শিক্ষাসফর

চারটি শিক্ষাসফর সিভিল সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছিল—

  1. দক্ষিণাঞ্চল সফরে লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত যাওয়া হতো। সিন্ধু প্রদেশের সাক্কার হয়ে করাচির রাস্তা ছিল প্রায় ৮০০ মাইল (১২১০ কিলোমিটার)। আমাদের যাত্রা শুরু হয় সাহিওয়াল জেলার ওকারা মহকুমা হয়ে প্রাচীন শহর হরপ্পাতে যাওয়ার মাধ্যমে। লাহোর থেকে হরপ্পার দূরত্ব ছিল প্রায় ১৯৬ কিলোমিটার। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার একটি বড় কেন্দ্র ছিল হরপ্পা নগরী। তবে ১৯৩০-এর দশকে লাহোর থেকে যখন দক্ষিণ দিকে রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছিল, তখন সেই রেলপথ সরাসরি প্রাচীন হরপ্পা নগরীর ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়। তখনো সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল। না। এই নগরীর মধ্য দিয়ে রেললাইন নির্মাণে লাভ হয়, কেননা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ইটগুলো রেললাইনে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। কিন্তু এই রেলপথ নির্মাণের ফলে সিন্ধু সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ চিরতরে হারিয়ে যায়। আমরা হরপ্পার জাদুঘরে সিন্ধু সভ্যতার কিছু স্মারক দেখতে পাই। হরপ্পা থেকে মহকুমা শহর খানেওয়াল হয়ে আমরা মুলতান পৌঁছাই। লাহোর থেকে মুলতানের দূরত্ব প্রায় ৩৩৭ কিলোমিটার। আমরা সন্ধ্যার দিকে মুলতান পৌঁছাই।

    মুলতানে আমাদের রাখা হয় সেখানকার মেহমানখানায়। মেহমানখানার সুযোগ-সুবিধা ছিল খুবই সীমিত, এমনকি শৌচকার্য করার জন্য কোনো টয়লেট ছিল না। সেখানে প্রথম ‘থান্ডার বক্স’ দেখতে পাই। থান্ডার বক্স একজন ব্যবহার করার পর মেথর এসে পরিষ্কার করে দিলে আরেকজন তা ব্যবহার করতে পারত। সন্ধ্যায় আমরা যাই দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইসলাম প্রচারক শেখউল ইসলাম বাহাউদ্দিন আবু মোহাম্মদ জাকারিয়া আল কুরেশি আল আসাদির (যিনি বাহাউল হক নামে পরিচিত ছিলেন) মাজারে। মাজারটি ছিল প্রাচীন মুলতান দুর্গের ওপরে। তাই মাজারটিতে যেতে হলে অনেকটা পথ উঁচুতে হেঁটে যেতে হতো। আমরা যখন মাজারে প্রবেশ করছিলাম, তখন হঠাৎ দেখতে পাই একজন সাধক একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান গাইছে ‘দমাদম মাস্তকেন্দর, আলিদা পয়লা নম্বর। গানের অনুরণন পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই এই গান সারা পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। মাজার থেকে বেরিয়ে আমরা মুলতানের বাজারে যাই। বাজারের কাছেই ছিল মুলতানের বিখ্যাত গণিকালয়। আমাদের ব্যাচমেট ইকতেদার আহমদের নেতৃত্বে আমরা গণিকালয়ে ঢুকি। রাতে বিদ্যুতের আলোয় পুরো গণিকালয়টি ঝলমল করছিল। সেখানে ঘোড়ার গাড়িতে করে গণিকারা কেউ বাইরে যাচ্ছিল, কেউ ফিরে আসছিল। বাইরে থেকে মিষ্টি সুরে অনেক গান শোনা যাচ্ছিল।

