খাঁ বাড়ির অন্দরমহল

হাজেরা খান: (জন্ম : ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : গাজীউদ্দিন চৌধুরী। আমার মা কণিকাড়া চৌধুরীবাড়ির সন্তান। কণিকাড়া চৌধুরীবাড়িতে মেয়েদের কোনো স্কুলে ভর্তি করানো হতো না। মেয়েদের জন্য গভর্ন্যাস নিয়োগ করা হতো। আমার মা ও তার ছোট বোন সুফিয়া খালার জন্য ঢাকার নবাববাড়ির এক বিধবা মহিলাকে গভর্ন্যাস নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর কাছে আম্মা নামাজ, রোজা, উর্দু ভাষা, রান্না করা এবং সেলাই করা শেখেন। বাড়ির ছেলেদের কাছ থেকে বাংলা পড়তে এবং লিখতে শেখেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তিনি স্বামীর ঘরে গিয়ে আরও ভালোভাবে বাংলা শেখেন। অবসর পেলে বাংলা বই ও খবরের কাগজ পড়তেন। নিজে উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তিনি নবীনগর ইচ্ছাময়ী গার্লস স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে বহুবার সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরিচালনা পর্ষদে থাকাকালীন তিনি ভালো শিক্ষক নিয়োগের ওপরে জোর দিতেন এবং দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। নবীনগর ও রসুল্লাবাদের খাঁ বাড়ির ভূসম্পত্তি তিনি একাই দেখাশোনা করতেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি ২০০৪ সালের ১৪ অক্টোবর তারিখে মারা যান।

হেনা খান: (জন্ম ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। লেখাপড়ায় খাঁ বাড়ির মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। খাঁ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আমীর আলী খাঁর মেয়ে নীলুফার আহমদ (১৯৫৪)। খাঁ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্নাতক হন ইয়াকুব আলী খাঁর প্রথম কন্যা ফরিদা খান। তিনি ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ইয়াকুব আলী খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা মুমতাজ খান গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। হেনা খানের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর সংসার করতে করতে তিনি আস্তে আস্তে লেখাপড়া করতে থাকেন এবং ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট, বিএ এবং এমএ পাস করেন। তিনি ১৯৭২ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৮০-এর দশকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে ছিলেন। সেখানে অভিবাসন বিভাগের প্রবাসীকল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এবং সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

নীলুফার আহমদ (বীণা): (জন্ম : ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আমীর আলী খ। নীলুফার আহমদ ১৯৩৩ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্প বয়সে তিনি তার মাকে হারান। তিনি ঢাকার কামরুননেছা গার্লস স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের কর্মকর্তা এ কে এন আহমদকে বিয়ে করেন। ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলায় তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি ঢাকা চারুকলা বিদ্যালয় থেকে চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তারপর আশির দশকে লন্ডনের চেলসি কলেজ অব আর্টস থেকে চিত্রকলা, ভাস্কর্য এবং স্কেচিংয়ে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৭ সালে তার দুটি চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। My Little World নামে তার একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

বেলা খান: (জন্ম : ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ফজলে আলী খাঁ। বেলা খান ফজলে আলী খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল হামীদ চৌধুরীকে বিয়ে করেন। আবদুল হামীদ চৌধুরী ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের শাসনকালে তিনি কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

সালমা ইসলাম (রেখা): (জন্ম : ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : আমীর আলী খাঁ। সালমা ইসলামের লেখাপড়া শুরু হয় নবীনগর ইচ্ছাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে। তবে স্কুলের লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। এর কারণ ছিল এই যে, বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তিনি ছিলেন খুব লম্বা। এ ধরনের লম্বা পাত্রীর জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া খুবই কঠিন। ছিল। উপরন্তু ওই সময়ে তার পিতার শরীর ভালো ছিল না। কাজেই বাইরা গ্রামে বসবাসরত দীর্ঘদেহী ও এমএ পাস নূরুল ইসলামের বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। গ্রামে থাকলেও সালমা খানের লেখাপড়ায় আগ্রহ মোটেও কমেনি। তিনি গ্রামে থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং আইএ পরীক্ষায় পাস করেন। বিএ পরীক্ষা তিনি দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাস করে উঠতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল এবং আমৃত্যু তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার বইপত্র পড়াশোনা করতেন। তার চার ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে।

