» » » সাপে আর নেউলে

বর্ণাকার

পাঁচ

বড়মামাও এলেন মাস্টারমশাইয়ের ঠাকুরদালানে। চারপাশে অনেক গাছ, তার মাঝখানে তিনপাশ খোলা বিশাল সেই নাটমন্দির। যে দেওয়ালকে পেছনে রেখে মায়ের মূর্তি বসত, সেই দেওয়ালের অপূর্ব কারুকার্য এখনও কিছু-কিছু আছে। সবচেয়ে সুন্দর মেঝেটা। কিছুই যত্ন হয় না, তাও কী শোভা! সাদা, কালো ইতালিয়ান মার্বেলের চোখধাঁধানো কাজ।

বড়মামা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ফরমান দিলেন, ‘আলম এ জিনিস তোলা হবে না।’

‘তা হলে?’

‘তা হলে এইখানেই থাকবে। এই নাটমন্দির আমি সংস্কার করাব। ছাত আর কিছু-পিলার ড্যামেজ হয়েছে! এখানে আমি মহাপ্রভুর মূর্তি স্থাপন করব। এখানে হবে একালের শ্রেষ্ঠ পাঠবাড়ি। পাঠ হবে, সঙ্কীর্তন হবে। কী না হবে?’

‘মাস্টারমশাইয়ের জিনিস, আপনি করার কে?’

‘আমি কিনে নেব। এর ওপর কোনও কথা আছে!’

‘না, নেই।’

‘তুমি মেরামতির কাজে লেগে যাও। রথের দিন উদ্বোধন।’

‘মূর্তি কোথায় পাবেন এত তাড়াতাড়ি!’

‘সেটা আমার ব্যাপার, আমি বুঝব।’

‘আমরা এখন তা হলে কী করব!’

‘তুমি এইখানে বোসো। আমি পাকা কথাটা কয়ে আসি।’

মাস্টারমশাই নীচের বৈঠকখানায় বসে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মোটা একটা বই পড়ছিলেন। এমনই তন্ময় যে, আমাদের প্রবেশ বুঝতে পারেননি।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড়মামা বললেন, ‘আমি এসেছি।’

চোখ তুলে তাকালেন, ‘তোমরা! আরে এসো এসো, বোসো। কী সংবাদ!’

বড়মামা উত্তেজনায় বসতে পারলেন না। মাস্টারমশাইয়ের হাত দুটো ধরে বললেন, ‘ওই অংশটা আপনি আমাকে বিক্রি করুন, আমি ওই মন্দির সংস্কার করে মহাপ্রভুর মূর্তি বসিয়ে, পাঠবাড়ি করব। আপনার পূর্বপুরুষ খুশি হবেন। ওইখানে দাঁড়িয়ে আমি এই নির্দেশ পেলাম। আপনার বসবাসের জন্য আমি একটা ছবির মতো ব্যবস্থা করব। আপনি আপনার লাইব্রেরি আর নিত্যপূজা ও পাঠ নিয়ে থাকবেন। ইচ্ছে করলে এই অংশটা বিক্রি করে টাকাটা ফিক্সড করে দিন।’

চশমার মোটা কাচের আড়ালে বড়-বড় চোখ। মাস্টারমশাই অস্বাভাবিক দৃঢ় গলায় বললেন, ‘আমি বিক্রি করব না।’ একটু থেমে রইলেন, বড়মামার মুখটা কেমন হয়ে গেছে। মাস্টারমশাই আরও জোর গলায় বললেন, ‘আমি সবটাই তোমাকে দিয়ে দেব। তুমি এখানে এমন একটা কিছু করো, যাতে অগ্নিযুগের সেই বিপ্লবীর স্মৃতি রক্ষা হয়। তিনি ছিলেন গৃহী সাধক, সর্বত্যাগী দেশসেবক।’

বড়মামা একটু ভাবনা-চিন্তা করে বললেন, ‘বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার, অনেকের তো আপত্তি থাকতে পারে!’

