» » » সাপে আর নেউলে

বর্ণাকার

তিন

আকাশে আলোর ডানা। সত্যিই ডানা। রাজহাঁসের পালকের মতো শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিখুঁত একটু মেঘ। যেন মা-সরস্বতী তাঁর হাতের কলমটি সুপ্রভাত লিখে ভাসিয়ে দিয়েছেন পুব আকাশে! ধারে-ধারে লাল রং! তিনি আসছেন নতুন একটি দিনের ঘোষণাপত্র হাতে নিয়ে।

বড়মামা হাঁক পাড়লেন, ‘হরিদা।’ সঙ্গে-সঙ্গে জাহিরুলদের বাড়ির মুরগি ডেকে উঠল, কোঁকোর কোঁ। ওদিকে সিদ্ধেশ্বরীতলায় মঙ্গলারতি শুরু হয়ে গেল। শুকতারা আকাশের গায়ে অস্পষ্ট একটা টিপ।

হরিদা আমাদের ম্যানেজার কাম অভিভাবক কাম সব কিছু। ত্রিভুবনে নেই কেউ। এই বাড়িকেই নিজের বাড়ি করে নিয়েছেন। আমরাই তাঁর সব। তবে শোনা যায়, হরিদা খুব বড় পরিবারের মানুষ। বিরাট জমিদার ফ্যামিলির ছেলে। বিষয়-সম্পত্তির লোভে হরিদার বাবাকে বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছিল। হরিদার মাকে সাপে কামড়েছিল, সেও এক সমাধানহীন রহস্য। হরিদা সেই শৈশবেই এক সাঁওতাল পরিবারের আশ্রিত হয়েছিলেন। জঙ্গলে মানুষ। সেই পালকপিতা ছিলেন এক সেরা গুণিন। হরিদা তাঁর কাছ থেকে অনেক বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন। ঘড়ি ছাড়াই বলতে পারেন ঠিক-ঠিক ক’টা বেজেছে। কাক কী বলছে তিনি বোঝেন। এক মুঠো ধুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে দিতে পারেন দিনটা কেমন যাবে। মুখ দেখে বলে দিতে পারেন শরীরের কোথায় গোলযোগ। আরও, আরও অনেক কিছু। পরিষ্কার একটা ধুতি মালকোঁচা মেরে পরেন। পায়ে হাফশার্ট। অঙ্কে ভীষণ পাকা। শিবঠাকুরের পরম ভক্ত। কত বয়েস, তবু ভীষণ ফিট। ওষুধ হল গাছপাতা, শিকড়বাকড়। সংস্কৃত স্তোত্র যখন সুরে আবৃত্তি করেন, বাড়িটা ঋষির আশ্রম হয়ে যায়। খুব ভালো রাঁধতে পারেন। হরিদা সকলের দাদা, পরামর্শদাতা। গরিবের চিকিৎসক। চিকিৎসায় অসুখ অবশ্যই সারে। বড়মামা হরিদাকে স্পেশ্যাল এটা ঘর তৈরি করিয়ে দিয়েছেন। গান শুনতে ভালেবাসেন বলে একটা মিউজিক সিস্টেম কিনে দিয়েছেন।

হরিদা এসে দাঁড়ালেন। এরই মধ্যে চানটান করে টিপটপ। এইটাই তাঁর অভ্যাস। পুকুরের জলে আলো যেই ফুটল, শালুকের পাপড়ি যেই খুলল, যেই ফুটল টগর, মাথায় ফুল দিয়ে হরিদা ডুব দেবেন জলে, ফুলগুলো সব ভেসে-ভেসে চলে যাবে জলের আন্দোলনে। একটা-একটা করে হাঁস ভারিক্কি চালে জলে নামবে। মন্দিরের ত্রিশূলে বসে দোয়েল ধরবে তান। হরিদা উদাত্ত গলায় পাঠ করবেন গায়ত্রীমন্ত্র। এই সময়টাকেই বলে ব্রাহ্ম মুহূর্ত।