    পরদিন সকালে আমরা সিন্ধু প্রদেশের সাক্কার শহরের দিকে রওনা হই। মুলতান থেকে সাক্কারের দূরত্ব হলো ২৩৪ মাইল (৩৭৬ কিলোমিটার)। বিকেলের দিকে আমরা সাক্কারে সেচ বিভাগের ইন্সপেকশন বাংলোতে উপস্থিত হই। বাংলোর সামনে জি এম ব্যারাজে জমানো সিন্ধু নদের বিশাল জলরাশি। এই জলরাশি দেখে মনে হচ্ছিল যে আমরা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে নেই। সাক্কার যেন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। আমাদের উপপরিচালক ড. তারেক সিদ্দিকী ১৯৫৫ সালে সিএসপি হন। সে সময় তার ব্যাচ যখন সাক্কার শহরে এসেছিল, তখন তার ব্যাচমেট সুলতানুজ্জামান খান স্যুট-কোট পরে ‘আমার সোনার বাংলা’ বলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। বহু কষ্টে তাঁর ব্যাচমেটরা তাঁকে ঝাঁপ দিতে দেননি। আমরা কেউ সিন্ধুর পানিতে ঝাঁপ দিইনি ঠিকই কিন্তু সবার মনেই সোনার বাংলার স্মৃতি ভেসে ওঠে।

    পরদিন সকালে আমরা শিকারপুর হয়ে মহেঞ্জোদারোর উদ্দেশে রওনা হই। শিকারপুরে তখন এসডিএম ছিলেন ১৯৬৪ ব্যাচের বাংলাদেশের সিএসপি কুদরত-এ-এলাহী চৌধুরী। তার সঙ্গে শিকারপুরের রাস্তায় দেখা হয়। শিকারপুর শহরটি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য শহর থেকে একেবারে ভিন্ন। এই শহরে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ ছিল হিন্দু। তাই রাস্তায় মসজিদের পাশাপাশি মন্দিরও দেখা যাচ্ছিল। দোকানপাটে দেখা যাচ্ছিল শাড়ি, আর রাস্তার পাশে ছিল অনেক মিষ্টির দোকান। এ মিষ্টিগুলো সাধারণত পশ্চিম পাকিস্তানে পাওয়া যায় না। দোকানের বাইরে থেকে দেখা রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম ইত্যাদি মিষ্টি আমাদের বাংলাদেশের মিষ্টির দোকানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এরপর লারকানা শহর হয়ে আমরা মহেঞ্জোদারোতে উপস্থিত হলাম। মহেঞ্জোদারো একটি বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসস্তূপ। এখানে অনেক বড় উপাসনালয়, খাদ্যগুদাম, রাস্তাঘাট, দালানকোঠা ছিল। আমরা মহেঞ্জোদারো শহরের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করলাম। মহেঞ্জোদারো মিউজিয়ামে মহেঞ্জোদারো এবং তার সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার স্মরণচিহ্নগুলো দেখতে পাই। রাতে মহেঞ্জোদারো থেকে আমরা সাক্কারে ফিরে আসি।

    সাক্কার থেকে আমরা করাচি রওনা হই। করাচি যাওয়ার আগে আমরা থাট্টা শহরে থামি। থাট্টা শহরে অজস্র মুসলমান সাধকদের কবর রয়েছে। আমরা কিছু কবর ঘুরে দেখি। সেখানে তখন এসডিএম ছিলেন ১৯৬৫ ব্যাচের সিএসপি সৈয়দ আবদুস সামাদ। তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়।

    থাট্টা থেকে আমরা করাচিতে হোটেল মেট্রোপোলে গিয়ে উঠি। সেখানে আমাদের জন্য সস্তায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। করাচিতে আমাদের কায়েদে আজমের মাজার দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে আমাদের নেওয়া হয় এবং একদিন ক্লিফটন সমুদ্রসৈকতে পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়। করাচিতে তখন ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টের সদর দপ্তর ছিল। এই দপ্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ১৯৪২ সালের আইসিএস কর্মকর্তা এম এ এইচ কার্নি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তিনি আমাদের জন্য বিরাট এক ডিনারের আয়োজন করেছিলেন। একদিন আমরা প্রাতরাশ গ্রহণ করি করাচির কমিশনার দরবার আলী শাহের সঙ্গে। করাচি থেকে ইসলামাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের পর এবং একত্র পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধু প্রদেশের অবলুপ্তির পর করাচি শহরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হন কমিশনার। শহরে তখন অসংখ্য শিল্পোদ্যোক্তা এবং বহুজাতিক কোম্পানি ছিল। এরা এদের অনুষ্ঠানে কমিশনারের উপস্থিতি চান। ফলে দুপুরে এবং রাতে কমিশনারের কোথাও না কোথাও নিমন্ত্রণ থাকত। যারা দুপুরে এবং রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিতে পারত না, তারা কমিশনারের জন্য প্রাতরাশের ব্যবস্থা করত। এর ফলে কমিশনারের বাড়িতে খুব কমই রান্নাবান্না হতো। দরবার আলী শাহ আমাদের জন্য তার বাসভবনে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করেন। আমাদের সবাইকে নিজ হাতে সিগারেট দেন এবং সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্প করেন। রাতে মেট্রোপলিটন হোটেলে কোনো না কোনো কোম্পানি আমাদের জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করত। তবে এসব নিমন্ত্রণে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল না। আমরা কোনো কোনো সময় রাতে বেরিয়ে পড়তাম। একদিন রাতে আমার খালাতো ভাই এইচ ডব্লিউ চৌধুরীর বাড়িতে যাই। তিনি তখন পাকিস্তান শিল্প ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। তার সঙ্গে আমার আরেক খালাতো ভাই মানিক চৌধুরীও থাকতেন। তিনি আমাকে খাওয়ানোর জন্য করাচির ইলিশ মাছ নিয়ে আসেন। আমার ধারণা ছিল ইলিশ মাছ শুধু বাংলাদেশে পাওয়া যায়। করাচিতে গিয়ে আমার সেই ভুল ভাঙে। ইলিশ মাছ পৃথিবীর অনেক বড় নদীর মোহনায় পাওয়া যায়। তবে পদ্মার ইলিশের মতো স্বাদ অন্যান্য নদীর ইলিশের হয় না। করাচিতে আমি যে ইলিশ খেয়েছিলাম, তা দেখতেই শুধু ইলিশের মতো ছিল; কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশের স্বাদ তাতে মোটেও ছিল না।

