২. ভেগোলজির দার্শনিক পটভূমি
পরিমল রায় মারা যাওয়ার পর অবশ্য উভয় বাংলাতেই ভেগোলজি চর্চায় ভাটা পড়েছে। তবে বিদেশে এ ধরনের শাস্ত্রচর্চায় অনেক নতুন গবেষণা হয়েছে। ‘ভেগোলজি’ শব্দটি এখনো ইংরেজি ভাষায় ঢুকতে পারেনি। তবে দর্শনচর্চায় আবোলতাবোলের গুরুত্ব প্লেটোর সময় থেকেই স্বীকৃত। প্লেটো যথার্থই মনে করতেন যে মিথ্যা না থাকলে সত্যের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে জরথুস্ত্র বলতেন যে শুভ (Ahura Mazda) ও অশুভ (Ahriman) দুই-ই যমজ। এরা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্লেটো লিখেছেন, ‘Serious things cannot be understood without laughable things, nor opposites at all without opposites.? (5599 বিষয় ছাড়া গুরুগম্ভীর বিষয় বোঝা সম্ভব নয়, যেমনি বিপ্রতীপ ছাড়া পরস্পরবিরোধী অবস্থানের উপলব্ধি সম্ভব নয়)। দর্শনের সুস্থ চর্চার জন্য তাই ভেগোলজি বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।
অর্থহীন আবোলতাবোল নিয়ে বিগত শতকে তিনজন দার্শনিক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। একজন হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিটগেনস্টাইন। তিনি বিষয়টির ওপর কোনো স্বতন্ত্র বই লেখেননি, তবে সাধারণভাবে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাক্স ব্লাক। এ সম্পর্কে ব্ল্যাক (১৯৮৩) The Prevalence of Humbug and other Essays’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। তৃতীয় দার্শনিক হলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যারি জে ফ্রাঙ্কফার্ট। ২০০৫ সালে প্রকাশিত তার বইয়ের নাম On Bullshit। লক্ষণীয় যে এরা অর্থহীন আবোলতাবোল অর্থে ইংরেজিতে তিনটি স্বতন্ত্র শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভিটগেনস্টাইন চিরাচরিত Nonsense’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। ব্ল্যাক এর নাম দিয়েছেন ‘Humbug’। আর ফ্রাঙ্কফার্ট বলছেন bullshit।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভেগোলজি বুঝতে হলে ‘ননসেন্স’, ‘হামবাগ’ ও ‘বুলশিট’ তিনটি শব্দেরই তাৎপর্য বুঝতে হবে। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি বাংলা অভিধানে nonsense-এর নিম্নরূপ বাংলা করা হয়েছে : ‘অর্থহীন শব্দ, নির্বোধ কথাবার্তা, আগড়ম-বাগড়ম, আলাৎ পালাৎ’। হামবাগ (humbug) শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, হামবাগ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে জার্মান শহর হামবুর্গ থেকে। মধ্যযুগে এ শহর থেকে ইউরোপ মহাদেশে বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হতো। তাই গুলবাজির নাম করা হয় হামবাগ। আবার কেউ কেউ বলেন, আয়ারল্যান্ডে দুনম্বরি মুদ্রাকে বলা হতো uimbog। এই আইরিশ শব্দটি থেকেই হামবাগ শব্দটি এসেছে। কারণ যা-ই হোক, হামবাগ শব্দটি এখন অভিধানে ঠাই পেয়েছে। বাংলা একাডেমীর ইংরেজি-বাংলা অভিধানে humbug শব্দটির নিম্নরূপ তরজমা করা হয়েছে : ‘দমবাজি, ধোঁকাবাজি, কৌতব, দমবাজ, ধোকাবাজ’।