‘কার আপত্তি! এসব আমার নামে। আমি তোমাকে উইল করে দিয়ে যাব।’

‘পাড়ার লোকে পাঁচ কথা বলবে। বলবে, আমি আপনাকে তোয়াজ করে সব লিখিয়ে নিয়েছি।’

‘রাখো তোমার পাড়ার লোক! শোনো ডাক্তার, আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। যে কোনওদিন চলে যেতে পারি। মানুষকে বেশি পাত্তা দিয়ো না। নিজের কাজ করে যাও।’

‘আমরা তা হলে আসি।’

‘এসো, তুমি আমাকে বড় নিশ্চিন্ত করে গেলে বাবা।’

আলমদা বাইরে বসেছিলেন। বড়মামা বললেন, ‘কাল থেকে কাজে লেগে যাও।’

সাইকেলে চেপে আমরা ফিরে এলুম। চেম্বারে রোগীদের লাইন পড়ে গেছে। বড়মামা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘একটা দিনের তরেও কি শান্তি নেই! আমার যে এখন নুন-লেবু মাখিয়ে ভুট্টা খেতে ইচ্ছে করছে। আমার যে এখন মাছ ধরতে ইচ্ছে করছে।’

বড়মামা গজগজ করতে-করতে চেম্বারে ঢুকলেন। ঢুকেই একজনকে ভীষণ ধমক দিলেন, ‘আপনার অসুখ মশাই কোনওদিন সারবে না। এখানে আপনি ইয়ার্কি মারতে আসেন। কাল গুপির দোকানে আলুর চপ খাচ্ছিলেন। এদিকে আলসারের রোগী!’

এ ধাতানি খেয়েও ভদ্রলোক হাসছেন, ‘জানি, এই ভুলটা আপনিও করবেন। ওটা আমি নই, আমার যমজ ভাই। আমাদের দু’জনকে অবিকল একরকম দেখতে। কে বিশ্বনাথ, কে জগন্নাথ, বুঝতে পারবেন না। ছেলেবেলায় একজনকে দু’বার খাওয়ালেন, আর একজনের উপোস। খাওয়ানো হয়ে গেলেই কপালে কাজলের টিপ। যেন ভোট দেওয়া হল। এই বুদ্ধিটা বেরোতে আমরা দু’জন খেয়ে বাঁচলুম। আর স্কুলে ঢোকার পর আমাকে ন্যাড়া করে দিলেন। একজনের চুল, একজন ন্যাড়া। ন্যাড়া জগন্নাথ। চুলো বিশ্বনাথ। চমৎকার ব্যবস্থা।’

বড়মামা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে কে আসে?’

‘আমরা দু’জনেই আসি। এ চুলোয় আর কে আছে যে, ডেথ-সার্টিফিকেট দিতে পারে!’

বড়মামা অতিশয় অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘আমি ফিট-সার্টিফিকেটও দিই। আপনি কে?’

‘নাম বললে গুলিয়ে যাবে, আমি আলসার, আমার ভাই আলুর চপ। তবে প্রবলমেটা কী হয় জানেন, আলুর চপ অনেক সময় ভুল করে আলসারের মুখে ঢুকে যায়, চিনতে পারে না তো! মাঝে-মাঝেই আমারই সন্দেহ হয়, কে প্রকৃত বিশ্বনাথ, কে প্রকৃত জগন্নাথ। আমার মা গুলিয়ে ফেলেননি তো!’

‘মাকে জিগ্যেস করলেই হয়!’

‘করেছিলুম। মা বলেছিলেন, দুটো নামই রইল, যখন যার যেটা ইচ্ছে, সেইটা ব্যবস্থা করিস। নাম হল জামা। লোক কখনও নীল জামা পরে, কখনও লাল।’

‘আরে দূর, ও উপমাটা আসছে না এখানে। নামের ওপর লোকে জামা চড়ায়। লাল বিশ্বনাথও বিশ্বনাথ, নীল বিশ্বনাথও বিশ্বনাথ।’

ওপাশ থেকে এক প্রবীণ মানুষ বললেন, ‘একজনকে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে, এখানে তো অসুখের হরিহর ছত্রের মেলা! ওই ইয়ারটিকে ছাড়ুন এইবার।’

‘আপনার প্রবলেম!’ স্টেথো নিয়ে বড়মামা এগোলেন সেইদিকে।

ভদ্রলোক বললেন, ‘সেই যে আমি বিষ খেয়েছিলুম!’

