১১
সাঁতরায় চারিটা দিন বেশ কাটিল। চমৎকার লাগিতেছে; তবে পূর্বেই বলিয়াছি, অবিমিশ্র আনন্দের অনুভূতি নয়, তাহার উপর সৌদামিনী আসিয়া একটা যেন মর্ম-নিংড়ান ব্যথা জাগাইয়াছে বুকের মধ্যে। কাল যতক্ষণ জাগিয়াছিলাম ঐ কথাই ভাবিয়াছিলাম—সেই সদু!—তার এই দশা?—আহা …
অনিলের প্রস্তাবটা বড় অশুচি বলিয়া বোধ হইতেছিল, কিন্তু তবু একথা অস্বীকার করিতে পারিতেছি না যে, অমোঘ সম্মোহনে ঐ চিন্তাটা আমায় আকর্ষণ করিতেছিল—সত্যই তো সিঁথির সিঁদুর তো ঘুচিল বলিয়া; আজ না হয় দু-দিন বাদে; তারপর?—ভাগবত হালদার? ভাবিতেও শিহরিয়া উঠিতে হয়। অথচ ঐ ওর নিশ্চিত পরিণতি।… কাল যতক্ষণ জাগিয়াছিলাম, বলাটা ভুল হইয়াছে, আসলে কাল একেবারেই নিদ্রা হয় নাই।
হোথায় মীরা। ভাবিলাম সুখে-বেদনায়, হরিষে বিষাদে জীবনটা অসঙ্গ হইয়া উঠিয়াছে, যাই দু-দিন একটু মুক্তির আস্বাদ লইয়া আসি।
এই মুক্তি।
আজ দুপুরে আবার আসিয়াছিল সৌদামিনী। সেই কালকের ব্যাপারের পুনরানুষ্ঠান, প্রায় আগাগোড়াই। সেই আমাদের নিদ্রার ভান করিয়া পড়িয়া থাকা, আর ওর ছেলেমেয়ে দুইটাকে লইয়া আকুলি-বিকুলি; বেশ বুঝা যায় ও যেন অনুভব করিতেছে এই সন্তান তো ওরই হইবার কথা ছিল। তাই ওদের বুকে করিয়া ওর নাড়িতে টান পড়িতেছে।
আজ বারান্দায়ই কাটাইল, বলিল, “ও ঘরটায় তো বড্ড গরম বৌ। ওঁরা ঘুমুচ্ছেন, এইখানেই আমরা গল্প করি। এই সময় একটু ফুরসত পাই, পালিয়ে আসি, তোর নন্দাই এই সময়টায় একটু ভাল থাকে।…আর ভাল থাকা!…”
একবার বলিল, “আজ শৈলদার সঙ্গে দেখা করে যাব ভাবছি, মনে করবে দুটো দিনের জন্যে এলাম সাঁতরায়, সদী এল, অথচ একবার দেখা করলে না।”
কপট-নিদ্রা শেষ দিকটায় কখন একটু অকপট হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। যখন উঠিলাম দুইজনে, তখন সৌদামিনী চলিয়া গিয়াছে। বরাবরই ঘুমাইয়া থাকিবার কথা বলিয়া অম্বুরীর কাছে ওর প্রসঙ্গটা তুলিতেই পারিলাম না।
সদু দেখা করিবে বলিল, আবার কি ভাবিয়া চলিয়া গেল? বিকেল বেলায় দুইজনে বাহির হইব,—আমি রকে দাঁড়াইয়া আছি, অনিল বাক্স থেকে কিছু পয়সা লইবার জন্য ভিতরে গিয়াছে। বাহিরে যেন কতকটা পরিচিত কণ্ঠের প্রশ্ন কানে আসিল, “এটা কি পরলোকগত সদাশিববাবুর বাড়ি?”
বাহিরের উঠানে পাড়ার কয়েকজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে সানু খেলা করিতেছে, প্রশ্নটা তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া।
দু-তিনবার প্রশ্নের পরও কোন উত্তর হইল না, অবশ্য না হওয়াই স্বাভাবিক। একে তো বছর কয়েক পূর্বে যে মারা গিয়াছে শিশুরা তাহার নাম মনে করিয়া রাখে না, তাহার উপর প্রশ্নকারী ‘পরলোকগত’ কথাটা জুড়িয়া দিয়া আরও দুর্বোধ্য করিয়া তুলিয়াছে। শেষে বোধ হয় ওরই মধ্যে একটু বড় গোছের একটি মেয়ে উত্তর করিল, “না পরলোকের নয় গো, সানুর বাবার বাড়ি।”
অগ্রসর হইতে হইতে শুনিতেছি, “কি নাম বাবার?”
