বেশ লাগিতেছে বটে, কিন্তু যতটা শান্তি পাইব বলিয়া আশা করিয়াছিলাম ততটা পাইতেছি না। যতক্ষণ অনিল থাকে, যতক্ষণ জেঠাইমার সঙ্গে অম্বুরীর সঙ্গে গল্প করি কিংবা খুকীকে লইয়া থাকি, দিব্য কাটে। একলা থাকিলেই মুশকিল—সেদিন লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্ট মুছিয়া যেমন সাঁতরা জাগিয়া উঠিয়াছিল, তেমনি সাঁতরাকে বিলুপ্ত করিয়া লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্ট জাগিয়া উঠে। ভাবিয়াছিলাম একবার ঘুরিয়া আমি, একটু শান্তি পাইব, আসিয়া দেখি কবে অলক্ষ্যে অশান্তির বীজ বপন করিয়া ফেলিয়াছি, অঙ্কুরিত হইয়াছে পল্লবিত হইবে, তাহার পর শাখা-প্রশাখা। …শান্তি চিরদিনের জন্য বিদায় লইয়াছে।

একলা থাকিলেই মীরার চিন্তা, সঙ্গে সঙ্গে তরু, অপর্ণা দেবী, মিস্টার রায়, দাসদাসী কত যে আপনার সব! কিন্তু ঐ এক মীরাকে ঘিরিয়া। তরু মীরার বোন ভাবিতে এত ভাল লাগে! —কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা বেদনা…

কেমন যেন একটু ভয় হয়—যেখানেই যাইব, এই বেদনা কি জন্মের সাথী হইয়া থাকিবে? এ কি বন্ধন! আবার এই বন্ধন হইতে মুক্তির কল্পনায়ও শিহরিয়া উঠে সমস্ত অন্তরাত্মা। ধর, মীরা নাই; বেদনাও নাই; কি অসীম, দুঃসহ শূন্যতা!

অনিল সমস্ত সপ্তাহটা ছুটি পাইয়াছে। আজ আপিসে যায় নাই। সকাল বেলাটা দুইজনে ঘুরিলাম একচোট, দেখিয়া শুনিয়া, দেখাশোনা করিয়া। দুপুরে দুইজনে আহার করিয়া শুইয়া আছি অনিলের ঘরে। গল্প করিতেছি। ছ’মাসের গল্প জমা আছে, একটু ফাঁক নাই যে নিদ্রা আসিয়া প্রবেশ করে।

অম্বুরী টানা বারান্দার ওদিকটায় মাদুর পাতিয়া শুইয়া ‘অন্নদামঙ্গল’ কিংবা ‘রামায়ণ’ কি ‘মহাভারত’ পড়িতেছে, খুব নীচু সুরে, দূর থেকে মাত্র একটা গুঞ্জন আওয়াজের মত মাঝে মাঝে কানে আসিতেছে। আজকাল আমাদের খাওয়াইয়া, পাট সারিয়া বই পড়িতে দেরি হয় বলিয়া অনিলের মা পূর্বেই শয্যা গ্রহণ করেন।

হঠাৎ অম্বুরী বলিয়া উঠিল, “ও মা! তুমি কোথা থেকে? কবে এলে?”

বেশ একটা হাস্যোচ্ছল কণ্ঠে উত্তর হইল, “যমের বাড়ি থেকে। এসেছি কাল সন্ধ্যেয়।”

“ব’স ঠাকুরঝি, তারপর কি খবর? দুবচ্ছর আসনি, শুনি বড় কড়া লোক, আসতে দেয় না; তা ছাড়লে যে হঠাৎ?”

একটা প্রশ্ন করিয়াছিলাম, অনিল উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া রহিল। মনে হইল যেন নিঃশ্বাসের শব্দটাও বন্ধ করিয়া লইয়াছে।

সেইরূপ নিখাদ কণ্ঠের উত্তর হইল, “জ্বালাস নে বউ, সত্তর বছরের নড়বড়ে একটা মনিষ্যি—মিত্তিরদের পোড়ো বাড়ির দরজা-জানালাগুলোর মত—সে হ’ল কড়া, সে দেবে না আসতে! দু-বছর আসতে মন চায়নি, আসিনি; আজ মনে হ’ল, এলাম। তারপর, কি খবর? বর কোথায়? শুনলাম নাকি শৈলদা এসেছে? শুনলাম তোর একটা খুকী হয়েছে? —কোথায় বৌ? —আন না দেখি…”

অনিল চুপ করিয়া আছে। আমিও প্রশ্নের কথা ভুলিয়া গিয়াছি। স্মৃতি হঠাৎ আলোড়িত হইয়া উঠিতেছে।

অম্বুরী উত্তর করিল, “তবু ভাল, খোঁজ রাখ দেখছি!”

