» » ‘আজব’ ও ‘জবর-আজব’ অর্থনীতি

৬. গতানুগতিক প্রজ্ঞার (Conventional Wisdom) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

আজব অর্থনীতি ও জবর-আজব অর্থনীতি বই দুটি পাঠককে আনন্দ ও জ্ঞান প্রদানের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। তবে যে জ্ঞান লেখকেরা পরিবেশন করতে চান তা গতানুগতিক জ্ঞান নয়। অর্থনীতিবিদ লেভিট এক অর্থে জন কেনেথ গলব্রেথ (John Kenneth Galbraith)-এর ভাবশিষ্য। গতানুগতিক প্রজ্ঞায় বা চিরাচরিত জ্ঞানে তার বিশ্বাস নেই। গতানুগতিক প্রজ্ঞা সব সময় সত্য নয়। সমাজজীবনে সত্য অত্যন্ত জটিল। তার সঠিক উপলব্ধি করতে হলে অনেক মানসিক পরিশ্রমের প্রয়োজন। এ পরিশ্রম এড়ানোর জন্য মানুষ গতানুগতিক প্রজ্ঞা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। গতানুগতিক প্রজ্ঞার ব্যাখ্যা হলো সহজ, সুবিধাজনক, স্বস্তিদায়ক ও চিন্তামুক্ত। গতানুগতিক প্রজ্ঞা আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং আমাদের মনে কোনো উদ্বেগের সৃষ্টি হতে দেয় না। কিন্তু গতানুগতিক প্রজ্ঞায় সব সময় সত্য মেলে না। গতানুগতিক প্রজ্ঞার ঘেরাটোপে আমাদের মন বন্দী থাকায় আমরা বাস্তব জীবনের জটিলতা এড়িয়ে চলি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ সম্পর্কে লেভিট ও ডুবনারের বক্তব্য হলো : ‘People respond to incentives, although not necessarily in ways that are predictable or manifest. Therefore one of the most powerful laws of the universe is the law of unintended consequences.’ (মানুষ প্রণোদনায় সাড়া দেয়, তবে তা সব সময় নিশ্চিতভাবে বা দৃশ্যমানভাবে নয়। সুতরাং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি শক্তিশালী বিধি হলো অনভিপ্রেত পরিণামের সূত্র)। যে উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো কাজ করা হয়, ফলাফল তার সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক কালে অপরাধ-প্রবণতা হ্রাস সম্পর্কে তাদের বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার

যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধীরা গেল কোথায়?

সারণি ১.১-এ ১৯৬০ থেকে ২০০৯ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সহিংস অপরাধের মূল প্রবণতাগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এখানে তিন ধরনের অপরাধের হার দেখানো হয়েছে। প্রথমে রয়েছে সহিংস অপরাধের হার। সহিংস অপরাধের মধ্যে রয়েছে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ও শারীরিক হামলা। দ্বিতীয়ত, খুনের হার দেখানো হয়েছে। তৃতীয়ত, সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ (চুরি, গৃহে অনুপ্রবেশ, গাড়ি চুরি ও অগ্নিসংযোগ) দেখানো হয়েছে। অপরাধের হার প্রতি ১ লাখ লোকের ভিত্তিতে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

সারণি ১.১ থেকে দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো বছর ওঠানামা সত্ত্বেও ১৯৬০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার অতি দ্রুত বেড়ে যায়। ১৯৯১ সালে সারণি ১.১-এ প্রদর্শিত তিন ধরনের অপরাধের হারই সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৬০ সালে প্রতি ১ লাখ লোকের মধ্যে গড়ে মাত্র ৫.১ জন খুন হয়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে খুনের হার ছিল ৯.৮ (৯২ শতাংশ বৃদ্ধি)। প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় ১৯৬০ সালে সহিংস অপরাধের হার ছিল ১৬০.৯; এই হার ১৯৯১ সালে ৭৫৮.২-এ উন্নীত হয় (৪৭১ শতাংশ বৃদ্ধি)। সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধের হার ছিল ১৯৬০ সালে প্রতি লাখে ১৭২৬। ১৯৯১ সালে এ হার বেড়ে ৫১৪০-এ দাঁড়ায় (২৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি)। অপরাধের হার সবচেয়ে বাড়ে ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অপরাধের হার ভবিষ্যতে আরও দ্রুত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। একজন বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০-এর দশকে অপরাধ এত বাড়বে যে দেশটিতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের হতবাক করে দিয়ে ১৯৯১ সালের পর অপরাধের হার হঠাৎ কমে যায়। অপরাধের এই নিম্নমুখী প্রবণতার দুটি বিশেষত্ব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, অপরাধের হার যুক্তরাষ্ট্রের সব অঞ্চলে কমেছে। কথাটার তাৎপর্য হলো, এর কারণ কোনো বিশেষ অঞ্চলের নীতি বা উদ্যোগ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। অপরাধ হ্রাসের এই রহস্য ব্যাখ্যা করতে হলে এমন উপাদান খুঁজতে হবে, যা সারা দেশে একই সঙ্গে কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার নাটকীয়ভাবে কমে গেলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তেমনটি ঘটেনি। এর সহজ অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছে, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ঘটেনি।

