রসুল্লাবাদ গ্রামে খাঁ বাড়ির অবদান

রসুল্লাবাদ গ্রামে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত খাঁ বাড়ির দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। তারা ছিলেন তালুকদার, ছিলেন অনেক জমির মালিক এবং বিরাট বড়লোক। এ ধরনের পরিবার গ্রামে থাকলে সাধারণত গ্রামের গরিব মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। দরিদ্র লোকেরা যখন তাঁদের শাকসবজি অথবা গৃহপালিত মোরগ, ছাগল, গরু অথবা দুধ বিক্রি করার জন্য বের হতেন, তখন এগুলো অনেক ক্ষেত্রে খাঁ বাড়ির সদস্যরা কিনে নিতেন। কিন্তু দরিদ্র লোকদের অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য দাম দেওয়া হতো না। এ ধরনের অত্যাচার হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটে থাকতে পারে। তবে এ ধরনের ঘটনার স্মৃতি রসুল্লাবাদ গ্রামের মানুষের মনে নেই।

তিনটি ক্ষেত্রে এখনো রসুল্লাবাদ গ্রামে খাঁ বাড়ির অবদান দেখা যায়। প্রথমত, রসুল্লাবাদ গ্রামে কোনো বাজার ছিল না। খাঁ বাড়ির সদস্যরা তাদের নিজেদের জায়গায় দোকানপাট খোলার ব্যবস্থা করে বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। সম্প্রতি বাজারের পাশে যে বিরাট খাল ছিল, সে খালটি ভরাট করা হয়েছে। খালের ভরাট করা অংশে রাস্তা করা হয়েছে এবং কিছু দোকানপাট করা হয়েছে। তবে এ অংশে রাইস মিল, কাঠ কাটার জন্য স মিল–এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকান এখনো খাঁ বাড়ির প্রতিষ্ঠিত বাজারেরই অন্তর্ভুক্ত। বাজার স্থাপন করাতে খাঁ বাড়ির লোকজনের যে রকম সুবিধা হয়েছে, তেমনি সারা গ্রামের লোকজন উপকৃত হয়েছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে খাঁ বাড়ির বিশেষ অবদান রয়েছে। রসুল্লাবাদ উলফত আলী খাঁ উচ্চবিদ্যালয় খাঁ বাড়ির সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের মূল জমির মালিক ছিল খাঁ বাড়ি। স্কুলের জন্য তারা জমি দান করেন। পরে অবশ্য গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে স্কুলের জমির পরিমাণ বাড়ান। প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলের জন্য খাঁ বাড়ির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হয়। এই স্কুলে রসুল্লাবাদ এবং তার আশপাশের অনেক দরিদ্র কৃষকদের সন্তানেরা শিক্ষা লাভ করার পর দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উচ্চপদ লাভ করেন। খাঁ বাড়ির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এখনো স্কুলটি উলফত আলী খাঁ উচ্চবিদ্যালয় নামে পরিচিত।

ক্রীড়াক্ষেত্রেও খাঁ বাড়ির বিশেষ অবদান রয়েছে। দুটি খেলার মাঠ খাঁ বাড়ির জমির ওপরে তৈরি করা হয়েছে। একটি খেলার মাঠে এখনো নিয়মিত ফুটবল খেলা হয়। এই মাঠে প্রতিবছর ফুটবল লিগ খেলা হয়। আরেকটি মাঠের কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেছে। এই মাঠে এখনো গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেট খেলে থাকে।

রসুল্লাবাদ গ্রামে খাঁ বাড়ি ছাড়া আরও ধনী পরিবার ছিল। পাল পরিবার নামে একটি তালুকদার পরিবার ছিল। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দারোগা নোয়াব কিশোর পাল। তার ছেলে সুকুমার পাল রসুল্লাবাদ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ছেলে পবিত্র পাল বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত রয়েছেন। পাল পরিবার ১৯৭২ সালে তাদের বাড়ি কলকাতার নিকটস্থ এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে বিনিময় করে। বর্তমানে কলকাতার অভিবাসী পরিবার এই বাড়িতে বসবাস করছে। দারোগা নোয়াব কিশোরকে বাড়ির কাছেই দাহ করা হয় এবং তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি মঠ নির্মাণ করা হয়, যা এখনো রয়েছে। এই পরিবার বা কোনো হিন্দু অভিজাত পরিবার গ্রামের হিন্দুদের জন্য অথবা গ্রামের সার্বিক উন্নতির জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য দান করেনি।

খাঁ বাড়ি ছাড়া রসুল্লাবাদ গ্রামের জন্য দান করেছে আরেকটি মুসলমান পরিবার। এই পরিবারটি অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের পরিবার। সাইদুর রহমানের বাড়ি খাঁ বাড়ির পাশেই। তিনি একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। বাল্যকালে তার ডাকনাম ছিল ‘ফেইরার বাপ’। অনেক কষ্টে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপক ছিলেন এবং পরে বাংলাদেশে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামের গরিবদের সাহায্য করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়িতে দরিদ্র লোকদের চিকিৎসা করার জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেন।

সাইদুর রহমানের অভিযোগ ছিল যে খাঁ বাড়ির যত কৃতী সন্তান রয়েছে, তার তুলনায় তাঁরা রসুল্লাবাদ গ্রামের জন্য বিশেষ কিছু করেননি। এ কথা সত্য যে রসুল্লাবাদ গ্রামের উন্নয়নের জন্য খাঁ বাড়ির আগের প্রজন্মের যত আগ্রহ ছিল, পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের মধ্যে তত আগ্রহ নেই। তার কারণ হলো গত আশি বছর ধরে এই পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসন করেছে। এদের অনেকেই জীবনে এক রাতও রসুল্লাবাদে থাকেননি। বিশেষ করে গ্রামে দলাদলির ভয়ে এরা গ্রামের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েননি। তবে হাবিবুল্লাহ খান সংসদ সদস্য থাকাকালে রসুল্লাবাদ গ্রামে পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। আশির দশকে বাংলাদেশ টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের সভাপতি মাকসুদ আলী খাঁন একটি পাবলিক কল অফিস স্থাপন করেন। এঁরা দুজনে গ্রামের কিছু ছেলেকে চাকরিও দিয়েছেন।

পাদটীকা

১. শরিফউদ্দিন আহমদ, ঢাকা : ইতিহাস ও নগরজীবন ১৮৪০-১৯২১, ২০০১, একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯২