তিন মাসের জন্য কোয়েটা জেলায় জেলা প্রশাসন প্রশিক্ষণ

সিভিল সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণের শেষ তিন মাস জেলা প্রশাসনে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিতে হতো। যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো জেলায় প্রশিক্ষণ নিতে হতো। যারা পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের পূর্ব পাকিস্তানের কোনো জেলায় প্রশিক্ষণ নিতে হতো। প্রশিক্ষণার্থীরা তিন কিংবা চারজনের একটি দলে সফর করতেন। শাহেদ সাদুল্লাহ, আবদুশ শাকুর, শাহ মোহাম্মদ ফরিদ এবং আমি–এই চারজন একটি দল গঠন করি এবং কোয়েটাকে জেলা প্রশাসনের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিই। মিজানুর রহমান শেলী এবং আরও পাঁচজন সহকর্মী মালাকন্দ পার্বত্য জেলায় যাওয়ার জন্য দরখাস্ত করেন। কিন্তু মালাক জেলার রাজনৈতিক এজেন্ট জানান, এই অঞ্চলের প্রশিক্ষণ পাকিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চলে চলবে না। তাই তাদের অন্য কোথাও প্রশিক্ষণে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এই দলকে কোহাট পাঠানো হয়। ওয়ালিউল ইসলামের নেতৃত্বে চারজনের আরেকটি দল কালাত বিভাগে প্রশিক্ষণের জন্য আসেন। তাদের কালাত উপস্থিতির পর কমিশনার অভিমত প্রকাশ করেন যে এখানে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। সুতরাং তাদের কালাত থেকে হায়দরাবাদ জেলায় পাঠানো হয়।

আমরা ট্রেনে করে লাহোর থেকে কোয়েটা রওনা হই। সাক্কার স্টেশন পার হওয়ার পর ট্রেন অনেক টানেলের ভেতর দিয়ে কোয়েটা শহরের দিকে অগ্রসর হয়। কোয়েটা শহরে পৌঁছানোর পর আমাদের রেলস্টেশনে অভ্যর্থনা জানান ১৯৬৬ ব্যাচের সিকান্দার হায়াত খান জামালির ছোট ভাই তাজ জামালি। তিনি আমাদের কোয়েটা মিউনিসিপ্যালটির রেস্টহাউসে নিয়ে যান। রেস্টহাউসটি মোটামুটি ভালো ছিল। লাহোর থেকে আমাদের সঙ্গে একজন মেস বিয়ারার আসেন, তাঁর নাম ছিল ফকির মোহাম্মদ। তার মেয়ের জামাই কোয়েটায় রেলওয়েতে কাজ করত। সে মেয়ের সঙ্গে থাকত এবং দিনের বেলায় এসে আমাদের কাজকর্ম করে দিত। আমরা যখন বাইরে সফরে যেতাম, তখন আমরা চাইলে সে আমাদের সঙ্গে যেত।

কোয়েটায় পৌঁছার পরদিন আমরা কোয়েটা ডেপুটি কমিশনার জামশেদ বারকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। জামশেদ বারকি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে সিএসপিতে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তাঁকে ১৯৬১ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানান। তিনি বলেন যে উপজাতীয়দের কিছু কোন্দলের জন্য তিনি খুবই ব্যস্ত আছেন। কাজেই কোয়েটাতে আমরা যা করতে চাই, তা যেন। আমরা নিজেরাই করে নিই। আমরা যা করব, তাতেই তার অনুমতি রয়েছে। আর বললেন, তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে ডিনারে। তোমরা মাসে অন্তত একটি ডিনার আমার সঙ্গে খাবে। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। তিন মাসে তিনি আমাদের তিনটি ডিনারে ডেকেছিলেন। ডিনারেই তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। সুতরাং কোয়েটায় আমরা কী কাজ করব, সেটা আমরাই ঠিক করে নিই। একাডেমি থেকে আমাদের প্রত্যেককে একটি করে বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন লিখতে বলা হয়েছিল। যেমন আমার দায়িত্ব ছিল কোয়েটা জেলায় কৃষি বিভাগের কার্যকলাপ। আমার সহকর্মী আবদুশ শাকুরকে দেওয়া হয়েছিল উপজাতীয়দের নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখার দায়িত্ব।