তবে bullshit শব্দটি নিয়ে সমস্যা আছে। বেশির ভাগ অভিধানে এর ঠাই হয়নি। আসলে শব্দটি নোংরা নয়। এখানে bull শব্দটি ষাঁড় অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বুল’ শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো nonsense বা অর্থহীন; আবোলতাবোল । শব্দটি এই অর্থে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে মার্কিন সেনারাই বুল’ শব্দটির সঙ্গে ‘শিট’ শব্দটির সংযোগ ঘটায়। বিষ্ঠা অর্থে মার্কিন সেনা বাহিনীতে shit একটি জনপ্রিয় লফজ। বড় অর্থে বাঙালিরা যেরূপ ছাগলের আগে রাম শব্দটি যোগ করে রামছাগল বলে, তেমনি মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোনো কিছু খারাপ মনে করলে বলে ‘শিট’। মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে পড়ে ‘বুল’ হয়ে গেল ‘বুলশিট’ বা (বিষ্ঠার মতো) জঘন্য অর্থহীন। তবে বুলশিট শব্দটি পাতে তুলতে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমী বা কলকাতার সাহিত্য সংসদ রাজি হয়নি। অবশ্য গৌরীপ্রসাদ ঘোষ তাঁর Everyman’s Dictionary English-Bengali-60 Japoyo wanfo অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বুলশিটের নিম্নরূপ অনুবাদ করেছেন : ‘(অশ্লীল) ফালতু কথা, ষাঁড়ের গোবর’ । ফালতু শব্দটির এখানে প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও, ষাঁড়ের গোবর প্রতিশব্দটি একেবারেই ফালতু। ঘোষমশাই গবাদিপশুর লিঙ্গভেদে বিষ্ঠার তফাত কীভাবে করেন জানি না। তবে গাভিরই হোক বা ষাঁড়েরই হোক, বিষ্ঠার জন্য গোবর শব্দটি যথেষ্ট। এখানে লিঙ্গভেদের প্রশ্ন না তোলাই ভালো।
ইংরেজি nonsense, humbug এবং bullshit–এই তিনটি ধারণার মধ্যে একমাত্র মিল হলো যে প্রতিটি শব্দই অর্থহীন ও আবোলতাবোল অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে এদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। ‘ননসেন্স’ শব্দটি অপেক্ষাকৃত নির্মল । ননসেন্স নিছক আবোলতাবোল; এর মধ্যে কোনো মতলববাজি নেই। হামবাগ’ শব্দে আবোলতাবোলের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। আর ‘বুলশিট’ হচ্ছে জঘন্য ধরনের মিথ্যাচার। যেখানে জঘন্য মিথ্যা বলা হয় সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুমতলব থাকে। কাজেই ‘হামবাগ’ আর ‘বুলশিট’ কাছাকাছি শব্দ। এদের মধ্যে হামবাগ কম জঘন্য আর বুলশিট সবচেয়ে জঘন্য।
প্রথমে ননসেন্স নিয়ে শুরু করি । nonsense poems ইংরেজি ও বাংলা উভয় সাহিত্যেই সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করেছে। উদাহরণস্বরূপ নিচে দুটি ইংরেজি ননসেন্স কবিতা উদ্ধৃত হলো। প্রথম উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে লুই ক্যারলের একটি কবিতা থেকে :
Twas brilling and slithy toves
Did gyre and gimble in the wabe
All mimsy were the borogoves
And mome raths outgrabe.
দ্বিতীয় উদাহরণটি নেওয়া হয়েছে স্পাইক মিলিগানের কবিতা থেকে :
On the Ning Nang Nong
Where the cows go bong!
And the monkeys all say Boo!
There’s a Nong Nang Ning.
এ দুটি কবিতায় কিছু অর্থপূর্ণ শব্দ থাকলেও অধিকাংশ শব্দ অর্থহীন। তাই এসব কবিতাকে আপাতদৃষ্টিতে অর্থপূর্ণ মনে হলেও আসলে এরা অর্থহীন। নেহাত ধ্বনি সৃষ্টির জন্য কিছু অর্থহীন শব্দ একত্র করা হয়েছে।
আবার কোনো কোনো কবিতায় সব শব্দের অর্থ আছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে কবিতাটির কোনো অর্থ নেই। সুকুমার রায় বাংলায় এ ধরনের কবিতা লিখেছেন। যেমন ধরুন, নিচের কবিতাটি :
শুনেছো কি বলে গেলো সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ?
