» » ‘আজব’ ও ‘জবর-আজব’ অর্থনীতি

৭. সামগ্রিক মূল্যায়ন

ওপরের আলোচনায় বই দুটির বক্তব্য সম্পর্কে আভাস দেওয়া হলো মাত্র। স্বল্প-পরিসরের কোনো নিবন্ধে লেভিট ও ডুবনারের সব বক্তব্যের সারসংক্ষেপ পেশ করা সম্ভব নয়। বই দুটি পড়লে আরও অনেক তথ্য জানা যাবে। তবু ওপরের আলোচনা থেকে এ দুটি বইয়ের কয়েকটি আকর্ষণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, এ দুটি বইয়ে অনেক বিষয় নিয়ে অত্যন্ত মনোগ্রাহী আলোচনা করা হয়েছে, যার অনেক তথ্যই সাধারণ পাঠকের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। বই দুটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। দ্বিতীয়ত, এ দুটি বইয়ে লেভিট ও ডুবনার অত্যন্ত আশাবাদী। তারা বিশ্বাস করেন যে, সব অর্থনৈতিক সমস্যারই সহজ সমাধান রয়েছে। তাদের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম তাই The Fix is in– And it’s Cheap and Simple’ (সমাধান আছে এবং তা সস্তা ও সহজ)। এই আশাবাদও পাঠকদের অতি সহজে আকৃষ্ট করবে। সবশেষে প্রতিটি সিদ্ধান্তের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য ও উপাত্ত পেশ করা হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য সহজে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

পদ্ধতিগত দিক থেকে অবশ্য বই দুটির কয়েকটি দুর্বলতা রয়েছে। এই বই দুটির লেখকদের সংখ্যাতত্ত্বের ওপর প্রচণ্ড আস্থা রয়েছে। কাজেই তারা সংখ্যাতত্ত্বের দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। প্রথমত, এঁরা কার্যকরণ (Causation) ও সহগমনের (correlation) মধ্যে পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রে গুলিয়ে ফেলেছেন। কার্যকারণের তাৎপর্য হলো একটি কর্মের ফলে আরেকটি কর্ম ঘটে। যেমন ধূমপানের ফলে ক্যানসার হয়। এর ফলে ধূমপান ও ক্যানসারের মধ্যে সহগমন দেখা যায়। কিন্তু সহগমন হলেই কার্যকরণ প্রতিষ্ঠিত হয় না।

দ্বিতীয়ত, লেভিট ও ডুবনারের অনেক বক্তব্যই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পদ্ধতির দিক থেকে বিচারকদের সাথে সংখ্যাতত্ত্ববিদদের একটি বড় মিল রয়েছে। বিচারকেরা যদি অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ না করেন, তবে নির্দোষ ব্যক্তির দণ্ডিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আবার অন্যদিকে যদি বিচারক অপরাধের সন্দেহাতীত প্রমাণ চান, তবে অনেক সত্যিকারের অপরাধীকেও শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয় না; কেননা, সন্দেহের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা ছাড়া পেয়ে যায়। সংখ্যাতত্ত্বেও একই ধরনের সমস্যা রয়েছে। যদি সন্দেহাতীতভাবে কোনো সূত্র প্রমাণ করতে হয়, তবে সম্ভাব্যতার মাত্রা ১০০% হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামান্য সন্দেহ দেখা দিলেই অনেক সত্য বক্তব্যও প্রত্যাখ্যান করতে হয়। সংখ্যাতত্ত্বে এ ধরনের ত্রুটিকে পয়লা কিসিমের গলতি বা Type 1 error বলা হয়ে থাকে। যেখানে প্রতিপাদ্য বক্তব্য সঠিক কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয় না বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়ে থাকে, সেখানেই পয়লা কিসিমের গলতি ঘটে। অন্যদিকে যদি প্রতিপাদ্য বক্তব্য আসলে মিথ্যা হয় অথচ সম্ভাব্যতার মাপকাঠি নিম্ন পর্যায়ে নির্ধারণ করা হয়, তবে অনেক মিথ্যা বক্তব্যও সত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের ভ্রান্তিকে দোসরা কিসিমের গলতি (Type 2 error) বলা হয়ে থাকে। লেভিট ও ডুবনারের সমর্থকেরা দাবি করেন যে এ ধরনের সমস্যা সংখ্যাতত্ত্বে স্বাভাবিক এবং এসব ঝুঁকি সত্ত্বেও বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। এ ধরনের ত্রুটি সংশোধনের জন্য বিভিন্ন সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতিও রয়েছে। কাজেই এ ধরনের দুর্বলতা নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। আসলে লেভিট ও ডুবনারের পদ্ধতিগত সমস্যাটি আরও অনেক জটিল হতে পারে। লেভিট ও ডুবনারের বিশ্লেষণের ঝুঁকি শুধু পয়লা ও দোসরা কিসিমের গলতিতে সীমাবদ্ধ নয়, এখানে তৃতীয় প্রকৃতির ত্রুটিরও আশঙ্কা রয়েছে। সংখ্যাতত্ত্বের ভাষায় একে তিসরা কিসিমের গলতি বা Type 3 error বলা হয়ে থাকে। এই ত্রুটি তখনই ঘটে, যখন ভুল কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রতিপাদ্য বক্তব্য ত্রুটিপূর্ণ হলে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এ ধরনের বিপত্তি ঘটতে পারে। লেভিট ও ডুবনার অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের অনভিপ্রেত পরিণামের ওপর জোর দিয়েছেন। এ ধরনের বিশ্লেষণে তিসরা কিসিমের গলতির আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সমর্থনই যথেষ্ট নয়, গ্রহণযোগ্য বক্তব্যের সুস্পষ্ট কার্যকরণও ব্যাখ্যা করতে হবে। যারা লেভিট ও ডুবনারকে অনুসরণ করতে চান, তাদের এসব পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কথা মনে রাখতে হবে।