বড়মামা বললেন, ‘দাদা, রাতটা কাল ছাতেই কাটল, এইবার বারান্দায় বসে একটু চা সেবন।’

‘সব রেডি, নামলেই হয়।’

আমরা খুব দুঃখ-দুঃখ মুখে আকাশের দিকে তাকালাম। রাতের রহস্য-উপন্যাস যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য ক্ষণকাল পুবদিগন্তে অবস্থান করে চড়চড় করে মধ্যগগনে উঠে পড়বে আগুনের গোলার মতো। সবকিছু এত স্পষ্ট হবে, উত্তাপ এত অসহ্য হবে যে, ভালো লাগবে না। নিজেকে মনে হবে জোয়াল পরানো বলদ।

সাবিত্রীদি আমাদের বাড়িতে সর্বক্ষণ থাকেন। তাঁর জীবন সবচেয়ে দুঃখের, তাই তিনি সবচেয়ে আনন্দে থাকেন। সদাই যেন নাচছেন। চকচকে মুখে সবসময় ঝকঝকে হাসি। বড়মামা পাটনা স্টেশন থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। মাসিমার ট্রেনিং-এ একেবারে চোস্ত। নাচকে ভালোবাসেন বসে মাসিমা নাচ শেখাচ্ছেন। পাড়ার লোকদের খুব হিংসে। তারা বলে, পাঁচিলের এপারে নিজেদের জগতে সব বেশ আছে। ক’দিনে থাকবে রে বাপ! চিরদিন কি সমান যায়। পতন একদিন হবেই হবে। কারও ক্ষমতা নেই ঠেকায়। মাসিমাকে সবাই মেমসায়েব বলে ব্যঙ্গ করে। বলে, ‘মেমসায়েব যেন ইউরোপ আমেরিকা তৈরি করে ফিরিঙ্গিনি সেজেছে।’

বিশাল ট্রেতে সাজানো কাপ, টিপট বাহারি, এক প্লেট বিস্কিট। মার্বেল পাথরের টেবিলে নামিয়ে রেখে সাবিত্রীদি বললেন, ‘গুড মর্নিং।’

আমরা সমস্বরে বললাম, ‘মর্নিং।’

সাবিত্রীদি পদ্মের ডাঁটার মতো দীর্ঘ হাত দুটো জড়ানো সাপের ভঙ্গিতে ওপর দিকে তুলে নমস্কার করলেন পুব আকাশের সূর্যকে। অপূর্ব ভঙ্গি। ‘হ্যাভ টি’, বলে চলে গেলেন। দিনটাকে ভালো করে শুরু করতে হয়। তারপর যা হয় হোক। এই সেই শুরু।

হরিদা বললেন, ‘ঝট করে মুখ ধুয়ে এসো। বাসী মুখে চা আমি অ্যালাউ করব না।’

ভিজে-ভিজে মুখে আমরা ফিরে এসে যে যার জায়গায় বসলুম। গভীর বারান্দা। সাবেক আমলের জাফরি। তরুণ তপনের কিরণ বিরীত দেওয়ালে নকশা এঁকেছে। সার-সার অর্কিডের টব। সামনের গাবগাছে সাদা একটা বক বসে-বসে প্ল্যান করছে, কোন পুকুরে যাবে আজ। হরিদা কাপে-কাপে চা ঢালছেন। মাসিমা রোজই বলেন, আমি ঢালি। আজও বললেন। হরিদার সেই একই উত্তর, ‘যেদিন আমার হাত কাঁপবে।’ বড়মামার তিনটে কাক, আমরা বলি কাকত্রয়ী, ঠিক এসে গেছে। বড়মামার হাত থেকে তিনজনে তিনখানা বিস্কুট ঠোঁটে নিয়ে সাট-সাট উড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে সেই পরিচিত কাশির শব্দ। নেপালবাবু। প্রবীণ শিক্ষক। কেউ কোথাও নেই। ভাঙা একটা বাড়িতে থাকেন। ছেলেরা বিরাট চাকুরে, প্রবাসী। বৃদ্ধ একা কমা দিয়ে যাচ্ছেন, একদিন ফুলস্টপ বসিয়ে দেবেন। কষ্ট দেখে বড়মামা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব এখানে। ‘মর্নিং টি’-র জন্য আসছেন। সাবিত্রীদি ম্যানেজ করবেন। ইংরেজির নামকরা শিক্ষক। সাবিত্রীদির সঙ্গে একটা কথাও বাংলায় হবে না। দু’পক্ষই ইংরেজি চালাবেন। ভুল বললেন মাস্টারমশাই শুধরে দেবেন। রাতের খাবার আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। নোনাধরা ভাঙা বাড়ির দোতলায় বড় একটা লাইব্রেরি আছে। ভালো-ভালো বই। আমুণ্ডসেনের আন্টার্কটিকা অভিযান। এভারেস্ট অভিযান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। ডেভিড লিভিংস্টোনের ডার্কেস্ট আফ্রিকা। ভলক্যানো। কত কী? বলেছেন, ‘খোকা! তুই এত সেবা করিস, তোকে সব দিয়ে যাব। জীবনে লেখাপড়ার চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।’

বড়মামা বললেন, ‘এইবার তা হলে সেইটা। ওয়াণ্ডার অব ওয়াণ্ডার্স।’

বড়মামা বারান্দার একেবারে শেষ ঘরটায় চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে সেইঘর থেকে আদেশ এল, ‘ক্লোজ ইওর আইজ।’

আমরা চোখ বোজালাম। পায়ের শব্দে বুঝতে পারছি বড়মামা আসছেন। শ্বেতপাথরের টেবিলের কাছে এসে গেছেন। কিছু একটা রাখার শব্দ হল।

‘ওপেন ইওর আইজ।’

এ কী! এমন জিনিস জীবনে দেখিনি। ছোট-ছোট সমান মাপের হাড় দিয়ে তৈরি একটা বেল্ট। প্রতিটি হাড়ের মাঝখানে একটা করে ঝকঝকে লাল পাথর বসানো। বকলসটা ড্রাগনের মুখ। সেখানে সমান দূরত্বে ছোট-ছোট নীল পাথর।

বড়মামা বললেন, ‘লালগুলো সব বহুমূল্য রুবি, আর নীলগুলো নীলা।’

আমরা সবাই ভয়ে-ভয়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লুম। এমন অপূর্ব জিনিস অতীতে দেখিনি কখনও। ভবিষ্যতেও দেখব বলে মনে হয় না। মন মনে-মনেই বলছে, কী সুন্দর, কী সুন্দর! স্পর্শ করার সাহস হচ্ছে না। ভয় এবং ঘেন্না। কিসের হাড় কে জানে!

হরিদা ভালো করে দেখে, সোজা হয়ে বললেন, ‘আমার সামান্য জ্ঞান থেকে যা মনে হচ্ছে, এটা চিন দেশের।’

মেজোমামা বললেন, ‘এটা তো ওই ড্রাগনটা দেখলেই বোঝা যায়।’

হরিদা বললেন, ‘এই ব্যাপারে আমার আরও একটু লেখাপড়া করা আছে। এটা শাং ডাইন্যাস্টির জিনিস। তোমরা যে যার জায়গায় বসে পড়ো, আমি ঝট করে তোমাদের মতো জ্ঞানীদের একটু জ্ঞান দিয়ে যাই। জিনিসটা আমি বিলক্ষণ চিনতে পেরেছি। বেশি না, তোমাদের হাজার ছয়েক বছর পেছোতে হবে। তবে আরও দু’হাজার বছর এগিয়ে এসে চার হাজার বছর থেকেই শুরু করব।’

বড়মামা বললেন, ‘পিপাসা।’

মেজোমামা বললেন, ‘হ্যাং ইওর পিপাসা। এখন একমাত্র পিপাসা হল জ্ঞানের পিপাসা। থার্স্ট ফর নলেজ।’

বড়মামা বললেন, ‘তা হলে চা এখন থাক।’