কপট গাম্ভীর্যের স্বরে টানিয়া টানিয়া উত্তর হইল,”তুমি তো জান না ভাই, খোঁজ রাখা কত শক্ত। বলে, ছেলেয়-মেয়েয়, স্বামীতে শ্বশুরে নিজের সংসারের কথা ভেবেই ফুরসত থাকে না; বিশেষ ক’রে কন্দর্পের মত স্বামী, সদাই ভয়—চোখের আড়াল করি আর কেউ কেড়ে নিক্‌…”

এক ঝলক আবার সেই তরল হাসি। অনিলের রুদ্ধ নিঃশ্বাসটা একটা শব্দ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল।

ওদিকে গম্ভীর হইয়া —

“না বৌ, মস্করা থাক্, এনে দে তোর মেয়েকে দেখি একবার; ছেলেটাই বা কোথায়?”

অম্বুরী অপেক্ষাকৃত নিম্নস্বরে বলিল, “ওদের কাছে, ঐ ঘরে।”

“তোর বর ঘরে?—শৈলদাও নাকি?”

অম্বুরী নিশ্চয় মাথা নাড়িয়া উত্তর দিল।

নিম্নকণ্ঠে প্রশ্ন হইল, “জেগে না ঘুমুচ্ছে লো?”

অম্বুরীও নীচু গলাতেই একটু হাসিয়া উত্তর দিল, “মনে হয় তো ঘুমুচ্ছিল, কিন্তু তুমি যে রকম…”

“মুয়ে আগুন তোমার, বলতে হয় আগে। নিশ্চয় ঘুমুচ্ছে, একটু গলা ছেড়েছিলাম বটে, কিন্তু অনেক দূরে আছি। যা, তুই মেয়েটাকে নিয়ে আয় আস্তে আস্তে। কোণের ঘরে চল, এখানে সুবিধে হবে না। শাশুড়ী কোথায়? তুই আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিস্ বৌ! দাঁড়া তো দেখি…ঠিক ইচ্ছে করে।”

তাহার পর দুইটা কণ্ঠের একটা উচ্ছল হাসি শোনা গেল।

অম্বুরী আসিয়া অতিসন্তর্পণে খুকীকে অনিলের বুকের কাছ থেকে উঠাইয়া লইয়া আবার খুব সাবধানে দুয়ার ভেজাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। আমরা গভীরভাবে নিদ্রামগ্ন, গাঢ় সুপ্তির নিঃশ্বাস উঠানামা করিতেছে।

প্রশ্ন হইল, “ঘুমিয়েছিল?”

“হুঁ।”

“ভাগ্যিস! তা হোক, এখানে সুবিধে হবে না, খুকীকে আমার কোলে দে, তুই মাদুরটা নিয়ে আয়।…বাঃ, কি চমৎকার হয়েছে রে!”

ঘন, আকুল চুম্বনের শব্দ হইতে লাগিল।

ওরা চলিয়া গেলে অনিল প্রশ্ন করিল, “চিনতে পারলি?”

প্রতিপ্রশ্ন করিলাম, “সদু নাকি?”

খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম দুইজনেই, তাহার পর আমিই প্রশ্ন করিলাম, “যা বললে ঠিক নাকি অনিল?”

“কি কথা?”

“এই সত্তর বছরের কথা?”

“না।”

“তবে?”

আবার একটুখানি চুপচাপ গেল।

প্রশ্ন করিতেছি না, কি উত্তর দেয় সেই উৎকণ্ঠায় নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া আছি। একটু পরে অনিল বলিল, “হিন্দুললনা স্বামী সম্বন্ধে কখনও এসব বিষয়ে সত্যি কথা বলতে পারে? নরকের ভয় নেই?—অন্তত পাঁচটা বছর কমিয়ে বলেছে।”

তাহার পর আর কোন কথাই হইল না। দুইজনেই বুঝিতেছি দুইজনেই জাগিয়া, অথচ যেন কথা কহিবার উপায় নাই। মাঝে মাঝে ওদিককার ঘর হইতে হাসির লহর ভাসিয়া আসিতেছে।

সন্ধ্যার একটু আগে চা খাইয়া আমরা দুইজনে বাহির হইলাম। অম্বুরী বলিল, “মেলা রাত ক’রো না যেন।”

বলিল, “সে বস্থা রেখে?”

