সেই ছোট বারান্দাটিতে বাহিরের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া আছি। চক্ষুর সামনে এক-একবার অতিমাত্র স্পষ্ট হইয়া দৃশ্যগুলা জীবনের চাঞ্চল্য লইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। এক-একবার মিলাইয়া যাইতেছে—মনটা লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্টে ফিরিয়া আসিতেছে—সম্মুখে রাস্তা, রাস্তার ওধারে বাড়ির শ্রেণী, তাহার পিছনে গাছের জটলা জমিয়া উঠিতেছে। মনটা হু হু করিয়া উঠিতেছে; আমি ঠিক এখানকার মানুষ নয়, কলিকাতার নয়, লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্টের তো একেবারেই নয়। …কি অসহ্য কাটাছাঁটা, মাপাজোখা ব্যাপার! কি অসহ্য রকম মানানসই করিয়া তৈয়ারী সব! এক ইঞ্চি অপব্যয় নাই, এক ইঞ্চি অতিরিক্ততা নাই—রাস্তাই বল, বাড়িই বল, বাগানই বল, কড়া হিসাবের যারা নিয়ন্ত্রিত। এই অসহ্য শুভঙ্করের রাজ্যে মানুষগুলা পর্যন্ত যেন এক-একটা অঙ্ক তাহাদের বাঁধা প্রসেস্ বা পদ্ধতির মধ্য দিয়া এক-একটা অমোঘ পরিণামের দিকে অগ্রসর হইতেছে। এক চুল এদিক-ওদিক হইলে অঙ্ক ভুল হইয়া যাইবে। রাজু বেয়ারা পর্যন্ত যেন একটা এ্যালজেব্রার ফরমুলা। সামনে দিয়া দোল-উৎসব গেল, আশা করিয়াছিলাম অন্তত বেহারী চাকরটা আউটহাউসে ভুলিয়াও একটা ছাপরেয়ে তান্ ধরিয়া বসিবে। কিছু করিল না; —সমীচীনতার তাসের ঘর ভূমিসাৎ হইয়া যাইবে যে!

মিস্টার রায় চমৎকার, অপর্ণা দেবী আরও চমৎকার—কিন্তু এখন অনুভব করিতেছি আমার সঙ্গে মিল নাই; শ্রদ্ধা করি, কিন্তু যেন মনে হইতেছে অনেক দূর থেকে।…সব চেয়ে আত্মীয়া মীরা—তাহার প্রাণের সঙ্গে মিতালি পাতাইতে বসিয়াছি, কিন্তু কোথায় তাহার প্রাণ?—আছে কি? পাওয়া যাইবে কি কখনও? এই কি ভালবাসিতেছি? না, খুব বিচক্ষণ মনস্তাত্ত্বিকে লেখা একটা উপন্যাস পড়িয়া যাইতেছি মাত্র? অশ্রুবিন্দুটি পর্যন্ত যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমনই—যেখানে দুইটি মানায় সেখানে তিনটি বিন্দু গড়াইয়া পড়িবে না।

এর চেয়ে সেই চিত্র–সদু পানফল চাহিয়াছে, ঠিক-দুপুরের সূর্যের অভিশাপকে আশীর্বাদ করিয়া লইয়া আমি আর অনিল দু-জনে বসিয়া আছি, যদি ধরা পড়ি কপালে আছে তারিণী জেলের লগুড়। কি রকম স্পষ্ট, নিঃসন্দিগ্ধ একটা ব্যাপার, একদিকে কত বড় উল্লাস আর অপর দিকে কি ভীষণ পরিণাম! রাজকন্যার জন্য সোনার গাছে মুক্তার ফল আহরণ করিবার অভিযান থেকে কিসে কম?