বড়মামা থমকে গেলেন, ‘সে তো পুলিশ কেস।’

‘না, পুলিশ কেস নয়, হাউসহোল্ড পয়জন। গৃহপালিত বিষ।’

‘কী খেয়েছিলেন? আমার আজকাল আর কিছুই মনে থাকে না।’

‘রোগীদের আপনারা কি আর মানুষ ভাবেন! সব গোরু-ছাগল। আমি কাফ মিক্সচার খেতে গিয়ে দু’ঢোক টিংচার আইডিন খেয়ে ফেলেছি। ভুল করে।’

পাশে বসে ছিল বাচ্চা নাতনি। সে অমনই চিৎকার করে উঠল, ‘না ডাক্তারবাবু, না, দিদার সঙ্গে ঝগড়া করে দাদাইয়া আইডিন খেয়েছিল, তারপর বাবা এসে নুন-জল খাইয়ে বমি করিয়ে দিল, অনেক রাত্তিরে, আমি জেগে-জেগে সব দেখেছি।’

‘অ্যায় চোপ, একদম চোপ, বড়দের কথায় একদম কথা বলবি না।’ বৃদ্ধ খ্যাঁক-খ্যাঁক করে উঠলেন। নাতনিও কিছু কম যায় না। সে ঘাড় বেঁকিয়ে, মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘না, বলব না আবার, তুমি আমার দিদাকে কেবল কষ্ট দাও, সেলফিশ জায়েন্ট।’

বৃদ্ধের ফরসা মুখ লাল হয়ে গেল। বড়মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। বুড়ির আদরে বাঁদর হয়ে গেছে। দিদার গুপ্তচর। একালের মাতাহারি। ওর কোর্টমার্শাল হওয়া উচিত।’

নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দিদা আমার, আমি যা খুশি তাই করব, তোর তাতে কী! এই যে সকালে তোর বাবা গরম জিলিপি এনেছিল, আমাদের একখানাও দিয়েছিলিস!’

‘দিদা তিনটে খেয়েছে, তোমাকে বলেনি। তোমার তো সুগার, জিলিপি খাবে! জিলিপি!’

বড়মামা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আপনার কমপ্লেনটা কী?’

‘নো খিদে, নো স্লিপ, চোখে সরষে ফুল।’

‘আয়োডিনের এফেক্ট। সুগার কত?’

‘লাস্ট তিনশো আশি।’

‘বলেন কী, সুগার ফ্যাক্টরি। খুব হাঁটুন। ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি।’

‘মেয়েরা খেতে পারে?’

‘ঘুমের ছেলে-মেয়ে নেই।’

‘অলরাইট।’

‘তার মানে!’

‘মানে, আমার ওয়াইফকে খাওয়াব। বুড়ি যদি একটু ঘুমোয়, তা হলে এই বুড়োটাও সুখে নিদ্রা যেতে পারে। কমপ্লেন অ্যাণ্ড কমপ্লেন অ্যাণ্ড কমপ্লেন। প্লেন আর ল্যাণ্ড করে না, সারা রাত চক্কর।’

কম্পাউণ্ডার মানিকদা এসে বললেন, ‘করছেন কী, সাতটা কল আছে। দুটো এখন-তখন।’

বড়মামা তৎপর হলেন, ‘ঝপাঝপ প্রেসক্রিপশন, ধপাধপ ইঞ্জেকশন। চেম্বার খালি। কেবল একজন মহিলা চুপ করে বসে আছেন উদাস মুখে। কাঁচাপাকা চুল। একেবারে যেন মায়ের মূর্তি। বড়মামা ড্রয়ার খুললেন, এক খামচা নোট দিয়ে সসম্ভ্রমে গিয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলার কাছে, যেন অঞ্জলি দিচ্ছেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ভদ্রমহিলা লজ্জায় অধোবদন, বড়মামা চোখ বুজে আছেন। নোট হস্তান্তরিত। ভদ্রমহিলা কাঁদছেন।

আমি জানি, কেসটা কী! এক বিখ্যাত ডাক্তারের স্ত্রী। দুটো ছেলেই অমানুষ, চোর, চিটিংবাজ। ডাক্তারবাবুর অকালমৃত্যুর কারণ তারাই। বাড়ি, গাড়ি, চেম্বার সব বিক্রি হয়ে গেছে। একটি ছেলে বোধহয় জেল খাটছে।

বড়মামা পূব দিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, ভদ্রমহিলা চলে যাচ্ছেন। ফিরে-ফিরে তাকাচ্ছেন। গোটা ব্যাপারটাই ঘটে গেল নিঃশব্দে। ভীষণ শব্দে উড়ে যাচ্ছে একটা প্লেন। বুম করে একটা শব্দ হল। টায়ার ফাটল রাস্তায়।

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পথ পেয়ে গেছি মাস্টার হাবু।’

যখন যা খুশি নামে ডাকা বড়মামার অনেক মজার একটা মজা। কয়েকদিন আগে মাসিমাকে ডাকছিলেন, ‘ম্যাডাম ফিশফ্রাই’। মেজোমামাকে কয়েকদিন ডেকেছিলেন, ‘শ্রীমান ভরদ্বাজ’। আমাদেরও বেশ মজা লাগে। কম্পাউন্ডার দাদা তাড়া দিলেন, ‘সাতটা কল, দুটো এখন-তখন।’

বড়মামা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘যাক, মরে যাক সব, বেঁচে থেকে কী হবে! মানুষের হাতে মরার চেয়ে রোগে মরা ভালো।’

চেয়ারে ধপাস করে বসে বললেন, ‘পাকা পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করছে।’

বড়মামা ডাক্তারি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললুম, ‘চলুন, চলুন, কল শেষ করে আমাদের পেয়ারাবাগানে যেতে হবে ক্রোটন গাছ কিনতে।’

‘রা-রাইট ইউ আর। লেটস গো।’

গাড়িতে বসে বললেন, ‘দ্যাখ তো, এখন-তখনে প্রথম কে আছেন!’

কলবুক খুললুম, ‘হরিসাধন দত্ত।’

‘থ্রোট ক্যানসার, লস্ট কেস।’

বিছানায় আধশোয়া, জ্বলে-পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসার এক মানুষ। জোরে-জোরে শ্বাস ফেলছেন হাপরের মতো, ফ্যালফ্যালে দুটো চোখ। পাশে বসে আছেন স্ত্রী। শীর্ণ চেহারা, উদ্বিগ্ন মুখ। দেখলেই মনে হয় বড় ঘরের মেয়ে। ঘরের বাইরে লাল মেঝেতে, পা গুটিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছেন বড় ছেলে, মানবদা। কলেজের অধ্যাপক। আমার সঙ্গে আলাপ আছে। বড়মামা রোগীর ঘরে ঢুকে গেলেন, আমি মানবদার পাশে মেঝেতে বসে পড়লাম।

মানবদা আমার ডান হাতটা আলতোভাবে ছুঁয়ে বললেন, ‘আজকের দিনটা কাটে কি না সন্দেহ। এ কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। মাঝে-মাঝে মনে হয়, কিছুই যখন করার নেই, চলে যাওয়াই ভালো।’

সারা বাড়ি থম মেরে আছে। যেন বর্ষার আকাশের তলায় মৃত্যুর কালো ছাতা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বড়মামা বেরিয়ে এলেন, থমথমে মুখ। বুকপকেট থেকে টাকা বের করে মানবদা ভিজিট দিতে গেলেন। বড়মামা ফিসফিস করে বললেন, ‘আমাকে জানোয়ার ভেবো না। শোনো, এক পারসেন্টও আশা নেই। প্রস্তুত থাকো। একটা স্টেরয়েড দিয়ে গেলুম। যতক্ষণ চলে। হার্ট স্ট্রং, তাই ফাইট করতে পারছেন। তুমি মাকে এইবার একটু রিলিফ দাও।

‘পাশ থেকে কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না। অনেকবার চেষ্টা করেছি।’

গাড়িতে এসে বড়মামা বললেন, ‘চারপাশে গিজগিজ করছে মৃত্যু, তার মধ্যে আমরা কোলা ব্যাঙের মতো খপাং-খপাং লাফাচ্ছি। লোকসভা, বিধানসভা করছি। আকাশ ভেঙে সব চাপা পড়ে গেলে বাঁচা যায়। তোর স্কুল কবে খুলছে?’

