» » » সাপে আর নেউলে

বর্ণাকার

দুই

গভীর রাতে কী একটা কারণে ঘুম ভেঙে গেল। একটা ঘরে দুটো আলাদা খাটে আমি আর বড়মামা ঘুমোই। দেখি, বড়মামার খাটটা খালি। এত রাতে ভদ্রলোক গেলেন কোথায়! দেখা দরকার। দরজা ভেজানো ছিল। খুলে বাইরে ছাতে এলুম। অল্প চাঁদের আলোয় চারপাশে ওড়ানা টানা। আগে আমার খুব ভূতের ভয় ছিল। নাইন থেকে টেনে ওঠার পর ভয় চলে গেছে। এখন আমি একা একটা পোড়াবাড়িতে থাকতে পারি। ভূত বাঘ নয়, সাপ নয়, বিছে নয়। ভূত কামড়ায় না, আঁচড়ায় না, কেবল একটু ভয় দেখায়। ভয় না পেলেই হল। চেহারার কোনও ছিরিছাঁদ নেই, কঙ্কালসার। সে আর কী করা যাবে।

যেদিকটায় বাগান, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল কদম, কৃষ্ণচূড়ার একাকার কাণ্ড, ছাতের সেই দিকটায় বড়মামা চুপ করে বসে আছেন। একটা উল্কা জ্বলতে-জ্বলতে দক্ষিণ থেকে পশ্চিম আকাশের দিকে সাঁই-সাঁই করে চলে গেল। স্কুলে আমরা এর নাম রেখেছি ‘তারকার আত্মহত্যা’। বড়মামা আমার দিকে পেছন ফিরে বসে আছেন। আমি যেই কাঁধে হাত রেখেছি, শিউরে উঠলেন। ভয়ে কাঠ। আমাকে ভূত ভেবেছেন। মৃদু স্বরে বলছেন, ‘রাম, রাম।’

আমি ধীরে ডাকলাম, ‘বড়মামা।’

আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘তুই?’

‘এত রাতে একা-একা তুমি এখানে কী করছ?’

‘সত্য খুঁজছি।’

‘সত্য আবার কী?’

‘বোস এইখানে। রাতের বেলা ঘুমোস কেন? ঘুমিয়ে জীবনটাকে নষ্ট করলি। জেগে থাকলে কত কী জানতে পারা যায়! কত কী দেখা যায়! জানিস তো, পাখিদের মধ্যে একমাত্র প্যাঁচাকেই বলে জ্ঞানী, ওয়াইজ আউল। কারণ, পৃথিবীর সবাই যখন ঘুমোয় তখন প্যাঁচা জেগে থাকে, রাতের চৌকিদার। এই তো একটু আগে আমগাছের এই ডালটায় বসে আমাকে দেখছিল, কী ঘুমোওনি! সবাই তো ঘুমোচ্ছে, তুমি কেন জেগে! যেই বলেছি, আমি যে তোমার শিষ্য, কী খুশি! বললে, রাতকে জানলেই সত্যকে জানতে পারবে।’

‘আপনি এক-একদিন এক-একরকম বলেন। এই সেদিন বললেন, উপনিষদ বলছে, জ্ঞানই সত্য আর সূর্যই হল জ্ঞান, দিন ছাড়া সূর্য পাবেন কোথায়! সেদিন বললেন, ‘জ্ঞান সূর্যের আলো, অজ্ঞানের অন্ধকার।’

‘এইসব ব্যাপারে তোর মাথাটা রিয়েল মোটা। যে-সূর্য পুব আকাশে ধকধক করে জ্বলে, ওটা ফায়ার বল। টন টন হিলিয়াম দাউ-দাউ জ্বলছে। আমাদের গরমে, ঘামে, ঘামাচিতে রোজ অতিষ্ঠ করে মারছে। কবে যে এই জ্বলা শেষ হবে! পৃথিবীটা একটু ঠান্ডা হবে! দরকার নেই আমার আমগাছ, জামগাছ, দরকার নেই ফড়িং প্রজাপতি। পৃথিবীটা কিছুদিনের জন্যে আইসক্রিম হয়ে যাক। শ্বেত ভালুক আর হোয়াইট টাইগার, স্নো লেপার্ড আর ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট পেঙ্গুইন। আর কুছ নেহি মাংতা।’

কোথা থেকে অন্যরকম একটা গলায় কে প্রশ্ন করল, ‘খায়েগা কেয়া। হরি মটর!’