মেজোমামা বললেন, ‘চা! আরে চা তো লিকুইড নলেজ। সৃষ্টির কাজ শেষ করে হাত ধুতে-ধুতে ভগবান বললেন, ‘নাও, আই উইল সেটল ফর এ কাপ অব টি। ইংরেজ শুনল টি, বাঙালি শুনল চা, হিন্দুস্থানিরা শুনল চায়ে।’

মাসিমা বললেন, ‘তা হলে ঢালি।’

হরিদা বললেন, ‘আমি একটু খাব।’

মেজোমামা কারেকশান করলেন, ‘পান করব।’

কুলকুল করে সোনালি রঙের চা ঝরনাধারায় নামতে লাগল স্বচ্ছ সুন্দর কাপে। আর তখনই সাবিত্রীদি নীচে থেকে বলল, ‘বড়দা, মাস্টারমশাই ওয়ান্টস টু সি ইউ।’

বড়মামা তাড়াতাড়ি বাস্কেটে জিনিসটা ভরতে-ভরতে বললেন, ‘দয়া করে ওপরে আসবেন।’

মাস্টারমশাই আসছেন। পায়ের শব্দ। ধীরে-ধীরে উঠছেন। চুড়ির শব্দ। তার মানে সাবিত্রীদি ধরে-ধরে আনছেন। শার্লক হোমস হতে আর বিলম্ব নাই! আমরা সবাই ভালোমানুষের মতো মুখ করে বসে আছি। মাস্টারমশাই প্রায় ছ’ফুট লম্বা। সামনে সামান্য ঝুঁকে আছেন। একমাথা পাকা চুল। টকটকে ফরসা। বনেদি ঘরের মানুষ।

চেয়ারে বসে দু’কদম কাশলেন। ভালো করে সকলকে দেখে নিলেন একবার, ‘যাক তোমরা সকলে ভালো আছো দেখে ভালোই লাগছে। সৎচিন্তায় মানুষ ভালোই থাকে। শোনো ডাক্তার, আমি একটা কাজের কথা বলি। আমাদের ঠাকুরদালানটা তুমি দেখেছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘বাড়িটা আমি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুটো প্লট করে, একটা বেচে দেব, আর সেই টাকায় নিজের জন্যে ছোট্ট একটা বাংলো তৈরি করব।’

‘সুন্দর সিদ্ধান্ত। যতদিন না বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, ততদিন আপনি আমাদের সম্মানিত গেস্ট।’

মাস্টারমশাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। ছানিপড়া বড়-বড় চোখ দুটো জল-টলটলে হচ্ছে। আবেগে শরীর কাঁপছে।

আবেগটা কেটে যেতেই গলা পরিষ্কার করে মাস্টারমশাই বললেন, ‘তোমরা ভালো, তোমরা যে এত ভালো তা জানতাম না। তোমরা ভিন্নগ্রহের মানুষ। মনে আছে ডাক্তার, তোমাদের আমি অস্কার ওয়াইল্ডের ‘হ্যাপি প্রিন্স’ পড়াতাম। মনে পড়ে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই পড়ানো কি ভোলা যায়!’

‘সোয়ালো, সোয়ালো, আমি দেখতে পাচ্ছি, দূরে, বহু দূরে গরিবের একটি কুটির। One of the windows is open, and through it I can see has a woman seated at a table. Her face is thin and worm, and she a coarse, radhands, all pricked by the needle far she is a Seamstren. রানির প্রধান পরিচারিকার নাচের পোশাকে এমব্রয়ডারি করছে। খাবার নেই, আগুন নেই, ছেলেটা খিদেয় কাঁদছে। সোয়ালো, তুমি আমার তলোয়ারের হাতলে যে বহুমূল্য রুবিটা রয়েছে সেইটা খুলে ওকে দিয়ে এসো। কিছুদিন তবু চলবে। এইভাবে সোয়ালোকে দিয়ে প্রিন্স তার সবকিছু দান করে দিল গরিবদের। সোনার আস্তরণ, চোখের মণি। মেয়র একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন সোনার মূর্তি সিসের হয়ে গেছে। পায়ের তলায় মরে পড়ে আছে ছোট্ট সোয়ালো। মূর্তি উৎপাটিত। আগুনে দেওয়া হল ধাতুটাকে উদ্ধার করে নেওয়ার জন্যে। সব গলে গেল, গলল না তার হৃদয়টি। মনে পড়ে সেই শেষ লাইন ক’টা।

Bring me the two most precious things in the city–said the God to one of His Angels; and the Angel brought Him the leader heart and the dead bird.