অম্বুরী বলিল, “রঙ্গ নয়, দু-জনে একত্তর হ’লে কোন্ জগতে থাক তার তো ঠিকানা থাকে না।”

খানিকটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলাম; এখানে আসিলে আমাদের যেমন অভ্যাস। কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া, যখন বিলম্বিত চন্দ্রোদয় হইল, তখন আমরা বড়পুকুরের ধারে। এদিকটা এখন জনবিরল হইয়া গিয়াছে। চৌধুরীদের তখন অবস্থা ভাল ছিল, মজা-নদী হইতে পুকুরে নুতন জল ফেলিবার জন্য একটা পাকা নালা করিয়া দিয়াছিল। সেটা যেখানে পুকুরে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহার পাশেই পাকা ঘাট। এখন চৌধুরীদের মত এ দুইটারও অবস্থা শোচনীয়। ঘাটটা পরিত্যক্ত বলিলেই চলে, বাগ্‌দীপাড়ার মেয়েরা অল্প অল্প সরে। তাহারাও প্রায় লোপাট হইয়া আসিতেছে।

যদিও নিরুদ্দেশ ভাবে বেড়াইতে বেড়াইতে আসিয়া পড়া, তবু দুইজনেই জানি কিসের টানে আমরা এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। এটা ছিল আমাদের স্নানের-ঘাট, সৌদামিনীর বাড়ি এখান থেকে বেশি দূর নয়। গঙ্গার ঘাট ছাড়িয়া আমরা এইখানেই স্নান করিতে আসিতাম, বেশির ভাগ। প্রথম আকর্ষণ ছিল ঘাটের উপরের কামরাঙা, জাম আর অন্যান্য ফলের গাছগুলা, দ্বিতীয় আকর্ষণ সৌদামিনী। ক্রমে ধারাটা উল্টাইয়া গেল, আমাদের অজ্ঞাতসারেই। প্রথম আকর্ষণ হইয়া উঠিল সৌদামিনী, দ্বিতীয় আকর্ষণ জাম, কামরাঙা ইত্যাদি। পরে দেখা গেল জাম-কাম-রাঙার যা কিছু খাতির, সৌদামিনীকে লইয়াই।

সৌদামিনীর একমাত্র অভিভাবক ছিল ওর বুড়ি দিদিমা—অত্যন্ত ক্ষীণ একটা প্রভাব। ছেলেবেলা থেকেই ও যেন ছিল কারুর কেউ নয়, সম্পূর্ণ মুক্ত, নিসম্পর্কিত। বড় হইয়া যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়িতে শিখি তখন ‘উর্বশী’ কবিতাটা পড়িলে মনে পড়িত সৌদামিনীকে, ঠিক মিলিয়া যাইত ওর সঙ্গে।

সেই স্মৃতির মধ্যে আসিয়া বসিয়াছি—আজ দুপুরে যাহা হইয়া গেল তাহার পর না আসিয়া উপায় ছিল না। কেহ কথা কহিতেছি না অথচ বুঝিতেছি দুইজনের মনেই এক প্রবাহ, সেই প্রবাহেই যেন ভাসাইয়া আনিয়াছে। আমাদের মন ক্রমেই যেন ভরিয়া উঠিতেছে, এক সময় না এক সময় কথা কহিতেই হইবে, বোধ হয় উভয়ে উভয়ের অপেক্ষায় আছি। পূর্বদিকে চাঁদ একটু উপরে উঠিতে তীরে বৃক্ষরাজির উপর দিয়া আলো আসিয়া পড়িল। ধীর সঞ্চারে কখন একটা হাওয়া উঠিল—যেন কালের ও-প্রান্ত হইতে একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ভাসিয়া আসিল। বড়পুকুরের কালো জল রূপালী রেখায় কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।

আমিই কথা কহিলাম, বলিলাম, “সদুর কথা তুই আমায় কখনও বলিস্‌নি তো অনিল।”

অনিল স্থির দৃষ্টিতে সামনে চাহিয়াছিল, বলিল, “আশ্চর্য হলি?”

উত্তর করিলাম “হলাম বই কি!”

অনিল সেইভাবেই বলিল, “তার চেয়েও একটা আশ্চর্য হবার আছে—অন্তত আমার মনে হয়।”

প্রশ্ন করিলাম, “কি?”

