৭
পরদিন দুপুর বেলার কথা।
অনিল আপিসে গিয়াছে। বলিয়া গেল চার-পাঁচ দিন ছুটির চেষ্টা দেখিবে অর্থাৎ বাকী সমস্ত সপ্তাহটা। অনিলের মা রকে বিশ্রাম করিতেছেন। অম্বুরী বেড়াইতে গিয়াছে খুকীকে লইয়া। কোণের ঠাণ্ডা ঘরটা ধুইয়া মুছিয়া, দুয়ার-জানালা বন্ধ করিয়া আমার জন্য আরও শীতল করিয়া রাখিয়াছিল, খোকাকে লইয়া আমি শুইয়াছি। খুব ভাব হইয়াছে খোকার সঙ্গে। সকালে তাহার পছন্দমত আরও একরাশ খেলনা আনিয়া তাঁহার চিত্তটা একেবারে জয় করিয়া লইয়াছি! বেশ চমৎকার ছেলে; নাদুস-নুদুস মাথায় একমাথা তারকেশ্বরের মানত করা চুল, তিনটা জটা হইয়া গেছে; একটু চঞ্চল ভাবে মাথা নাড়া অভ্যাস বলিয়া সর্বদা ডমরুর দোলকের মত দুলিতে থাকে। কখনও কাপড় ঠিক রাখিতে পারে না, প্রায়ই কসিয়া গেরো দিয়া দিতে হয়, আবার কখন কি করিয়া খুলিয়া যায়, কাঁকালে জড় করিয়া লইয়া বেড়ায়। একটি শিশু ভোলানাথ। কথার মধ্যে ‘ট’ কারের বাড়াবাড়ি থাকায় আরও যেন আলগা, আপন-ভোলা বলিয়া বোধ হয়।
জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোকে কে বেশি ভালবাসে রে সানু?—মা, না বাবা?”
সানু বলিল, “ঠাম্মা।”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “ঠাকুরমার পর?”
পাশের ডল্ পুতুলটা আরও কাছে টানিয়া বলিল, “টুমি।”
আর কিছু প্রশ্ন করিবার পূর্বেই সানু চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, “বাট্রিরে ঠাম্মার কাছে যাবো বলে কাঁডলে কি হয় জান শৈল টাকা?”
জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হয়?”
“হুমো ঢোরে নেয়।”
এর পরে হুমোর নানা রকম কীর্তিকলাপের কথা বলিতে বলিতে খোকা একসময় ঘুমাইয়া পড়িল।
আমারও ঘুম আসিবার কথা, কাল অনেক রাত পর্যন্ত ছাদের উপর গল্প-গুজবে কাটিয়াছে, কিন্তু ঘুম আসিতেছে না। পল্লীর মধ্যাহ্ন কাল যেমন ছিল সেই রকমই স্তব্ধ, বরং বেশি। পাশের আগাছার মধ্যে একটা ঝিল্লীর অবিরাম সংগীত ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। আমি এই রূপের লালসাতেই কলিকাতা হইতে আসিয়াছি, কাল মুগ্ধ হইয়াছিলাম, আজ রূপ যখন আরও নিবিড় হইয়া ফুটিয়াছে, তখন আরও মুগ্ধ হওয়ার কথা, কিন্তু আজ ভাল লাগিতেছে না। একটা অব্যক্ত বেদনা অনুভব করিতেছি। এই ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে সুর মিলাইয়া মনের অতল শূন্যতায় কোথায় যেন একটা করুণ ক্রন্দন উঠিয়াছে। ক্রমে অভৃতি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়া লিণ্ড্সে ক্রেসেণ্টের দু-একটা দৃশ্য ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। সন্ধ্যার ধূসর শূন্যে যেমন ধীর সঞ্চরণে ফোটে তারা—অস্পষ্ট থেকে ক্রমে স্পষ্টতর হইয়া। আশ্চর্য, আর কাহারও কথা মনে পড়িবার আগে আমার মনে পড়িল সরমার কথা। তরুর কথা নয়, এমন কি মীরার কথাও নয়।