এ ছাড়া আমাদের তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমাদের কতগুলো মামলা নিষ্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুটি কাজ করা হলে বাকি সময় আমরা যা খুশি করতে পারি।

এ সময়ে সরকারি আইনের ফাঁকে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের একটি উৎস আমাদের নজরে আসে। কোনো সরকারি কর্মচারী যখন সফরের জন্য তাঁর দপ্তর ছেড়ে বাইরে যান, তখন তিনি দশ দিন পূর্ণ হারে দৈনিক ভাতা পান। দশ দিন পার হলে দশ দিন থেকে এক মাস অর্ধেক হারে দৈনিক ভাতা পান।

এক মাস পার হওয়ার পর তখন ওই স্থান তার অস্থায়ী দপ্তর হিসেবে গণ্য হবে। এবং তাঁকে আর দৈনিক ভাতা দেওয়া হবে না। তবে যদি কোনো কর্মকর্তা তাঁর নতুন দপ্তরে যাওয়ার দশ দিনের মধ্যে আবার অন্য কোথাও কমপক্ষে তিন দিনের জন্য সফরে যান, তাহলে আরও দশ দিন তাকে পূর্ণ হারে দৈনিক ভাতা দিতে হবে। এভাবে দশ দিন পরপর সফরে গেলে পুরো তিন মাস সময় পূর্ণ হারে দৈনিক ভাতা পাওয়া সম্ভব। আমরা তদনুসারে কর্মসূচি প্রণয়ন করলাম। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি গাড়ির দরকার ছিল। সৌভাগ্যবশত জামালি গোত্রের কোয়েটায় একটি রেস্টহাউস ছিল। এ রেস্টহাউসে একটি গাড়ি ছিল মেহমানদের জন্য। সিকান্দার হায়াত খান। জামালির নির্দেশে এই গাড়িটি চালকসহ আমাদের দিয়ে দেওয়া হয়। তাই আমরা যখন যেখানে খুশি যেতে পারতাম।

কোয়েটা জেলায় তখন দুটি মহকুমা ছিল। একটি মহকুমার নাম ছিল পিশিন। সেখানে একটি ফলের বাগানের মধ্যে অতি সুন্দর একটি রেস্টহাউস ছিল। সেই রেস্টহাউসের বাবুর্চি খুব ভালো রান্না করতে পারত। সেই রেস্টহাউসের বাগানের আপেল, আখরোট, বাদাম, আঙুর ইত্যাদি ফলও আমরা খেতে পারতাম। সুতরাং যখনই কোয়েটায় নয় দিন হয়ে যেত, তখনই আমরা পিশিন চলে যেতাম।

আরেকটি মহকুমা ছিল চমন। চমনের অতিথি ভবন ছিল আফগানিস্তান সীমান্তে। অতিথি ভবনের বারান্দা থেকে আমরা আফগানিস্তানের গাড়িঘোড়ার চলাচল দেখতে পেতাম। চমনে লান্ডিকোটালের মতো কিছু চোরাচালান করা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হতো। আমরা কয়েকবার চমনে গিয়েছি। আমাদের আগের। ব্যাচের কর্মকর্তারা লাহোর থেকে পাসপোর্ট করে এনেছিলেন। এ পাসপোর্ট ব্যবহার করে তাঁরা চমন থেকে কাবুলে গিয়েছিলেন। আমরা যেহেতু পাসপোর্ট করে আনিনি, সেহেতু আমাদের পক্ষে আফগানিস্তানে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