You have rightly chosen—said God,—far in my garden of Paradise this little bird shall sing for evermore, and in my city of Gold the Happy Prince shall praise me.

‘ডাক্তার, তোমার হৃদয়টা ওই প্রিন্সের হৃদয়।’

‘মাস্টারমশাই, আপনার সব মুখস্থ।’

‘ভালো যা কিছু সব আমি স্মৃতিতে ধরে রাখি। শোনো ডাক্তার, আমি আশ্রয়ের জন্যে আসিনি। আমি এসেছি তোমাকে কিছু দিতে, যদি অনুগ্রহ করে নাও।’

‘কী জিনিস মাস্টারমশাই!’

‘ঠাকুরদালানের বিরাট মেঝেটা ইটালিয়ান মার্বেল পাথরের। দু’রকমের, সাদা আর কালো। তাঁদের পয়সা ছিল। তুমি ওই পাথরগুলো সব নিয়ে এসো তোমার লোক দিয়ে।’

‘কত দাম হবে মাস্টারমশাই?’

‘এক পয়সাও না।’

বিস্ময়ে বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেল। এইবার তাঁর চোখে জল।

‘কাল থেকেই শুরু করিয়ে দাও।’

মাস্টারমশাই ধীরে-ধীরে, পা টেনে-টেনে চলে গেলেন।

বড়মামা অভিভূতের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! এইটাকে যখনই আমি বের করি, তখনই ভয়ঙ্কর রকমের ভালো একটা কিছু ঘটে। এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কুসি, কাল তোকে বলেছিলুম, এই বাড়িতে মার্বেল আসছেই আসছে।’

হরিদা বললেন, ‘ওটা এমন একটা অঞ্চলের জিনিস, যে অঞ্চলের মাটিতে জাদু আছে।’

বড়মামা বেতের চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললে, ‘বলুন বলুন, শুনি, আর বেশি সময় নেই। লাফিং ক্লাব হয়ে আমাকে চেম্বারে যেতে হবে।’

হরিদা শুরু করলেন, ‘চীন ভূখণ্ডের ঠিক মাঝখানের অঞ্চলটিকে এখন বলা হয় হেনান। চার হাজার বছর আগে নাম ছিল, য়ু ঝাও। পশ্চিম থেকে পুবে ঢালু একটি প্রদেশ। তিন দিকে পাহাড়, পশ্চিমে ঝিয়াও আর ফুনিউ পর্বতমালা, দক্ষিণে থংবো আর দাবিয়ে পাহাড়, আর উত্তরে তাইহান। আর পুব দিক দিয়ে ভীমবেগে ছুটে চলেছে চিনের বিখ্যাত হলুদ নদী হুয়াংহে, সঙ্গে দোসর হুয়েহে। এই হেনানেই থাকতেন সেই বিখ্যাত মানুষটি, চীনের রূপকথায় যাঁর নাম, দি ফুলিশ ওল্ড ম্যান।’