    করাচি থেকে ফেরার পথে আমরা হায়দরাবাদ শহরে যাই। সেই শহরে একদিকে যেমন আছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, অন্যদিকে অনেক নতুন সরকারি দালানকোঠাও গড়ে তোলা হয়েছে। হায়দরাবাদে তখন কমিশনার ছিলেন। ১৯৪৯ ব্যাচের সিএসপি মসরুর হাসান খান। তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। এ ছাড়া আমরা একটি কৃষি গমবষণাকেন্দ্র দেখতে যাই। হায়দরাবাদ থেকে আমরা যাই ভাওয়ালপুরে। সেখানে একটি অব্যবহৃত রাজপ্রাসাদে আমাদের রাখা হয়। ওই এলাকার কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়া হয়। হায়দরাবাদ থেকে আমরা যাই পানজনদ নামে একটি স্থানে। সেখানে সিন্ধুর পাঁচটি নদী একত্রে মিলেছে। সেখানে সেচ বিভাগের ইন্সপেকশন বাংলোতে আমরা মধ্যাহ্নভোজন করি। রাতে আমরা ফিরে আসি রহিম ইয়ার খান নামক জেলা শহরে। এখানকার একজন ভূস্বামী রাতে আমাদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করেন। রহিম ইয়ার খান থেকে লাহোরের দূরত্ব ছিল প্রায় ৫৯০ কিলোমিটার। মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমরা খানেওয়াল মহকুমা শহরের কাছে অবস্থিত মিচেল কোম্পানির ফলের বাগান এবং কারখানায় যাই। সেখানে খুবই উন্নত মানের যান্ত্রিক চাষাবাদ করা হচ্ছিল। রাতে আমরা সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ফিরে আসি।