উত্তর হইল, “তুই কখনও জিগ্যেস করিস্‌নি।”

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম, “না, করিনি জিগ্যেস। বহু দিন আগে এক বার জিগ্যেস ক’রে শুনলাম, বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। আর কি জিগ্যেস করব?”

অনিল বলিল, “তা তো বটেই;–পরস্ত্রী!”

একটু পরে বলিল, “আমাকেই জিগ্যেস করেছিলি, আমি ঐটুকু খবর দিয়েছিলাম। তুইও আর কিছু জিগ্যেস করলিনি, আমিও আর তুলিনি ওর কথা। ভাবলাম পরস্ত্রীর কথা শুনিয়ে মহাসাত্ত্বিক ব্রহ্মচারীর ব্রত ভঙ্গ ক’রে মহাপাতকের ভাগী হই কেন?”

অভিমানের কথা অনিলের! ওর মুখের পানে চাহিলাম—স্ফীংক্‌সের মত সামনেই চাহিয়া আছে, মুখের প্রতিটি রেখা কঠিনভাবে নির্বিকার।

একটু পরে আমার মুখ থেকে যেন আপনি-আপনিই নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল, “শেষে পঁচাত্তর বছরের বুড়োর হাতে পড়ল? ..সদু!”

অনিল বলিল, “যখন পড়েছিল তখন অত কোথায়? পাঁচ বছর তো কেটেও গেল!”

এর পর বহুক্ষণ একেবারে চুপচাপ। রাত্রি ঘনাইয়া আসিতে লাগিল, বাগ্দী-পাড়ায় একটা গুপী-যন্ত্রের আওয়াজ উঠিল, দু-একটা আলো নিবিল।‥মৌন বিস্ময়ে ভাবিতেছি পাঁচটা বৎসর সৌদামিনী এইভাবে কাটাইল। প্রথম যৌবনের পাঁচটা বৎসর। নারীজীবনের সার সম্পদ! কী ব্যর্থতা! …

এক সময় কঠোর মুখটা আমার পানে ফিরাইয়া অনিল বলিল, “শৈল, তুই সদুকে বিয়ে কর; মীরা যে হবে না বুঝতেই পাচ্ছি। She is too far off (ও বহু দূরে)।”

এত ধাক্কা জীবনে কম পায় লোকে। বলিলাম, “ওর স্বামী!…তুই কি বলছিস অনিল!”

অনিল স্থির কণ্ঠে বলিল, “না, ওর স্বামী থাকতে থাকতে নয়, মরে—মানে স্বর্গ-গত হ’লে।”

অনিল কথা কহিতেছে। —আমি দাঁড়াইয়া উঠিলাম; কহিলাম, “তুই বলছিস্ অনিল? সদুর বৈধব্য কামনা করছিস্? —সদুর? —অনিল…তুই!”

আমার ভাষা জোগাইতেছিল না।

অনিল বলিল, “তাই কামনা করলাম শৈল?—না কামনা করছি ও চিরএয়োস্ত্রী হয়ে থাকুক? ..তুই যে অন্তত এখনও পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর বাঁচবি এটা আশা করা যায় না?”

তাহার পর অনিলের মুখ খুলিয়া গেল। বলিল, “আমার ক্ষমতা থাকলে আমি ঐ অশীতিপর বুড়োকেই গন্ধর্বের রূপযৌবন দিতাম শৈল—সব ভুলে—শুধু সৌদামিনীর জন্যে, কিন্তু তা হবার যো নেই। আমি খোঁজ নিয়েছি, সিঁথির সিঁদুরের উপর বড় মায়া সদুর—কাকে একবার সজল চোখে বলেছিল– ‘কপালের ঐ আলোটুকু জ্বলতে থাকাই কি কম ভাগ্যি?’ —বুড়োকে এখানে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছে, অসম্ভব ব্যাপার শৈল, আমি দেখে পর্যন্ত এসেছি এর মধ্যে, দরকার আছে বলে আজ সকালে একবার বেরিয়ে গেছলাম না? লোকটা যে এতদিন বেঁচে ছিল কি ক’রে সেইটেই আশ্চর্যের কথা, আর এখন যা অবস্থা হয়েছে দেখলে আঁতকে উঠতে হয়, মনে হয় যেন মরবার আগেই ভূত হ’য়ে বসে আছে! সদুর বর!… কাল চল, একবার দেখে আসবি শৈল, ভাগবত হালদারের বাড়িতে রয়েছে…।”

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “ভাগবত হালদারের বাড়িতে!”

