সিভিল সার্ভিস একাডেমির ভৌত অবকাঠামো

লাহোরের কেনেল রোডে অবস্থিত ছিল সিভিল সার্ভিস একাডেমি। কেনেল রোড ছিল একটি বহমান ও সুন্দর খালের পাড়ে। ১৯৪৭ সালের আগে সিভিল সার্ভিস একাডেমি পাঞ্জাবের রেসিডেন্টের আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পাঞ্জাবে অনেক করদ রাজ্য ছিল। এই করদ রাজ্যগুলো পাঞ্জাবের গভর্নরের অধীন ছিল না। ভাইসরয়ের পক্ষ থেকে এ রাজ্যগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন। পাঞ্জাবের রেসিডেন্ট। রেসিডেন্সির মূল ভবন ছিল দোতলা। এই ভবনে তিনটি অংশ ছিল। মধ্যের অংশে দোতলায় ছিল একটি বড় হলঘর এবং একটি বিশাল ডাইনিং রুম। আরেকটি বড় কক্ষে ছিল একাডেমির লাইব্রেরি। নিচে দুটি বড় কক্ষ ক্লাস রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো আর ছিল একাডেমির ডিরেক্টর ও একাডেমির তিন ডেপুটি ডিরেক্টরের তিনটি কক্ষ। এর পূর্ব দিকে ছিল আরেকটি ভবন। যার অর্ধেকটি ব্যবহৃত হতো অফিস হিসেবে। বাকি অর্ধেকটিতে থাকতেন একাডেমির তিনজন উপপরিচালক। আরও পূর্ব দিকে একটি গেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়। এই গেস্টহাউসের প্রতিটি কক্ষ ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। একাডেমির প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়ার পরও এখানে আট-দশটি কক্ষ খালি থাকত। এই কক্ষগুলোতে একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সিএসপি কর্মকর্তারা অতিথি হিসেবে থাকতে পারতেন। মূল ভবন থেকে পশ্চিম দিকে একাডেমির পরিচালকের নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল।

একাডেমিতে মূল ভবনে পাশাপাশি দুটি কক্ষে তিনজন প্রশিক্ষণার্থী থাকতেন। একজন থাকতেন এক শয্যাবিশিষ্ট একটি কক্ষে। পাশের দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে থাকত দুজন প্রশিক্ষণার্থী। একাডেমির সময়কালকে তিনটি সেমিস্টারে ভাগ করা হয়। প্রথম সেমিস্টারে কে কোন কক্ষে থাকবেন, সেটা নির্ধারণ করত একাডেমি কর্তৃপক্ষ। প্রথম সেমিস্টারে আমার কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাকে থাকার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাঁর নাম সাফকাত হোসেন শেখ। তিনি প্রায়ই রাতে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য একাডেমির বাইরে চলে যেতেন এবং অনেক রাতে ফিরে আসতেন। তবে একাডেমিতে এমনভাবে কাজকর্ম করতে হতো যে রুমে বসে থাকার সময় খুবই কম পাওয়া যেত।

একাডেমির রুটিন

একাডেমিতে দিন শুরু হতো সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগে। প্রতিটি উইংয়ে প্রতি তিনজন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য একজন মেস বিয়ারার থাকত। এই মেস বিয়ারারকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত Batman বা একান্ত পরিচারক থেকে। নিয়োগ করা হতো। সেই মেস বিয়ারাদের একাডেমিতে থাকার কোনো জায়গা ছিল না। তাদের থাকতে হতো একাডেমি থেকে মাইল তিনেক দূরে। এক বস্তিতে। তারা প্রতিদিন সূর্য ওঠার ঘণ্টা দুয়েক আগে রওনা হতো। একাডেমিতে এসে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর জন্য বেড-টি নিয়ে তাদের কক্ষে যেত। বেড-টি খাওয়ার সময় ঘোড়ায় চড়ার জন্য কাপড়চোপড়, জুতা ইত্যাদি বের করে দিত। প্রশিক্ষণার্থীরা একাডেমির ভেতরে ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণের জন্য মাঠে যেত। সেখানে প্রত্যেককে ঘোড়ায় চড়তে হতো। সব প্রশিক্ষণার্থীকে একসঙ্গে ঘোড়ায় চড়ানোর জন্য যথেষ্ট ঘোড়া ছিল না। তাই দুই ব্যাচে আধঘণ্টা করে ঘোড়ায় চড়তে হতো। ঘোড়াগুলো দশাসই ছিল। আমার মতো খর্বাকৃতি বাঙালি এ ধরনের ঘোড়া দেখলেই ভয় পেত। তার মধ্যে ঘোড়াগুলোর মেজাজের তারতম্য ছিল। কোনো কোনো ঘোড়া সওয়ার মোটেও পছন্দ করত না। কেউ উঠলে তাকে ফেলে দেওয়ার জন্য নানা কসরত করত। এই ধরনের ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করাই হলো ওস্তাদ সওয়ারির আসল আনন্দ।

