ছয়
আবার সেই চাঁদের আলোর রাত।
রাতের ঘড়িতে সংখ্যা এক। আকাশ থেকে রুপোর তবক খসে-খসে পড়ছে। এমন প্রখর চাঁদের আলো যে, গাছের প্রতিটি পাতা গুনে নেওয়া যায়। দক্ষিণের বাতাস বইছে, বুঝি বসন্তকাল। কোকিলরা চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছে না। আকুল আবেগে বারেবারে ডেকে উঠছে।
পুবের আকাশে নতুন এক ছবি, দুধসাদা এক মন্দিরের চূড়া। সাদা একটি পতাকা ফনফন করে উড়ছে। সেই মন্দির, যে মন্দিরের স্বপ্ন বড়মামা দেখেছিলেন। মহাপ্রভু সেখানে শ্বেতপাথরের বেদিতে। ফুলের সাজে সেজে আছেন। মাস্টারমশাইয়ের আশ্রম তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে মহিলাবাস। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী এসে গেছেন। তিনি আবার মাস্টারমশাইয়ের দেখাশোনা করছেন।
আমাদের প্রত্যেকের বয়েস দু’বছর বেড়ে গেছে। হরিদার সব গোঁফ পেকে গেছে। মাসিমা নাকি চার-পাঁচটা পাকা চুল খুঁজে পেয়েছেন নিজের মাথায়। মেজোমামার ভুঁড়ি আরও দু’ইঞ্চি বেড়েছে। আমি আরও লম্বা হয়েছি।
সকলে একসঙ্গে বললেন, ‘পুব দিকে তাকালে মনে হচ্ছে স্বপ্ন। পতাকাটা যেন প্রেম-ভালোবাসার মতো উড়ছে। ঠিক মাথার ওপর সেই সাক্ষীতারাটা।’
বড়মামা বললেন, ‘তা হলে আমি বাকি গল্পটা বলি। আমাদের বেঁচে থাকার গল্প! আমাদের অপ্রকৃতিস্থ মা ওই ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছেন। একটা-একটা করে ইট তুলে আঁচলে রাখছেন আর বলছেন, ‘এক টাকা, দশ টাকা, কুড়ি টাকা, একশো টাকা।’ ছোট্ট ফ্রক পরা কুসি যতবার মা বলে কাছে যাচ্ছে, মা বলছেন, ‘খুকি রাত হয়েছে বাড়ি যাও, রামছাগলে গুঁতিয়ে দেবে।’ কুসি কাঁদতে-কাঁদতে ছুটে আসছে আমার কাছে, ‘দাদা, মা কেন আমাকে চিনতে পারছে না!’ মেজোর টনসিলের ধাত, নাগাড়ে কেশে যাচ্ছে। কেউ নেই। ওই অতটুকু মেয়ে আমাকে রান্নায় সাহায্য করছে। অতীতের সেই দৃশ্য চোখ বুজলেই দেখতে পাই। বুকের কাছে কাঠকুটো ধরে এগিয়ে আসছে। দু’হাতে বালতি নিয়ে আসছে হেঁইসো-হেঁইসো করে। নিজেই নিজের চুল বাঁধছে। আমাকে জিগ্যেস করছে, ‘দাদা, তুমি বিনুনি করতে পারো!’