হামীম খান: (জন্ম : ৩ জুন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ৩১ মে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। স্বামী : ড. আকবর আলি খান। হামীম খান ১৯৪৯ সালের ৩ জুন ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ডা. মুজিবুর রহমান। ডা. মুজিবুর রহমানের পৈতৃক নিবাস সন্দ্বীপে। তিনি ১৯৩০-এর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এবং কলকাতায় ট্রপিক্যাল স্কুলে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। হামীম খানের জন্মের পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাতে যান। সেখান থেকে তিনি চর্মরোগ এবং প্রাচ্যদেশীয় বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে ডিপ্লোমা অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার পর উপযুক্ত পদোন্নতি না দেওয়ায় তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং স্বাধীনভাবে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সহজ ডাক্তারি নামে বাংলা ভাষায় চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপরে একটি বই লেখেন এবং সেটি খুবই জনপ্রিয় হয়।

হামীম খানের মায়ের নাম জাহানারা রহমান। জাহানারা রহমানের পিতা ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। জাহানারা রহমান লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন এবং ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পঞ্চাশের দশকে বেগম জাহানারা রহমান ঢাকার বিভিন্ন সমাজসেবামূলক ক্রিয়াকাণ্ডে অংশ নেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নূনের স্ত্রী ভিকারুননিসা নূনের নেতৃত্বে তিনি ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল স্থাপনে বিশেষ অবদান রাখেন। বিশেষ করে কন্যাসন্তানদের স্কুলে পাঠাতে রাজি করানোর জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সম্মতি আদায় করেন।

১৯৬০-এর দশকে তিনি অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (APWA) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। তার মেয়াদকালে পশ্চিম পাকিস্তানের মারি শহরে APWA-এর সাধারণ সভা হয় এবং এ সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দলের নেতৃত্ব দেন। ষাটের দশকেই তিনি APWA ছাড়াও উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (WVA) সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের WVA সভাপতি নির্বাচিত হন এবং লালমাটিয়ায় মেয়েদের জন্য WVA কলেজ স্থাপনে নেতৃত্ব দেন।

হামীম খানের বড় ভাইয়ের নাম ড. এহসানুর রহমান। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিসিএস পাস করার পর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি হৃদরোগের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যে হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

হামীম খান সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুল থেকে ‘ও লেভেলে প্রথম শ্রেণিতে পাঁচটি বিষয়ে পাস করেন। এরপর ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ফলে তাঁর এমএসসি পরীক্ষা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৩ সালের দাঁড়ানো জাহানারা রহমান ও ডা. মুজিবুর রহমান। উপবিষ্ট এহসানুর রহমান এবং হামীম রহমান (শৈশবে) আগস্ট মাসে আমার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আমি কানাডিয়ান কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় চলে যাই। হামীম খানও কানাডাতে চলে আসেন।

হামীমের সঙ্গে আমার বিয়ে একটি আকস্মিক ঘটনা। চাকরিতে যে বেতন পাচ্ছিলাম, তাতে আমার নিজের খরচই চলছিল না। তাই আমি বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। ১৯৭৩ সালে আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দিই। এই সময়ে আমি কানাডার কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে কানাডায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডায় চলে যাচ্ছি–এই খবরে আমার পিতা-মাতা ভেঙে পড়েন। বিশেষ করে আমার মা দাবি করেন যে তিনি আমার সব খামখেয়ালি মেনে। নেবেন, যদি আমি বিয়ে করে বউ নিয়ে কানাডায় যাই। মায়ের কান্নাকাটিতে এবং ভাইবোনদের পীড়াপীড়িতেও আমি বিয়ে করতে রাজি হই না। এই পর্যায়ে আমার পিতা হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আমাকে ডেকে বলেন, তার বয়স প্রায় ৮০ এর কাছাকাছি এবং তিনি বেশ অসুস্থ। চার বছর পর যদি পিএইচডি করে দেশে ফিরে আসি, তাহলে হয়তো কানাডা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা হবে আমার শেষ দেখা। আমি তাঁর বড় ছেলে। বড় ছেলেকে নিয়ে সব পিতা-মাতারই অনেক স্বপ্ন থাকে। তিনি বললেন, তিনি স্বপ্ন দেখতেন তার বড় ছেলে তার লাশ কবরে নামাবে। তার বড় ছেলের সন্তানেরা বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। অথচ আমি এখনো বিয়েই করিনি। যদি তিনি আমার বউকে আশীর্বাদ করে যেতে পারেন, তাহলেও মনে কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। এই বলে তিনি কাঁদতে থাকেন। বাবার কান্নায় আমিও ভেঙে পড়ি এবং তার প্রস্তাবে রাজি হই।