দ্বিতীয় শ্রেণির ঘোড়া সাধারণত গন্ডগোল করত না। তবে মাঝেসাঝে উগ্র রূপ ধারণ করত। তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল দু-তিনটি ঘোড়া, যেগুলো কখনো উত্তেজিত হতো না। এই তৃতীয় শ্রেণির ঘোড়া পেলে ঘোড়ায় চড়া কোনো রকমে সামাল দেওয়া যায়। ঘোড়ার মাঠে যাওয়ার সময় আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যেত। যদি ভালো ঘোড়া না পাওয়া যায়, তাহলে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। প্রত্যেক ব্যাচেই ঘোড়া থেকে পড়ে কমপক্ষে একজন কর্মকর্তাকে হাসপাতালে এবং বিছানায় শুয়ে মাসখানেক সময় কাটাতে হয়েছে। আমার বন্ধুরা বলত যে ঘোড়ার মাঠে আমাকে নাকি ফাঁসির আসামির মতো দেখাত। ঘোড়ার মাঠের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চনন খান। সে প্রথম থেকেই আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। বেশির ভাগ সময়ই আমাকে চড়ার জন্য ভালো ঘোড়া দেওয়া হতো এবং সেই সঙ্গে ভালো প্রশিক্ষকও দেওয়া হতো। তাই শেষ পর্যন্ত একদিনও আমি ঘোড়া থেকে পড়িনি। এমনকি প্রশিক্ষণের শেষ দিকে আমাদের লাহোর একাডেমি থেকে বাইরের সড়ক দিয়ে লাহোর রেসকোর্সে ঘোড়দৌড়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে অতি দ্রুত ঘোড়া চালানো বা গ্যালোপিং (Gallopping) শেখানো হতো। মাঝারি গতিতে ঘোড়া চালানোকে বলত ক্যান্টারিং (Cantering) এবং শ্লথগতিতে ঘোড়া চালানোকে বলত ট্রটিং (Trotting) বা দুলকিচাল। একাডেমিতে শেষ দুই পদ্ধতিতে ঘোড়া চালানো হতো। তবে একাডেমির সহিসদের সহযোগিতায়। শেষ পর্যন্ত আমি ঘোড়া চালানোর পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাস করে যাই। আমি ৫০-এর মধ্যে ৩০ নম্বর পাই। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন সৈয়দ মেহেদী (৪৪) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী (৪৩)। আমার চেয়ে কম নম্বর পেয়েছিলেন আমিনুল্লাহ চৌধুরী (২৭) ও খসরুজ্জামান চৌধুরী (২৯)।

আইসিএসদের জন্য ঘোড়ায় চড়তে জানা একটি অত্যাবশ্যক শর্ত ছিল। পাকিস্তানে সিএসপি এবং পিএফএস অফিসারদের জন্য এই শর্ত প্রয়োগ করা হয়। সিএসপি অফিসারদের অনেক ক্ষেত্রে তখনো ঘোড়ায় চড়তে জানা প্রয়োজন ছিল। ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য তাঁদের অনেক সময় দুর্গম পল্লি অঞ্চলে সফর করতে হতো, যেখানে ঘোড়া ছাড়া চলাচলের আর কোনো বাহন ছিল না। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ ধরনের প্রয়োজন ছিল না। ঘোড়ায় প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার কারণ ছিল ভিন্ন। সরকার মনে করত যারা ভালো ঘোড়া চালাতে পারে, তাদের পক্ষে যেকোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। সুতরাং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণের ওপরে জোর দেওয়া হতো।

ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ ছাড়াও একাডেমির কর্মসূচিতে আরও দুটি প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল। প্রথমত, একাডেমিতে বিকেলবেলা প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর লন-টেনিস খেলার কথা। একাডেমিতে প্রায় ১০টির মতো টেনিস কোর্ট ছিল। সব প্রশিক্ষণার্থী টেনিসের জন্য উপযোগী কাপড়চোপড় পরে টেনিস-র্যাকেট নিয়ে বিকেলবেলা খেলার জন্য টেনিস কোর্টে যেত। সেখানে দু-একজন প্রশিক্ষক ছিলেন, তবে আমি একেবারেই টেনিস খেলতে জানতাম না। আমার মতো প্রশিক্ষণার্থী বোধ হয় আর কেউ ছিল না। তাই আমার সঙ্গে খেলার জন্য প্রশিক্ষণার্থী পাওয়া যেত না। আমি টেনিস খেলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। টেনিস আমি কখনো নিয়মিত খেলিনি। স্বাস্থ্যের জন্য টেনিস খেলা অত্যন্ত উপকারী। তাই প্রায় প্রত্যেক সিএসপি অফিসার টেনিস খেলতেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ডেপুটি কমিশনার ও এসডিওদের যত আবাস দেখতে পেয়েছি, তার প্রতিটিতেই একটি টেনিস কোর্ট ছিল।