‘এখনও পনেরো দিন।’

‘বাঁচা গেছে। তুই সব দেখে রাখ, পরে গল্প, উপন্যাসে মানুষের কথা লিখবি। দু’নম্বরটা দ্যাখ।’

‘বিনোদ দত্ত।’

‘মরেছে।’

‘না, মরেনি, মরলে কেউ কল দেয়!’

‘ধুর ও মরবে কেন! মরেছি আমি। কিছু রুগি থাকে যারা ডাক্তারকে মারে। পকেটে-পকেটে রোগ। দুটো কথা মনে রাখ, পরে জট ছাড়াবি। মানুষের রোগ, আর রোগের মানুষ। ইংরেজি করতে পারিস, আর ও জি ইউ ই। রোগ।’

বিনোদবাবুর বিশাল বাড়ি। চতুর্দিকে তার ধ্যাবড়া-ধ্যাবড়া কাজ। উৎকট রং। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনছি, রেকর্ড প্লেয়ার ধাঁইধাপ্পড় গান হচ্ছে। বিচ্ছু টাইপের গোটাকতক বাচ্চা উঠোনে রবারের বল পেটাচ্ছে। একটা বউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কর্কশ গলায় কাজের মেয়েটাকে গালাগাল দিচ্ছে। আর একটা বউ খ্যাড়খেড়ে গলায় উপদেশ দিচ্ছে, ‘ও বলে কিছু হবে না, বেশ করে পিটিয়ে দাও।’ মোটা থলথলে, আদুর গা, লুঙ্গি-পরা একজন লোক বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলছে, ‘হ্যাঁ, আমার জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। খেদদাও, খেদদাও, উকিলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্ট আছে। আঃ, কুমার শানু যা গায় না, নাচতে ইচ্ছে করে। বাংলার গৌরব, শানু আর সৌরভ। আর একটা সেঞ্চুরি হাঁকড়ে দিলে।’

নীচের উঠোনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যায় গুটকে, ফুটবল রাখ, ব্যাট পেটা। মেরাদোনা নয়, সৌরভ।’

সেই শব্দব্রহ্ম ভেদ করে, বারান্দায় প্যাঁচ খুলে আমরা দ্বিতীয় মহলে এলাম। বিছানায় ছত্রিশটা বালিশ ফিট করে শয্যাশায়ী, পাকা টুসটুসে এক বৃদ্ধ।

‘ডাক্তার, আজ আবার একটা করে বিট মিস করছে।’

‘ভয় নাই, আজ শেষ ওষুধ অব্যর্থ নিয়ে এসেছি।’

‘কী, কী, বিলিতি?’

‘জাপানি।’

‘আরে, ওরা তো বামন অবতার! কী ওষুধ!’

‘সাইজটা একটু বড়, গিলতে পারবেন?’

‘চেষ্টা করে গিলতেই হবেই। বাঁচতে যখন হবে! কত বড়?’

‘একটা কোয়ার্জ রিস্টওয়াচ। জেন্টস নয়, লেডিজ।’

‘আমি মরে যাচ্ছি ডাক্তার, আর তুমি আমার সঙ্গে কৌতুক করছ!’

বড়মামা হঠাৎ ডিক্টেটরের গলায় বললেন, ‘গেট আপ, উঠে বসুন।’

ভদ্রলোক ভয়ে-ভয়ে উঠে বসলেন।

‘বিছানা থেকে নেমে আসুন। গেট ডাউন।’

ইংরেজি কমাণ্ডে বেশ কাজ হচ্ছে। ভদ্রলোক কাঁপতে-কাঁপতে মেঝেতে দাঁড়ালেন।

বড়মামা বললেন, ‘কানে কিছু আসছে, গান-বাজনার শব্দ!’

