» » রাইফেল, রোটি, আওরাত

পরিচিতি

এ গ্রন্থের লেখক আনোয়ার পাশা আজ আমাদের মধ্যে নেই, হারিয়ে গেছেন তিনি। চিরকালের জন্য। অসহ্য এক বেদনার ভার বুকে নিয়ে তার নামের আগে এখন কিনা যোগ করতে হচ্ছে শহীদ কথাটা। আনোয়ার পাশা তো শহীদ হতে চাননি, অমন পবিত্র শব্দাবলীর প্রতি তাঁর বিন্দু মাত্রও লোভ ছিল না। জীবনকে তিনি ভালোবাসতেন, তাঁর সমস্ত ভালোবাসা নিবেদিত ছিল জীবন আর শিল্পের প্রতি। তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে জীবন প্রেমিক শিল্পী। জীবনকে ভালোবাসা ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না এ তিনি জানতেন, মানতেনও। চেয়েছিলেন জীবনকে সুন্দর করে গড়তে এবং সে সঙ্গে শিল্পোত্তীর্ণ করে প্রকাশ করতে—এ ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। আনোয়ার পাশা বাঁচতে চেয়েছিলেন শিল্পী হিসেবে। জীবনের সে দূর পিপাসা, তাঁর আকুল ব্যাকুলতা তাঁর এ অন্তিম রচনায়ও ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র।

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এ অসামান্য বইটি তিনি লিখে রেখে গেছেন আমরা যারা বেঁচে আছি তাদের জন্য। মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-বিভীষিকার এমন ছবি আঁকা সত্যই দুঃসাধ্য। আনোয়ার পাশা তেমন এক দুঃসাধ্য কাজ করে গেছেন। তাঁর শিল্পী-প্রতিভার এ এক নিঃসন্দেহ প্রমাণ। বাংলাদেশের মাটিতে আগামীতে যারা জন্মগ্রহণ করবে, তাঁরা এ দেশের ইতিহাসের এক দুঃসহ ও নৃশংসতম অধ্যায়ের এ নির্ভেজাল দলিল পাঠ করে নিঃসন্দেহে শিউরে উঠবে। অবশ্য সে সঙ্গে আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেমের নজীরহীন দৃষ্টান্তে সগৌরব আনন্দও যে তারা বোধ করবে তাতেও সন্দেহ নেই। নিজের দেশ আর দেশের মানুষের সম্বন্ধে তাদের আস্থা, এ বই পড়ার পর দৃঢ়তর না হয়ে পারে না।

এ শুধু একাত্তরের বাংলাদেশের হাহাকারের চিত্র নয়, তার দীপ্ত যৌবনেরও এ এক প্রতিচ্ছবি। এ গ্রন্থের নায়ক সুদীপ্ত শাহিন বাংলাদেশ আর বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংকল্প প্রত্যয় আর স্বপ্ন-কল্পনারই যেন প্রতীক। একাত্তরের মার্চের সে ভয়াবহ কটা দিন আর এপ্রিলের প্রথমার্ধের কালো দিনগুলির মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সংকীর্ণ পরিধিটুকুতেই এ বই-র ঘটনাপ্রবাহ সীমিত, কিন্তু এর আবেদন আর দিগন্ত এ সময়-সীমার আগে ও পরে বহু দূর বিস্তৃত। বাঙালির দুঃখ-বেদনা আর আশা-এষণার এ এমন এক শিল্পরূপ যা সব সময় সীমাকে ডিঙিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী অপরূপ সাহিত্য-কর্ম হয়ে উঠেছে।

ভেবে অবাক হতে হয় নির্মম ঘটনাবলীর উত্তপ্ত কড়াইয়ের ভিতর থেকেও লেখক কি করে তার উর্ধ্বে উঠে এতখানি নির্লিপ্ত হতে পারলেন। রাখতে পারলেন মনকে সংযত ও সংহত যা শিল্পীর জন্য অপরিহার্য। সদ্য এবং সাক্ষাৎ ঘটনার এমন অপরূপ শিল্পরূপ কদাচিৎ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ যে একবার লিখেছিলেনঃ “কোন সদ্য আবেগে মন যখন কানায় কানায় ভরিয়া উঠিয়াছে তখন যে লেখা ভালো হইবে এমন কোন কথা নাই। তখন গদগদ বাক্যের পালা।” সুখের বিষয় আনোয়ার পাশার এই বই কোন অর্থেই গদগদ বাক্যের পালা হয় নি। এ এক সংহত সংযত, নির্লিপ্ত শিল্পী মনেরই যেন উৎসারণ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এ সাবধান বাণীটুকুও উচ্চারণ করেছিলেনঃ “প্রত্যক্ষের একটা জবরদস্তি আছে— কিছু পরিমাণে তাহার শাসন কাটাইতে না পারিলে কল্পনা আপনার জায়গাটি পায় না।” কথাটা সত্য, কিন্তু আনোয়ার পাশা এ আশ্চর্য দক্ষতায় এ সত্যকে অন্তত এ গ্রন্থে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন। প্রত্যক্ষের জবরদস্তির শিকার তিনি হন নি, সে জবরদস্তির শাসন কাটিয়ে তিনি তার শিল্পী-কল্পনার যথাযথ স্থান খুঁজে নিতে পেরেছেন এ বইতে। চোখের সামনে ঘটা টাটকা ঘটনাবলীর উত্তাপ তাঁর শিল্প-সত্তাকে কেন্দ্রচ্যুত করেনি কোথাও, লেখকের জন্য এর চেয়ে প্রশংসার কথা আর হতে পারে না।