  2. পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কুমিল্লা সফর। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আমাদের দুই সপ্তাহের জন্য সফরে নিয়ে যাওয়া হয়। আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রের সূতিকাগার ছিল কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ১৯৩৮ ব্যাচের আইসিএস অফিসার আখতার হামিদ খান। তিনি পরে আইসিএস চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এখানে ইউনিয়ন কাউন্সিল, সমবায় সমিতি এবং কোতোয়ালি থানা সমবায় সমিতি–এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম আমাদের হাতে-কলমে দেখানো হয়। এ ছাড়া প্রতিদিনই কুমিল্লা একাডেমির প্রশিক্ষকেরা গ্রামীণ সমাজ, গ্রামীণ অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিন-চারটি ক্লাস নিয়েছিলেন আখতার হামিদ খান নিজে। কুমিল্লা মডেলে এলিট শ্রেণির লোকেরা বেশি উপকৃত হচ্ছে–এ ধরনের প্রশ্ন করলে আখতার হামিদ খান রেগে যান। তিনি স্বীকার করেন যে কুমিল্লা মডেলে দুর্বলতা আছে, তবে এ দুর্বলতা মডেলকে নিয়ে কাজ করতে করতে দূর করতে হবে; রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। কুমিল্লায় আমাদের ব্যাচের কর্মকর্তাদের তিনটি মধ্যহ্নভোজের নিমন্ত্রণ করা হয়। একটি ভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন কুমিল্লার ডিসি আবদুস সালাম সাহেব। আরেকটি লাঞ্চ দেন আমার ফুফা আজিজুর রহমান সাহেব, যিনি কুমিল্লা কনভেনশন লিগের সভাপতি এবং জাতীয় সংসদের সদস্যও ছিলেন। সবশেষ ভোজের ব্যবস্থা করেন আমার চাচা আবদুস শাকুর খান। তিনি প্রাদেশিক প্রদেশের সদস্য ছিলেন। তাঁর ছেলে হাবিবুল্লাহ খান তখন গওহর-আইয়ুবের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গান্ধার ইন্ডাস্ট্রিজের পূর্ব পাকিস্তানের ম্যানেজার ছিলেন। আমার কুমিল্লা অবস্থানকালে আমার বাবা-মা নবীনগর থেকে কুমিল্লায় শাকুর খান সাহেবের বাসায় চলে আসেন। প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। ড. তারেক সিদ্দিকী সে সময় আমাদের প্রত্যেককে একটি করে কৃষক সমবায় সমিতি পরিদর্শন করিয়ে সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেন। যেহেতু সন্ধ্যাবেলায় আমি শহরে চলে যেতাম, সেহেতু আমার কাজের বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। একদিন সন্ধ্যায় ড. তারেক সিদ্দিকী আমাকে কুমিল্লা যাওয়ার আগে ধরে ফেলেন এবং বলেন যে এখনই তোমাকে গ্রামে যেতে হবে। তোমাকে সমবায় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আমি রিকশা করে একাডেমি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত গ্রামটিতে যাই। সেখানে গিয়ে আমি সমবায় সমিতির অফিস খুঁজতে শুরু করি। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে কোনো উত্তর দেয় না। ঘণ্টাখানেক পর একজন শিক্ষক আমাকে কানে কানে বললেন, সামনের বাড়িটিতেই এই অফিস অবস্থিত ছিল। কিন্তু এই অফিস এখন আর নেই। কারণ গ্রামের দলাদলিতে সমবায় সমিতির সভাপতিকে দিন দশেক আগে জবাই করা হয়েছে। ভয়ে কেউ ওই অফিসে এখন আর যায় না। আমি কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। আমার রিপোর্টে আমি লিখলাম, গ্রামের দলাদলি হ্রাস করা না গেলে সেখানে সমবায় সমিতির বিকাশ সম্ভব হবে না।

  3. মধ্য পাঞ্জাবে শিক্ষাসফর। ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমাদের পাঁচ দিনের একটি সফরে পাঞ্জাবের মধ্যাঞ্চলে শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা লাহোর থেকে গিয়ে লায়ালপুর (যা এখন ফয়সালাবাদ নামে পরিচিত) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসে গিয়ে উঠি। লায়ালপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভিন্ন বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের সঙ্গে পরিচিত করানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা তাঁদের বিষয়ে বক্তৃতা দেন এবং তাঁদের গবেষণাগার দেখান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নতুন প্রজাতির শস্য, ফল এবং গবাদিপশুর আবিষ্কারের জন্য কাজ চলছিল। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছিলেন এবং এ সফল পরীক্ষাগুলো কৃষকদের মধ্যে মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। এর ফলে এখানে কৃষি অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ অধিবেশন হয় ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে। ভাইস চ্যন্সেলরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তফাত কোথায়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে বরাদ্দ আসে, তার। সিংহভাগ ব্যয় করা হয় গবেষণার জন্য। তারা দালানকোঠা নির্মাণে অতি অল্প ব্যয় করেন। আর পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই দালানকোঠা নির্মাণে ব্যয় করা হয় কিন্তু গবেষণার জন্য ব্যয় অত্যন্ত কম। গবেষকদের উৎসাহিত না করলে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উন্নতি হবে না।