ইংরেজি একটি আপ্তবাক্যে বলা হয়েছে, সাফল্যের পিতৃত্বের দাবি অনেকেই করে, কিন্তু ব্যর্থতা হচ্ছে এতিম; ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে রাজি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার বাড়ার দায়িত্ব কোনো রাজনৈতিক দলই নেয়নি। অথচ অপরাধ কমার পর সবাই দাবি করতে থাকেন যে তাঁদের অনুসৃত নীতির সাফল্যের জন্যই অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা জিগির তুলল, ক্লিনটন আমলে অর্থনীতিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ফলেই অপরাধ কমেছে। রিপাবলিকানরা ডেমোক্র্যাটদের দাবি নাকচ করে বলল যে, তাদের দল হিংস্র অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড পুনঃপ্রবর্তন করায় এবং অপরাধীদের সাজার মেয়াদ বাড়ানোর ফলেই অপরাধ কমেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বললেন যে পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনমূলক পুলিশি টহলদারি ও তৎপরতার কারণে অপরাধের হার কমেছে। সমাজতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন যে অপরাধ হ্রাসের প্রবণতার উৎস খুঁজতে হবে জনসংখ্যার পরিবর্তনে ও অন্যান্য সমাজতাত্ত্বিক উপাদানের মিথস্ক্রিয়াতে (interaction)। লেভিট (২০০৪) যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ হ্রাসের প্রবণতা সম্পর্কে একটি সাড়া-জাগানো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন Journal of Economic Perspectives সাময়িকীতে। লেভিটের মূল বক্তব্যগুলি নিম্নে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হলো :