সানু ঠাকুমার কাছে শোনা নামটা বলিল, “বাবার নাম অনা, টোমার নাম কি?”
“রাজীবলোচন।”
বাহির হইয়া দেখি রাজু বেয়ারা চৌকাঠের নীচে দাঁড়াইয়া আছে। ‘পরলোকগত’ কথাটার জন্য বিস্মিত হইলাম না। পরে অবশ্য তরুর কাছে টের পাইলাম, মীরা দুষ্টামি করিয়া গালভরা কথাটা শিখাইয়া দিয়াছিল। যা হউক, ওর উপস্থিতির জন্য বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলাম, “রাজু যে! কি ব্যাপার?”
কিছু বলিবার পূর্বে রাজুর দৃষ্টিটা যেন অনিচ্ছাকৃতভাবেই বাড়ির উপর একবার ঘুরিয়া গেল, কহিল, “এই বাড়িতেই রয়েছেন আপনি মাস্টার-মশা?”
উত্তর করিলাম, “হ্যাঁ, এইটেই আমার বন্ধুর বাড়ি, রাজু। …তারপর, ব্যাপার কি বল তো, তুমি হঠাৎ?”
অনিল আসিল, চাপরাশ আঁটা মানুষ দেখিয়া একটু বিমূঢ়ভাবে প্রশ্ন করিল, “কে রে শৈল? কি দরকার তোমার?”
আমি উত্তর করিলাম, “মিস্টার রায়ের বেয়ারা।”
“ডাকতে এসেছে তোকে?”
রাজু উত্তর করিল, “আজ্ঞে না, দিদিমণি এসেছেন।”
অনিল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিল। আমিও অতিমাত্র আশ্চর্যান্বিত হইয়া রাজুকে প্রশ্ন করিলাম, “মীরা দেবী এসেছেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ!”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া আবার আমরা পরস্পরের মুখের পানে চাহিলাম; রাজুকে আবার প্রশ্ন করিলাম, “কোথায়?”
“ওই মোড়ের মাথায়, পন্টিয়াক্টা দাঁড় করিয়ে আছেন।”
এ কি নিদারুণ লজ্জায় ফেলিল মীরা– আমাকেও আর অনিলকেও! আমি যেন বিপর্যস্ত হইয়া অনিলের পানে চাহিলাম, ঠিক ইচ্ছা করিয়া চাহিবার উপায় ছিল না, দৃষ্টিটা আপনা হইতেই তাহার মুখের উপর গিয়া পড়িল। অনিল কিন্তু নিজেকে সংবৃত করিয়া লইয়া ইতিকর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিয়াছে। বলিল, “একটু দাঁড়া শৈল, এলাম বলে।”
মিনিটখানেকের মধ্যে আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “চল”, বেয়ারাকেও বলিল “এস হে।”
আঁকাবাকা গলিপথ হইতে বাহির হইয়াই আমরা মীরার মোটরের সামনে আসিয়া পড়িলাম। কয়েকজন কৌতুহলী বালক-বালিকা মোটরটা ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরিয়া সামনের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া আছে, তরু দরজার উপর মুখ চাপিয়া একটু বিমর্ষভাবে বসিয়া আছে। মীরা গাড়ির ও-পাশে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমাইয়াছে।
তরু আমায় দেখিয়াই উল্লসিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “ও দিদি, মাস্টারমশাই!”
মীরা ফিরিয়া চাহিতেই আমরা দুইজনে নমস্কার করিলাম। আমি অনিলকে পরিচিত করিয়া দিতে, অনিল আর একবার নমস্কার করিয়া দরজাটা খুলিয়া বলিল, “আসুন, নামুন।”
তরুকে বলিল, “নামো খুকী।”
তরু লক্ষ্মী-পাঠশালার পোষাকে আসিয়াছে; জড়িত পদে নামিয়া প্রথমে অনিলের, পরে আমার পদস্পর্শ করিল।
মীরা নামিয়া অনিলের দিকে চাহিয়া বলিল, “আপনাদের বোধ হয় ভয়ানক আশ্চর্য ক’রে দিলাম; খুব ব্যতিব্যস্ত করলাম বোধ হয়!”