‘ও তো অষ্টপ্রহরই আসছে। তিষ্টোতে দিচ্ছে না শান্তিতে।’

‘দু’ মাত্রার তাল, লেফট-রাইট। নিন আসুন, আমার সঙ্গে নাচুন। ধেই, ধেই, ধেই, ধেই। এই বিটে নাচুন। হার্টবিট আর মিস করবে না।’

পাকা ঠানদির মতো চেহারার এক ভদ্রমহিলা পান-জর্দা চিবোতে-চিবোতে ঘরে ঢুকে বললেন, ‘বুড়ো, এইবার জব্দ হয়েছে। সারাটা জীবন বাতিকের অসুখে আমাকে জেরবার করে দিলে।’

বৃদ্ধ নাচতে-নাচতে বললেন, ‘বেশ লাগছে নাচতে!’

বড়মামা মহিলাকে বললেন, ‘এবার আর আমাকে ডাকবেন না, নাচের মাস্টারমশাইকে কল দেবেন। অনেক কম খরচে আরোগ্য।’

মহিলা বললেন, ‘কাউকে ডাকতে হবে না, আমি নাচিয়ে দেব।’

‘এর পর আমাকে ডাকলে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওপরের বাঙ্কে তুলে দেব। ঘুমোতে-ঘুমোতে ডেস্টিনেশনে। হরিবোল ইস্টিশন।’

বড়মামা ভিজিটের টাকা গুনে-গুনে পকেটে পুরলেন।

ভদ্রলোক করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘ডাক্তার আমাকে ত্যাগ কোরো না, তা হলে আমায় প্রাণত্যাগ করতে হবে।’

বড়মামা গাড়িতে বসে উত্তরটা দিলেন, ‘তোমার মতো দুধেল গোরুকে কেউ ত্যাগ করে? তোমার তো অসুখ নয়, ব্যায়রাম। ব্যায়রামের ব্যুৎপত্তি জানিস—ব্যয় করিলেই আরাম।’

পেয়ারাবাগানে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুটো। রোদের দুপুর চড়চড় করছে। গাছের পাতা ঝিম মেরে আছে। জায়গাটা এতই সুন্দর যে লোকে বলে, দ্বিতীয় বারাণসী। কোনও গাছে ঝাপড়া হয়ে আছে হলদে ফুল, কোনও গাছে সাদা। তামাটে-নীল আকাশ, হলুদ, সাদা ফুলের বাহার, নিঝুম সবুজ পাতা, ঘন ছায়া, এত বড়-বড় ফিঙে পাখি, শালিকের ঝাঁক।

মেটে রাস্তা দিয়ে ঢিকোতে ঢিকোতে চলেছে বড়মামার হিন্দুস্তান ফোর্টিন। যার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল সেটা যেন মুঘল আমলের দুর্গ। ছোট-ছোট লাল ইটে গাঁথা সুউচ্চ পাঁচিল। কয়েদি টপকাতে পারবে না। জায়গায়-জায়গায় সবুজ শৈবাল ছোট-ছোট পরগাছা। বিশাল একটা দরজা। হাতি গলে যাবে। বড়মামা হর্ন দিলেন। ঘড়ঘড় করে খুলে গেল দুর্গের দরজা। যেন স্বপ্ন খুলে গেল। লাল টুকটুক চওড়া একটা পথ ভেতরে হারিয়ে গেছে। শুধু গাছ আর গাছ। রঙের বিস্ফোরণ। মশমশ শব্দে গাড়ি দরজা অতিক্রম করে কিছুটা গিয়ে ঘস করে থামল।