তখন আমার কানাডা যাওয়ার আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি। কনে খোঁজার সময়ও ছিল অত্যন্ত সীমিত। আমার আম্মা এবং আমার বড় বোন বীণা আপা উপযুক্ত কনে খুঁজতে শুরু করেন। তাঁদের কাছে হামীম খান একজন। গ্রহণযোগ্য কনে বলে মনে হয়। হামীম খান আমার মামাতো ভাই আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রীর ফুফাতো বোনের মেয়ে। আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বিয়ের প্রস্তাব দেন। যে বিষয়টি সবচেয়ে আমার মাকে আকৃষ্ট করে, সেটি হলো হামীম খান একজন ভালো ছাত্রী। সুতরাং তিনি ধরে নেন যে এই কনেই তাঁর ছেলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আম্মা এবং বীণা আপা আমাকে পাত্রী দেখতে বলেন। আমি তাতে রাজি হইনি। তার কারণ হলো পাত্রী দেখে যদি আমি বলি যে পাত্রী আমার পছন্দ হয়নি, তাহলে সবাই ধরে নেবে আমি ফাঁকি দিতে চাচ্ছি এবং আমার বক্তব্য গ্রহণ করা হবে না। দ্বিতীয়ত, যদি একজন শিক্ষিত পাত্রী আমাকে না দেখে বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে আমারও। তাঁকে বিয়ে করতে ভয় পাওয়া উচিত নয়। সুতরাং আমি দেখতে রাজি হইনি এবং বিয়ের আগে আমরা একে অপরকে দেখিনি। বয়সে আমরা ছিলাম কাছাকাছি। তিনি আমার চেয়ে সাড়ে চার বছরের ছোট ছিলেন।

বিয়ের পর দেখা গেল আমাদের মধ্যে যতটুকু মিল রয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, ধর্মকর্মের ব্যাপারে ছিলাম উদাসীন। অন্যদিকে হামীম শুধু ধার্মিকই ছিলেন না, অনেক বিষয়ে ছিলেন মৌলবাদী। আমার শ্বশুর মুজিবুর রহমান সাহেবও অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাসের প্রভাব তার মেয়ের ওপরে পড়েছিল। আমি গ্রামে মানুষ হয়েছি, হামীম খানের গোটা জীবনই ঢাকা শহরে কেটেছে। সেদিক থেকেও আমাদের মধ্যে তফাত। ছিল। আমি ছোট মাছ পছন্দ করতাম, তিনি তা মোটেও পছন্দ করতেন না। আমি বাংলা গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করতাম, তার পছন্দ ছিল হিন্দি গান। অনেক ছোটখাটো ব্যাপারে আমরা একমত ছিলাম না। বিয়ের প্রথম দিকে এসব নিয়ে কিছুটা খটাখটি হয়েছে, তবে হামীমের সহযোগিতার ফলে বিশেষ কোনো সমস্যা হয়নি।