সরমা কিসের প্রতীক্ষায় আছে? মীরার দাদার কথা যতটা শুনি, তাহাকে নিজের সমাজে বা নিজের দেশে কখনও ফিরিয়া পাওয়া যাইবে তাহার আশা নাই। সে বাড়িতে কাহাকেও চিঠি দেয় না, কেন না, চিঠি দেওয়ার একটি মাত্র যে উদ্দ্যেশ্য শেষ পর্যন্ত দাঁড়াইয়াছিল—টাকা চাওয়া—বাড়িতে, বাহিরেও—সেটা সব জায়গায় বন্ধ হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত মাত্র অপর্ণা দেবীর কাছে চিঠি আসিত—ক্বচিৎ কখনও; কিন্তু টাকা পাঠাইবার বিপদ বা ব্যর্থতা তিনি উপলব্ধি করিতেই চিঠি বন্ধ হইয়া গিয়াছে—বহু দিন হইতেই। এখন অবশ্য অনেকের বিশ্বাস সরমার কাছে কখনও কখনও আসে চিঠি। কিন্তু আমার মনে হয় এ বিশ্বাসটুকু পরিণাম থেকে কারণে গিয়া ওঠা, অর্থাৎ সরমা যখন শবরীর ধৈর্য লইয়া এখনও প্রতীক্ষা করিয়া আছে, তখন নিশ্চয় ওর সঙ্গে যোগ আছে;—নিশ্চয় ও চিঠি পায়ই।
কিন্তু যদি থাকেও যোগসুত্র তো একতরফা, অর্থাৎ চিঠি দিলেও যে মীরার দাদা ঠিকানা দেয় না এটা নিশ্চয়, তাহা হইলে অন্তত আর একজনের সঙ্গে যোগটা থাকিয়া যাইত—অপর্ণা দেবীর সঙ্গে। সেটা নাই।
তাহার প্রকৃত খবর মাঝে মাঝে এখন যেটুকু পাওয়া যায়, সে এখানকার বিলাত-প্রবাসী ছাত্রদের কাছ থেকে। তাও নিতান্ত অসম্পূর্ণ, শুধু একটা কথা স্পষ্ট তাহাতে—সে দিন-দিনই নামিয়া যাইতেছে। মীরার দাদা অর্থের শৃঙ্খল রচনা করিয়া বিদেশী সমাজের গহ্বরে নামিতে আরম্ভ করিয়াছিল; যতদিন অর্থ পাইয়াছে শৃঙ্খল জুড়িয়া জুড়িয়া ক্রমাগতই নামিয়া গিয়াছে। এখন সে অদৃশ্যপ্রায়।
ইহাই দীর্ঘ আট বৎসরের ক্রমিক ইতিহাস। অপর্ণা দেবীর কথা মনে পড়িতেছে, প্রথম যেদিন দেখা হয়, বলিতেছেন, “তুমি জান না তাই বলছ শৈলেন, আমার নিজের ছেলে এই রকম আত্মবিলুপ্ত।”
সরমা এরই কাছে বাগদত্তা, এরই প্রতীক্ষায় আছে। শান্ত অল্পভাষিণী, চারিদিকে অসংঘত বিলাসের মধ্যে কঠোর সন্ন্যাসের জীবন লইয়া এই আত্মবিলুপ্তির জন্য তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করিয়া দিতেছে সরমা। এত বড় করুণ দৃশ্য চক্ষে পড়ে না, ঠিক যেমন ওর মত সুন্দরী ও সহসা পড়ে না চক্ষে। সরমার জীবনের সঙ্গে খর দ্বিপ্রহরের পল্লীর এই একটানা কলতানের—এই দহন-সংগীতের কোথাও যেন একটা মিল আছে—কী এর পরিণতি? এ কি শুধুই ভুল, একটা অপচয়? তাই যদি হয় তো এই বিরাট ভ্রান্তির সার্থকতা কি?—যদি ভ্রান্তির সার্থকতা থাকা সম্ভবই হয় নিতান্ত।
আমার মনে হয় এই তিল তিল করিয়া জ্বলার মধ্যেই বোধ হয় লোকোত্তর কোন বিপুল সার্থকতা লুকানো আছে, যার রহস্য শুধু সরমারাই জানে। কবি ফিক্রির দুইটা লাইন মনে পড়িল—
কঁহা ব্ লজ্জতে উলফৎ পতংগ তুঝে
মিলি যো শ্যামাকে ঘুল্ ঘুল্ কর জান দেনে মে।
[হে পতঙ্গ, (প্রদীপের কাছে মুহূর্তের আত্মসমর্পণে) তুমি ভালবাসার সে আনন্দ কোথায় পাবে, যা পেল মোমবাতি তিল তিল ক’রে নিজের জীবন আহুতি দেখার মধ্যে?]