  • রমরমা অর্থনীতি : ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন অর্থনীতিতে তেজি অবস্থা বিরাজ করায় এবং বেকারত্বের হার কমায় অপরাধ কমেনি। প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, যখন তেজি ভাব কেটে যায় এবং অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তখন অপরাধের হার বাড়ে না। লেভিটের এ বক্তব্যের ভিত্তি হলো ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অপরাধের হার ও অর্থনৈতিক অবস্থার সম্পর্ক বিশ্লেষণ। পরবর্তীকালের অপরাধ-সম্পর্কিত উপাত্ত লেভিটের অনুমান সমর্থন করে। বস্তুত, ২০০১ থেকে ২০০৯ সময়কালে অপরাধের হার সারণি ১.১ দেখা যাবে। এ সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০০১-২০০৯ সময়কালেও অপরাধের হার কমে চলেছে। ২০০৭-২০০৯ সময়কালে একটি বড় আকারের মন্দা দেখা দিলেও অপরাধের হার বাড়েনি।
  • অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন : অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রবর্তনের ফলে অপরাধের হার কমেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র ক্রয়ের ওপর কার্যত কোনো বাধানিষেধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের হাতে ২০ কোটি বন্দুক রয়েছে। মোট প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যার তুলনায় বন্দুকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু আজব বিষয় এই যে, বন্দুকের এত ছড়াছড়ি সত্ত্বেও ৮০ শতাংশ অপরাধী আইনসম্মত পদ্ধতিতে বন্দুক সংগ্রহ করেনি। কাজেই অস্ত্র ক্রয়ের আইন পরিবর্তন করলেই অপরাধ কমবে না। শিকাগো শহরে ১৯৮২ সালে অস্ত্র বিক্রয়ের ওপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শিকাগো শহর কোনো লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেনি।
  • মৃত্যুদণ্ডের হার বৃদ্ধি : অপরাধ দমনে এ ব্যবস্থা মোটেও কার্যকর হয়নি। ১৯৮০-এর দশকে মোট ১১৭ জন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ১৯৯০-এর দশকে ৪৭৮ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। অর্থাৎ ১৯৯০-এর দশকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হার প্রায় চার গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু অপরাধ-পরিস্থিতির ওপর এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদৌ কোনো প্রভাব পড়েছে কি না, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। ২০০১ সালে মাত্র ৬৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। খুনের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সম্ভাব্যতার হার রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক কম। কাজেই মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে অপরাধ লক্ষণীয়ভাবে কমবে, এ অনুমান মোটেও সঠিক নয়।
  • লুকিয়ে অস্ত্র বহনের অনুমতি : এই আইনের প্রধান যুক্তি ছিল যে অপরাধের সম্ভাব্য শিকারেরা যদি লুকিয়ে অস্ত্র বহন করে, তবে অপরাধীরা জানতে পারবে না যে তার সম্ভাব্য শিকারের কাছে অস্ত্র রয়েছে কি না। কাজেই অপরাধীরা আক্রমণ করতে ভয় পাবে এবং এর ফলে অপরাধের হার কমে যাবে। এ অনুমানও সঠিক প্রমাণিত হয়নি।
  • যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যায় প্রবীণদের প্রাধান্য : ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ায় জনসংখ্যায় প্রবীণদের (৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক) অনুপাত বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের প্রবীণদের সহিংস অপরাধ করার প্রবণতা কিশোর-অপরাধের ৫০ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম। আবার অপরাধীরা যত সহজে শিশু-কিশোরদের আক্রমণ করে তত সহজে প্রবীণদের আক্রমণ করতে সাহস পায় না। তাই জনসংখ্যায় প্রবীণদের অনুপাত বাড়লে অপরাধের হার হ্রাস পেতে পারে। তবে লেভিট মনে করেন, দুটি কারণে বিংশ শতকের সর্বশেষ দশকে জনসংখ্যায় প্রবীণদের অনুপাত বৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার হ্রাসের একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক হবে না। প্রথমত, জনসংখ্যায় শিশু-কিশোরদের অনুপাত কমলেও মোট শিশু-কিশোরের সংখ্যা বেড়েছে। কাজেই অন্য সবকিছু অপরিবর্তিত থাকলে এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ বাড়ার কথা। একই সঙ্গে এ সময় জনসংখ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের অনুপাত বেড়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি। এ দুটি কারণে জনসংখ্যার বয়স-ভিত্তিক বিন্যাসে (age-distribution) পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার কমানোতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি।
  • পুলিশ-ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনশীল কৌশল : অনেক পুলিশ কর্মকর্তা অভিমত পোষণ করেন যে পুলিশ-ব্যবস্থাপনায় নতুন কার্যক্রম অপরাধ হ্রাসে খুবই কার্যকর অবদান রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ নিউ ইয়র্ক শহরের পুলিশের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নিউ ইয়র্ক শহরে একসময় ছোটখাটো অপরাধ আমলে নেওয়া পুলিশ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে দেখা যায় যে অপরাধের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছোটখাটো অপরাধ যারা করে, তারাই পরবর্তীকালে বড় অপরাধ করে। ছিঁচকে অপরাধীদের ধরা শুরু হলে অপরাধের হার কমে যায়। তবে নিউ ইয়র্ক শহরের ক্ষেত্রে এ অনুমান কতটুকু সত্য, সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। নিউ ইয়র্ক শহরে ১৯৯১ সাল থেকে অপরাধের হার কমতে থাকে। অথচ পুলিশের উদ্ভাবনশীল কর্মসূচিগুলি চালু হয় ১৯৯৩ সালের পর। দ্বিতীয়ত, যেসব শহরে নিউ ইয়র্কের মতো উদ্ভাবনশীল কর্মসূচি নেওয়া হয়নি, সেসব শহরেও নিউ ইয়র্ক শহরের মতো অপরাধের হার কমে আসে।
  • পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি: ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের সংখ্যা ১৪ শতাংশ বাড়ানো হয়। অনেকে দাবি করেন যে এর ফলেই এই দশকে অপরাধের হার কমে আসে। অবশ্যই পুলিশের সংখ্যা বাড়ালে অপরাধ করা শক্ত হয়ে পড়ে। তবু সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে সহিংস অপরাধের ওপর পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব প্রমাণ করা অত্যন্ত দুরূহ। একদিকে অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে পুলিশের সংখ্যা বাড়ছে। কালীন (time series) উপাত্তের ভিত্তিতে পুলিশের সংখ্যা ও অপরাধের হার বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যাবে, বড় অপরাধের হারের সঙ্গে পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। আসলে অপরাধের ওপর পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর ফল বিশ্লেষণ করতে হলে একই সময়ে যেসব শহরে পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে আর যেসব শহরে পুলিশের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে, তাদের অপরাধের হারের তুলনা করতে হবে। সারা দেশে অপরাধের মাত্রার ওপর পুলিশের সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাব নির্ণয় করা অত্যন্ত শক্ত। লেভিটের গবেষণা হতে দেখা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ এর দশকে যে অপরাধ কমে আসে, তার ১০ শতাংশ পুলিশের সংখ্যাবৃদ্ধির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
  • কারাগারে আটক অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধি : ১৯৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১ লাখ নাগরিকের মধ্যে ১০৫ জন কারায় অন্তরীণ ছিল। ২০০০ সালে এই হার ৪৯০-এ উন্নীত হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যার অনুপাত হিসাবে কারাগারে আবদ্ধ লোকের হার চার গুণের বেশি বাড়ে। এর একটি বড় কারণ হলো, মাদকসংক্রান্ত অপরাধে সাজা দানের হার বাড়ানো হয় এবং জনমতের চাপে বিচারকেরা সাজার পরিমাণও বাড়িয়ে দেন। অপরাধীরা জেলে আটক থাকায় অপরাধ কমে যায়। আবার সাজার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জেলের বাইরে যেসব অপরাধী ছিল তারা সতর্ক হয়ে যায়। ফলে অপরাধের হার কমে যায়। এতে ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন মুলুকে যে হারে অপরাধ কমে আসে তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যাখ্যা করা যায়।
  • মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ে পরিবর্তন : ১৯৮৫-এর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ে দুটি পরিবর্তন দেখা যায়। একটি কারিগরি ও অন্যটি অর্থনৈতিক। তখন পর্যন্ত কোকেন ছিল নেশার প্রধান সামগ্রী। ১৯৮৫ এর দিকে একটি নতুন পদ্ধতি চালু হলো। এ পদ্ধতিতে বেকিং সোডার সঙ্গে সামান্য কোকেন মিশিয়ে গরম করলে আরও অনেক শক্তিশালী নেশার সামগ্রী উৎপাদন করা সম্ভব হয়। এর নাম দেওয়া হয় ক্র্যাক (Crack)। যেহেতু ক্র্যাকে কোকেন (যা বেআইনি ও তাই দামি) কম লাগে, তাই এর দাম কমে যায়। অর্থনৈতিক সূত্র অনুসারে উন্নত কোকেনের মানের এ পণ্যের দাম কমে গেলে তার চাহিদা বেড়ে যায়। এর ফলে ক্র্যাক কোকেনের চেয়েও লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়। প্রথম পর্যায়ে ক্র্যাক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বে অনেক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। মার্কিন মুলুকে খুনের হার বেড়ে যায়। অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়াতে ক্র্যাকের দাম কমতেই থাকে। এর ফলে লাভ কমে যায়। ক্র্যাক ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা কমে যায়। খুনাখুনিও কমে যায়। ১৯৯০-এর দশকে মাদক ব্যবসায়ের এসব পরিবর্তনের ফলে খুনের হার কমে যায়। তবে সম্পত্তি-সংক্রান্ত ও অন্যান্য সহিংস অপরাধ হ্রাসে এর ভূমিকা সীমিত।

