লাহোর একাডেমির প্রশিক্ষকেরা

  1. আমরা যখন সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিই, তখন একাডেমির পরিচালক ছিলেন আবদুল মজিদ। তিনি ১৯৩৯ ব্যাচের আইসিএস অফিসার ছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজশাহীতে ও ময়মনসিংহে ডেপুটি কমিশনারের কাজ করেছেন। তিনি পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন, কিন্তু কোনো কারণে তিনি তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিরাগভাজন হন। তাই তাকে অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। তিনি সিভিল সার্ভিস একাডেমির পরিচালক পদেও অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদা ভোগ করতেন। তিনি অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদা নিয়ে পাঞ্জাব সরকারের ভূমি রাজস্ব বোর্ডের সদস্য পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮০-এর দশকে করাচিতে ইন্তেকাল করেন।
  2. ১৯৫৪ ব্যাচের পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা আকরাম জাকি ছিলেন উপপরিচালক। মূলত পররাষ্ট্র সার্ভিসের কর্মকর্তাদের তদারকি ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব। তিনি নেপালের কৈরালা বংশের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীকালে তিনি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের কাজ করেছেন।
  3. উপপরিচালক ছিলেন ড. তারেক সিদ্দিকী। ১৯৫৫ সালে তিনি সিএসপিতে যোগ দেন। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে লালমনিরহাট ও চাঁদপুরে এসডিও ছিলেন এবং ঢাকায় জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর উপপরিচালক ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে এমপিএ ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আমাদের লোকপ্রশাসন বিষয়ে পড়াতেন। অত্যন্ত সুন্দরভাবে তিনি পড়াতেন। তার সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য শিক্ষানবিশদের উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যে তিনি বলতেন, ‘You will not be my friend unless you fight with me.’ যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় তিনি একজন যুগোস্লাভ মহিলার পাণি গ্রহণ করেন। কিন্তু ওই মহিলা পাকিস্তানে আসতে রাজি হননি। তাই বিয়ে ভেঙে যায়। তবে ওই বিয়েতে তার একটি কন্যাসন্তান হয়। আমরা যখন তার ছাত্র, তখন তার কোনো স্ত্রী ছিল না। পরবর্তীকালে ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন অধ্যাপিকাকে তিনি বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে হয়।
  4. তারেক সিদ্দিকী কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব হন। এরপর তিনি আল্লামা ইকবাল উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন। তিনি ভালো বাংলা বলতেন এবং সব প্রশিক্ষণার্থীর প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে যেসব কর্মকর্তা আটকা পড়েছিলেন, তাদের অনেককে তিনি বাংলাদেশে আসার জন্য ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। পিপিপি দলের আজ্ঞা অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানালে জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে কোনো কারণ না দর্শিয়ে পাঞ্জাব সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদ থেকে বরখাস্ত করেন। পরে জিয়াউল হক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হলে স্ব-উদ্যোগে তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনেন। সরকারি চাকরি চলে যাওয়ার পর তিনি স্যুটের বদলে কওমি ড্রেস পরা শুরু করেন। জিয়াউল হক রাষ্ট্রপতি থাকাকালে এই কওমি ড্রেসকে জাতীয় পোশাক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বছর দুয়েক আগে। ড. তারেক সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর স্ত্রী তার আগে মারা যান।
  5. ১৯৫৯ ব্যাচের আরেকজন উপরিচালক ছিলেন শেখ মাকসুদ আলী। শেখ মাকসুদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। তিনি পটুয়াখালী মহকুমার এসডিও ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ১৯৬৪ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং কমপ্লেক্সে রেক্টর এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। বছরখানেক আগে শেখ মাকসুদ আলী ইন্তেকাল করেন। তার স্ত্রী তার আগেই মারা যান।
  6. কাসেম রিজভী। তিনি ১৯৫০ ব্যাচে সিএসএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আমরা যখন ছাত্র, তখন তিনি কমিশনার ছিলেন। তিনি আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি আইন সম্পর্কে পড়াতেন। তিনি বলতেন ভালো, তবে ভূমি আইন সম্পর্কে তিনি তত জানতেন না।
  7. মাসুদ নবী নূর। তিনি পাঞ্জাব সরকারের তথ্যসচিব ছিলেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমি আইন সম্পর্কে আমাদের পড়াতেন। তবে তাঁর বক্তৃতায় গভীরতা ছিল না।
  8. শেখ ইমতিয়াজ আলী। তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ডিন ছিলেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আমাদের সাক্ষ্য আইন পড়াতেন। তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। আইনের জটিল বিষয়গুলোকে অতি সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। তিনি ক্লাসে প্রশ্ন করতেন এবং ছাত্ররা প্রশ্নের উত্তর না দিলে খুবই অসন্তুষ্ট হতেন। আমি প্রায়ই তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতাম। একদিন তিনি একটি কল্পিত কেস উপস্থাপন করেন। যেখানে দুই পক্ষের উকিল একই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ব্যাখ্যা দুটি সম্পর্কে বলে তিনি বললেন, তোমাদের আদালতে যদি কেস উত্থাপিত হয়, তাহলে তোমাদের রায় কী হবে? আমি হাত তুলে প্রথম উকিলকে সমর্থন করলাম। উত্তর শুনে তিনি যা বললেন, তার সারমর্ম এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। তিনি বললেন :

    My dear learned friend, you think that when you sit in a court one party will come and tell you the truth; the other party will come and tell you lies. You will give verdict in favor of truth. My dear learned friend, this will never happen. Both the parties will tell you lies. You will have to find the truth from two lies.