গলাটা বেশ ভারী। ছাতে সম্প্রতি যে নতুন জলের ট্যাঙ্কটা তৈরি হয়েছে, প্রশ্নটা এল তার ওপাশ থেকে। সেদিকে একটা বেলগাছ আছে। খুবই প্রাচীন। প্রবাদ আছে, গাছে নাকি বন্ধুভাবাপন্ন এক ব্রহ্মদৈত্য বহুদিন বসবাস করেছেন। এই পরিবারেরই এক মানুষ, সামান্য অপরাধে ব্রহ্মদৈত্য হয়ে আছেন। কিন্তু কেউ কোনওদিন তাঁর দর্শন পায়নি।

বড়মামা আমার হাতটা কষকষে করে চেপে ধরলেন। আমার বুকের ভেতরটাও গুমগুম করছে। যুক্তিবাদে তেমন জোর পাচ্ছি না। লৌকিক অলৌকিক হয়ে গেল বলে। আমিও বড়মামার হাতটা জোরে চেপে ধরেছি। এই কণ্ঠস্বর তাঁরই। বড়মামা খুব ভক্তিভরে বললেন, ‘প্রভু! রাতের প্রাণী প্যাঁচাদেরও তো খাদ্য আছে।’

‘কী খাদ্য বৎস?’

‘ইঁদুর।’

‘ইঁদুর পাবে কোথায়, সবই যদি বরফ হয়ে যায়!’

‘প্রভু, বরফে গর্ত খুঁড়ে শ্বেত ইঁদুর বের করব। হোয়াইট র‍্যাট।’

‘বৎস, হোয়াইট র‍্যাট কী খেয়ে বাঁচবে? হোয়াইট ব্যাট? গবেট!’

বড়মামা ব্রহ্মদৈত্যের ওপর ভীষণ কুপিত হয়ে বললেন, ‘আমার বাঁচার ব্যবস্থা আমি করে নেব, আপনাকে ভাবতে হবে না আমি সকাল-বিকেল আচ্ছাসে পেঁয়াজ, আদা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে পেঙ্গুইনের ডিমের ওমলেট আর কফি খাবে। চমরি গাইয়ের দুধ দিয়ে রাবড়ি করে খাব। লেবু দিয়ে ছানা কাটিয়ে কমলাভোগ তৈরি করব।’

এইবার ব্রহ্মদৈত্য আরও কুৎসিত গালাগাল দিলেন, ‘পাঁঠা, সূর্য চলে গেলে সবুজও অদৃশ্য হবে। যে ঘাস তুমি এখন খাও সেই ঘাসও হবে না, শাকপাতা, গাছপালা সব মরে যাবে। কোথায় পাবে তোমার পেঁয়াজ, লেবু, কাঁচালঙ্কা, সরষে, সরষের তেল। সব প্রাণী, জীবজগৎ মরে ভূত হয়ে যাবে। সূর্য আছে বলেই জল থেকে বাষ্প, বাষ্প থেকে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি। মরুভূমি আছে বলেই মৌসুমী বায়ু, ধান চাল, গম, রবিশস্য। গর্দভ, সূর্য ফাদার হলেও পৃথিবীর মাদার।’

‘প্রভু, এত গালাগাল দিচ্ছেন কেন?’

‘আমি তোমার শিক্ষক ছিলাম বৎস। তোমার মতো গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া করার কৃতিত্ব যে আমার। সূর্যশূন্য পৃথিবী মৃত পৃথিবী।’

‘মানতে পারলাম না প্রভু, সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ডে মানুষ বাঁচছে কী করে! সমুদ্রের তলায় আছে অঢেল সম্পদ। নতুন ধরনের মানুষ নতুন জীবনে অভ্যস্ত হবে। সবুজ মাঠের বদলে সাদা মাঠ, সাদা বাড়ি, জুতোর বদলে স্কেটিং শু মোটরের বদলে স্লেজ, টানবে বলগা হরিণ, স্কি করতে-করতে অফিস। আলোর মালায় শহর, নগর ঝিলমিল করবে। ঠান্ডার দেশের ধর্ম হবে খ্রিস্ট ধর্ম। দিকে-দিকে ক্রিসমাস ট্রি, পাতায়-পাতায় আইসক্রিমের মতো বরফ। চার্চ বেল। হিম। লুঙ্গি, গামছা, পাজামা, পাঞ্জাবি বিদায়। শুধু প্যান্ট, কোট, হ্যাট, টাই। সিল মাছের গ্রিল, ডলফিনের ড্রিল! আকাশে সবসময় চাঁদ আর তারা। কেয়া মজা!’

‘ছাগল।’

‘কে ছাগল?’

‘তুমি একটি আস্ত বোকাপাঁঠা। সূর্য চলে গেলে চাঁদ আলো পাবে কোথায়?’