না, হে ভগবান, আমায় ঐ রকম করিয়া ভালবাসিতে দাও, তাহাতে আসুক মুক্তি, আসুক প্রসার। অম্বুরীর মত, আমাকেও যে ভালবাসিবে তাহার প্রাণে একটা খুব বড় রকম মিথ্যার বাহুল্য থাকুক, সে আমায় বলুক জন্ম-জন্মান্তর ধরিয়া সে আমার সামান্য খুঁটিনাটির দিকে পর্যন্ত চক্ষু নিবদ্ধ করিয়া বসিয়া থাকিবে, আর আমি মুগ্ধ বিশ্বাসে সেই মিথ্যাকে সত্য বলিয়া বুকে ধরিয়া রাখি।

অনেকক্ষণ পরে চিন্তায় একটা অবসাদ আসিল। কলিকাতা স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

অনেকক্ষণ ধরিয়া স্থির চিন্তার দ্বারা মনটা শান্ত করিবার চেষ্টা করিলাম। নিজের অজ্ঞাতসারেই কোন্ উর্ধ্বলোকে যেন উঠিয়া গিয়াছি, ধীরে ধীরে আবার নামিয়া কঠিন মাটির স্পর্শ অনুভব করিলাম। অনিলের হাতের লেখাটা পুরানো স্মৃতিকে ঘাটাইয়া মনটাকে বিচলিত করিয়া তুলিয়াছে। …না, এটা ঠিক স্বাভাবিক অবস্থা নয়। মন আমার শান্ত হউক; যেন রূঢ়-সত্য এই জীবনের দিকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতে পারিবার শক্তি না হারাই। আমার এখান থেকে যাইলে চলিবে না এখন। কলিকাতাও সত্য, মীরাদের দেওয়া টাকাটা আরও সত্য। ভাগ্যে মীরাদের সঙ্গে সম্বন্ধটা কাটাইয়া দিয়া আসি নাই। আমি আজ একজন উদীয়মান ছাত্র, আমার আলোচনা ছাত্র-মহলের একটা বড় প্রসঙ্গ, প্রফেসাররা আমার মুখের দিকে চাহিয়া আছেন। মীরার দেওয়া এই টুইশ্যনই ত সবার মূলে।

আশ্চর্য, অনিলের চিঠিটা এখনও পড়াই হয় নাই; এত ছবি, এত কথা মনে ভিড় করিয়া আসিলই বা কোথা হইতে?

খাম খুলিয়া চিঠিটা পড়িলাম।

অনিলের লেখা ঠিকানায় একটু ভুল ছিল। লিণ্ড্‌সে ষ্ট্রীট লেখা ছিল, তিনদিন ঘুরিয়াছে চিঠিটা। এখানে ঐ ব্যাপার লইয়া বেশ একটু গোলমাল হয় মাঝে মাঝে। লিণ্ড্‌সে ষ্ট্রিট আছে, লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্ট আছে, আবার লিণ্ড্‌সে হাউস বলিয়া বড় একটা কারখানা আছে, সেখানে একবার ঢুকিলে তাহাদের নানা ডিপার্টমেণ্ট ঘুরিতেই কখন কখন চিঠির দুইটা দিন কাটিয়া যায়। ব্যাপারটা আগে আমি জানিতাম না। সবে কাল রাত্রে আহারের সময় মিস্টার রায়ের একটা চিঠি গোলমালের প্রসঙ্গে আমার সামনে কথাটার প্রথম আলোচনা হইল। আমি এখানে আসিয়া অবধি তিনখানা পত্র দেওয়ার পর অনিলের পত্র পাইয়াছি। রহস্যটা পরিষ্কার হইল।

অনিল অত্যন্ত চটিয়াছে। আমার প্রথম পত্রের উত্তরও দিয়াছিল, দুইখানি। দ্বিতীয় চিঠি ও পায় নাই, আদৌ বিশ্বাস করে না যে আমি লিখিয়াছি—একটা ভাঁওতা আমার। তৃতীয় পত্র পাইয়াছে, কিন্তু এই দুইখানি পত্রের কোনখানিতেই ঠিকানা দেওয়া নাই। প্রথম দুইখানি চিঠি ও আমার আগেকার বাসার ঠিকানায় দিয়াছিল, আশা করিয়াছিল সেখান থেকে রিডাইরেক্টেড হইয়া আমার হাতে পৌঁছিবে। আমার পত্র পাইয়া বুঝিল পৌঁছায় নাই। আমার পুরোনো বাসায় লিখিয়া ঠিকানা আনাইয়া পত্ৰ দিল। কর্তাকে পত্র দিয়াছিল, তিনি ছেলেদের নিকট হইতে ঠিকানা লইয়া পাঠাইয়াছেন, লিখিয়াছেন ভুল হওয়া অসম্ভব নয়।

