চার
মোহনদার দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নামলাম। নামলাম বললে ভুল হবে। কারণ, সাইকেল থেকে আমি বেশ কায়দা করে নামতে পারি না। আমার সপাটে পতন হল। মোহনদার দোকানের নাম, প্রথম বিল্ডার্স। মোহনদা কাচের গেলাসে চা খাচ্ছিলেন। সাইকেল থেকে আমার নামার রকম দেখে জটায়ুর মতো হেসে উঠলেন। কয়েক মাস হল শিখেছি। ওঠা আর নামাটায় এখনও কিছু কাজ বাকি আছে। হরিদা বলেছেন, ও হতে-হতে হয়ে যাবে। কয়েকবার মোক্ষম ধরনের পতন না হলে সাইকেলকে ঠিক চেনা যায় না।
মোহনদার হাসি দেখে ভীষণ রাগ হল। রাগ-রাগ গলায় জিগ্যেস করলাম, ‘আলমদা কোথায়?’ রেগে গেছি বুঝতে পেরেছেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ‘ডাক্তারবাবুর সাইকেল?’
‘হ্যাঁ!’
‘তোমার বড়মামা যত বিদঘুটে জিনিস কেনেন। একটা কোম্পানি প্রথম এই মডেল বের করেছিল। বিরাট উঁচু। ছ’ফুট না হলে পা পাবে না। তোমার ছ’ফুট হতে আর কতটা বাকি?’
‘দু’ফুট।’
‘ও হয়ে যাবে। এই তো তোমার বাড়ের বয়েস, চড়চড়িয়ে বেড়ে যাবে। ওই তোমার আলম আসছে। শুনলাম তোমার বড়মামা পাহাড় কিনেছেন! এইবার একটা সমুদ্র কিনতে বলো।’
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত রেগে যাও কেন, তোমার মামারা কত বড়লোক ছিলেন, সে আমার ঠাকুরদার কাছে শুনেছি। তোমার দাদুর বিশাল বড় কাঠের ব্যবসা ছিল বার্মায়। নিজেদের একটা জাহাজও ছিল। যা-তা ভেবো না ভাগনে! এই গোটা গ্রামটাই তোমাদের ছিল। এত রেগে যাও কেন! তোমার সঙ্গে একটু মজা করব না তো কার সঙ্গে করব?’
আলমদাকে বললাম, ‘সাইকেলে উঠুন, বড়মামা তলব।’
‘কে উঠবে?’
‘আপনি।’
‘কোথায় উঠব?’
‘সিটে।’
‘তাই বলো। বড়মামা কোথায়?’
‘এই মুহূর্তে লাফিং ক্লাবে। সেইখানেই যেতে বলেছেন। ত্রাণনাথের মাঠে।’
‘পাগলের আখড়ায়!’ সাইকেল চালাতে-চালাতে আলমদা বললেন। আমি বসে আছি সামনের রডে। মাঠে ওরা খেটেখুটে খুব সুন্দর সবুজ ঘাস করেছে। ময়দানে যেমন ক্লাবটেন্ট আছে, সেইরকম একটা সুন্দর টেন্ট। একটা ফোল্ডিং টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার। চেয়ারে বড়মামা। সাদা ট্রাউজার, সাদা স্পোর্টস শার্ট। আমরা যখন গেলাম, তখন বড়মামা একজনকে প্রশ্ন করছেন, আমরা শুনেছি, ‘আপনি কতদিন হাসছেন?’
‘সাতদিন। আজ নিয়ে আট।’
‘কোনও উন্নতি!’
‘কী উন্নতি, তা তো বলেননি।’
‘হুঁ, ঠিক কথা। আচ্ছা, পাখির মতো হালকা লাগছে?’
‘পাখি কীরকম হালকা তা তো জানি না স্যার।’
‘স্যার নয়, দাদা, এটা সরকারি অফিস?’
‘আজ্ঞে না।’
‘আজ্ঞে বাদ।’
‘ইয়েস স্যার!’
‘স্যার বাদ স্যার।’
‘কোথায় কাজ করেন বলুন তো?’
‘রাইটার্সে স্যার।’
‘তুলোর মতো হালকা মনে হয় নিজেকে?’
‘না।’
‘শোলার মতো?’