‘আমাদের রকেট গিয়ে হ্যালোজেন ফিট করে দিয়ে আসবে।’

‘তুমি একটা পাগল।’

‘তুমি একটা ভূত।’

‘তুমি একটা মুক্তকচ্ছ উন্মাদ।’

‘মনে পড়েছে, কচ্ছপ আর কাঁকড়া খাব, ঝিনুক আর মাশরুম খাব।’

আমাদের পেছনে কখন যে মাসিমা এসে দাঁড়িয়েছেন আমরা খেয়াল করিনি। তরজার মতো ঝগড়া, ঝগড়ার মতো তরজা চলেছে। মাসিমার হাতে বেত। সেটা নাচাতে-নাচাতে বললেন, ‘এই যে, বলি এটা যে রাত সেটা খেয়াল আছে কী?’

‘আছে।’

‘রাত্তিরে মানুষ কী করে!’

‘ভোগীরা ঘুমোয়, যোগীয় জেগে থাকে।’

‘পাগলরাও জেগে থাকে, আর দাওয়াই হল পেটাই।’

মাসিমা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে কী করছিস। তোর কাল স্কুল নেই।’

আমার তখন উত্তেজনার শেষ নেই। মাসিমাকে আমি মৌ বলি। ‘জানো মৌ, বেলগাছের ব্রহ্মদৈত্য এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সত্যি-সত্যি। নিজের পরিচয় দিলেন, বড়মামার মাস্টারমশাই ছিলেন। খুব ভালো ব্রহ্মদৈত্য, বড়মামাকে গাধা ছাগল, পাগল সব বলেছেন।’

‘ব্রহ্মদৈত্য! সিদ্ধিফিদ্দি খেয়েছিস নাকি? এত বছর এ-বাড়িতে আছি, একদিনও কিছু শুনলাম না।’

বড়মামা বেশ অহঙ্কারের গলায় বললেন, ‘সাধক ছাড়া ওরা দর্শন দেন না কথাও বলেন না।’

‘কথাটা কোনদিক থেকে আসছিল রে!’

‘ট্যাঙ্কের ওপাশ থেকে। যেদিকে বেলগাছ।’

মাসিমা দুদ্দাড় করে সেদিকে এগোলেন। শুনতে পেলুম মাসিমা বলছেন, ‘ও পালের গোদা, তুমিও আছ।’

বড়মামা হামা দিয়ে সেদিকে কিছুটা এগিয়ে ট্যাঙ্কের পাশ থেকে উকি মারলেন, ‘মেজো তুই?’

‘ভগবানকে দেখব বলে বসে ছিলুম, এমন সময় ব্রহ্মদৈত্য ভর করল।’

মাসিমা হতাশ হয়ে বসে পড়লেন থেবড়ে, ‘বুঝলে, আমার দ্বারা আর হবে না। তোমাদের জন্যে চাই জাঁদরেল একজন শাসক। তোমরা যা বেড়েছ না!’

দূরে একটা বিশাল কারখানা আছে, সেখানকার পেটা ঘড়িতে ঢ্যাং-ঢ্যাং করে দুটো বাজল। উত্তরের আকাশে ব্লপ করে ভেসে উঠল একটা আলোর বল। ধীরে-ধীরে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে ফানুসের মতো। এদিকে বিরাট ক্যান্টনমেন্ট। মিলিটারিরা গভীর রাতে অনেক কিছু পরীক্ষা করে। আলোর বলটায় অনেকরকম শব্দ হচ্ছে, যেন মন্ত্র পড়ছে। সহসা আকাশভর্তি আলো হয়ে গেল। সেই আলোয় ছাতে আমাদের ছায়া পড়ল। গাছের পাতায় ঘন কালো ছায়া, এত জোর আলো। কিছু পাখি ভোর হয়ে গেছে ভেবে বোকার মতো কিচিরমিচির করে উঠল।

বড়মামা বললেন, ‘মার্কার। সেকেন্ড ওয়ারে আমি অনেকবার দেখেছি।’

জিগ্যেস করলুম, ‘মার্কার কী?’

‘রাত্তিবেলা শত্রু কোথায় দেখার জন্যে এই ফসফরাস আলো ভাসানো হয়।’

হঠাৎ মাসিমা বললেন, ‘রাতটা কত সুন্দর! এমন কত সুন্দর রাত আমরা ঘুমিয়ে নষ্ট করি। ভাগ্যিস জেগে ছিলুম তাই না এমন সুন্দর আলো দেখতে পেলুম।’

বড়মামা মাসিমার কথায় খুব খুশি হলেন, ‘আমি তো সেইজন্যে জেগে থাকারই চেষ্টা করি। রাতে অনেক সত্য ধরা যায়।’

মেজোমামা জ্ঞানী মানুষ, সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘একটু কারেকশন করে দিই, সত্য অনেক নয়, সত্য এক এবং অদ্বিতীয়।’

বড়মামা বললেন, ‘সেটা কী?’