    ব্যাখ্যা করে বললেন, ধরো ‘ক’ এবং ‘খ’-এর মধ্যে ঝগড়া হলো। ‘ক’ ‘খ’-কে চড় মারল। ‘খ’ ‘ক’-কে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তার আইনজ্ঞের কাছে গেল। আইনজ্ঞ বলল যে শুধু চড় মারাতে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যাবে না। মামলাটা জটিল করার জন্য সে একটা ব্লেড দিয়ে ‘খ’-এর হাতে একটি ক্ষত সৃষ্টি করল। তারপর একজন অনুগত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল যে অর্থের বিনিময়ে প্রত্যয়ন করল ‘ক’ ‘খ’-কে খুন করার জন্য ছুরিকাঘাত করেছে। এই ঘটনার পক্ষে সাক্ষীও জোগাড় হলো। ‘খ’ এই মামলা করেছে। শুনে ‘ক’ তার উকিলের কাছে গেল। তার উকিল বলল, আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’ ‘ক’ বলল, ময়মনসিংহে’। আইনজ্ঞ বললেন, আপনি আদালতকে বলবেন ঘটনার আগের দিন আপনি ময়মনসিংহে যান এবং ঘটনার পরদিন আপনি ময়মনসিংহ থেকে ফিরে আসেন। ওই সময়ে ময়মনসিংহে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে এ রকম মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে এমন ৫০-৬০ জন লোক জোগাড় করুন। আদালতে যখন বিচার শুরু হলো, তখন একদল বলছে ‘ক’ ‘খ’-কে ছুরি দিয়ে মারার চেষ্টা করেছে। আরেক দল বলছে সে ঢাকা শহরেই ছিল না। এই দুই মিথ্যা থেকে বিচারককে সত্য বের করতে হবে। এভাবে উদাহরণ দিয়ে তিনি আমাদের সাক্ষ্য আইন পড়িয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য ক্লাসের ছাত্রদের তিনি learned friend বলে সম্বোধন করতেন। সাধারণত উকিলেরা আদালতে একে অপরকে learned friend বলে সম্বোধন করেন। learned friend ছিল তার কাছে মামুলি সম্বোধন। এর সঙ্গে বিদ্যার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে আমার ব্যাচমেটদের এ সম্বোধন খুবই পছন্দ হয়। তাই সবাই আমাকে learned friend বলে ডাকেন। এখানে উল্লেখযোগ্য ইমতিয়াজ আলী শেখ পাকিস্তানে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

    আমের রেজা। তিনি আমাদের সিভিল প্রসিডিউর কোড পড়াতেন। কোডের সব বিষয় ছিল তাঁর নখদর্পণে। যেকোনো প্রশ্নের তিনি চটপট উত্তর দিতে পারতেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। খুব সম্ভব তিনি লাহোর হাইকোর্টে বিচারপতিও হয়েছিলেন।

  9. দাউদ ইলিয়াস। তিনি একাডেমিতে ডেভিড নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন একজন ইংরেজ মহিলা। তাঁর স্ত্রীকে লাহোরে দুবৃত্তরা একবার অপহরণ করে নিয়ে যায়। তবু তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক অটুট ছিল। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিএল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আমাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড পড়াতেন। বিষয়টিতে তার জ্ঞান তেমন গভীর ছিল না, কিন্তু অক্সফোর্ডের উচ্চারণভঙ্গিতে তার বক্তৃতা শুনতে আমাদের ভালোই লাগত। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর তিনি ম্যানিলায় এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সহকারী আর্থিক উপদেষ্টা পদে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে ব্যাংকটির প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা পদে পদোন্নতি লাভ করেন। সেখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
  10. আবদুল হাফিজ সিদ্দিকী। তিনি হায়দরাবাদ রাজ্যে জেলা জজ ছিলেন। হায়দরাবাদ রাজ্য ভারত দখল করে নিলে তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন। তাকে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আইনের প্রভাষকের পদ দেওয়া হয়। তিনি আমাদের পেনাল কোড পড়াতেন। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন না তিনি। তাই তাঁর বক্তৃতা আমাদের খুব পছন্দ হতো না। আইন পড়ানো। ছাড়াও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের উর্দু পড়াতেন। এ বিষয়ে তিনি পরীক্ষকের কাজও করতেন।