অদ্ভুত এক শীতলতা, অদ্ভুত শান্তি। জীবনে প্রথম বাবুই পাখির বাসা দেখলাম। গাছের ডালে সার-সার ঝুলছে। প্রত্যেকটায় একটা করে গোল দরজা। একটা করে পাখির ঠোঁট উঁকি মারছে। এক জোড়া কুবো পাখি বিশাল লেজের ভারে টলবল করে উড়ছে। যে ডালে বসছে সেই ডালই ঝুঁকে পড়ছে দেহভারে। ছোট-ছোট পেয়ারাগাছ আষ্টেপৃষ্ঠে ফল ধরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দেখলাম আফ্রিকার কালো পেঁপেগাছ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব কালো। ক্রোটন অন্তত পঁচিশ-তিরিশ রকমের। ফার্ন বহুরকমের। রাশি-রাশি হাইব্রিড গোলাপ। অবাক-করা ডোরাকাটা গোলাপ। প্রায় এক-একটা বারকোশের মতো সূর্যমুখী। রং হল সানসেট ইয়েলো! গোল্ডেন কাঞ্চন। জিনিয়ার কী বাহার! পিটুনিয়া এখনও ফুটছে। হেঁটে-হেঁটে আর শেষ করা যাচ্ছে না। পান্থপাদপ পাতার পাখা মেলে উড়ে যেতে চাইছে। আয়নার মতো এখানে-ওখানে পড়ে আছে ছোট-ছোট জলাশয়। পাড় বাঁধানো বিশাল এক পদ্মপুকুর। বাতাসে পাতার কানগুলো মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে। বড়-বড় পদ্মফুল গোটা-গোটা ভ্রমরের অহঙ্কার ফেটে পড়ছে। বড়মামা একদিকে হারিয়ে গেছেন, আমি একদিকে। হেথায় আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।

‘আর পারি না।’ বলে, সিমেন্ট বাঁধানো একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। পায়ের তলায় মখমল-সবুজ ঘাস। হাতের পাতার চেয়েও বড় চিত্র-বিচিত্র প্রজাপতি ভেসে-ভেসে যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। আমি আর এখান থেকে যাব না। তামাটে রঙের চারজন বলশালী মানুষ দূরে একটা কিছু করছেন। রোদে চকচক করছে শরীর। মাথার ওপর ফড়িংয়ের ঝাঁক।

বহু দূর থেকে বড়মামার গলা, ‘শিগগির আয়।’

বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা কুঠিয়ার সামনে বড়মামা। জানলায় উঁকি মারছেন। দরজায় মরচে-ধরা তালা।

আগাছা, লতা, গুল্ম দণ্ডবৎ হয়ে আছে।

বড়মামা বললেন, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, উঁকি মেরে দ্যাখ।’

আলোছায়ায় একটা মূর্তি। পাথরের কোন দেবতার, বুঝলাম না। ‘একটা মূর্তি!’

বড়মামা খলখল করে হেসে বললেন, ‘মহাপ্রভু! চিনতে পারছিস না, মহাপ্রভুর মূর্তি।’ ‘কানু, কানু!’ বড়মামা ছুটছেন।

তামাটে বর্ণ মানুষদের মধ্যে একজন এগিয়ে এলেন, ‘কী হয়েছে ডাক্তারবাবু!’

‘মহাপ্রভুর মূর্তি।’

‘হ্যাঁ, অবহেলায় পড়ে আছেন বহুদিন। চোদ্দ বছর আগে এক বৈষ্ণব সাধক এখানে ছিলেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ”বৃন্দাবন দর্শন করে আসি” বলে সেই যে গেলেন, আর এলেন না।’

‘মূর্তি আমার চাই, যা লাগে।’

‘আপনি নেবেন! নিয়ে যান, একটা পয়সাও লাগবে না। রাতে আমার ঘুম হয় না। স্বপ্ন দেখি। কিছু না করতে পারার ভয়ে মরি।’

বড়মামা ঘর্মাক্ত সেই মানুষটিকে জড়িয়ে ধরলেন। ফড়িং উড়ছে, প্রজাপতি খেলছে, একঝাঁক টিয়া মহাকলরবে পেয়ারাগাছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনটে রাজহাঁস, চতুর্থটাকে গলা মিলিয়ে ডাকছে। বড়মামা কাঁদছেন। দমকা একটা বাতাসে গাছের মাথা দুলিয়ে দিয়ে গেল। কৃষ্ণচূড়ায় চূড়াপাতায় বাতাস নাচছে।

