১৩
আর মাত্র দুইটি দিন ছুটি। ইচ্ছা ছিল আরও দুইটা দিন বাড়াইয়া লইব কি মীরা আসিয়া পড়াতে সে উপায় রহিল না; বিশেষ করিয়া অম্বুরীর কাছে মীরা যাহা বলিয়া গিয়াছে সেকথা শুনিবার পর।
সকালে অম্বুরী বলিল, “সদু ঠাকুরঝি দু-দিন এসেছিল ঠাকুরপো। তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আমি বলি কি, একবার দেখে এস না ওর বরকে; আহা, ঐ এক পোড়াকপালী! অমন মানুষ, আর ভগবান্ ওরই ওপর—”
জিহ্বা মার দন্তমূলের সাহায্যে অম্বুরী “চ্যু” করিয়া একটা সহানুভূতি শব্দ করিল।
অনিল আমার পানে চাহিয়া বলিল, “ওকে তো বলেছিলাম, সেদিন একবার দেখে আসা উচিত, যাব তো বলেও ছিল। কি, যাবি নাকি শৈল?”
অনেকগুলা কথা একসঙ্গে ভিড় করিয়া আসিল মনে। অস্বীকার করিবা না, তাহার মধ্যে মীরার আগমনের কথাটা খুব স্পষ্ট এবং প্রবল। একটু চিন্তা করিয়া বলিলাম, “নাঃ, গিয়ে কি হবে? ভাল ক’রে দিতে পারবো না তো?”
অনিল তাহার নিজস্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া ছিল আমার মুখের পানে, যেন খোলা পাতার মত আমার মনটা পড়িয়া লইল, “তবে থাক, আর সত্যিই তো—”
অম্বুরী অবশ্য বুঝিল না, একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলিল, “ভাল ক’রে দিতে না পারলে আর যেতে নেই? দুঃখ-কষ্টের সমর মানুষে চায় আত্মীয়-স্বজনে এসে একটু জিগ্যেসাবাদ করে। তোমাদের দু-জনের কথা এত বলে বেচারী—”
প্রসঙ্গটা কি করিয়া চাপা দেওয়া যায় তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। যাহা এড়াইতে চাহিতেছিলাম, তাহা অন্য এক অসন্দিগ্ধ পথে একেবারে ঘাড়ে আসিয়া পড়িল।—
অনিল বলিল, “আজ আর আমি নাইতে যাব না, শৈলেন; পরশু বৃষ্টিতে ভিজে মাথাটা বড় ভার হয়েছে, তাতে আবার গঙ্গার নতুন জল নেমেছে। তুই নেয়ে আয়, আমি পারি তো এইখানেই দু-ঘটি তোলা জল মাথার ঢেলে নেব এর পরে।”
নিরুপায় ভাবে বললাম, “একলা যেতে হবে?”
সানু উঠানটায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া একটা প্রজাপতি ধরিবার চেষ্টা করিতেছিল, সহসা থামিয়া সতর্ক করিবার ভঙ্গিতে আমার পানে চাহিয়া বলিল, “না শৈল টাকা, খবরডার একলা যেও না; টুমীরে টেনে নিয়ে যাবে।”
ওর মুরুব্বিয়ানার রকম দেখিয়া তিনজনেই হাসিয়া উঠিলাম। অনিল বলিল, “ডেঁপোর একশেষ হয়েছে।”
আমি বললাম, “তুই চল না সানু; সত্যিই যদি ধরে কুমীরে…”
“ঠামো।”—বলিয়া সানু প্রজাপতি শিকার ভুলিয়া তিন লাফে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেল। আমার সদ্য কিনিয়া দেওয়া জাপানী খেলনা-বন্দুকটা আনিয়া স্পর্ধিত ভঙ্গিতে বলিল, “টলো।”
অম্বুরী হাসিয়া বলিল, তাই তো গা, কি বীরপুরুষ! কাকার আর ভাবনা রইল না। যাচ্ছিস তো তেলটা মাখিয়ে দিই দাঁড়া, নেয়ে আসিস।”
তেল মাখা হইলে সান্ত্রী-সমন্বিত হইয়া স্নানের জন্য বাহির হইলাম।
গলি থেকে সদর রাস্তায় পড়িয়া একটু দ্বিধায় পড়িলাম, গঙ্গায় না গিয়া বড়পুকুরে স্নান করিয়া আসিলে কেমন হয়? বহু দিন স্নান করা হয় নাই বড় পুকুরে—বহু দিন। অনিল সঙ্গে থাকিলে ভাল হইত; অনিল থেকে আলাদা করিয়া বড়পুকুরের কথা ভাবা যায় না; আরও একজন থেকে আলাদা করিয়া, সে সৌদামিনী। সৌদামিনীর কথা মনে পড়তেই মনস্থির করিয়া ফেলিাম…না, ও-পথে নয়। মীরা আসিয়া পথ-নির্দেশ করিয়া গিয়াছে; বড়পুকুরে ডুব দেওয়ার অর্থ যদি হয় সৌদামিনীর স্মৃতিতে ডুব দেওয়া তো বড়পুকুর থাক। সহানুভূতি? তা আছে বইকি সদুর দুঃখে, কিন্তু সে ‘আহা’টুকু স্পষ্ট করিয়া মুখে বলেই কি তাহার মূল্য বাড়িয়া যাইবে?