বাহিরের দিকের জানালার ছিদ্রপথে নিরাভরণ মধ্যাহ্নের আলো প্রবেশ করিতেছে, ঘরের অন্ধকারের বৈষম্য আরও তীব্র হইয়া। মাঝে মাঝে উত্তপ্ত হাওয়ার হলকা। মনটা ঝিমাইয়া যাইতেছে। এক-একবার হঠাৎ উগ্র স্পষ্টতায় লিণ্ড্সে ক্রেসেণ্ট পূর্ণ অবয়বে ফুটিয়া উঠিতেছে—রেডিওর রেগুলেটারটা বাড়তির দিকে ঘুরাইয়া দিলে যেমন ঐকতান যন্ত্রসংগীতের শব্দগুলা হঠাৎ ঝংকার করিয়া ওঠে : মীরা–তরু–ইমানুল–অপর্ণা দেবী–মিস্টার রায়–বাড়ি, বাগান, পার্টি–আভিজাত্যের সচ্ছলতা–পুত্র-শোকাতুরা ভুটানী জননী–সব মিলাইয়া একটা সংগীত, একটা অদ্ভুত সিম্ফনি যার মূল সুর–কেমন করিয়া জানি না—সরমা।
খোকার শীতল, মসৃণ, নগ্ন গায়ে ধীরে হাত বুলাই! শিশুজীবনের উত্তপ্ত অঙ্গে ভগবানের চন্দন প্রলেপ। বেশ বুঝিতে পারি তপ্ত আঙুল বাহিয়া যেন শান্তি উঠিয়া আসিতেছে—হাত বুলাইয়া যাই, বুলাইয়া বুলাইয়া যেন আশ মিটিতেছে না।
মন আবার ঘুরিয়া যাইতেছে; ঠিক শান্তিতে তৃপ্তি পাইতেছে না। চাই বেদনা, চাই দহন; তাই বিধির বিধান এই যে শিশুর আগে আসিবে সরমা, আনিবে মীরা।
আমি সেদিন বিরহের দীর্ঘ অবকাশে প্রেমকে যেন ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম। বলিলাম, “হে জীবনের শ্রেষ্ঠ দেবতা, তুমি শ্রেষ্ঠ, তুমি অনবদ্য, তাই সৃষ্টির যা চরম ভাল তাহাই তোমার চরণে পড়ে অর্ঘ্য হইয়া, তাই তো তুমি যুগ-যুগান্তর ধরিয়া তাহাদেরই পূজা গ্রহণ করিয়াছ—রাজ্য, মান, লজ্জা, রূপ, যৌবন-সমস্ত বিভবকেই ধুলিমুষ্টির মত পথে ফেলিয়া যাহারা তোমার মন্দির-তোরণে উত্তীর্ণ হইয়াছে। তোমাকে পাইয়াছে সরমা, নিজেকে নিখুঁতভাবে গড়িয়া তুলিয়া নিঃশেষ ভাবে তোমার চরণে বিলাইয়া দিয়াছে। পদে পদে এই হিসাব, আত্মাভিমানের এই চুলচেরা বিচার, মনের এই বণিগ্বৃত্তি লইয়া আমি তোমার মন্দিরে প্রবেশ করিবার স্পর্ধা কোথা হইতে পাই?”
✵ ✵ ✵ ✵
দরজায় ধীরে ধীরে আঘাত পড়িল। ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, উঠিয়া দেখিলাম জানালার ছিদ্রপথে আলো নরম হইয়া আসিয়াছে। দরজা খুলিয়া দেখি অম্বুরী দাঁড়াইয়া; বলিল, “বেলা পড়ে এসেছে যে ঠাকুরপো, খুড়ো-ভাইপোতে খুব ঘুমোচ্ছ। কাল অনেক রাত হ’য়ে গিয়েছিল, না?”
বলিলাম, “হ’য়ে থাকবে, কিন্তু ক্ষতি হয়নি; কাল রাত্তিরটাও যেমন ভাল লেগেছিল আজ দিনের ঘুমটাও তেমনি চমৎকার লাগল।”
মুখ-হাত ধুইলাম। অম্বুরী খোকাকে তুলিয়া আনিয়া বলিল, “এবার রকে ওই আমগাছের ছায়াটায় মাদুর পেতে দিই ঠাকুরপো। সরবত ক’রে দোব, না চা?…বেশ চা-ই হবে। তারপর একটা ফরমাস আছে—অমন সরবতের নেশা ছাড়িয়ে যারা চা-য়ের নেশা ধরিয়েছে তাদের কথা বলতে হবে।”
তাহার পর আমার মুখের পানে কৌতূহল-দীপ্ত চোখে একবার চাহিয়া লইয়া বলিল, “আরও নেশা যদি কিছু ধরিয়ে থাকে, সেসব কথাও; ছাড়বার পাত্রী নই আমি।”