নূতন জায়গায় গিয়া ঠিকানা না দিয়া পত্র দেয় এমন লোকের মস্তিক নিজের ঠিকানায় আছে কি না অনিল সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছে। একটি মাত্র ছাত্রী পড়ানয় আরাম আছে স্বীকার করে অনিল, কিন্তু একটা কথা—যখন প্রতিদিন গড়পড়তা দশটি বারোটি করিয়া ছেলেমেয়ে পড়াইয়াছি তখন আমার চিঠি পড়িয়া কখনও মারাত্মক রকম ভ্রান্তি বা জটিলতার সন্ধান পায় নাই। চিন্তিত আছে,—একটু সন্দিগ্ধভাবে।

অনিলের নিজের অত হিসাব থাকে না, অম্বুরী খুকির জন্মতারিখ হইতে গুনিয়া বলিতেছে, ঠিক ছ-মাস সতের দিন আমি সাঁতরামুখো হই নাই। এই ছ-মাস সতের দিনে আমার কিরূপ পরিবর্তন হইয়াছে—আমাকে আর ওদের কাছে যাইতে বলা চলে কি না অনিল ঠিক বুঝিতে পারিতেছে না, তাই শুধু অবস্থাটা জানাইয়া দিল মাত্র।

ওর ছেলের কথা লিখিয়াছে; বয়সের অতিরিক্ত পাকা হইয়া উঠিতেছে। এদিকে জিভের আড়টা এখনও ভাঙে নাই, ট-বর্গের উপর পক্ষপাতিত্ব বেশি। সবচেয়ে দুর্বোধ্য ওর ব্যাকরণটা,—‘ক’ উচ্চারণ করিতে পারে, কিন্তু ‘কাকা’ বলিতে পারে না। আমার প্রসঙ্গ উঠিলে বলে ‘শৈল টাকা’। এ শব্দতত্ত্বের রহস্র ভেদ করিবার জন্য আর একজন,পাণিনির জন্মান দরকার।

অনিলের মা এমনই ভাল আছেন, তবে কানটা আরও খারাপ হইয়া গিয়াছে।

চিঠিটা মুঠোর মধ্যে লইয়া আবার বাহিরের পানে চাহিয়া রহিলাম। মনের-কোথায় বিদ্রোহ উঠিয়াছে, আমি প্রাণপণে লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্টের যশোগান করিয়া শান্ত-করিবার চেষ্টা করিতেছি। মন বলাইবার জন্য সাড়ম্বরে সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিতে লাগিলাম। ঠিক হইয়া গেল ছাড়িব না।

তাহার পর কি করিয়া কি হইল বলিতে পারি না, শুধু বুকের মধ্যে একটা প্রবল ব্যাকুলতা…একটু মুক্তি দাও আমায়, কলিকাতায় এই ইটের পাঁজার মধ্যে থেকে মুক্তি চাই সাঁতরার শ্যামল কোলে, অন্তত একটু দেখিবার মুক্তি…কয়েদী যেমন জানালার গরাদেটা চাপিয়া ধরিয়া বাহিরের খণ্ডিত দৃশ্যের পানে চাহিয়া থাকে।

ফিরিয়া আবাব মীরার ঘরের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। মুঠার মধ্যে কপালটা চাপিয়া সামান্য একটু চিন্তা করিলাম, তাহার পর প্রবেশের অনুমতি চাহিব, কণ্ঠস্বরটা একটু কাঁপিয়া গেল। পরিষ্কার করিতে গিয়া একটু শব্দ হইতেই মীরা ডাকিল, “কে? এস।”

