১. ভেগোলজির উৎপত্তি ও বিকাশ
বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রায় আড্ডার শোকে অকালে ঝরে পড়লেও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে তার একটি অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি হলেন ভেগোলজি তত্ত্বের জনক। লাতিন ভেগাস (পথবিলাস) ও logos (বিজ্ঞান) শব্দ দুটি মিলিয়ে তিনি ভেগোলজি’ শব্দটি পয়দা করেন। তাঁর মতে, ভেগোলজির বাংলা প্রতিশব্দ হলো সন্ধ্যাবিদ্যা অথবা আলো-আঁধারি বিদ্যা। এটি এমন ধরনের বিদ্যা, যার কিছুটা বোঝা যায় এবং অনেকটাই অনধিগম্য থেকে যায়। ভেগোলজি ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, যেখানে গন্তব্য নেই অথচ গগন আছে, ক্ষুধা নেই অথচ ভুঞ্জন আছে, বক্তব্য নাই কিন্তু বাক্য আছে–অর্থাৎ যেখানে যাবতীয় সন্ধান, বিকৃত মনোবৃত্তির ঊর্ধ্বে লক্ষ্য নিরপেক্ষ নভোচারী চিলের মতো কেবল ভাসিয়া বেড়াইবার উৎসাহ আছে। সেখানেই ভেগোলজির প্রকৃষ্ট প্রকাশ’ (রায়, ২০০৩ (পুনর্মুদ্রণ, ৩৫৫)। এখানে অধ্যাপক রায় গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করেছেন; ভেগোলজির ভাষাতেই ভেগোলজির সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন।
পরিমল রায় ভেগোলজি তত্ত্বের জনক। তবে বাংলাদেশে ভেগোলজি কোনো অভিনব বিষয় নয়। এর উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার সুপ্রাচীন। ঐতিহ্যে। সান্ধ্য বিদ্যার চল ছিল প্রাচীন বাংলায়। সান্ধ্য বিদ্যা রচিত হতো সান্ধ্য ভাষায়। সান্ধ্য ভাষা গোধূলিলগ্নের মতো অস্পষ্ট। ধর্মের গূঢ়তম তত্ত্বগুলি আলো-আঁধারি ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ এর বিকৃত ব্যাখ্যা না করতে পারে। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাগীতি সান্ধ্য ভাষায় রচিত। এর বক্তব্যে রয়েছে আলো-আঁধারের সংমিশ্রণ, যার কিছুটা বোঝা যায় আর অনেকটাই বোঝা সম্ভব নয়। তবে চর্যাপদে এই অস্পষ্টতার অত্যন্ত সুন্দর দার্শনিক ব্যাখ্যা রয়েছে। লুই পাদ লিখেছেন,
জাহের বাণ চিহ্ন রূব ণ জানী
সো কইছে আগম বেএঁ বখানী।
কাহেরে কিস ভণি মই দিবি পিরিচ্ছা
উদক চান্দ জিম সাচ ন মিচ্ছা।।
(সরকার, ২০০১, ৯৯)।
অধ্যাপক সুকুমার সেন শ্লোকটির নিম্নরূপ অনুবাদ করেছেন :
যার রঙ চিহ্ন রূপ কেহ নাহি জানে
কিরূপে তাহারে বেদে শাস্ত্রেতে বাখানে।
জলেতে চাঁদের ছবি না মিথ্যা না সত্য।
(অনুবাদ : সুকুমার সেন, ১৯৭৮, ৫৮)
লুইপাদ বলছেন যে চূড়ান্ত সত্য ভগবান। তাঁর রং, রূপ, চিহ্ন নিয়ে আমরা কিছু জানি না, কাজেই বেদ বা শাস্ত্রের ভিত্তিতে ভগবানকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তেমনি বাস্তব জীবনে আমরা অনেক কিছু দেখি–যা না সত্য, না মিথ্যা। যেমন জলেতে চাঁদের ছবি। অবশ্যই জলের ভেতরে চাঁদ নেই। কেউ যদি বলে যে জলের ভেতর চাঁদ রয়েছে তবে সে মিথ্যা বলছে। অথচ জলের ওপর চাঁদের প্রতিবিম্বও সত্য। এ ধরনের অনেক ক্ষেত্রেই সত্য আর মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করা সম্ভব নয়। কাজেই ভেগোলজির অস্পষ্টতা মুনাফেকি নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে বাস্তব।
শুধু দার্শনিক কারণে নয়, বাঙালি চরিত্রেই অস্পষ্টতার দিকে ঝোঁক রয়েছে। মধ্যযুগের পুঁথিকাররা লিখেছেন, ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, একুনে শুমার হইল চল্লিশ হাজার’। এখানে কবি লাখ আর হাজারের তফাতই বোঝেন না। তাই বক্তব্যের অসামঞ্জস্যতা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই।
ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে অজ্ঞানতা হচ্ছে ভেগোলজির একটি বড় কারণ। কোথাও কোথাও এই অজ্ঞানতা স্পষ্ট (যেমন পুঁথিতে লাখের সঙ্গে হাজার গুলিয়ে ফেলা)। আবার কোথাও কোথাও ভেগোলজি অজ্ঞতাকে ঢেকে দেয়। এ ধরনের ভেগোলজির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হিং টিং ছট’ কবিতায়। গৌড়ীয় পণ্ডিত হিং টিং ছট শব্দগুলির নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দেন :
…নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিষ্কার–
বহু পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার।
ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদে দ্বিগুণ বিগুণ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বৰ্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট,
সংক্ষেপে বলিতে গেলে–হিং টিং ছট্।
এখানে পণ্ডিত হিং টিং ছটের তাৎপর্য জানেন না। তার অজ্ঞতাকে পাণ্ডিত্যের আড়ালে ঢাকার জন্য অর্থপূর্ণ শব্দ এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে মনে হবে তিনি অনেক কিছু বলছেন। পণ্ডিতদের এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে পরিমল রায়ও লিখেছেন। এক পণ্ডিতকে প্রশ্ন করা হলো, গ্রিক কালচার আর ইন্ডিয়ান কালচারের মধ্যে তফাতটা কী? পণ্ডিত বোর্ডে দুটি লাইন টেনে বললেন যে ধরা যাক, এই লাইনটি গ্রিক কালচার আর অপর লাইনটি ইন্ডিয়ান কালচার। এবার তিনি জবাব দিলেন, ‘বেশ। এখন কথা হচ্ছে কী জানেন? গ্রিক কালচার অর্থাৎ এইটেতে এমন একটি বস্তু আছে, যা ইন্ডিয়ান কালচারে অর্থাৎ এইটেতে নেই। বুঝলেন কিনা। আবার ইন্ডিয়ান কালচারে অর্থাৎ এইটেতে এমন একটি জিনিস আছে যা গ্রিক কালচারে বা এইটেতে নেই।’
তবে ভেগোলজি শুধু পণ্ডিতদের ভাবমূর্তি রক্ষার ব্রহ্মাস্ত্র নয়। রাজনীতিবিদেরাও একে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু লোককে খুশি করা সহজ। উপরন্তু অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সম্ভব কি না, সে সম্বন্ধেও প্রশ্ন ওঠে না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অস্ত্র হচ্ছে যে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই তাঁরা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, সমস্যার সমাধান হচ্ছে বা হবে। হচ্ছে-হবের মানেই হচ্ছে আদতে কিছুই হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভেগোলজিকে বিদ্রূপ করে তাই অন্নদাশঙ্কর রায় ছড়া লিখেছেন :
সব পেয়েছির দেশে নয়
হচ্ছে হবের দেশে
কাঁঠাল গাছে আম ধরেছে
খাবে সবাই শেষে।
দুধের বাছা, কাঁদে কেন
হচ্ছে হবের দেশে
গোরুর বাটে মদ নেমেছে
খাবে সবাই হেসে।
হাত পা কেউ নাড়বে নাকো
হচ্ছে হবের দেশে।
ফাইল জমে পাহাড় হলে
প্ল্যানগুলো যায় ফেঁসে।
কারখানাতে ঝুলছে তালা
হচ্ছে হবের দেশে।
মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে
বক্তৃতা দেয় ঠেসে।
মনের কথা লুকিয়ে রাখে
হচ্ছে হবের দেশে
সবাই ভাবে পেয়ে যাবে।
সব কিছু অক্লেশে।
লক্ষ্মী সোনা ভয় পেয়ো না
হচ্ছে হবের দেশে
হাজারটা দল বাজায় মাদল
বিপ্লবীর বেশে।
রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা ভেগোলজির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। এ ধরনের বক্তৃতার একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন পরিমল রায়। বক্তৃতাটি নিম্নরূপ :
মানে আপনারা এদিক থেকে এই করতে থাকুন। আর আমরা ওদিক থেকে ওই করতে থাকি। আপনারা যদি এটুকু করেন, তাহলে আপনাদের কাছ থেকে আমাদের এতে একটি সত্যিকারের সাহায্য হবে। মানে, বাংলাদেশের যে অবস্থা, বুঝতে পেরেছেন। এখন যদি আমরা এটা না করি তাহলে মানে, এদের ব্যাপারটি তো বুঝতে পারছেন? এরা দেবে না। কিন্তু দেবে না বললেই তো আমরা এ করতে পারি না। আমাদের কেড়ে নিতে হবে।
এখানে বাক্য অনেক আছে, কিন্তু অর্থ কিছু নেই। দুষ্ট লোকেরা বলে যে এ ধরনের বক্তৃতা শুনেই রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন :
অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি ৷।
অনুমান করি, আলো-আঁধারি বক্তব্যের ছড়াছড়ির জন্যই বিভিন্ন দেশে রাজনীতিবিদদের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায় ।