তৃতীয়ত, সমালোচকেরা লেভিট ও ডুবনারের পদ্ধতির সঙ্গে মোটেও একমত নন। জন ডিনারডো (২০০৭) লেভিট ও ডুবনারের গবেষণাকে ‘বিনোদন’ (entertainment) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন যে শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে লেভিট ও ডুবনারের উত্থাপিত প্রশ্নগুলির জবাব দেওয়া যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন RCT (Randomized Control Trials) বা দৈবচয়নভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ। সমীক্ষার জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিত এ দুই গোষ্ঠীতে ভাগ করতে হবে। নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন প্রবর্তন করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ফলাফল সমরূপ অনিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনা করতে হবে। লেভিট ও ডুবনার এ ধরনের পরীক্ষা করেননি। তাই তাদের ব্যবহৃত পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়।

চতুর্থত, লেভিট ও ডুবনার দেখিয়েছেন যে অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের অপ্রত্যাশিত ফলাফল দেখা যায়। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ফলাফলের একটি বড় কারণ হলো অজ্ঞতা। আর. কে. মার্টন (১৯৩৬) যথার্থই লিখেছেন, ‘In other words, “chance consequences” are those which are occasioned by the interplay of forces and circumstances which are so complex and numerous that prediction of them is beyond our reach’ (অন্যভাবে বলতে গেলে দৈবাৎ পরিণামগুলি এমন ধরনের জটিল ও অসংখ্য শক্তি ও পরিস্থিতির মিথস্ক্রিয়াতে ঘটে, যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের আয়ত্তের বাইরে)। কাজেই এ ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিণামের ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক চলবে।

সবশেষে সমাজতাত্ত্বিক সমালোচকেরা মনে করেন, লেভিটের ও ডুবনারের মতো অর্থনীতিবিদেরা ধরে নেন যে মানুষ সব সময়ই যুক্তিশীল। বাস্তব জীবনে মানুষ এত চালাক ও যুক্তিবাদী হয় না। সাধারণ মানুষ যে রকম চিন্তা করে, সে রকম চিন্তা করতে না পারলে বিশ্লেষণ অবাস্তব ও অপূর্ণাঙ্গ থাকবে। এ সম্পর্কে স্যামুয়েলসন একটি সুন্দর গল্প বলেছেন। গল্পটি একজন চাষির সম্পর্কে। চাষির একমাত্র গাধাটি হারিয়ে যায়। চাষি সারা দিন গাধাটিকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু তার সন্ধান পাওয়া যায় না। রাতে গাধার শোকে চাষির ঘুম আসছিল না। চাষি ভাবছিল, সে কেন গাধাটি খুঁজে পেল না। সে মনে মনে চিন্তা করল, নিজে যদি গাধা হতো তবে সে কোথায় যেত। সে মনে মনে ভাবল, সে নিজে গাধা হলে স্কুলঘরের বারান্দায় শুয়ে থাকত। এই কথা মনে হওয়ামাত্রই চাষি স্কুলঘরের বারান্দায় ছুটে গিয়ে দেখে যে গাধাটি সত্যি সত্যি সেখানে শুয়ে আছে। স্যামুয়েলসন তাই বলতেন যে গাধা পেতে হলে গাধার মতো চিন্তা করতে হবে। লেভিট ও ডুবনারের বই পড়লে মনে হয় যে এরা সব সময় সপ্রতিভ ও যুক্তিশীল মানুষের মতো চিন্তা করেছেন, গাধার মতো চিন্তা করেননি। তাঁদের পদ্ধতি অনুসরণ করে তাই অনেক সময় হারানো গাধা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

উল্লেখিত রচনাবলি (Works Cited)

  1. কলবার্ট, এলিজাবেথ (Kolbert, Elizabeth)। ২০০৯। Hose’. The New Yoker. November 16, 2009.
  2. ডনোহু, জন ও স্টিভেন লেভিট (Donohue, John and Steven Levitt)। ২০০১। ‘Legalized Abortion and Crime’ Quarterly Journal of Economics. 116:2, 379-420.
  3. ডিনারডো, জন (Dinardo, John)। ২০০৭। Interesting Questions in “Freakonomics”. The Journal of Economic Literature. Vol. 45, No-4 (Dec, 2007), 973-1000.
  4. বেকার, গ্যারি এস (Becker, Gary S)। ১৯৯২। The Economic Way of Looking at life’. Nobel Memorial Lecture. Stockholm: Nobel Foundation.
  5. লেভিট, স্টিভেন ডি (Levitt, Steven D.)। ২০০৪। Understanding Why Crime Fell in the 1990s: Four Factors That Explain the Decline and Six that Do Not. Journal of Economic Perspectives. Vol. 18. No.1 (Winter 2004), 163-190.
  6. লেভিট, স্টিভেন ডি ও স্টিফেন যে ডুবনার (Levitt, Steven D. and Stephen J. Dubner)। ২০০৫। New York: Harper Collins.– Ipood, Super Freakonomics. New York: Harper Collins.