মীরা জানালার গরাদে হাত দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়াছিল। ফিরিয়া আমায় দেখিয়া অপ্রতিভ আর বিস্মিত হইয়া যেন হঠাৎ কেমনধারা হইয়া গেল। ওর ডাকিবার ভাষাতেই বুঝিয়াছিলাম, এবারেও আমি আসিতেছি ভাবিতে পারে নাই।

তাড়াতাড়ি কাজটা সারিয়া লইবার জন্য বলিলাম, “আমি ক’টা দিনের ছুটি চাইতে এলাম। একবার ঘুরে আসব, মাস পাঁচেক যাইনি।”

মীরা যেন বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না একটা প্রকৃতিস্থ লোকের সঙ্গে কথা বলিতেছে। স্থির কতকটা শঙ্কিত দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, “এই বললেন যে থেকে যাবেন, এর মধ্যেই কি হ’ল আবার?”

বেশ মজার ব্যাপার। মীরা আমায় অপ্রকৃতিস্থ ভাবিতেছে বোধ হয়, অথচ, তাহার নিজের কথাই প্রকৃতিস্থ নয়। বলিলাম, “আমি তো ছেড়ে যাবার কথা বলছি না মীরা দেবী—”

“তবে?”

“ক’দিনের ছুটি চাইছি মাত্র।”

“ও। বাড়ি যাবেন?”

“না, বাড়ি আমাদের পশ্চিমে, অল্পেই যাওয়া-আসা চলে না, আমার এক বন্ধুর বাড়ি যাব, কাছেই।”

অনিলের মায়ের কানের কথা লইয়া একটা মিথ্যা রচনা করিয়া ফেলিলাম। “লিখেছে তার মায়ের অবস্থা বড্ড খারাপ, তাই, …”

“ও! তা বেশ, যাবেন। ক’দিনের জন্যে?”—দুর্বলতায় মীরার স্বরটা মনিবের মত হইয়া গেছে, অর্থাৎ ও অধিকারের জোর খাটাইতে চায়।

বলিলাম, “হপ্তাখানেকের জন্যে; ক্ষতি হবে?”

মীরা ধীরে ধীরে বলিল, “বে—শ। …না, ক্ষতি কিসের?”

নামিয়া আসিতেছি, সিঁড়ির মোড় ঘুরিব, মীরা উপর হইতে ডাকিল। দেখি রেলিঙের উপর ভর দিয়া নিম্নমুখী হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। বলিল, “শৈলেনবাবু, একটা কথা…”

আমি দুই ধাপ উঠিয়া আসিয়া বলিলাম, “কি বলুন!”

মীরা একটু মুখটা ঘুরাইয়া কি ভাবিল, তাহার পর বেশ শান্ত স্থির কণ্ঠে বলিল, “মাপ করবেন, তরুর ক্ষতি হবে বলে কথাটা বাধ্য হ’য়ে জিজ্ঞেস করতে হ’ল, অনুচিত জেনেও,—মানে আমায় আর টিউটরের জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে না তো? কথা হচ্ছে, অনিশ্চিতের মধ্যে না পড়ে থাকতে হয়—তাই…”

আমার মনটা অতিশয় ব্যথিত হইয়া উঠিল—এই নিরুপায় নারীকে কি করিয়া বিশ্বাস করাই ওর আশঙ্কা মিথ্যা?

শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে চাহিয়া বলিলাম, “মীরা দেবী, অযথা একটা প্রবঞ্চনা ক’রে যাব আমায় এমন ভাবলেন কেন? আমি যে নিজের তাগিদেই থেকে গেলাম এটা কি আপনি টের পাননি? বলুন?”

“নিজের তাগিদ” যে কোথায় মীরা আশা করি বুঝিল, বুঝিবে বলিয়াই বলা, তবু এর মধ্যে অর্থ-উপার্জনের কথাও যে আসিতে পারে এই সম্ভাবনার সুক্ষ্ম একটা অন্তরাল রহিল।

হয়তো আমার দেখিবার ভুল, কিন্তু মনে হইল মীরার সন্দেহক্লিষ্ট মুখটায় এক মুহূর্তের জন্য আশ্বাসের সঙ্গে লজ্জার একটা ক্ষীণ আভাস খেলিয়া গেল।