» » ‘আজব’ ও ‘জবর-আজব’ অর্থনীতি

৩. আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি

এই ধরনের মজার বিষয় নিয়ে লেভিট ও ডুবনার যে দুটি বই লিখেছেন তাদের নাম রাখা হয়েছে Freakonomics (আজব অর্থনীতি) ও Super Freakonomics (জবর-আজব অর্থনীতি)। ইংরেজি freak শব্দটির সঙ্গে Economics শব্দটির সন্ধি করে freakonomics শব্দটি পয়দা করা হয়েছে। Freak শব্দটির অর্থ হলো উদ্ভট, আজব অথবা খাপছাড়া। আজব আর ‘অর্থনীতি’ শব্দ দুটি হচ্ছে বিপরীতধর্মী। অর্থনীতির একটি মৌল প্রতর্ক হলো, মানুষের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড কতগুলি সূত্র অনুসরণ করে।

সূত্র মেনে অর্থনীতি চললে সেখানে আজব বা খাপছাড়ার কোনো স্থান নেই। তাহলে আজব অর্থনীতি বা জবর-আজব অর্থনীতি, কোনো শিরোনামেরই অর্থ হয় না। তাই বই দুটি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে শিরোনামের তাৎপর্য নিয়ে : ‘আজব’ ও ‘জবর-আজব’ শব্দ দুটি কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আমার মনে হয় যে বই দুটির বিষয়বস্তু তিন অর্থে আজব। প্রথমত, এ বইয়ের বিষয়বস্তুগুলি অর্থনীতির মূল ধারার সঙ্গে খাপ খায় না। চিরাচরিতভাবে অর্থনীতিবিদেরা যেসব বিষয়ে মাথা ঘামান তা এখানে নেই। পক্ষান্তরে এ দুটি বইয়ে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে তা অর্থনীতির আওতায় সীমাবদ্ধ নয়। লেখকদ্বয় বলছেন, তাঁদের বইয়ে অর্থনীতি না থাকলেও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ’ (economic approach) রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ দুটি বইয়ে অনেক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য রয়েছে, যা সাধারণ পাঠকদের কাছে আজগুবি মনে হবে। এগুলি সরাসরি অর্থনীতিসংক্রান্ত না হলেও পাঠকের নজর কেড়ে নেয়। তৃতীয়ত, এ দুটি বইয়ে তথ্য-উপাত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে অনেক প্রচলিত মত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বই দুটির বক্তব্য সঠিকভাবে বোঝার জন্য এ তিনটি বিশেষত্বের সম্যক উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে।

৪. ‘অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ’

সাধারণত পাঠকেরা অর্থনীতির বইয়ে মানুষের রুটি-রোজগারের সমস্যার সমাধান খোঁজেন। এ ধরনের প্রশ্ন আলোচিত হয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে। এ দুটি বইয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি বা এ ধরনের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। শুধু ব্যাষ্টিক অর্থনীতির কিছু সূত্র প্রয়োগ করা হয়েছে অপরাধ, পতিতাবৃত্তি, সন্তান পালন, প্রতারণা ইত্যাদি সমাজতাত্ত্বিক সমস্যার বিশ্লেষণে। কৈফিয়ত হিসেবে বলা হয়েছে, বই দুটি সরাসরি অর্থনীতিসংক্রান্ত নয়, তবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ ধারণাটির জনক হচ্ছেন গ্যারি বেকার (Gary Becker)। ১৯৯২ সালে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। বেকার (১৯৯২) অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘It is a method of analysis and not an assumption about particular motivations. …Behavior is driven by a much richer set of values and preferences.’ (এটি হচ্ছে একটি বিশ্লেষণের পদ্ধতি, বিশেষ প্রণোদনা সম্পর্কে পূর্বানুমান নয়।…মানুষের আচরণ অনেক বেশি সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও অভিরুচি দ্বারা তাড়িত হয়)।

গ্যারি বেকারের মতে, অর্থনীতি শুধু সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের সূত্রমালা নয়, অর্থনীতি হচ্ছে একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করা যায়। এ ধরনের বিশ্লেষণের জন্য জানতে হবে মানুষ কী চায়। এই সমস্যাটিই রবীন্দ্রনাথ অতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায় :

সব চেয়ে দুর্গম-যে মানুষ আপন-অন্তরালে,

তার পূর্ণ পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।

সে অন্তরময়,

অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।

পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার;

একমাত্র মানুষের অন্তরের পরিচয় জানলেই তার আচরণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু তার অন্তরের প্রবেশের দ্বার সহজে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এটাই হলো অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের সমস্যা।