উচ্চতর শিল্পকর্মের জন্য স্থান-কালের দূরত্বের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। আশ্চর্য, আনোয়ার পাশার জন্য তার প্রয়োজন হয় নি। যথার্থ শিল্পী বলেই এ হয়তো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ঘটনাকে ছাড়িয়ে পৌঁছতে পেরেছেন ঘটনার মর্মলোকে।

এ তাঁর শেষ বই, জীবনের শেষ বই—প্রত্যক্ষ আর সাক্ষাৎ ঘটনাবলীকে তিনি উপন্যাসের রূপ দিয়েছেন এ গ্রন্থে। ঢাকায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে, যে বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের সব রকম প্রগতি আন্দোলনের উৎস, তার এমন নিখুঁত ছবি, এমন শিল্পোত্তীর্ণ রূপায়ণ আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ইতিহাসের দিক দিয়েও এ বই-এর মূল্য অপরিসীম।

এ বই-র ভাষা আর রচনাশৈলী এমন এক আশ্চর্য শিল্পরূপ পেয়েছে যে পড়তে বলে কোথাও থামা যায় না। এ কারণেও, আমার বিশ্বাস বইটি দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আনোয়ার পাশার জন্ম পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়। লেখাপড়া করেছেন উভয় বঙ্গে। তিনি বি. এ. পাস করেছেন রাজশাহী কলেজ থেকে এবং বাংলায় এম, এ, পাস করেছেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জীবিকার জন্য বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। বেশ কয়েক বছর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনা করার পর চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিবেদিত, পরিশ্রমী ও দক্ষ শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম শুনেছি অনেকেরই মুখে। ছাত্র শিক্ষকদের কাছে তিনি শুধু প্রিয় ছিলেন না, শ্রদ্ধেয়ও। আজকের দিনে যা দুর্লভ সৌভাগ্য! শিক্ষকতার বাইরে তাঁর প্রধানতম নেশা ছিল সাহিত্য। কবিতা আর গদ্যে তাঁর সমান দক্ষতা দেখে আমরা বিস্মিত না হয়ে পারতাম না। সমালোচনায় তিনি যে অসাধারণ গ্রহণশীলতা আর বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তারও নজির খুব বেশি নেই। বিশেষ করে তাঁর রবীন্দ্র ছোট গল্প সমীক্ষা আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের মানকে যে উন্নত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। ‘নীড় সন্ধানী’ আর ‘নিষুতি রাতের গাঁথা’ নামে তার দুটি উপন্যাস আর ‘নদী নিঃশেষিত হলে’ নামে একটি কবিতার বই বহু আগেই প্রকাশিত হয়েছে। তদুপরি বহু পরিশ্রমে তিনি আমার মতো নগণ্য লেখকের উপরও একটি বড় বই লিখেছেন। এতে অন্য যা প্রমাণিত হোক না কেন, অন্তত স্বদেশের সাহিত্য আর সাহিত্যিকের প্রতি তাঁর যে আন্তরিক অনুরাগ আর আস্থা রয়েছে সে সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি।

আলোচ্য গ্রন্থের আগাগোড়া যে স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, যার প্রতীক্ষায় তিনি প্রহর গুণছিলেন, সে স্বাধীনতার শুভলগ্নের মাত্র দিন দুই আগে পাক হানাদারদের দোসরেরা নিজের পেশা আর আদর্শে আত্মনিবেদিত প্রাণ এ নিরলস শিল্পীকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তবুও মনে জিজ্ঞাসা জাগে: শিল্পীকে কি হত্যা করা যায় যায়। শিল্পীকে হত্যা করা যায় কিন্তু শিল্পকে হত্যা করা যায় না। শিল্পকে হত্যা করা মানে মানুষের আত্মাকে হত্যা করা, তা করা দুনিয়ার কোন ঘাতকের পক্ষেই সম্ভব নয়। লাইফ ইজ সর্ট আর্ট ইজ লং—ঘাতকের অস্ত্র আনোয়ার পাশার মর-জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে সত্য কিন্তু তাঁর রচিত গ্রন্থের পাতায় পাতায় ফুল হয়ে ফুটে রয়েছে। তাকে হত্যা করবে কে? শিল্পীকে হত্যা করা যায়—শিল্পকে হত্যা করা যায় না তার অবিসম্বাদিত প্রমাণ এ বই— ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। এর প্রতি ছত্রে ঘাতকদের প্রতি ধিক্কার ধ্বনি যেমন আমরা শুনতে পাই তেমনি শুনতে পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্যের উদয় মুহূর্তে নব জীবনের আগমনীও।

“পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কত দূরে? বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এ রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।”

এ অমোঘ ভবিষ্যৎ বাণীটি উচ্চারণ করেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ লেখাটি শেষ করেছেন। যে নব প্রভাতের জন্য এত দুর্ভোগ, এত আশা, এতখানি ব্যাকুল প্রতীক্ষা তা সত্য সত্যই এলো কিন্তু আনোয়ার পাশা তা দেখে যেতে পারলেন না। তাঁর অন্তিম রচনার সঙ্গে দেশবাসীর এ বেদনাটুকুও যুক্ত হয়ে থাক।

এ বই একাধারে ঐতিহাসিক দলিল আর সার্থক সাহিত্য-সৃষ্টি। এ বই পড়ে অভিভূত হবেন না এমন পাঠক আমি কল্পনা করতে পারি না।

সাহিত্য নিকেতনআবুল ফজল

চট্টগ্রাম২৮শে মে, ১৯৭৩