এই সুদীর্ঘ বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে মার্কিন মুলুকে অপরাধ হ্রাস সম্পর্কে যেসব প্রতর্ক তুলে ধরা হয়েছে তার বেশির ভাগই ভিত্তিহীন। পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি, মাদকদ্রব্যের অপ্রত্যাশিত মূল্যহ্রাসের ফলে মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে খুনাখুনি কমে যাওয়া এবং অপরাধীদের কারাবাসের সম্ভাবনা ও মেয়াদ বেড়ে যাওয়া অপরাধ হ্রাসে সহায়তা করেছে। কিন্তু অপরাধের হার গত শতকের নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ কমে যাওয়ার কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা এতে পাওয়া যাচ্ছে না।

২০০১ সালে জন ডনোহু (John Donohue)-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে লিখিত এক প্রবন্ধে লেভিট দাবি করেন যে নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার কমার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক গর্ভপাত বৈধকরণ। আদালতের এ সিদ্ধান্তের আগে যুক্তরাষ্ট্রে গুটি কয়েক অঙ্গরাজ্য ছাড়া গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। এর ফলে বাপ-মা যেসব সন্তান চাইতেন না, তাদের জন্ম নিরোধ করা সম্ভব ছিল না। এ ধরনের বাপে খেদানো মায়ে-তাড়ানো অবাঞ্ছিত সন্তানেরাই কিশোর অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। গর্ভপাত বৈধ বলে স্বীকৃত হওয়ার ফলে এ ধরনের অপরাধীর সংখ্যা কমে যায়।

