এমন মেয়েও তো আগে খুঁজে বের করতে হবে জেঠাইমা?—সেটা কি খুব সহজ কথা?”

বধূগর্বে শাশুড়ীর মুখটা দীপ্ত হইয়া উঠিল, বলিলেন, “তা বটে শৈল, এমন বৌ হাজারে একটা মেলে না। তা যা বলেছিস্ …”

অম্বুরী একটা বড় কাচের গেলাসে করিয়া এক গেলাস সরবত আনিল। জেঠাইমার কথার উত্তরস্বরূপ বলিলাম, “তা আর নয় জেঠাইমা? এই দেখ না, প্রশংসা করেছি কি না করেছি, এক গেলাস সরবত এসে হাজির হ’ল!”

অম্বুরী গেলাসটা বাড়াইয়া ছিল। “কার প্রশংসা?” বলিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইল; সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখটা রাঙা হইয়া উঠিল, গেলাসটা তাড়াতাড়ি আমার হাতে দিয়া বলিল, “তোমাদের মায়েপোয়ে বুঝি ঐসব বাজে কথা হচ্ছে? বেশ, কর ঠেসে প্ৰশংসা, আমি উনুনে আঁচ দিয়ে এসেছি, যাই দেখিগে।”

লজ্জিতভাবে হন্‌ হন্ করিয়া চলিয়া গেল।

আমি বলিলাম, “আমি সাত তাড়াতাড়ি এলাম সবার সঙ্গে একটু গল্প-গুজব করতে…বেশ, এবার তাহ’লে নিন্দের পালা আরম্ভ হ’ল….”

অম্বুরী রান্নাঘর থেকেই উত্তর করিল, “হোক আরম্ভ। ওঃ, বছর ঘুরিয়ে কি সাত তাড়াতাড়ি আসা রে! ঐ-কথা ব’ল না, দেখব, আর একজনের কাছে!”

বলিলাম, “জেঠাইমা, তুমি একটু গড়াও বাছা, ব্যাঘাত হ’ল। আমি একবার দেখে আসি চারিদিকটা, ফিরে এসে খুকীটাকে তুলতে হবে… অনার ঘুম পেরেছে বেটী।”

অনিলের মা বলিলেন, “আবার পাগলামি এল ছেলের। এই দুপুর রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে কি দেখবি?”

হাসিয়া বলিলাম, “দুপুরই দেখব জেঠাইমা, অনেক দিন দেখিনি, দুপুর কাকে বলে ভুলে গেছি।”