মেজোমামা গান গেয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমি নেই, তুমি নেই, কেউ নেই, কেউ নেই, ওড়ে শুধু একঝাঁক পায়রা।’

‘এ তো সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান রে! আমার কলেজ জীবনের। শ্যামল মিত্রের সেই গান, স্মৃতি তুমি বেদনা। সতীনাথের পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম। কীসব গান! ও দয়াল বিচার করো। সিনেমার আমার প্রিয় হিরো ছিলেন অসিতবরণ। সেইসব দিন হইহই করে চলে গেল মিছিলের মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান হয়ে গেল, আসবে না ফিরে কোনওদিন।’

মাসিমা আমাকে বললেন, মোটা বড় শতরঞ্জিটা আনতে, সেটা ধরাধরি করে পাতা হল। উত্তর আকাশের মিলিটারি আলো মিলিয়ে গেছে। গাছপালা আবার মিশে গেছে নরম অন্ধকারে। চাঁদ আবার তার জেল্লা ফিরে পেয়েছে। তিনটে সরাল ওঁয়াক-ওঁয়াক করে ডাকতে-ডাকতে আকাশের অনেকটা উঁচু দিয়ে উত্তর দিকে উড়ে গেল। এইবার সোজাসুজি একটা উল্কাপাত হল। ছেলেবেলায় আমরা বলতাম, তারা খসে পড়ল।

শতরঞ্জির মাঝখানে বসেছেন মাসিমা, আমরা তিনজনে তাঁকে ঘিরে আছি মুখোমুখি। মাসিমার প্রিয় দুধসাদা, থুপুরথাপুর বেড়ালটা কোলে এসে বসেছে। নাম তার ‘চিত্রা’। রূপের গরবে আমার সঙ্গে বেশি কথাই বলে না, পাত্তাও দেয় না, মাসিমা একবার ডাকলেই, যেখানেই থাকুক, চামরের মতো লেজ খাড়া করে ছুটে আসবে। রুপোলি চাঁদের আলোয় চিত্রার রূপ ফেটে পড়ছে, সাদা বড়-বড় লোমের ডগা জরির মতো চকচক করছে। সব যেন ফ্লুরোসেন্ট ফাইবার। নারকেল গাছের পাতা চাঁদের আলো ধরায় এক্সপার্ট। পাতার ঝিরিঝিরি বেয়ে পিছলে পড়ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, আমি একটা ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর স্বপ্নের মধ্যে বসে আছি। মাঝরাতের পরেই বাতাস ঘুরে যায়। তাই গেল। এতক্ষণ ফুলের গন্ধ ছিল না। তাও এল। ভোরের জন্য ফুল তার সাজি সাজাচ্ছে। সূর্যপ্রণাম করবে, মন্দিরে যাবে।

মাসিমা বললেন, ‘একটা প্রশ্ন আমার খুব ইচ্ছে করে তোমাদের করি।’

বড়মামা বললেন, ‘করো, করো। প্রশ্নোত্তরের আসর হয়ে যাক।’

‘আচ্ছা, তোমরা দু’জনেই কেন বিয়ে করলে না!’

বড়মামার চটজলদি উত্তর, ‘মেয়েদের দেখলেই আমার মনে হয় বোন অথবা মা, আর জীবনের সেরা বোন-কাম-মা কুসিকে তো পেয়েই গেছি। আর আমি কিছু চাই না বাবা! জীবন ভরপুর। একমেবাদ্বিতীয়ম আমার কুসি। আর আমি চাই না কিছু।’

‘মেজদা, তোমার কেস?’

‘এমন একটা বোন থাকতে কোন ছাগল বিয়ে করবে! কুসি, আমি তোর নাবালক ডিপেন্ডেন্ট। বিয়ে খুব ব্যাড থিং। যতবার বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়েছি, ততবারই আমার পেটখারাপ হয়েছে। মালা, সানাই, টোপর এ তিনো হায় ফাঁসিকা ফান্দা!’

‘তুমি এই ডায়ালগ শিখলে কোথা থেকে, ফাঁসিকা ফান্দা!’

মেজোমামা অপরাধী বালকের মতো মাথা নীচু করে ভয়ে-ভয়ে বললেন, ‘লুকিয়ে-লুকিয়ে শোলে দেখেছি।’

‘তুমি লাইন দিয়ে টিকিট কেটে হলে বসে শোলে দেখেছ। শেম, শেম!’