দ্বিতীয়ত, আগে সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে টাইপ করতে শেখানো হতো। আমরা যখন একাডেমিতে যাই, তখন টাইপিং শেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে টাইপিং শেখার জন্য উৎসাহিত করা হতো। সরকার বিদেশ থেকে টাইপরাইটার আমদানি করে অত্যন্ত কম দামে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে এ যন্ত্রগুলো বিক্রি করত। আমি একটি টাইপরাইটার মেশিন কিনেছিলাম। এক আঙুলে টাইপ করতে পারতাম কিন্তু টাইপিংয়ে কখনো দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি।

একাডেমিতে সব খাবার তৈরি করত একাডেমির বাবুর্চিরা। খাবারের মান। খুবই উন্নত ছিল। ডাইনিং টেবিলে বসে ছুরি কাটা দিয়ে আমাদের খেতে হতো। ডাইনিং টেবিলে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হতো। অনেক সময় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে ঝগড়াও হতো। একাডেমিতে প্রধানত মাংসের বিভিন্ন পদ, রুটি, ভাত, ডাল ও সবজি দেওয়া হতো। মাছ সপ্তাহে দু-এক দিন দেওয়া হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা সাধারণত মাছ খেতেন না। মাস দুয়েক খাওয়ার পর এ খাবার আমাদের কাছে একঘেয়ে মনে হয়। এই একঘেয়ে খাবারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার দুটি পথ ছিল।

একটি পথ ছিল লাহোর জিমখানা ক্লাবে ছুটির দিনে মধ্যাহ্নভোজন করা। আমাদের আগের ব্যাচ পর্যন্ত নিয়ম ছিল যে সব প্রশিক্ষণার্থী জিমখানা ক্লাবের সদস্য হবেন। আমাদের পূর্বের ব্যাচ থেকে জিমখানা ক্লাবের সদস্য পদ ঐচ্ছিক করা হয়। যারা খুশি তারা সদস্য হতে পারতেন, যারা চাইতেন না, তাঁদের সদস্য হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। আমাদের কোর্সের উদ্বোধনী ভাষণে পরিচালক জিমখানা ক্লাবের সদস্য হতে পারার সহজ সুযোগের কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি মন্তব্য করেন, জিমখানা ক্লাবের সদস্য না হওয়াই ভালো। আমাদের ব্যাচের একজন ছাড়া সবাই জিমখানা ক্লাবের সদস্য হই। ব্যতিক্রম ছিলেন শাহেদ সাদুল্লাহ। দুষ্ট লোকেরা বলত যে পরিচালকের ঐচ্ছিক নম্বর

বেশি পাওয়ার জন্য শাহেদ সাদুল্লাহ পরিচালকের উপদেশকে শিরোধার্য করে। নিয়েছিলেন। জিমখানা ক্লাবের সদস্য হওয়ার একটি সুবিধা ছিল যে জিমখানা ক্লাবের সদস্যরা পাকিস্তানের যেকোনো শহরের ক্লাবে গেলেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। জিমখানা ক্লাবের সদস্য কার্ড দেখিয়ে যেকোনো ক্লাবের সদস্য হওয়া যেত। এভাবেই আমাদের ব্যাচের প্রায় সবাই পূর্ব পাকিস্তানে এলে ঢাকা ক্লাবের সদস্য হন। অবশ্য আমি যদিও জিমখানা ক্লাবের সদস্য ছিলাম, তবু ঢাকা ক্লাবের সদস্য কখনো হইনি।

দ্বিতীয় উপায়টি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের ব্যাচমেট শাহ মোহাম্মদ ফরিদ। একাডেমিতে নিয়ম ছিল যে যদি কেউ অসুস্থ হয়, তাহলে তার জন্য ভিন্ন ধরনের খাবার পরিবেশন করা হবে। পাঞ্জাবিরা মনে করে জ্বর হলে রোগীকে রুটি খেতে দিতে নেই, এতে জ্বর বাড়ে। জ্বর হলে রোগীকে ভাত বা খিচুড়ি দিতে হয়। তাই একাডেমির ডাইনিং হলে যদি কেউ খবর পাঠিয়ে দেয় যে তার জ্বর জ্বর লাগছে, তাহলে তার জন্য ভিন্ন খাবার আসবে। এই খাবারে থাকত ভুনা খিচুড়ি, মোরগের মাংসের তরকারি, সবজির ভুজিয়া এবং কেরামাল কাস্টার্ড বা পুডিং। এই খাবারের জন্য ডাইনিং হলে যেতে হতো না, আমাদের শোবার ঘরে মেস বেয়ারারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এতে আমরা শুধু পছন্দের খাবারই পেতাম না, আমাদের সময়ও বাঁচত। তাই প্রায়ই ছুটির দিন বিকেলবেলায় আমরা ডাইনিং হলে জ্বরের খবর পাঠিয়ে দিতাম।