হরিদা চা খেলেন এক চুমুক, তারপর শুরু করলেন, ‘Long long ago there lived a foolish old man. বৃদ্ধের বাড়ির সামনে আকাশছোঁয়া দুটি পাহাড়, তাইহান আর ওয়াংয়ু। আকাশ আটকে দাঁড়িয়ে অছে। ও-পাশের কোনও কিছুই দেখা যায় না। বৃদ্ধ তার ছেলেদের ডেকে বললে, আয়, আমাকে একটু সাহায্য কর। পাহাড় দুটোকে এখান থেকে সরাব। শুরু হয়ে গেল খোঁড়া। গর্ত করে পাহাড় দুটোকে তুলে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে বোকা বুড়ো। দিনরাত তারা খুঁড়ছে আর খুঁড়ছে। মানুষ বলছে, দ্যাখো, বোকাটার কী বুদ্ধি! কিন্তু, স্বয়ং ভগবান যখন জানতে পারলেন, তখন একেবারে অভিভূত! মানুষটার কী জেদ, কী কঠিন তার সঙ্কল্প! ভগবান তাঁর দুই দেবদূতকে ডেকে বললেন, ‘যাও, পাহাড় দুটোকে একেবারে উত্তরে সরিয়ে দিয়ে এসো।’ রাতের অন্ধকারে দেবদূত দু’জন পাহাড় দুটো পিঠে নিয়ে উড়ে গেলেন উত্তরে। এই কাহিনী ছড়িয়ে গেল ঘরে-ঘরে। পরে, আধুনিককালে এর ব্যাখ্যা হল, ইচ্ছে থাকলে, উদ্যোগী হলে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। এই হুয়াংহে নদীতে আধুনিক চীন বাঁধ তৈরি করে। খরস্রোতা এই ত্রিধারার জলকে সেচের কাজে লাগিয়ে কী ফসলই না ফলাচ্ছে। এই হেনানের মাঝখানে আছে বিখ্যাত, পবিত্র পঞ্চ পাহাড়ের একটি—মাউন্ট সং। এই পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে আছে হাজার বছরের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সংগিয়াং। আর একেবারে পাদদেশে আছে সেই বিখ্যাত মন্দির, শাওলিন, যেখানে ক্যারাটে আর কুংফুর চর্চা হয়। শাং ডাইনাস্টিতে এইখানে স্থাপিত হয়েছিল দাস রাজ্য। হেনানের উত্তরে ছিল রাজধানী—জিন। পুরাতত্ত্ববিদরা ঝিয়াউটানে এক্সকাভেশন চালিয়ে সেই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন। দশ হাজারের মতো অপূর্ব-অপূর্ব সব শিল্পনিদর্শন উদ্ধার করা গেছে। বেরিয়েছে হাড়ের কাজ, কচ্ছপের খোল কেটে তৈরি শিল্পকর্ম। বেরিয়েছে প্রাচীনতম অক্ষরে কচ্ছপের খোলের ওপর লেখা পুঁথি। সেকালের মানুষের জ্যোতির্বিদ্যা, ক্যালেণ্ডার, আবহাওয়াতত্ত্ব এবং শিল্পচর্চার লিখিত ইতিহাস। ব্রোঞ্জের পাত্র বেরিয়েছে নানারকম আর পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জের তৈরি আটশো পঁচাত্তর কিলোগ্রাম ওজনের চার নৌকো, চার পায়াঅলা একটি ধূপদান বা ধুনুচি। অসাধারণ তার কারুকার্য। চারপাশে ড্রাগন। তোমার ওই হাড়ের বেল্টটা প্রায় চারহাজার বছরের প্রাচীন। শাং ডাইনাস্টির জিনিস। কচ্ছপের খোলা কেটে তৈরি। হয়তো কোনও রাজকুমারীর কোমরবন্ধনী। তোমার কাছে ওটা আছে কেউ যেন কোনওভাবেই জানতে না পারে। লন্ডনে সুদবির অকশনে নিয়ে গেলে কোটি টাকা দাম উঠবে। যারা ট্রেজার হান্টার তারা জানতে পারলে তোমাকে খুন করবে। ওই বেল্টে ম্যাজিক্যাল পাওয়ার, অকাল্ট, স্পিরিচুয়াল পাওয়ার, সবই থাকতে পারে। ওই জগতের কূলকিনারা নেই।’

বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেল ভয়ে। বললেন, ‘এইটা পাওয়ার পর থেকে আমাদের ভাগ্য ফিরেছে। এটাকে এখন কাছছাড়া করি কী করে!’

বড়মামা অসহায়ের মতো আমাদের মুখের দিকে তাকালেন।