মেজোমামা হাত নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদের গলায় বললেন, ‘সত্যি বলছি হলে নয় শোভনদের বাড়িতে ভি সি আরে। কী মিউজিক! এ দোস্তি, ছোড়েঙ্গে নেহি। কুসিকো নেহি ছোড়ুঙ্গা। লালা, ট্রালা ট্রালা।’

‘কী বরাত! এক ছবিতে এতদিনের চরিত্রটা বিগড়ে গেল। সত্যি বলছ, হিন্দি গান গাইছ, ডায়ালগ বলছ, ভাগনে বসে আছে পাশে।’

‘ও তো আমাদের বন্ধু।’

অনেক উঁচু দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে। একেবারে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। ডানার তলায় আলো ফ্ল্যাশ মারছে। আমি বললুম, ‘এত রাতে প্লেন যায় কোথায়!’

মেজোমামা বললেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট। লণ্ডন হয়ে নিউ ইয়র্ক। তুইও একদিন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে এইভাবে উড়ে যাবি বিশাল জগতে।’

বড়মামা বললেন, ‘ওই ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপটার দিকে তাকিয়ে আজ আমার কত কথাই মনে পড়ছে! চাঁদের আলোয় কেমন পড়ে আছে দ্যাখ। বৃদ্ধ অতীত। পুরনো সেই দিনের কথা। এক সময় এই গোটা গ্রামটা আমাদের জমিদারী ছিল। দূরের ওই কারখানা, কাগজ কল, কাপড়ের কল, উত্তরের ওই বিল, সব ছিল আমাদের সম্পত্তি। বাবার কথা তোদের মনে পড়ে!’

মেজোমামা বললেন, ‘অস্পষ্ট!’

মাসিমা বললেন, ‘একেবারেই নয়।’

‘মানুষের মতো মানুষ ছিলেন, আমরা তাঁর পায়ের নখের যুগ্যি নই। তিনি ছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী। ওই যে দেখছিস চণ্ডীমণ্ডপের ধ্বংসস্তূপ, ওর তলায় আছে একটা চোরকুঠুরি। একটা সুড়ঙ্গও আছে। সোজা চলে গেছে জোড়া বিলের ধারে। ছেলেবেলায় দেখেছি সেখানে একটা ডাম্বা লেটার বক্স। ওই যেমন দেখা যায়, মন্দিরের মতো লাল রং করা। আসলে সেটা লেটার বক্স ছিল না। কায়দাটা ছিল অদ্ভুত। উলটে শুইয়ে দিলে গহ্বরের মুখ। নামলেই সুড়ঙ্গ। বিপ্লবীরা ওই পথে এসে কুঠুরি থেকে বোমা, রিভলভার, পিস্তল, গুলি, সব নিয়ে যেতেন। বারীন ঘোষ অনেকদিন লুকিয়ে ছিলেন আমাদের চিলেকোঠায়।

‘তুমি তখন কত বড়?’

‘বালক। বোধবুদ্ধি হয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপে বাবা পাঠশালা করতেন। আমার খুব মজা লাগত। বিরাট, সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু হচ্ছে। দেশ থেকে ইংরেজ খেদানো। মায়ের সব গয়না গেল। জমিদারি বিক্রি হতে লাগল। বিপ্লবের খরচ জোগাতে বাবা ফতুর। মাঝে-মাঝে পুলিশ আসে, বাড়ি সার্চ করে। বাবা টিকিতে জবাফুল বেঁধে চণ্ডীপাঠ করেন, ঘণ্টা নাড়েন। পুলিশের সব প্রশ্নের উত্তরে সংস্কৃত বলেন। গ্রামের রটে গেল বাবার অলৌকিক ক্ষমতা। যাকে যা বলেন তাই হয়। গভীর রাতে শূন্যপথে ভ্রমণ করেন। তাগা-তাবিজে অসম্ভবকে সম্ভব করেন। খোদ দারোগার মরো-মরো মেয়ের গায়ে আঙুল ঠেকাতেই সে উঠে বসল। ধন্য, ধন্য। গোটা পুলিশ-ব্যারাক বাবার ভক্ত। কে ধরবি ধর!’

মেজোমামা বললেন, ‘সত্যি, এইরকম পাওয়ার এসেছিল।’