আমাদের বিয়ে হওয়ার পর হামীমের কানাডার ভিসার জন্য দরখাস্ত করতে হয়েছে। তাই আমরা একসঙ্গে কানাডা যেতে পারিনি। হামীমকে মাসখানেক পর কানাডাতে আমার সঙ্গে যোগ দিতে হয়েছে। কানাডায় আসার আগে গৃহবধূর কাজকর্মে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। ভালো ছাত্রী হিসেবে শুধু বই পড়তেন কিন্তু রান্নাঘরের ধারেকাছেও যেতেন না। কানাডায় যাওয়ার পর তাঁর রান্নার দায়িত্ব নিতে হয়। ঢাকা থেকে যাওয়ার আগে তাঁর মার কাছ থেকে বেশ কিছু রান্নার রন্ধনপ্রণালি লিখে নিয়ে যান। প্রথম দিকে রান্না ভালো হতো না কিন্তু কোনো রান্না ভালো না হলে তিনি হতাশ হয়ে যেতেন না। খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন কী ঠিকমতো করা হয়নি। রাঁধতে রাঁধতে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ভালো রাঁধুনি হয়ে যান। বাড়িতে কাপড়চোপড় ধোয়া, শুকানো এবং ইস্তিরি করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। বিয়ের আগে আমি অনেক সময় ইস্তিরি ছাড়া জামাকাপড় পরতাম কিন্তু বিয়ের পর ইস্তিরি করা ছাড়া কোনো জামাকাপড় হামীম আমাকে পরতে দেননি। এমনকি আমার জুতা পর্যন্ত। তিনি পরিষ্কার করে দিতেন। একজন স্বামীকে সন্তুষ্ট করার জন্য গৃহবধূর যা করা আবশ্যক, তার সবই তিনি করেছেন।

গতানুগতিকভাবে সব স্বামীই তাঁদের স্ত্রীদের কাছে ঋণী থাকে, কিন্তু হামীম খানের কাছে আমার ঋণ শুধু গতানুগতিক নয়। তিনটি বিষয়ে তিনি আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রথমত, আমি যখন কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে যাই, তখন অঙ্ক সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল সীমিত। প্রবেশিকা পরীক্ষার বাধ্যতামূলক অঙ্ক ছাড়া আমি আর কোনো অঙ্ক পড়িনি। অথচ কুইন্সের অর্থনীতি বিষয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতর পর্যায়ের অঙ্ক জানার আবশ্যকতা ছিল। হামীম খান পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও তিনি অঙ্কে। খুবই দক্ষ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর কর্মজীবনে অঙ্কের শিক্ষকতাই করেছেন। অঙ্কে আমার দুরবস্থা দেখে তিনি আমাকে অঙ্ক শিখতে সাহায্য করেন। তার সহায়তার ফলেই আমার পক্ষে কুইন্সের অর্থনীতির জটিল কোর্সগুলো সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। তার হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল না এবং লেখার সময়ে অনেক কাটাকাটি করতাম। তাই তিনি স্বেচ্ছায় কোর্সের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবন্ধসমূহের কপি নিজের হাতে করে দিতেন। এর ফলে আমার সময় বেঁচে যায়।

দ্বিতীয়ত, হামীম খানের চেষ্টার ফলেই আমি সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পেরেছি। আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি ছিলাম চেইন স্মোকার। হামীম খান। বিশ্বাস করতেন সিগারেট খাওয়া না ছেড়ে দিলে আমি অল্প বয়সে মারা যাব। তাই সিগারেট খাওয়া নিয়ে আমাদের দুজনের প্রায়ই প্রচণ্ড ঝগড়া হতো। কিন্তু তিনি কোনোমতেই এ ব্যাপারে আপস করতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত এ লড়াইয়ে আমি হেরে যাই। এর কারণ হলো ১৯৭৭ সালে আমার আলসার হয় এবং আলসার থেকে রক্তপাত হওয়ার পরে আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়। ডাক্তাররা তখন বলেন যে সিগারেট খাওয়া বন্ধ না হলে ঘন ঘন আলসার হতে পারে। সুতরাং দীর্ঘজীবন চাইলে আমাকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে। এ সময়ে আমাদের মেয়ের জন্ম হয়েছে। হামীম খান তখন প্রায়ই কাঁদতেন এই বলে যে তাঁর মেয়ে অদূর ভবিষ্যতে পিতাকে হারাবে। হামীম খানের চাপ, ডাক্তারদের হুঁশিয়ারি এবং মেয়ের জন্য ভালোবাসার ফলে আমার মধ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসে। আমি ১৯৭৭ সালে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিই। সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সব ঝুঁকি দূর হয়ে যায় না। সব ঝুঁকি দূর হতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগে। প্রায় ৪৫ বছর হলো আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। হামীম খান এবং আমার কন্যা উভয়ই পরলোকগমন করেছেন কিন্তু এখনো আমি বেঁচে রয়েছি। হামীম খানের কল্যাণেই সম্ভবত আমার জীবন দীর্ঘ হয়েছে।