বহুকালের পুরনো চাবি। তালার প্যাঁচ আর ঘোরেই না। ফোঁদলে করে তেল ঢালা হল। একসময় ফস করে তালা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে ঠাকুর-ঠাকুর গন্ধ। মনে হল সঙ্কীর্তন চলছিল। এইমাত্র বন্ধ হল। দেওয়ালে একটি মৃদঙ্গ ঝুলছে। বেদির ওপর একজোড়া খঞ্জনি। বিছানার একটি রোল একপাশে। পূজার আসনটি আজও পাতা। মনেই হচ্ছে না ঘরটি অব্যবহৃত। কেউ কি রোজ গভীরে রাতে এসে সব পরিচ্ছন্ন করে পূজায় বসতেন! শ্বেতপাথরে দণ্ডায়মান মূর্তি যেন বড়মামাকে দেখে হাসছেন, ‘এসো, এসো, এগিয়ে এসো, চোদ্দটা বছর আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।’

বড়মামা এগোচ্ছেন। কোথায় পা পড়ছে দিশা নেই। মূর্তির সামনে তিনিও মূর্তি হয়ে গেলেন। আমাদের পণ্ডিতমশাই যেমন বলেন, কাষ্ঠপুত্তলিবৎ। চিত্রার্পিত। আমি অতশত বুঝি না; কিন্তু আমারও মনে হচ্ছিল মূর্তির একটা প্রভাব আমাদের মধ্যে ধীরে-ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সবাই বর্তমান ছেড়ে অতীতের দিকে চলেছি।

সন্ধে তখন প্রায় সাতটা। একটা ম্যাটাডর ভ্যানে আমরা বসে আছি। মহাপ্রভুর মূর্তি ধরে। আমাদের ঘিরে আছে ক্রোটন আর ফার্নের টব। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মেজোমামা আর মাসিমা।

তাঁরা দু’জনে ঝাঁ-ঝাঁ করে ওঠার আগেই বড়মামা চিৎকার ছাড়লেন, ‘ওরে শাঁখ বাজা শাঁখ বাজা, তিনি এসেছেন।’

দু’জনেই থ’ হয়ে গেছেন। অন্ধকারে হদিশ পাচ্ছেন না। পাতার ফাঁকে উকি মেরে দেখেই মাসিমা বললেন, ‘এ কী গো! এ কী সুন্দর!’

গাড়ির ওপর বড়মামার নৃত্য, ‘মহাপ্রভু এলেন, মহাপ্রভু।’

শাঁখ বাজল। ছুটে এসেছেন হরিদা। প্রথমে নামল গাছের টব। এইবার নামছেন মহাপ্রভু, ধীরে, সাবধানে, সন্তর্পণে। শীতল, মসৃণ। চন্দনের গন্ধ। গাড়িতে যতক্ষণ ধরে বসে ছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমার সবচেয়ে প্রিয়জনকে ধরে আছি। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা কত সুন্দর।

দোতলার বারান্দায় এসে বসলেন মহাপ্রভু। যেন বাড়ির সর্বময় অভিভাবক! গলায় দুলছে জুঁইফুলের গোড়ের মালা। সবাই বসেছি সামনে।

হরিদা বললেন, ‘অনেক আশ্চর্য দেখেছি, এমন দেখিনি কখনও। মহাপ্রভুর এমন সুন্দর মূর্তি তোমার জন্যে অপেক্ষা করে ছিলেন পেয়ারাবাগানে! এমন মূর্তি সহসা দেখা যায় না!’

বড়মামা বললেন, ‘আমি আজ সকালে আমাদের ডাক্তারবাবুর স্ত্রীর অবস্থা দেখে ঠিক করেছি, অনাথ মেয়েদের জন্যে একটা আশ্রম করব। যেখানে কর্মই হবে ধর্ম। ধর্মই কর্ম নয়।’

মেজোমামা বললেন, ‘গুড আইডিয়া।’

মাসিমা বললেন, ‘এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে আমাদের বাবা আর মায়ের নাম। আমাদের মা জীবনে কোনও সুখই পাননি। আমাদের বিপ্লবী বাবার জন্যে সব ত্যাগ করেছিলেন। ছেঁড়া কাপড়, দিনের পর দিন উপোস।’