‘না স্যার।’
‘থার্মোকলের মতো?’
‘নো স্যার।’
‘মাটির খালি কলসির মতো?’
‘না স্যার।’
‘তা হলে কতটা হালকা মনে হয়?’
‘সিমেন্টের বস্তার মতো।’
‘তা হলে উন্নতিটা কী হল?’
‘হল না স্যার!’
‘আচ্ছা অন্য বিভাগে যাই। হজম কেমন হচ্ছে?’
‘হচ্ছে না, খেতেই ইচ্ছে করে না।’
‘মোটা হচ্ছেন কী করে?’
‘পিতামাতার কৃপায়। একজন ছিলেন পর্বত, আর একজন পার্বতী।’
‘ক’ গেলাস জল খান?’
‘ঢুক-ঢুক খাই, ক’ গেলাস হয় বলতে পারব না।’
‘ঘুম?’
‘ভীষণ। পড়লুম কি মরলুম।’
‘রাগ?’
‘ভীষণ! মনে হয় সব ব্যাটাকে পেটাই।’
‘গুনগুন করে সব সময় গান গাইতে ইচ্ছে করে?’
‘না, গালাগাল দিতে ইচ্ছে করে।’
‘কাকে?’
‘আমার বাড়িঅলাকে।’
‘পৃথিবীকে সুন্দর মনে হচ্ছে?’
‘নরক।’
‘বাঁচার ইচ্ছে বাড়ছে?’
‘বাতের যন্ত্রণায় মরে গেলাম।’
‘আপনাকে কোন ধরনের হাসি দেওয়া হয়েছে, হিহি, হাহা, হোহো, কোনটা?’
‘হিহি তো মেয়েদের স্যার। আমার পাঁচ রাউন্ড হাহা, তিন রাউন্ড হোহো।’
‘আমি লিখে দিচ্ছি, ওর সঙ্গে পাঁচ রাউন্ড খ্যাখ্যা যোগ হবে।’
‘একটু দেখিয়ে দেবেন না স্যার!’
‘পঞ্চানন।’
বড়মামা আমাদের ইশারায় দাঁড়াতে বলেছিলেন। এতক্ষণের কাণ্ড দেখে আলমদা অনবরত হাসছিলেন। বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘হাসছ কেন?’
আলমদা বললেন, ‘হাসির ক্লাবে হাসব না!’
‘ঠিকই তো।’
বড়মামা মাঠে নামলেন। আমরা পেছনে। একজনকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বড়মামা প্রশ্ন করলেন, ‘হাসছ না কেন? হাসছ না কেন?’
তিনি বললেন, ‘হাসা উচিত নয়।’
বড়মামা বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে, প্রায় ধমকে উঠলেন, ‘হাসা উচিত নয় কেন?’
‘কাল আমার শ্বশুরমশাই মারা গেছেন।’
বড়মামা হনহন করে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, ‘আর পাঁচ মিনিট, কাতুকুতু সেকশনটা দেখলেই কাজ শেষ।’
ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমাদের অনেক বিভাগ দেখা হল, কাতুকুতু, গড়াগড়ি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে, দেঁতো হাসি, হাসি কাশি। হাসি কাশি হল, যাঁরা হাসতে-হাসতে কাশিতে চলে যান, তারপর জল, পাখা, বুকে মালিশ।
বড়মামা মাঠের একপাশে এসে আলমসাহেবকে বললেন, ‘তোমার ফুলটিম নিয়ে আজই চলে যাও মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। ঠাকুর দালানের সমস্ত পাথর সাবধানে একটাও না ভেঙে তুলে ফেলো। আমাকে দান করেছেন।’
‘ও তো খুব দামী পাথর!’
‘জানি। রাজভবনে আছে।’
ওপাশে পরিচালক তখনই হাঁকলেন, ‘স্টার্ট, হাহা, ওয়ান, টু, থ্রি!’
সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে গেল, ‘হাহা, হাঃ হা, হাহা।’
আমরা পালিয়ে বাঁচলাম। ওদিকে নারীবিভাগে হিহি। ডানপাশে একটা ব্যানারে লেখা রয়েছে স্লোগান, লাফ ফর লাইফ, লাফ ফর হেলথ, লাফ ফর ওয়েলথ, লাফটার দি বেস্ট মেডিসিন।’