সানু মীরাকে আরও স্পষ্ট করিয়া তুলিল, বোধ হয় আমায় একটু ইতস্ততঃ করিতে দেখিয়া তাহারও মনে পড়িয়া গিয়া থাকিবে। বলিল, “মীরা মাসীর গাড়ী এইঠানেই ডাঁড়িয়েছিল, না শৈল টাকা?…মীরা মাসী তোমার কে হয়?”
বলিলাম, “কেউ নয়।”
সানু ক্ষণমাত্র যেন কি একটা চিন্তা করিয়া লইল, তাহার পর প্রশ্ন করিল, “কে হবে?”
প্রশ্নটার মধ্যে অম্বুরীর অলক্ষ্য ইঙ্গিত আছে। কথাটা বদলাইয়া লইয়া বলিলাম, “পা চালিয়ে চল দিকিন, নয়তো আবার কুমীর এসে পড়বে গঙ্গায়।”
নিজের মনকে লোকে কি নিজেই চেনে যে কারণটা বলিব? যাহা করিলাম তাহাই বলিতে পারি মাত্র, কয়েক পা অগ্রসর হইয়া থামিয়া পড়িলাম। সানুকে বলিাম, “গঙ্গায় আজ বড্ড কুমীর সানু, তুই এতগুলো মারতে পারবিনে একলা, তার চেয়ে চল বড়পুকুরে নেয়ে আসি।”
সানু একটু নিরাশ হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “বড়পুকুরে টুমীর নেই শৈল টাকা?”
তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিলাম, “একটা দুটো আছে বইকি, চল।”
“টলো।” বলিয়া সানু অগ্রসর হইল। ফিরিয়া যাইতে যাইতে একটু তলাইয়া বুঝিবার চেষ্টা করিলাম ব্যাপারটা। বুঝিলাম সৌদামিনীর প্রতিও ততটা নয়, আসলে পরশু রাত্রে বড়পুকুরের যে রহস্যময় রূপ দেখিয়াছিলাম তাহাই টানিতেছেন। অবশ্য তাহার সঙ্গে সৌদামিনী যে নাই এমন নয়। তবে আসল কথা ঐ বড়পুকুর পাড়া গাঁয়ের প্রতীক… আমার কলিকাতা প্রাপ্ত মন যে পাড়াগাঁকে অনু অনু করিয়া সন্ধান করিতেছে।
বড় রাস্তা হইতে নামিয়া ঘন আগাছার মধ্যে দিয়ে সরু বিসর্পিত পথ ধরিয়া চলিয়াছি। সানু বন্দুকটা বাগাইয়া ধরিয়া খানিকটা আগে আগে চলিয়াছে; অবশ্য আমি আছি কিনা মাঝে মাঝে দেখিয়া ভরসার পুঁজি পূর্ণ করিয়া লইতেছে। আসিয়া পড়িয়াছি—চৌধুরীদের পোড়ো বাড়ির একটা কোণ ঘুরিলেই বড়পুকুর দেখা যাইবে। দিনের বেলায় কেমন দেখায় একটা উন্মুখ আগ্রহ লাগিয়া আছে। এমন সময় হঠাৎ সানু কোণ ঘুরিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটিয়া আসিল। কাপড় আলগা হইয়া গিয়াছে, বাঁ-হাতে সেটা গুটাইয়া ধরিয়া বলিল, “শৈল টাকা টুমীর!”
হাসিয়া বলিলাম, “সত্যি নাকি—তা চল, মারবি চল্।”
“টুমি নাও।” বলিয়া অম্বুরীর বীরসন্তান আমার হাতে বন্দুক দিনা বাঁ-হাতে আমার কোমর জড়াইয়া পাশে দাঁড়াইল।
অগ্রসর হইয়া দেখি ঘাটের উপর কেহ নাই। জলে খানিকটা দূরে একটি স্ত্রীলোক যেন আধডোবা সাঁতার কাটিতে কাটিতে ঘাটের পানে আসিতেছে। শরীরের এখান-ওখান জলের উপর জাগিয়া আছে, মাথা আর পা অনুমান আধি হাতে জলে মগ্ন।
আমি ফিরিয়া চলিয়া আসিতেছিলাম, সানু বলিল, “মার না শৈল টাকা, ভয় করছে?”
বলিলাম, “হ্যাঁ, ভয় করছে, চল্।”
সানু আমার কোমরের কাপড়টা খামচাইয়া ধরিয়া ফিরিয়া চাহিল, সঙ্গে সঙ্গেই হাততালি দিয়া বলিয়া উঠিল, “ও শৈল টাকা, টুমীর নয়, ড্যাকো, মাসীমা!”
ঘুরিয়া দেখি সৌদামিনী কোমর পর্যন্ত জলে দাঁড়াইয়া সাঁতারের পরিশ্রমে হাঁপাইতেছে। আমায় ফিরিতে দেখিয়াই শরীরটা জলে আকণ্ঠ ডুবাইয়া দিল।