তৃতীয়ত, হামীম খান কোনো দিনই হারাম উপার্জনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বেশি টাকা চাইতেন না কিন্তু চাইতেন যেন সব রোজগার হালাল হয়। সরকারি চাকরিতে অনেক প্রলোভন রয়েছে। এই প্রলোভন থেকে আত্মরক্ষা করতে হলে অবশ্যই কর্মকর্তাকে ঘুষ ও অবৈধ উপার্জনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে হয়। এই ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাকে সাহায্য করতে পারেন তাঁর স্ত্রী ও তাঁর পরিবার। যদি সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী ও পরিবার সহজ-সরল জীবনযাত্রায় সন্তুষ্ট থাকেন এবং অবৈধ অর্থকে ঘৃণা করেন, তাহলেই সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে সৎ থাকা অনেক সহজ হয়। হামীম খান সারা জীবনই অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন। তিনি সৎ থাকার জন্য আমাকে সমর্থন করেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। ঘটনাটি ঘটেছিল আমি যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলাম। ঈদুল আজহার সময় অনেক করদাতা ও কর কর্মকর্তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের নেকনজরে আসার চেষ্টা করতেন। ঈদুল আজহার সময় তাঁদের অনেকেই খাসি ও গরুর রান চেয়ারম্যানের বাসায় পাঠাতেন। আমি ও হামীম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে এ রকম কোনো মাংস এলে তা কোনোমতেই গ্রহণ করা হবে না এবং তা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে।

ঈদের দিন বিকেলবেলা আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য তার বাসায় যাই। সে সময়ে হামীম খান একা বাসায় ছিলেন। একটি মাইক্রোবাসে করে এক ভদ্রলোক বিরাট একটি গরুর রান নিয়ে আসেন। তিনি দাবি করেন টি রহমান সাহেব কোকো লঞ্চ কোম্পানির পক্ষ থেকে এ রান পাঠিয়েছেন। এটি যেন রাখা হয়। আমার স্ত্রী নির্দেশ পাঠালেন কোনো অবস্থাতেই এটি রাখা হবে না এবং এটি যেন ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। বাহক বিড়বিড় করে হুমকি দিতে দিতে চলে যান।