টক টক থাকে নাকো হলে পরে বৃষ্টি–
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।
এখানে প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ আছে। কিন্তু পুরো কবিতাটি স্রেফ গুল । আকাশের কি গন্ধ আছে? কারও পক্ষে সে গন্ধ চাটা কি সম্ভব? কবিতাটি যে অর্থহীন তা কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অথবা নিচের কবিতাটি উপভোগ করলেও কেউ এর অর্থ খুঁজতে যাবে না :
মাসি-গো মাসি পাচ্ছে হাসি
নিম গাছেতে হচ্ছে শিম
হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা
কাগের বাসায় বগের ডিম।
সুকুমার রায়ের কবিতায় কোনো অস্পষ্টতা নেই। রায়ের পাঠককে কখনো বলে দিতে হবে না যে তার বক্তব্য উদ্ভট। বরং উদ্ভট বলেই আমাদের তা আওড়াতে ইচ্ছে করে :
যে সব লোকে পদ্য লেখে
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে
কানের কাছে নানান সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে
সামনে রেখে মুদির খাতা–
হিসাব কষায় একুশ পাতা।
‘আবোলতাবোল’ কবিতায় অর্থ না থাকলেও শব্দের ফুলঝুরি রয়েছে। বক্তব্য না থাকলেও শব্দের মূৰ্ছনা আমাদের মোহিত এবং আনন্দিত করে। ননসেন্স’ রচনা হচ্ছে নির্মল ভেগোলজি। এখানে বক্তব্যে আলো-আঁধারের অস্পষ্টতা আছে, তবে কোনো ফেরেববাজি নেই।
নির্দোষ ভেগোলজির উদাহরণ হচ্ছে ‘ননসেন্স’ আর ফেরেববাজ ভেগোলজি হলো হামবাগ’ ও ‘বুলশিট’। অধ্যাপক ব্ল্যাকের সংজ্ঞা অনুসারে 7455 260g: ‘Deceptive misrepresentation short of lying, especially by pretentious word or deed, of somebody’s own thoughts, feelings or attitudes.’ (প্রবঞ্চনামূলক অসৎ উপস্থাপন যা মিথ্যা নয়, তবে মিথ্যার কাছাকাছি এবং যাতে বক্তার চিন্তা, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি চালবাজ ভাষায় ও কর্মে প্রকাশিত)। এ সংজ্ঞা অনুসারে অর্থহীন আবোলতাবোলের বা হামবাগের চারটি বিশেষত্ব রয়েছে।
ফেরেববাজ ভেগোলজি বা হামবাগের প্রথম শর্ত হলো এতে প্রবঞ্চনার অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে। না জেনে অথবা প্রতারণার মতলব ছাড়া ভ্রান্ত উপস্থাপনকে এই সংজ্ঞা অনুসারে bullshit বা humbug বলা যাবে না। ভিটগেনস্টাইন এ মতের সঙ্গে একমত নন। তাঁর মতে, ভেবেচিন্তে কিছু না বললে, মতলব যা-ই হোক না কেন, তা অসৎ উপস্থাপন।
ভিটগেনস্টাইনের এ মত সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ভিটগেনস্টাইনের বান্ধবী ফানিয়ার একবার টনসিল অপারেশন হয়। ভিটগেনস্টাইন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান ও জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন লাগছে?’ ফানিয়া উত্তর দিলেন, ‘গাড়ি চাপা পড়লে কুকুরের যেমন লাগে তেমন।’ ভিটগেনস্টাইনের মতে, এ উক্তি অর্থহীন আবোলতাবোল । ফানিয়া কুকুর নন। গাড়ি চাপা পড়লে কুকুরের কেমন লাগে, ফানিয়া তা জানেন না। কাজেই তার উক্তি নিজেকে গাড়ির নিচে চাপা পড়া কুকুরের মতো লাগছে সম্পূর্ণ অর্থহীন বা ননসেন্স। অধ্যাপক ব্ল্যাক বা ফ্রাঙ্কফার্ট এ মতের সঙ্গে একমত নন। তাঁদের মতে, এখানে ফানিয়ার পক্ষ থেকে কোনো ছলনা বা প্রতারণা নেই। ফানিয়া তাঁর নিজস্ব অনুভূতি সম্পর্কে সত্য কথা বলেছেন। বিভিন্ন রূপে সত্যের উপস্থাপন সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, ব্ল্যাকের মতে, চালবাজ বা ভণ্ডামিপূর্ণ কথা বা কাজ হচ্ছে ফেরেববাজ আবোলতাবোলের আরেকটি লক্ষণ। কিন্তু ব্ল্যাক নিজেই স্বীকার করেছেন যে ভণ্ডামি প্রায়শ দেখা যায়, তবে সব সময় তা না-ও ঘটতে পারে। এর ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে। কোনো কোনো সময়ে অজ্ঞতার কারণেও আবোলতাবোল বলা সম্ভব। আবার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়াও আবোলতাবোল বলার ঘটনা ঘটতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসে একজন নেতা বলেছেন, আমাদের মহান ও আশীর্বাদপুষ্ট দেশে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা-জনকেরা ঐশী নির্দেশে মানবজাতির জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এখানে কোনো প্রমাণ নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা ঐশী নির্দেশ পেয়েছেন। তবে বক্তব্যটি সত্য না হলেও এতে কোনো খারাপ মতলব নেই। আবার এ বক্তব্যকে ননসেন্সও বলা যাবে না।