অনিল বলিল, “ও, তাও তো বটে, তুই যে কিছুই জানিস্ না!—হ্যাঁ, সদু এখন ভাগবতের ওখানেই ওঠে। ভাগবত এখন ওর মস্ত বড় অভিভাবক, একেবারে বড় কুটুম! ওর দিদিমা মারা যেতেই ভাগবত ওরবপড়া হয়ে ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল, সেই দিনই। সদু তখন সমত্থ মেয়ে, তা ভাগবতের দয়াতে একদিনও তাকে অরক্ষিত থাকতে হয়নি। কেউ বললে, ‘সাবাস ভাগবত!’ কেউ সদুর জন্যে একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, কেউ বললে, ‘ও যা মেয়ে, ঠিক জায়গাতেই পৌঁছল—যোগ্যং যোগ্যেন যুজ্যতে’। তখন ব্যাপারটা অতশত বুঝি নি, শুনে যেতে লাগলাম। কিছুদিন গেল, তারপর এল ভাগবতের উপকারের দোসরা দফা। একদিন গ্রামে জন দুই-তিন নতুন লোক দেখে খোঁজ নিয়ে টের পেলাম ভাগবতের বাড়ি বরযাত্রী এসেছে—সদুর বিয়ে। দিনটা বেশ মনে আছে। বরযাত্রীদের দেখে আমি সদুর সঙ্গে দেখা করলাম। একটু গা-ঢাকা হয়ে এসেছে; খিড়কীর পুকুরে গা ডুবিয়ে সে গামছা দিয়ে মুখটা পরিষ্কার করছে, ঘাটে রক্ষক হিসাবে ভাগবতের ছোট মেয়ে নারাণী। ভাগবতের বাড়িতে লোকজন তো কমই, বিশেষ কাউকে ডাকেওনি—বললাম, ‘তোর বর দেখে এলাম সদী।’ বিয়ের জন্যে মুখখানাকে ঘষে ঘষে রাঙা ক’রে ফেলেছে—অন্ধকার হ’য়ে এলেও বেশ বুঝতে পারা যায়, কি রকম সৌখীন জানিসই তো। গামছাটা সরিয়ে মুখের একপাশে জড় ক’রে বললে, ‘ওমা, অনিল?—এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, আমি বলি হঠাৎ কে কথা কয়? কি রকম বর দেখলি রে?’ বলে গামছা দিয়ে মুখটা সব ঢেকে ফেলে শুধু কৌতুকভরা চোখ দুটো বের করে আমার পানে চেয়ে রইল। বললাম, ‘ভালই।’ সদু হেসে বললে, ‘তবে যে শুনেছিলাম বড় বুড়ো? অবিশ্যি আমায় কেউ বলেনি, এমনি শুনেছিলাম।’ আমি বললাম, ‘তোর শ্বশুর খুব বুড়ো সদু, বর-যাত্রীর আর সবাইও বুড়ো-বুড়োই, শুধু তোর বর দেখলাম কম বয়সী, মানে এই ছাব্বিশ, সাতাশ-তিরিশের মধ্যে।’ সদু মুখের জলটা কুলকুচি ক’রে ফেলে দিয়ে বললে, ‘মরুক গে, শ্বশুর নিয়ে তো আর ধুয়ে খাব না’—বলে খিলখিল করে হেসে বললে, ‘তুই এবার সর্ অনিল, উঠতে দে আমায় .. আর শোন্, বিয়ে দেখতে আসবি তো? নিশ্চয় আসবি। তোকে নেমন্তন্ন করেছে? নিশ্চয় করেনি; ভাগবত-কাকার জানাশোনা নিজের দলের ক’জন ছাড়া কাউকে বলেনি। না করলেও আমি করলাম। বিয়ে আমার, ভাগবত-কাকার তো বিয়ে নয়’—বলে আবার একবার চাপা গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল।

গেছলাম বিয়ে দেখতে অনিমন্ত্রিত হ’লেও অবশ্য না গেলেই ছিল ভাল। ছাদনা-তলায় দেখলাম শ্বশুরই বর, বরোচিত লজ্জায় এবং শ্বশুরোচিত বয়সে এত ঝুঁকে গেছে যে মুখই দেখা যায় না প্রায়। আমার যে কী হল! না ভাল ক’রে বুঝে টাই ক’রে বসে আছি! আমি দাঁড়াতে পারিনি, কিন্তু তারই মধ্যে সদুর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হ’য়ে গেল, সে কী নীরব মর্মন্তুদ দৃষ্টি!—যেন এত বড় বিদ্রূপটা আর যার কাছে হোক, অন্তত আমার কাছে ও প্রত্যাশা করেনি।”

অনিল আবার চুপ করিল। পাড়াগাঁ হিসাবে রাত্রি বেশ গাঢ় হইয়া আসিয়াছে। বাগ্দী-পল্লীতে দুই-একটা যে আলো ছিল নিবিয়া গিয়াছে শুধু জাগিয়া আছে বৈষ্ণব ভক্তের সেই গুপী-যন্ত্রটা। আমার দুইজনেই আবার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম। এক সময় অনিল প্রশ্ন করিল, “বদলালো মত?”