‘এই দুর্দিনে এলেন হরিদা। দাদা বলি, কিন্তু হরিদা আমার বাবা। আজ আমি যা হয়েছি তা ওই মানুষটির জন্যে। আমাদের সংসার চালাবার জন্যে, আমাদের লেখাপড়া শেখাবার জন্যে হরিদা জুটমিলে চাকরি করেছেন। হরিদা আমাদের মাকে চোখে-চোখে রেখেছেন, বাড়ি থেকে যাতে ছিটকে বেরিয়ে না যান। হরিদা আমাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্যে মাসের পর মাস কোর্ট-কাছারি করছেন। শেষে যা হল, সে এক অলৌকিক ব্যাপার। কে একজন জোর করে হরিদাকে একটা লটারির টিকিট গছিয়েছিল, সেই টিকিটে লেগে গেল ফার্স্ট প্রাইজ। আমার, মেজোর, কুসির লেখাপড়ার খরচ ওই টাকা থেকেই হল।’
‘আর মায়ের মৃত্যু! সে তো ভোলার নয়! মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। যেন দীর্ঘ একটা ঘুমের পর জেগে উঠলেন। বলতে লাগলেন, ‘ওমা! তোরা কবে এত বড় হলি! এই বুঝি কুসি, তোকে কত ছোট দেখেছি।’ মা আবার সংসারটাকে সাজিয়ে তুললেন। মায়ের হাতের বিখ্যাত রান্না খেয়ে আমরা মোটা হতে লাগলুম। কী আনন্দ! হঠাৎ পায়ে একটা পেরেক ফুটল। আমাদের কাউকে জানতে দিলেন না। টিটেনাসে মৃত্যু হল। আমরা ভাবছি হিস্টিরিয়া, একমাত্র হরিদাই ঠিক ধরেছিলেন ডাক্তার না হয়েও। নতুন করে শুরু করতে গিয়ে মা শেষ হয়ে গেলেন। শ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস, এই আমাদের জীবন। বুঝলি মেজো, ডাক্তার হওয়ার ফলে জীবনটাকে আচ্ছাসে দেখা গেল।’
‘তুমি তো সাধক দাদা!’
‘তুই একদিন আমাকে শয়তান বলেছিলিস।’
‘তুমি আমাকে একদিন পাঁঠা বলেছিলে।’
‘তুমি তার আগে আমাকে উড়নচণ্ডে বলেছিলে।’
মাসিমা এইবার হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘স্টপ, স্টপ আই সে।’
বড়মামা বললেন, ‘কেন এমন করলুম জানিস, মাকে ভুলব বলে। দৃশ্যটা যে চোখের সামনে ভাসছে। পরের দিন রেজাল্ট বেরলো। ডাক্তার হয়েছি আমি। ডাক্তার! শ্মশানচিতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে এলাম, জানো মা, তোমার সব দুঃখের অবসান করব বলে, রাত জেগে, রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বেলে এই এতটা পথ এলাম, তুমি খাঁচা খুলে উড়ে গেলে। তোমার মুখটা কত সুন্দর ছিল, তোমার দু’চোখে কত স্নেহ ছিল, তোমার দু’হাতে কত সেবা ছিল, তোমার মনে কত ত্যাগ ছিল, তোমার হৃদয়ে কত বড় একটা আকাশ ছিল, তুমি ছাই হয়ে গেলে!’
‘স্টপ, স্টপ আই সে।’
‘সেদিনও ছিল এমনই চাঁদের আলোর রাত। কেউ ছিল না শ্মশানে। কুসি, তোর মুখটা ঠিক আমার মায়ের মতো।’
‘দাদা’—মাসিমা বড়মামার কোলে মুখ গুঁজলেন। মেজোমামা ধীরে ধীরে হাত রাখলেন মাসিমার পিঠে। সেদিনের সেই প্লেনটা উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে আলোর পিচকিরি ছুড়তে-ছুড়তে। সেই প্যাঁচা আমগাছের ডালে।