তৃতীয়ত, ব্ল্যাকের মতে, আবোলতাবোল সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়। তবে মিথ্যার কাছাকাছি। মূল সমস্যা হলো, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক করা অনেক সময় শক্ত হয়ে ওঠে। ধরুন, করিম রহিমের শত্রু। গ্রামে আজিজ খুন হলো। গ্রামের লোকেরা সন্দেহ করছে আসমত এ খুনের জন্য দায়ী। কিন্তু কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই করিম অভিযোগ করল যে রহিম এ খুনের জন্য দায়ী। করিম মনে মনে জানে, সে মিথ্যা বলছে। পরে পুলিশি তদন্তে দেখা গেল, আসলে রহিম এ কাণ্ড করেছে। প্রশ্ন হলো। করিম কি সত্য বলছে, না মিথ্যা বলছে? করিম মনে মনে জানত, সে শত্রুতা করে মিথ্যা বলছে। অথচ বাস্তবে সে সত্য কথা বলেছে। আমরা যদি এ ক্ষেত্রে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের যুক্তি গ্রহণ করি, তবে করিম সত্য কথা বললেও সে মিথ্যার চেয়েও খারাপ কাজ করেছে। ব্ল্যাক লিখেছেন :
A truth that is told with bad intent
Beats all the lies you can invent.
(অসৎ উদ্দেশ্যে বলা সত্য কল্পনা করা যায় এমন সব মিথ্যার চেয়েও নিকৃষ্ট।) চতুর্থত, ব্ল্যাক বলছেন যে ‘হামবাগে’ বক্তার চিন্তা, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এ বক্তব্যও সব সময় সঠিক না হতে পারে। এসব বিষয় সম্পর্কেও বক্তা প্রতারণা করতে পারে।
ওপরের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ব্ল্যাক চালবাজ ভেগোলজির যে। সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়। তবে এ সংজ্ঞার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মিথ্যার সঙ্গে ভেগোলজি বা হামবাগ বা বুলশিটের সম্পর্ক। বাইরে থেকে মিথ্যা ও সত্যের ফারাকটা সহজ মনে হলেও আসলে এদের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। সেন্ট অগাস্টিন নিম্নলিখিত আট ধরনের মিথ্যা চিহ্নিত করেছেন :
- ধর্মের শিক্ষা সম্পর্কে মিথ্যা
- যে মিথ্যা অন্যের অপকার করে কিন্তু কারও উপকারে লাগে না
- যে মিথ্যা অন্যের অপকার করে তবে কারও উপকারে লাগে
- মনের আনন্দে মিথ্যা বলা
- অন্যদের খুশি করার জন্য মিথ্যা বলা।
- যে মিথ্যা কারও অপকার করে না অথচ কারও জীবন রক্ষা করে
- যে মিথ্যা কারও অপকার করে না অথচ কাউকে সাহায্য করে
- যে মিথ্যা কারও ক্ষতি করে না অথচ কারও উপকার করে।
ওপরের তালিকার আট ধরনের মিথ্যার মধ্যে সাত ধরনের মিথ্যা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বলা হয়। নিজস্ব ধর্মীয় মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ধর্মের শিক্ষা সম্বন্ধে মিথ্যা বলা পাপ নয়। অন্য ক্ষেত্রে উপকার, অপকার বা খুশি করার জন্য মিথ্যা বলা হয়। অগাস্টিনের মতে, এসব মিথ্যা ঠিক মিথ্যা নয়। এই ধরনের মিথ্যা যারা বলে, তারা ঠিক মিথ্যুক নয়। শুধু একধরনের মিথ্যা আছে, যা শুধু আনন্দের জন্য বলা হয়। সেন্ট অগাস্টিনের মতে, এ ধরনের মিথ্যাই হলো আসল মিথ্যা। এ ধরনের মিথ্যা যারা বলে তারাই প্রকৃত মিথ্যুক ।
অধ্যাপক ফ্রাঙ্কফার্টের মতে, মিথ্যা হামবাগ’ বা ‘বুলশিটের প্রধান চিহ্ন নয়। বুলশিটের প্রধান লক্ষণ হলো এ ধরনের বক্তব্য জাল। ফ্রাঙ্কফার্টের ভাষায়, ‘For the essence of bullshit is not that it is false but that it is phony.’ (বুলশিটের মর্ম এই নয় যে এটি মিথ্যা, আসলে এটি হচ্ছে মেকি)।
অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত সম্প্রসারণের পরও ভেগোলজি এখনো কীভাবে টিকে আছে? অর্থনীতির ভাষায়, এর কারণ খুঁজতে হবে ভেগোলজির চাহিদা ও জোগানে। ভেগোলজির চাহিদা বাড়ার কারণ দুটি। প্রথমত, মানুষ সব জটিল প্রশ্নের সহজ জবাব চায়। এ জবাব তাদের চিরাচরিত ধারণার সঙ্গে যত সংগতিপূর্ণ হয় ততই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। দ্বিতীয়ত, কোন উত্তর কতটুকু সত্য তা যাচাই করার সময় বেশির ভাগ লোকেরই নেই। মনস্তাত্ত্বিকেরা এ ধরনের প্রবণতার নাম দিয়েছেন Belief perseverance and confirmatory bias (পূর্ববিশ্বাসের প্রলম্বন ও অনুসমর্থক পক্ষপাত)। একবার কোনো তত্ত্বে বিশ্বাস জন্মালে মানুষের মধ্যে নতুন ও বিপরীত সাক্ষ্য অগ্রাহ্যের প্রবণতা দেখা দেয়। (ম্যাথু রাবিন, ১৯৯৮)।
ভেগোলজির জোগানও বাড়ছে। শুধু প্রতারণার জন্য মানুষ ভেগোলজির আশ্রয় নেয় না। জীবনের জটিলতা বাড়ার ফলে অনেক নতুন প্রশ্ন উঠছে, যার জবাব কারও জানা নেই। অধ্যাপক ফ্রাঙ্কফার্ট (২০০৫, ৬৩) তাই লিখেছেন, ‘Bullshit is unavoidable whenever circumstances require someone to talk without knowing what he is talking about.’ (যখনই কেউ যে বিষয় সম্পর্কে জানে না সে বিষয় সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়, তখনি আবোলতাবোল অনিবার্য হয়ে ওঠে)।
প্রশ্ন হলো, আবোলতাবোল কি সত্যি সত্যি ক্ষতিকর? স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে আবোলতাবোলের চাহিদা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থহীন আশ্বাস সমাজে অস্থিতিশীলতা হ্রাস করে। সঠিক উত্তর না দিতে পারলেও আবোলতাবোল অজ্ঞেয় রহস্যের ভয় কমিয়ে আনে।
আবোলতাবোল সত্য নয়, আবার একেবারে মিথ্যাও নয়। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে অর্থহীন আবোলতাবোলের বিরূপ প্রভাব অত্যন্ত সীমিত। অধ্যাপক ফ্রাঙ্কফার্ট অতি সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন, আবোলতাবোল মিথ্যা না হলেও মিথ্যার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর। যারা মিথ্যা বলে তারা জানে যে তারা মিথ্যা বলছে। তারা এ ক্ষেত্রে সত্য কী, তা-ও জানে। তারা জেনেশুনেই সত্য কিংবা মিথ্যা বলে। যারা আবোলতাবোল বলে তারা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি যথার্থই লিখেছেন, ‘Someone who lies and someone who tells the truth are playing on opposite sides, so to speak, in the same game. Each responds to the facts as he understands them, although the response of the one is guided by the authority of the truth, while the response of the other defies that authority and refuses to meet its demands. The bullshit ignores these demands altogether. He does not reject the authority of the truth as the liar does and oppose himself to it at all. By virtue of this bullshit is a greater enemy of the truth than lies.’ (যে সত্য বলে এবং যে মিথ্যা বলে, তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে একই খেলা খেলে। তাদের নিজস্ব উপলব্ধির আলোকে তারা প্রতিটি ঘটনা সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, যদিও একজন সত্যের কর্তৃত্বের প্রতি অনুগত এবং অন্যজন এ ধরনের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে এবং এর চাহিদা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। আবোলতাবোলের বেলায় এসব বালাই নেই। যিনি আবোলতাবোল বলেন তিনি মিথ্যাবাদীর মতো সত্যের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন না আবার মিথ্যার বিরোধিতাও করেন না। এ কারণে আবোলতাবোল মিথ্যার চেয়েও সত্যের বড় শত্রু।)। আবোলতাবোলের জগতে মিথ্যা আর সত্যের মধ্যে প্রভেদ ঘুচে যায়। আবোলতাবোল সত্য উদ্ঘাটনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।