মনের যে রকম অবস্থা, একটু বিরক্তিও লাগিল। অনিল দার্শনিক, সবাই তো তাহা নয়। মনের ভাবটা চাপিয়া বলিলাম, “থাক্ ও-কথা এখন অনিল।”

অনিল বুঝিল; বলিল, “নাই বদলাক, একটা কথা শুনিয়ে রাখি। জানিস্ তো সাঁতরায় ‘ভাগবত হালদারের উপকারের দুই দফা’ বলে একটা কথা আছে?”

আমি ওর মুখের পানে চাহিলাম।

বলিল, “প্রথম দফা টাকা হাওলাত দেওয়া, অমন খুঁজে খুঁজে উপকার ও ছাড়া আর কেউ পারবে না! তার ওপর সুদের তাগাদা নেই—টাকা যে ধার দিয়েছে ভুলেই গেছে যেন—বলে ‘গেরস্ত যখন দেবার দেবেই, তাগাদা দিয়ে মিছে দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় ফেলা কেন?’ ফলে ওর সম্বন্ধে লোকে নিশ্চিন্দি হয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় ভাগবত তোমার কাঁধ থেকে বিষয়-সম্পত্তির বোঝা পর্যন্ত নামিয়ে তোমায় আরও নির্ভাবনা ক’রে দিলে।…সদু প্রথম দফা পেয়েছে এখন দ্বিতীয় দফা বাকি, ভাগবত তার গোড়াপত্তন ক’রে রেখেছে। অবশ্য সদীর বিষয়-সম্পত্তির মধ্যে সে নিজে।”

আমি আবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর মুখের পানে চাহিলাম।

অনিল বলিতে লাগিল, “সদুর স্বামী ভাগবতের কুটুম। সে যদি স্বর্গে যায় ভাগবত কি সদুকে ঠেলতে পারে? যে-ভাগবত, যখন একেবারেই কোন সম্পর্ক ছিল না পরের বোঝা বাড়ি এনে থুয়েছিল। গোড়াপত্তনের মধ্যে আরও একটা দূরদৃষ্টি আছে ভাগবতের। —সদুর বর আবার ঘে-সে কুটুম নয়, দূর সম্পর্কের সম্বন্ধী? —ভাগবতের এমনই আটঘাট বেঁধে কাজ করা, মানুষেও সম্বন্ধ-বিরুদ্ধ একটা কিছু হচ্ছে বলতে পারবে না, ভগবানেও নয়। সবার মুখ বন্ধ ক’রে রেখেছ। অবশ্য সদু এখনও ওকে আগেকার মত ‘ভাগবত-কাকা’ বলেই ডেকে আসছে, বোধ হয় আশা করে এইটেই হবে ওর বর্ম, ভাগবতের উপকারের পরিণতি থেকে ওকে বাঁচাতে।”

অনিল আবার একটু চুপ করিয়া বলিল, “বুঝেছি তোর মনেব ভাব শৈল। সদুর বৈধব্যকে ওর মুক্তি বলতে প্রাণে লাগে, কিন্তু আমি জানি সিঁথির সিঁদুর নিয়ে যাই বলুক, ও-ও মনে মনে ক্লান্ত। আজ দুপুরে শুনলি তো?…তারপর, বিধবা-বিবাহ ক’রে সদুর জীবনে দাগ, লাগানো!—শিউরে উঠেছিস ভাবতেই। কিন্তু সদুর সামনে ঐ নরক ভাগবতের দ্বিতীয় দফা উপকার।…দেখ্ ভেবে, জীবনকে, সমাজকে তোরা শুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখিস্, আমার মত নাস্তিকের আবার বেশি বল মানায় না।”

“চল, ওঠা যাক্‌, রাত অনেক হ’ল। অম্বুরীর কাছে একটা মিথ্যে জবাবদিহি দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে চল।”