‘কতটা পাওয়ার কতটা প্রচার, সে-বিচারের বুদ্ধি তখন আমার ছিল না। তবে হাঁ, বাবা ছিলেন মহাসাধক। সে-ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। অষ্টমীর দিন দুর্গাদালানে বসে যখন চণ্ডীপাঠ করতেন, মনে হত মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। বুক ওঠানামা করছে। অসাবধানে মায়ের গায়ে অস্ত্রের খোঁচা লাগলে রক্ত বেরোবে। প্রকৃত শাক্ত ছিলেন। বিসর্জনের দিন রাতে জ্বর আসবেই আসবে, ধুম জ্বর। একদিন মনে আছে, ওই যে বুড়ো আমগাছ, এখন বুড়ো, তখন যুবক, গাছটার তলায় বাবা বসে আছেন খোলা গায়ে, আমরা বাচ্চারা সব খেলা করছি। গাছে কচি-কচি আম। কে একটা ছেলে আধলা ইট ছুড়েছে। ইটটা ডালে লেগে ছিটকে এসে সপাটে বাবার পিঠে। চওড়া পিঠ। ফরসা ধবধবে। একেবারে থেঁতলে গেল। বাবা ছেলেটাকে ডেকে শান্ত গলায় বললেন, ‘ইট ছুড়ো না বাবা, তোমাদেরই মাথায় লাগবে।’ ছেলেটা বাবার ক্ষতস্থান, আর অমন শান্ত কথা শুনে, হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। ছেলেরা দুব্বো ঘাস ছিঁড়ে, চিবিয়ে-চিবিয়ে রস বের করে বাবার ক্ষতস্থানের ওপর থেবড়ে-থেবড়ে লাগাচ্ছে। বাবা হাসছেন। সে এক দৃশ্য। আজও ভুলিনি। কী সহ্যশক্তি! বাবা বলতেন, বিপ্লবী মানে সাধক, সাধক মানে বিপ্লবী। চলে যাওয়ার দু’দিন আগে, আমার হাতে একটা ডায়েরি দিয়ে বললেন, ‘আমি চলে যাওয়ার পর মন দিয়ে পড়বে। এটা শুধু তোমারই জন্যে, আর কেউ যেন না পড়ে। হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে, একটা বাক্সয় ভরে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় বিসর্জন দেবে। কোনও ভুল যেন না হয়।’ তখন আমার বয়েস ষোলো।’

মাসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘সে কী, এই ডায়েরির কথা তো তুমি আগে আমাদের কখনও বলোনি। কোথায় সেই ডায়েরি! আমি পড়তে চাই।’

‘সরি! বাবার নির্দেশ পালন করতে আমি বাধ্য, অন্তত এই ডায়েরিটা পড়ার পর।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমিও দাদার সঙ্গে ছিলাম। বাক্সটা জলে পড়ে ধীরে-ধীরে তলিয়ে গেল। তারিখটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর, আমার মনে আছে স্পষ্ট। একজন সুন্দর চেহারার সন্ন্যাসী স্নান করছিলেন, তিনি বললেন, ‘সব মনে আছে তো, ভুলে যাওয়ার আগে লিখে রেখো। শুধুমাত্র শ্রুতি আর স্মৃতিতে বিশ্বাস কী!’ আচ্ছা দাদা, সাধু কেমন করে বলেছিলেন! একটু পরে আমরা তাঁকে কত খুঁজলুম, আর পাওয়াই গেল না!’

বড়মামা সুন্দর একটা উত্তর দিলেন, ‘দ্যাখ, বিদ্যুতের খুব শক্তি, আমরা জানি, মাপতেও পারি। কিন্তু কেন এই শক্তি আমরা বলতে পারব না। সেদিন একটা হার্ট অপারেশনের সময় আমি অ্যাসিস্ট করছিলাম। রিববক্স ফেঁপে হার্টটাকে বের করে এনে, আইসপ্যাক দিয়ে তার ধুকপুকুনি থামানো হল। রোগী তখন হার্ট অ্যাণ্ড লাং মেশিনে। প্র্যাকটিক্যালি ডেড। এদিকে তার নিজের হার্টও ফ্রোজন। অপারেশন হল। হার্টটাকে ক্যাভিটিতে ভরে টুক করে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ দেওয়া হল। চালু হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। এখন একটা প্রশ্ন, প্রথম স্পন্দনটা কে দিয়েছিল। আমরা তো চালু যন্ত্র নিয়েই এসেছি; কিন্তু ভাই, প্রথম কে চালু করেছিলেন। দেখলুম, বরফ দিয়ে বন্ধ করা যায়, আবার বিদ্যুৎ দিয়ে চালু করা যায়, তা হলে কে তিনি?’

বড়মামা তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে, সাধকের মতো দু’হাত তুলে বললেন, ‘এই সত্যটাই জানতে চাই, রাতের পর রাত তাই জেগে থাকি। জানতে চাই, কে আমি!’ মেজোমামা তাঁর উদাত্ত গলায় বলে উঠলেন :

খেলো খেলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা—

খুঁজিব তারার মাঝে চঞ্চলের মালার মণিকা।

খুঁজিব সেথায় আমি যেথা হতে আসে ক্ষণতরে

আশ্বিনে গোধূলি-আলো, যেথা হতে নামে পৃথ্বী’ পরে

শ্রাবণের সায়াহ্নযূথিকা—

যেথা হতে পারে ঝড় বিদ্যুতের ক্ষণদীপ্ত টীকা।।

এই মেজোমামার কাছে আমি আবৃত্তি শিখে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি। মেজোমামা খুব ভালো অভিনয় করতেন কলেজে। শেকসপিয়ারের নাটকে। সুইমিং চ্যাম্পিয়ান ছিলেন। বড়মামা মাঝে-মাঝেই বলেন, মেজো আমাদের গর্ব।

মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘বড়দা, ডায়েরিতে কী লেখা ছিল আমাদেরও বলা যাবে না?’