আমি আসার পর আমার স্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করেন, কোকো লঞ্চ কোম্পানির টি রহমান কে? তার মাংস আমি ফেরত দিয়ে দিয়েছি। আমি বললাম, তিনি প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। আমি তাকে আরও বললাম, আমি নিজে বাসায় থাকলে এভাবে ফেরত দিতে আমার ভয় হতো কিন্তু তুমি আমাকে এ ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছ। এখানে একটি সত্য কথা অবশ্যই লিপিবদ্ধ করতে হবে যে আমি যত দিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলাম, তত দিন প্রধানমন্ত্রীর। পরিবারের পক্ষ থেকে কর সম্পর্কে কখনো কোনো তদবির আমার কাছে করা হয়নি। অনুরূপভাবে আমি যখন অর্থসচিব ছিলাম, তখনো পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পরিবার এবং অফিস থেকে কখনো কোনো তদবির পাইনি।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে হামীম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির জন্য তাকে নিয়ে যাই। বিভাগীয় প্রধান তার সুপারভাইজারের প্রশংসাপত্র দেখতে চাইলেন। তার সুপারভাইজারও (খুব সম্ভব ড. সিদ্দিক) কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের গ্র্যাজুয়েট স্কুলের প্রধান ছিলেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী। হামীমের প্রশংসাপত্র পড়ে তিনি বললেন, আমি তোমাকে সরাসরি এমএসসি ক্লাসে ভর্তি করে নিলাম। এমএসসি পরীক্ষার ভর্তি ফি এবং অন্যান্য ব্যয় অনেক বেশি। সুতরাং যাতে কোনো আর্থিক অসুবিধা না হয়, সেহেতু তিনি হামীমকে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট করার প্রতিশ্রুতি দেন। দু-তিন। দিন ক্লাস করার পর হামীম খান ঠিক করলেন যে তিনি পড়াশোনা করবেন না। অনেক বোঝানোর পরও তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তিনি কুইন্সের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধানকে জানিয়ে দেন যে ব্যক্তিগত কারণে তিনি এখন ভর্তি হবেন না। তার ভর্তি না হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না। সুতরাং বাসে করে ক্লাসে যেতে তাঁকে ঠান্ডার মধ্যে কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। এটি করতে তিনি রাজি ছিলেন না। তিনি ঘুমাতে পছন্দ করতেন। তখন আমরা জানতাম না কী জন্য তিনি ঘুমাতে পছন্দ করতেন। ১৯৯০-এর দশকে ধরা পড়ে তিনি muscular distrophy নামে একটি স্নায়বিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার ব্যাধিকে সংক্ষেপে মায়োটনিয়া (myotonia) বলা হয়ে থাকে। এই রোগে শরীরের বিভিন্ন পেশি অকেজো হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে এ রোগ ছড়াতে থাকে। বিশেষ করে হৃৎপিণ্ডের পেশি এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। ১৯৯০ সালে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন বাংলাদেশ দূতাবাসে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলাম, তখন ডাক্তারের পরামর্শে তাকে টেস্ট করা হয়। টেস্ট করার পর প্রমাণিত হয় যে তার মায়োটনিয়া হয়েছে। বাইরের দিকে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরের দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলতেন। অনেক রাতে বুকে ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। এ ধরনের রোগীদের অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে খুবই সাবধান হতে হয়। ২০১৬ সালে তার অন্ত্রনালিতে কোনো প্রদাহ আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে এন্ডোসকোপি (endoscopy) করার জন্য ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ডাক্তারদের জানানো হয় যে যেহেতু তার মায়োটনিয়া রয়েছে, সেহেতু অস্ত্রোপচারের জন্য কোনো চেতনানাশক পদার্থ প্রয়োগ করার আগে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের ডাক্তাররা সতর্কতা অবলম্বন করেননি। তারা দাবি করেন যে স্বল্পমাত্রায় চেতনানাশক ব্যবহার করলে কোনো অসুবিধা হবে না। ডাক্তাররা যে মাত্রার চেতনানাশক ব্যবহার করেছিলেন, তা আমার স্ত্রী সহ্য করতে পারেননি। ফলে তাঁর হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে হৃৎপিণ্ড চালু করার পরও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। দুদিন পর তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যান। ইচ্ছা করলে হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমি ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারতাম। আদালত হয়তো আমাকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতেন কিন্তু আমার স্ত্রীর প্রাণ তো আর ফিরে আসত না। তিনি ছিলেন আমার পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। আমি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিইনি কিন্তু আল্লাহ নিশ্চয়ই দোষীকে শাস্তি দেবেন।

ছোটবেলায় হামীমকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতেন যে বড় হয়ে তিনি কী হতে চান, তিনি উত্তর দিতেন মাদাম কুরি। বাংলাদেশের মাদাম কুরি হওয়া ছিল তাঁর লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার ফলাফল দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি হয়তো একজন বড় বিজ্ঞানী হবেন। বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ায় তাঁর পক্ষে বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বিজ্ঞানে গবেষণা না করলেও তিনি অঙ্কের শিক্ষকতা শুরু করেন। ঢাকার সানবীমস স্কুলে ২০ বছর ধরে তিনি প্রায় হাজারখানেক ছাত্রছাত্রীকে যত্ন করে অঙ্ক শিখিয়েছেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদিও হামীম খান মাদাম কুরি হতে পারেননি, তিনি মাদাম কুরি গড়ার কারিগর হওয়ার জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন।