মাসিমা বড়মামার কোলে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন। চাঁদের অলোয় সাদা ব্লাউজ-পরা পিঠটা যেন দুধের মতো সাদা! ঘাড়ের কাছে আলগা খোঁপা। পিঠের ওপর পড়ে আছে তিনটে হাত, দুটো বড়মামার, একটা মেজোমামার। প্রশ্ন জাগছে, মানুষের অতীতটা কি লিকুইড, শুধু জল? হাসি আর আনন্দের পাউডার বলে কিছু নেই। থাকবে কী করে! নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। পৃথিবীর তিনভাগই যে জল। বড়মামার বড়-বড় চোখ থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল মাসিমার পিঠে পড়ছে।
মাস্টারমশাই সেদিন হ্যাপি প্রিন্সের কথা বলছিলেন। সারাদিন ওড়াওড়ির পর ক্লান্ত সোয়ালো সোনায় মোড়ায় প্রিন্সের মূর্তির দু’পায়ের ফাঁকে আশ্রয় নিয়ে ভাবছে, আই হ্যাভ এ গোল্ডেন বেডরুম। সোয়ালো ডানার তলায় তার ছোট্ট মাথাটা গুঁজে সবে ঘুমোতে যাবে, পিঠের ওপর বড় একফোঁটা জল পড়ল। আকাশে একটুকরো মেঘ নেই, বড়-বড় তারা, উজ্জ্বল একটি রাত, তাও বৃষ্টি। উত্তর ইউরোপের আবহাওয়া প্রকৃতই ভয়ঙ্কর।
আবার একফোঁটা জল।
সোয়ালো ভাবছে, দুর ঘোড়ার ডিম, এই মূর্তির কী দরকার, সে একটা ছোট্ট পাখিকে বৃষ্টির আশ্রয় দিতে পারে না। এর চেয়ে বরং একটা চিমনি ভালো। যাই, আবার উড়ি।
ডানা মেলার আগেই আবার একফোঁটা জল। সোয়ালো তখন ওপর দিকে তাকাল, এ কী দেখছি! দ্য আইজ অব দ্য হ্যাপি প্রিন্স ওয়্যার ফিল্ড উইথ টিয়ারস, অ্যান্ড টিয়ারস ওয়্যার রানিং ডাউন হিজ গোল্ডেন চিকস। হিজ ফেস ওয়াজ সো বিউটিফুল ইন দ্য মুনলাইট!
আমার বড়মামা যেন হ্যাপি প্রিন্স। সেই মূর্তির মতোই তিনি দেখতে পাচ্ছেন—অল দ্য আগলিনেস, অ্যাণ্ড অল দ্য মিজারি অব মাই সিটি।
পুব দিকের আলসের কাছে আমরা গিয়ে দাঁড়ালুম পাশাপাশি। চাঁদের সমুদ্রে ভাসছে নতুন মন্দিরের চূড়া। হাঁসের ডানার মতো পতপত করছে পতাকা। একটি তারা তাকিয়ে আছে নীচের দিকে। দুধসাদা মন্দির-চূড়া।
আমি বললুম, ‘বড়মামা, আপনার মন্দিরের চূড়াটা কী ফ্যানটাসটিক দেখাচ্ছে!’
বড়মামা বললেন, ‘আমার মন্দির কী রে! বল, মানুষের মন্দির; বল, দুঃখ নয় সুখ; বল, ঘৃণা নয়, প্রেম; বল, মৃত্যু নয়, জীবন; বল, অশান্তি নয়, শান্তি; বল, আমরা মানুষ।’
শঙ্খ-ঘণ্টার শব্দ। সে কী! মঙ্গল আরতি শুরু হল বড়মামার মানবমন্দিরে। রাত তা হলে ভোর হল! মাস্টারমশাই মহামানবের ঘুম ভাঙাচ্ছেন!
একটু আগে আমরা কেঁদেছি
এখন আমাদের মুখে হাসি
মানুষের দুটো পা
সুখ আর দুঃখ!
এইরকম কিছু মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বড়মামা বললেন, ‘রাতের রহস্য যদিও-বা জানা যায়, মানুষের জীবনের রহস্য কোনওদিনই জানা যাবে না।’
মেজোমামা বললেন, ‘স্টিফেন হকিং প্রায় একই রকম বলেছেন, যে নিয়মে প্রকৃতি বাঁধা তা বোঝা হয়তো কঠিন নয়, কিন্তু মানুষের সমাজের নিয়মকানুন চির দুর্বোধ্য।’
‘তার মানে তুই বলতে চাইছিস আমি হকিং থেকে মেরেছি?’
‘এর মানে কি তাই হল?’
‘হ্যাঁ, হল।’
‘আচ্ছা কুচুটে তো!’
‘তুমি ভারি সরল!’
‘তোর মতো কুটিল নই!’
মাসিমা শাসন করলে, ‘স্টপ, স্টপ আই সে। তোমাদের স্বভাব জীবনে পালটাবে না।’
দুই মামা হাসতে-হাসতে সমস্বরে বললেন, ‘সাপে আর নেউলে, ম্যাডাম!’
মন্দিরে শুরু হয়েছে নাম-সঙ্কীর্তন।