‘দ্যাখো, ডায়েরিতে বাবা আমাকে দীক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। বাবাই আমার গুরু। একটা কাগজের মোড়কে ছিল বীজমন্ত্র। ডায়েরিতে ছিল নির্দেশ। আমার জীবনের পথটা তিনি এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বরফের ধ্যান করবে। বলেছিলেন, রাতকে আপন করে নেবে। বলেছিলেন, বাঘ যেমন অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকে, সত্যও সেইরকম অন্ধকারে থাকে। তিনটে জিনিস মানতে বলেছিলেন, নারীর অঙ্গ স্পর্শ করবে না, আরতি লঙ্ঘন করবে না, মিথ্যা বলবে না।’

মাসিমা বললেন, ‘আরতি লঙ্ঘনের মানে?’

‘ধর যদি দেখিস কোনও মন্দিরে আরতি হচ্ছে, যত তাড়াই থাক একটু দাঁড়িয়ে প্রণাম করে যাবি।’

‘আর কি লেখা ছিল?’

‘লেখা ছিল, চণ্ডীমণ্ডপের তলায় চোরকুঠুরিতে ভয়ঙ্কর একটা জিনিস আছে, যেটা পেলে যে পাবে তার অদ্ভুত একটা শক্তি আসবে, পাওয়ার। সে যা ইচ্ছে করবে তাই হবে।’

‘সেটা কী?’

‘জানি না।

‘তুমি অনুসন্ধান করোনি?’

‘কী করে করব! এক ঝড়ের রাতে মণ্ডপটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। স্তূপাকার। জঙ্গল। কার সাহস হবে ওখানে যাওয়ার!’

‘জীবনের পথ কী বলেছেন?’

‘কর্তব্য। দেশ স্বাধীন হল, দেশ ভাগ হল, আমাদের জায়গাজমি সব জবরদখল হয়ে গেল। সুবিধাবাদীরা গদিতে বসল। এই গ্রামের এক ধান্দাবাজ, ইংরেজের ইনফরমার মন্ত্রী হয়ে গেল। বিপ্লবীদের স্থান হল না। দশমীর সন্ধেবেলা বাবা মারা গেলেন। শ্মশানে মুখাগ্নি করছি, ওদিকে বিসর্জনের বাজনা বাজছে। মা পাগল হয়ে গেলেন। ষোলো বছরের আমি। সংসারের দিকে তাকালাম। দুই বোন, এক ভাই, অপ্রকৃতিস্থ মা। তিন মাস স্বাভাবিক, ন’মাস অস্বাভাবিক। ডায়েরিতে লেখা, কর্তব্য। মামলা, দেনা জ্ঞাতি-শত্রুতা। ঘুম চলে গেল। সেই থেকে আমি রাতজাগা প্রাণী। প্যাঁচা আমার বন্ধু। সাহস করে একদিন চোরকুঠুরিতে নামলাম।’

মাসিমা বললেন, ‘এই যে বললে অনুসন্ধান করোনি!’

‘আমি করিনি বলিনি, আমি প্রশ্ন রেখেছি, কী করে করব! তার মানে এই নয় আমি করিনি। আমি তোদের সাসপেন্সে রেখেছি।’

চটপট, চটপট কয়েক ফোঁটা জল আমাদের গায়ে পড়ল। আমরা সবাই আকাশের দিকে তাকালুম। কোথাও কিছু নেই। হাহাকার ফাঁকা। বড়মামা বললেন, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই, মাঝে-মাঝে মেঘ ছাড়াই আকাশ থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ে শিশিরবিন্দুর মতো। একেই বোধ হয় বলে স্বাতী নক্ষত্রের জল। ঝিনুক জানে। কপ করে গিলে নিলেই মুক্তো। কে যেন বলেছিল, একটি-একটি শিশির কণায় ধানের গর্ভে চাল আসে।’

বাতাস একটু ভিজে-ভিজে। মাসিমা তাঁর শাড়ির আঁচলটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। পাছে ঠান্ডা লেগে যায়। আঁচলে সুন্দর ধূপের গন্ধ। মাসিমা কাপড়ের আলমারিতে ধূপের খালি প্যাকেট রাখেন, সুবাসিত হবে বলে। মাসিমা উদগ্রীব, চোরকুঠুরি থেকে বড়মামা কী পেলেন, ‘কী পেলে তুমি?’