লেভিটের বক্তব্য অনুধাবনের জন্য গর্ভপাত সম্পর্কে কতিপয় তথ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রো বনাম ওয়েড মামলায় (Roe versus Wade) গর্ভপাতকে বৈধ ঘোষণার পর প্রথম বছরে যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে সাত লাখ গর্ভপাত ঘটে। ১৯৮০ সালে এই সংখ্যা ১৬ লাখে উন্নীত হয়। ১৯৯০-এর দশকে মোট গর্ভপাতের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসে। ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১২ লাখের সামান্য ওপরে। প্রতি পাঁচটি গর্ভপাতের চারটি গর্ভপাতই ঘটে কৃষ্ণাঙ্গ মায়েদের ক্ষেত্রে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা অনেক বেশি। যদি ধরে নিই যে গর্ভপাত না হলে প্রতিবছর যে লাখ লাখ অবাঞ্ছিত ও অবৈধ সন্তান জন্ম নিত, তাদের মধ্যে প্রতিবছর ১ লাখ শিশু ১৬ বছর বয়স থেকে পেশাগত অপরাধী হয়ে যেত, তাহলে সোজা অঙ্কের হিসাবে দেখা যায় যে গর্ভপাতের বৈধ সুযোগ সৃষ্টির ফলে কমপক্ষে ২২ লাখ অপরাধী জন্ম নেওয়ার সুযোগ পায়নি। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।

অপরাধের ওপর গর্ভপাতের প্রভাব সম্পর্কে লেভিটের যুক্তি অত্যন্ত সহজ। কিন্তু এ বক্তব্য প্রমাণ করা সহজ নয়। লেভিট ও ডনোহু তাঁদের প্রতর্কের সমর্থনে তিন ধরনের প্রমাণ পেশ করেন।

প্রথমত, অপরাধের ওপর গর্ভপাতের প্রভাব গর্ভপাত বৈধকরণের ১৫ থেকে পঁচিশ বছর (এই বয়সের অবাঞ্ছিত সন্তানদের অপরাধী হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি) পর দেখা যাবে এবং এই প্রভাব অনেক দিন ধরে চলবে। বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০ বছর ধরে মার্কিন মুলুকে অপরাধের হার কমেই চলেছে। যদি কোনো বিশেষ ব্যবস্থার ফলে অপরাধ কমত তবে তার প্রভাব এক বছর-দুবছর পর দেখা দিত এবং এর প্রভাব কিছুদিন পর নিঃশেষিত হয়ে যেত। কোনো বিশেষ সংস্কারের প্রভাব ১৫/২০ বছর পর দেখা যেত না এবং প্রভাবটা দীর্ঘদিন ধরে অনুভূতও হতো না।

দ্বিতীয়ত, ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাত বৈধকরণের কয়েক বছর আগেই নিউ ইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে আইন করে গর্ভপাত বৈধ করা হয়। এসব রাজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্যের আগে অপরাধের হার কমতে শুরু করে। এতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে অবাঞ্ছিত সন্তান জন্মের হার কমে গেলে অপরাধের হারও হ্রাস পায়।

তৃতীয়ত, রাজ্যভেদে গর্ভপাতের হারের তারতম্য রয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে যেসব রাজ্যে গর্ভপাতের হার বেশি ছিল সেসব রাজ্যে ১৯৯০-এর দশকে অপরাধের হার অপেক্ষাকৃত বেশি কমেছে।

এই গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে অনেক ঘটনার প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় না। এবং দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল তাৎক্ষণিক ফলাফল থেকে ভিন্ন হতে পারে। গর্ভপাত বৈধকরণের প্রধান যুক্তি ছিল সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে মায়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বৈধ গর্ভপাতের সুযোগ না থাকলে অনেক কুমারী মা বিপজ্জনক ও বেআইনি গর্ভপাতের চেষ্টা করত। এর ফলে কেউ কেউ মারা যেত এবং কেউ কেউ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ত। গর্ভপাত বৈধকরণের ফলে অপরাধের হার কমে যাবে–এ ধরনের দাবি গর্ভপাত অধিকারের বড় সমর্থকেরাও করেননি। অথচ বাস্তবে তা-ই ঘটল। এই ধরনের অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিকে অভিপ্রেতের অতিরিক্ত প্রভাবের সূত্র (Law of Unintended Consequences) বলা হয়ে থাকে।