১৯৬৭ সালে ১৫ জন কর্মকর্তাকে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তারা ছিলেন নিম্নরূপ–

  1. আহমদ তারেক করিম। তিনি ইংরেজিতে বিএ অনার্স পাস করার পরই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে চাকরি পান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ইরান ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাঁকে পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর তিনি অবসর নেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। বাংলাদেশে আবার সরকার পরিবর্তিত হলে আহমদ তারেক করিম দীর্ঘদিন দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।
  2. তারেক ওসমান হায়দার। তিনি ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রদূত সাজ্জাদ হায়দারের ছেলে। অক্সফোর্ড থেকে অনার্স ডিগ্রি নিয়ে তিনি পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগ দেন। তবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল খামখেয়ালিতে ভরা। ব্যাচের সবাই তার পাগলামির ভয়ে অস্থির থাকত। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন।
  3. মোহাম্মদ সেলিম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের কৃতী ছাত্র এবং অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিভাগে কাজ করেন। ১৯৮৩ সালে হেগে পদস্থ থাকাকালে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
  4. তৈয়ব সিদ্দিকী। তিনি যখন পিএফএসে যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ২৫-এর অনেক বেশি। তাকে ঠাট্টা করে ব্যাচের সবাই ‘ড্যাড’ বা ‘বাবা’ বলে ডাকত। ১৯৭০-এর দশকে তিনি জর্ডানের পাকিস্তানি দূতাবাসে তৃতীয় সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হক পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। জর্ডানে দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরে জিয়াউল হক পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হন। জিয়াউল হকের সময় তৈয়ব সিদ্দিকীকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয়।
  5. শাফকাত হোসেন শেখ। তিনি লাহোর সরকারি কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে কাজ করেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে পাঞ্জাব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিয়োগ করা হয়।
  6. বশির আহমদ। তিনি একজন পাঠান ছিলেন। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পরও তিনি পাঠান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর ফলে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কয়েক বছর পরই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং একবার পাকিস্তান সংসদের উচ্চকক্ষে সিনেটর পদে নির্বাচিত হন।
  7. মুশতাক আহমদ মেহের। তার বাড়ি ছিল মুলতানে। তিনি অত্যন্ত লম্বা ছিলেন এবং ব্যাচের সবাই ঠাট্টা করে তাকে ‘উট’ বলত। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে অবসর নেন। তিনি বাংলাদেশ ও কুয়েতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
  8. চৌধুরী জাভেদ হোসেন। তিনি একজন পাঞ্জাবি ছিলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে অনেক উঁচু পদে তিনি কাজ করেছেন। তেহরানে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
  9. মুনির আকরাম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে পড়াশোনা করার সময় সিএসএস পরীক্ষা দিয়ে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে নিয়োগ পান। তিনি কোর্স চালু হওয়ার কয়েক মাস পর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দেন। জেনেভায় জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানসমূহে তিনি পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি। ছিলেন। তিনি নিউইয়র্কে পরপর দুবার জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তার স্থায়ী প্রতিনিধির চাকরি চলে যায়। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে আবার জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
  10. মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। তবে রাজনৈতিক কারণে তাকে কোথাও রাষ্ট্রদূত করা হয়নি। তাকে সচিবের পদমর্যাদা দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ একাডেমির অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন।
  11. আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা দূতাবাসে তৃতীয় সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব ছিলেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে তাঁকে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের পদমর্যাদা দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়। এই পদ থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন। তিনি Culture of Peace আন্দোলনের প্রবক্তা। ডাইসাকু ইকিদার সঙ্গে লেখা তাঁর বই Culture of Peace ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
  12. জিয়াউশ শামস চৌধুরী। প্রথম জীবনে পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরি তার একেবারেই ভালো লাগেনি। সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে থাকাকালীন তিনি কয়েকবার পদত্যাগপত্র দাখিল করার চেষ্টা করেছেন। তবে সতীর্থদের এবং একাডেমির পরিচালকের অনুরোধে তিনি তা প্রত্যাহার করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের আচার-আচরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাষ্ট্রদূত এবং অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন।
  13. রাশেদ আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্য হিসেবে তিনি বেশির ভাগ সময়ই বিদেশি। দূতাবাসগুলোতে কাজ করেছেন। তিনি জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০০-২০০৫ পর্যন্ত সময়কালে তিনি কসোভোর জন্য জাতিসংঘের আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি কসোভোর স্বাধীনতার জন্য কসোভোর সার্বিয়ান এবং আলবেনিয়ান নেতৃত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতা করেন।
  14. আমিনুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি অনেক দেশে কাজ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিবের কাজও করেছেন তিনি। পরবর্তীকালে সচিবের পদমর্যাদায় তিনি কানাডায় রাষ্ট্রদূতের কাজ করেছেন।
  15. মোস্তফা কামাল। তিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরিতে যোগ দেন কিন্তু বিদেশে কাজ করতে গিয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে পররাষ্ট্র বিভাগের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নির্বাহী হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি পিটসবার্গ শহরে অবসর জীবন যাপন করছেন।