‘ধপাস করে তো নীচে গিয়ে পড়লুম। মড়াক করে একটা শব্দ হল। ভাবলাম ঠ্যাংটা ভাঙল বুঝি। পাঁচ সেলের টর্চটা জ্বালালাম। কিসের ওপর পা পড়ল দেখি। শুকনো একটা গাছের ডাল। বিজবিজ করে উইপোকা বেরোচ্ছে। অজস্র ইঁদুর চারদিকে দৌড়ছে চিঁক-চ্যাক করে। টর্চের আলোয় তাদের বিন্দু বিন্দু চোখ হিরের মতো জ্বলছে। ওপর থেকে নেমে এসেছে ঘন কালো ঝুল। বিরাট-বিরাট মাকড়সা দেওয়ালে-দেওয়ালে ঘাপটি মেরে আছে। অনেকটা দূরে দেখি ডাইনির চুলের মতো কী ঝুলছে, জায়গাটায় ঘুরপাক খাচ্ছে নীল বাষ্প। পরে আবিষ্কার করলাম, ওপরের কোনও বড় গাছ, যাকে বলে বৃক্ষ, শিকড় নামিয়ে দিয়েছে। থেকে-থেকে শিসের শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলাম, বড় কোনও সাপ। গোখরো অথবা তক্ষক। পরে বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝলাম বাতাস, নানা ফুটো দিয়ে সাঁই-সাঁই করে ঢুকছে। অনুসন্ধান করব কী! ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রাণীদের জ্বালায় পালাই-পালাই অবস্থা। সেই সময় হঠাৎ যেন নির্দেশ এল, সামনে দশ পা এগোও। এইবার ডান দিকে তাকাও একটু ওপরে। তাকাতেই মনে হল, সেখানে একটা খুপরি আছে। লুজ একটা ইট। সাহস করে ইটটা টানতেই প্রথমে খানিক ধুলো বেরোল ঝুরঝুর করে। পায়ের ওপর সব জমা হল। ভয় করছে, ফ্যাঁস করে সাপ না বেরোয়! টর্চ মারলুম। বেশ গভীর। কাঁধ পর্যন্ত হাত ঢুকে যাবে। প্রথমে-হাত পা ঢুকিয়ে গাছের সেই ভাঙা ডালটা সাঁদ করালাম। মনে হল কিছু একটা আছে, শুধু আছে না, ঠেললে সরে যাচ্ছে। তখন ‘জয় মা’ বলে ঢোকালাম হাত। বার করে আনলাম জংধরা একটা লোহার বাক্স। একটু টানাটানিতেই ঢাকনাটা উপড়ে চলে এল হাতে। আলো ফেলতেই ভয়ে হাড় হিম। গুটিয়ে পাকিয়ে রয়েছে সাপের একটা কঙ্কাল। ভয়ে তিন লাফ। কিছুক্ষণ ভাবলাম। আবার নির্দেশ, সাহস করে জিনিসটা তোলো। তবু সাহস হচ্ছে না। অনেকক্ষণ থম মেরে রইলাম। দেওয়ালের ভয়ঙ্কর মাকড়সাগুলো হঠাৎ খুব তৎপর হয়ে খিড়খিড় করে নাচানাচি শুরু করল। দু-একটা লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে। বাতাসের সিঁসিঁ ভীষণ বেড়ে গেল। গাছের ঝুলো শেকড়গুলো হিলহিল করে উঠল। আবার, যা থাকে বরাতে—দু’আঙুল দিয়ে জিনিসটাকে টেনে তুললাম। আঃ, কী সুন্দর!’

বড়মামা হঠাৎ থেমে গেলেন। আকাশে সেই ভোরের তারাটা মুকুটের কোহিনুরের মতো জ্বলজ্বল করছে। সমস্ত প্যাঁচা রাত শেষ হবে বলে সমস্বরে ডেকে উঠল, চলো, ভাই শুতে যাই, বিশ্রী দিন ওই আসছে। কর্কশ, ঘসঘস, গোলমাল, চিৎকার, মানুষেরা এইবার জাগছে।

মাসিমা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘হঠাৎ হঠাৎ থেমে পড়াটাই তোমার রোগ। ব্যাটারি ডাউন, গাড়ির মতো। তারপর বলো, কী হল তারপর!’

বড়মামা বললেন, ‘আর তো শোনার কিছু নেই। এইবার যা তা দেখার। জিনিসটা তোদের দেখাব।’

‘কবে?’

‘আজই। ভোরের নীল আলোয়। দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবি, গ্যারাণ্টি।’