কোয়েটা থেকে আমরা জিয়ারত যাই। জিয়ারত একটি শৈলশহর। এই শহরে বেলুচিস্তানের এজিজির (Assistant to Government General) জন্য একটি সুন্দর বিশ্রামাগার ছিল। গ্রীষ্মকালে এজিজি এবং তাঁর অতিথিরা এ বাড়িতে এসে থাকতেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ১৯৪৮ সালে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তিনি বিশ্রাম করার জন্য জিয়ারত এসেছিলেন। এখানে তার মৃত্যুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর তাঁকে বিমানে করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জিয়ারতে অনেক ধনী ব্যক্তি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। জামালি পরিবারের পরিচিত এক ধনীর বাংলোয় আমরা তিন। রাত ছিলাম। জিয়ারতের আশপাশে বিভিন্ন অঞ্চল আমরা ঘুরে দেখেছি।

কোয়েটায় থাকাকালে আমরা ফোর্ট স্যান্ডেম্যান (Fort Sandeman) বেড়াতে যাই। অনেক উঁচুতে অবস্থিত এই শহরে গ্রীষ্মকালে পর্যটকেরা বেড়াতে যেতেন। ফোর্ট স্যান্ডেম্যানে তখন এপিএ (Assistant Political Agent) ছিলেন লুফুল্লাহিল মজিদ। তাঁর অতিথি হিসেবে আমরা ফোর্ট স্যান্ডেম্যানে যাই। ব্রিটিশ শাসনামলে এই দুর্গে একটি বিরাট সেনানিবাস ছিল। যখন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, তখন সীমান্তের পাঠানদের সঙ্গে পাকিস্তান। সরকারের চুক্তি হয় যে তারা পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। তাই এখান থেকে সেনানিবাস তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে আমরা যখন ফোর্ট স্যান্ডেম্যানে যাই, তখন সেনানিবাসের মেস ভবনটি ছিল শূন্য। এই শূন্য ভবনে আমরা চারজন কয়েক দিন ছিলাম। মেস ভবনের উল্টো দিকে উঁচু পাহাড়ে দুটি বাড়ি ছিল। নিচের বাড়িটিতে থাকতেন এপিএ লুৎফুল্লাহিল মজিদ আর ওপরের বাড়িটিতে থাকতেন পলিটিক্যাল এজেন্ট। পলিটিক্যাল এজেন্ট আমাদের একদিন ডিনারে ডেকেছিলেন। লুফুল্লাহিল মজিদও আমাদের ডিনার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আমাদের তিনি পাঠানদের একটি বসতিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে সবাই মিলে মাটিতে বসে মধ্যাহ্নভোজন করি।

যাহোক, আমাদের কোয়েটা সফর শেষ হলে আমরা লাহোর ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। এই সময় জামালিরা আমাদের নিমন্ত্রণ করে তাদের বাড়ি হয়ে লাহোর ফিরে যাওয়ার জন্য। জামালিদের বাড়ি ছিল জেকোবাবাদ জেলার নাসিরাবাদ মহকুমায়। আমরা কোয়েটা থেকে সিবি হয়ে জেকোবাবাদ পৌঁছাই। সে সময়ে জেকোবাবাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন সৈয়দ মুহিবুল্লাহ শাহ। সার্কিট হাউসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আমরা নাসিরাবাদ মহকুমায় যাই। নাসিরাবাদ মহকুমাকে তখন ঝটপট বলা হতো। ঝটপটে একটি গ্রামে জামালিরা থাকতেন। ওই অঞ্চলে সিন্ধু নদীর পানি একটি খালের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়। সুতরাং সেখানে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা ছিল। তাই এ অঞ্চলে ভালো ধান এবং গম ফলত। জামালিরা আমাদের জন্য একদিন মধ্যহ্নভোজনের ব্যবস্থা করে। সেই ভোজনে আস্ত দুম্বার রোস্ট করা হয়েছিল। এই অঞ্চলের কৃষকেরা সামন্ত প্রভুদের হাতে বন্দী ছিলেন। আমরা গ্রাম দেখতে বেরিয়ে ছিলাম। গ্রামের কৃষকদের আর্থিক অবস্থা ছিল দুর্বল। শিক্ষার হার ছিল খুবই নিচু। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ঝটপট থেকে গাড়িতে করে আমাদের সাক্কার নিয়ে যাওয়া হয়। সাক্কার থেকে ট্রেনে করে আমরা আবার লাহোর ফিরে যাই। ১৯৯০-এর দশকে ঝটপট অঞ্চলে অনেক পরিবর্তন। এসেছে। এখন নাসিরাবাদ বা ঝটপট মহকুমা আর নেই। সেখানে জামালি গোত্রের জাফর আহমদ জামালির নামে জাফরাবাদ জেলা স্থাপন করা হয়েছে।