অনিল হাসিয়া উত্তর করিল, “আমাদের মুখ চেয়ে, ব্যতিব্যস্ত করবার ক্ষমতা থেকে ভগবান আপনাদের বঞ্চিত করেছেন! যদি সে রকম অভিসন্ধি ওঠেও কখনও আপনাদের মনে তো আপনারা আগে থাকতেই নোটিস দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য পণ্ড ক’রে ফেলেন।”
আমরা তিনজনেই হাসিয়া উঠিলাম। মীরা বলিল, “তবুও নিশ্চিন্দি হবেন না, নোটিস দিয়েও যে উপদ্রব করা চলে, তার নজির আমাদের দেশে আছে অনিলবাবু। —জানেন তো, এই দেশেই চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত।”
তাহার পর আমার দিকে চাহিয়া বলিল, “বাবা গেলেন পূর্ণিয়া শৈলেনবাবু, তাঁর কাছ থেকে হুকুম আর মোটর চেয়ে রেখেছিলাম, এলাম চলে।”
বলিলাম, “আমাদের সৌভাগ্য, আপনি যে মনে ক’রে আসবেন এটা আশা করিনি।”
তরুর মুখটা যেন একটু বিষণ্ণ। মীরা অনিলের কথাবার্তার মধ্যে আমায় একটু একান্ত বলিল, “মাস্টারমশাই, উনি বাড়িতেও সবার সামনে আমায় ‘খুকী’ বলবেন নাকি?”
ও-বেচারির দুশ্চিন্তার কারণ বুঝিতে পারিয়া আমি আর হাসি চাপিতে পারিলাম না। মীরা জিজ্ঞাসা করিল—“কি হয়েছে?” প্রথমটা বলিতে চাহিলাম না, কিন্তু ওর জেদাজেদিতে বলিতেই হইল। আমাদের তিনজনের হাসিতে তরু একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া আমার গায়ে সাঁটিয়া গেল। মীরা বলিল, “সত্যিই, কি রকম আক্কেল আপনাদের! দেখছেন কত বড় একটা মেয়ে,–অত কষ্ট ক’রে বেচারি শাড়ি পর্যন্ত পরে এল, তবু ‘খুকী’ বলবেন।”
চৌকাঠের কাছে গলিতে অম্বুরী দাঁড়াইয়া আছে। একটা ধোপদস্ত শেমিজ আর শাড়ি পরা, চুলটাও সামান্য একটু গোছগাছ করিয়া লইয়াছে।
মীরাকে দেখিয়া প্রথমটা একটু থতমত খাইয়া গেল যেন, তখনই আবার সে ভাবটা সামলাইয়া লইয়া কয়েক পা অগ্রসর হইয়া মীরার বাঁ-হাতটা ধরিয়া বলিল, “এস ভাই।”
তাহার পর তরুর পিঠে হাত দিয়া আমার পানে চাহিয়া বলিল, “এই তোমার ছাত্রী ঠাকুরপো? সত্যি কি চমৎকারটি! এত ছোট মেয়ে মেমেদের স্কুলে পড়ে ঠাকুরপো?”
মীরা তাড়াততাড়ি বলিল, “সর্বনাশ! দেখবেন, ছোট, তা বলে ওকে যেন ‘খুকী’ বলে বসবেন না আপনিও।”
মীরা নিজেও এবং আমরা দুইজনে হাসিয়া উঠিলাম। তরু আবার লজ্জার অম্বুরীকে জড়াইয়া কাপড়ে মুখ লুকাইল। অম্বুরী আমার মুখের পানে চাহিল, —ব্যাপারটা শুনিয়া হাসিয়া বলিল, “না, এ অন্যায়। ছেলেমানুষ পেয়ে সবাই মিলে আপনারা ওর কি অবস্থা ক’রে তুলেছেন দেখুন তো।”
তাহার পর প্রথম সুযোগেই আমায় একটু একান্তে ডাকিয়া ব্যগ্র মিনতির সহিত বলিল, “দোহাই ঠাকুরপো, আমায়ও যেন ‘অম্বুরী’ বলে ডেক না—শুধু আজকের দিনটা—ওঁকেও বলে দিও—দোহাই তোমাদের…।”