    লায়ালপুর থেকে আমরা একদিন সারগোদা বিমানবাহিনীর কেন্দ্রে যাই। সেখানে প্রশ্ন ওঠে যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশসীমার প্রতিরক্ষা সম্ভব কি না। তখন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক স্কোয়াড্রন বিমান ছিল। তার বিপরীতে চীনা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পূর্ব ভারতে অনেক স্কোয়াড্রন বিমান ছিল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়ার শক্তির অধিকারী ছিল। পাকিস্তান বিমানবাহিনী কেন্দ্রের পরিচালক এ মত প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান উড়ে ভারতের ওপর বোমা ফেলতে ফেলতে ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে অবতরণ করবে। তারপর সেই বিমান ঢাকা থেকে জ্বালানি এবং বোমা নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বোমা ফেলতে ফেলতে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসবে। সুতরাং ভারত কোনোমতেই পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে অচল করতে পারবে না। তাঁর এই বক্তব্য শুনে সব পূর্ব পাকিস্তানি প্রশিক্ষণার্থী হেসে ওঠেন। এ নিয়ে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের কিছুটা কথা-কাটাকাটি হয়। এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে, অর্থাৎ ‘৬৮ এবং ‘৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানি প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের ঝগড়া হয়েছে বলে জানা যায়।

    এ ছাড়া আমরা ঝং শহরে যাই। সেখানে একটি বিরাট পশুর মেলা বসেছিল। সেখানে আমরা অনেক ধরনের গরু, ছাগল, মহিষ, মোরগ ইত্যাদি দেখতে পাই। ঝং জেলায় কৃষি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। এই জেলা শুধু কৃষির জন্যই নয়, হির-রঞ্জার আবাসস্থলও ছিল এই জেলা। হির এক ধনীর দুলালী ছিলেন এবং রঞ্জা ছিল এক গরিব চাষির ছেলে। এরা প্রেমে পড়লে হিরের পরিবার তাদের রোমান্স ভেঙে দেওয়ার জন্য হিরকে এক ধনীর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। হির এই বিয়ে ভাঙতে চাইলে তাকে বিষ খাওয়ানো হয়। হির বিষ খেয়ে মারা গেলে রঞ্জাও একই বিষ খায় এবং মারা যায়। তাদের কবর ঝং শহরে অবস্থিত। তবে এই কবর জিয়ারত করার সুযোগ আমাদের হয়নি।

  4. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সফর। আমাদের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল সীমান্ত সফরের জন্য পেশোয়ার শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে আমাদের কিছু ক্লাসও নিতে হয়। একাডেমির পরিচালক আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন, তবে একাডেমিতে কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা তখনো শুরু হয়নি। এই একাডেমির প্রশিক্ষকদের মান কুমিল্লা একাডেমির চেয়ে নিচু বলে মনে হয়েছে। পেশোয়ার থেকে আমাদের কোহাট জেলা সদরে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে দাঁড়াআদমখেল নামে একটি বসতিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাইসেন্স ছাড়া বন্দুক বেচাকেনা হতো। পেশোয়ার থেকে কোহাটের রাস্তা ছিল তখন অত্যন্ত দুর্গম। প্রায়ই এই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটত। আমরা কোহাট থেকে সহিসালামতে ফিরে আসি।

    পেশোয়ার থেকে আমাদের একদিন লান্ডিকোটালে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লান্ডিকোটাল অঞ্চলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এখানে আফগানিস্তানে যাওয়ার নাম করে পাকিস্তানকে শুল্ক না দিয়ে সরাসরি বিদেশি পণ্য নিয়ে আসা হতো। কিন্তু এগুলো আফগানিস্তানে বিক্রি না করে বিক্রি করা হতো লান্ডিকোটালে। এই স্মাগলিং ব্যবসা এখানকার জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস ছিল। আমি লান্ডিকোটালে বিদেশি স্যুটের কাপড় এবং স্যুটকেস কিনেছিলাম। লান্ডিকোটাল ভ্রমণের পরদিন আমরা লাহোর ফিরে আসি। এই সফরের সময় আমরা নওসেরা নামক একটি শহরের মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি। নওসেরা ছিল একটি মহকুমা শহর। পেশোয়ার একাডেমির বাইরে যাওয়ার জন্য আমাদের কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের ব্যাচমেট মামুনুর রশীদের কল্যাণে একটি গাড়ির ব্যবস্থা হয়। এই গাড়িতে করে আমরা রিসালপুর বৈমানিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র ঘুরতে যাই। সেখানে বাঙালি প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। মামুনুর রশীদের ফুফাতো ভাই একজন প্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর কল্যাণে আমরা ‘বেইজ’-এর দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে পাই।