সফর শেষে একাডেমিতে ফিরে আসার পর আমাদের ফাইনাল পাসিং আউট পরীক্ষা শুরু হয়। সব পরীক্ষা শেষে আমাদের একটি ডিনার হয় এবং একটি গ্রুপ ছবি তোলা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নেওয়া পরীক্ষা ছাড়াও সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে পরিচালকের জন্য ১০০ নম্বর রাখা হয়েছিল। আমাদের ব্যাচে ২০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে ১৯ জনের সর্বনিম্ন নম্বর ছিল ৬০ (ওয়ালিউল ইসলাম ও সৈয়দ রেজাউল হায়াত) এবং সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ৯২ (পেয়েছিল শাহেদ সাদুল্লাহ)। শুধু একজন পেয়েছিল মাত্র ৪৮ নম্বর, তার নাম মামুনুর রশীদ। এই নম্বর নির্ধারণে পরিচালক উপপরিচালকদের অভিমত নিতেন। এ ছাড়া একাডেমির অনানুষ্ঠানিক গোয়েন্দাদের পরামর্শও নিতেন। মেস বেয়ারাররা ছিল এই গোয়েন্দা। প্রতি প্রশিক্ষণার্থী একাডেমিতে কী করে এবং তার চারিত্রিক প্রবণতাগুলো কী, সে সম্পর্কে তথ্য মেস বেয়ারাররা সংগ্রহ করত। পরিচালক নম্বর দেওয়া ছাড়াও প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী সম্পর্কে একটি রেখাচিত্র (Pen Picture) লিখতেন। এই রেখাচিত্রে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর সবলতা এবং দুর্বলতাসমূহ লেখা হতো। আমার সম্পর্কে পরিচালকের সুপারিশ আমি দেখেছি। তিনি লিখেছিলেন এই প্রশিক্ষণার্থী একজন ভালো ছাত্র ছিল, ভালো বিতর্ক করত। তারপর দুর্বলতা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, এই কর্মকর্তা ধর্ম এবং বিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় খুঁজে পাচ্ছেন না। ইসলাম সম্পর্কে আরও পড়াশোনা করলে হয়তো তিনি সেটা পেতে পারেন। সবশেষে তিনি সুপারিশে লিখেছেন, এই কর্মকর্তা সৎ, তাঁর সতোর মধ্যে কোনো খাদ নেই। এ ধরনের কর্মকর্তা বিচার বিভাগের জন্য বেশি উপযোগী। এই মন্তব্য দিয়ে তিনি আমাকে বিচার বিভাগে পাঠাতে চেয়েছিলেন। যদি পাকিস্তান টিকে থাকত এবং আমি সিভিল সার্ভিসে টিকে থাকতাম, তাহলে তাঁর এই মন্তব্য

আমার জন্য অভিশাপ হিসেবে বিবেচিত হতো। পাকিস্তান টেকেনি, নির্বাহী। কর্মকর্তাদের বিচার বিভাগের বদলির ব্যবস্থা উঠে গেছে। তাই তাঁর সুপারিশ কোনো কাজে লাগেনি।