নেহরীন খান: (জন্ম : ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু : ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। পিতা : ড. আকবর আলি খান। নেহরীন খান ১৯৭৭ সালের ১২ জুলাই তারিখে কানাডার কিংস্টন শহরের জেনারেল হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করে। ১৯৭৯ সালে মা-বাবার সঙ্গে সে দেশে ফিরে আসে। ১৯৮০ সালে তাকে কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু স্কুল তার মোটেও ভালো লাগত না। ক্লাসরুমে যাওয়ার পরই সে তার আম্মার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিত। ১৯৮১ সালে তাকে ধানমন্ডির সানবীমস স্কুলে ভর্তি করা হয়। তার মা সে সময় সানবীমস স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা শুরু করেন। মা স্কুলে থাকার ফলে সানবীমসে সে আর কান্নাকাটি করত না। ১৯৮৭ সালে তার বাবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে বদলি হন। নেহরীন মন্টগোমারি কাউন্টিতে বেভারলি ফার্মস স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। এরপর পোটোম্যাকের হার্বার্ট হুভার নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই বছর পড়ে। ১৯৯১ সালে সে ঢাকায় ফিরে আসে। ঢাকায় ফিরে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা দেয়। পরে এসব পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি। তার মায়ের ধারণা ছিল যে তার মেয়ে তার মতোই মেধাবী। সুতরাং সে একজন বিজ্ঞানী হবে এবং খুব সহজেই বিজ্ঞান বিষয়ে সে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পাস করবে। এখানে তার মা একটি বড় ভুল করেছিল। নেহরীনের বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ ছিল না। সে গল্প শুনতে পছন্দ করত। ইতিহাস পড়ায় তার আগ্রহ ছিল। সাহিত্যের বদলে বিজ্ঞান চাপিয়ে দেওয়াকে সে সহজে মেনে নিতে পারেনি। তবু সে মায়ের দাবি পূরণ করার চেষ্টা করত। ছোটবেলায় তার হাতের লেখা ছিল খারাপ। তার হাতের লেখাকে ভালো করার জন্য সে যখন লিখত তখন মা তার পাশে বসে থাকতেন এবং লেখা খারাপ হলে আঙুলে আঘাত করতেন। সে কান্নাকাটি করত। প্রায় বছরখানেক কান্নাকাটি করার পর সে তার হাতের লেখা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। মা ধরে নেন যে নেহরীন হাতের লেখা পরিবর্তনের মতো বিজ্ঞানশিক্ষাতেও সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু সেটি কোনোমতেই সম্ভব হয়নি। আমি তাকে জোর করে বিজ্ঞান পড়ানোর বিরোধী ছিলাম। এমনকি আমি তাকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম সে বাংলা মিডিয়ামে ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে দেশের অন্য ছেলেমেয়েদের মতো লেখাপড়া করুক। তার মা এতে মোটেও রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা মিডিয়ামের মান নিচু। হয়তো তার মায়ের বক্তব্য সঠিক কিন্তু অন্যদিকে নেহরীনের একটি বড় লোকসান হয়ে যায়। বাংলা মিডিয়ামে পড়লে তার অনেক বন্ধু হতো কিন্তু ইংরেজি মিডিয়ামে পড়তে গিয়ে সে তার প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত যখন প্রমাণিত হলো যে নেহরীনের পক্ষে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া সম্ভব নয়, তখন তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে ভর্তি করা হয়। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের শেষ পর্যায়ে নেহরীন খানের বাবা বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে মনোনীত হন। সে বাবার সঙ্গে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে ওয়াশিংটনে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে (The American University at Washington D.C) ভর্তি হয় এবং ২০০৫ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ ডিগ্রি অর্জন করে। সে দেশে ফিরে পুনরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে।

কর্মজীবন: নেহরীন খান ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়। এক সেমিস্টার পড়ানোর পর সে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) এ প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয় এবং কিছুদিন পর সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পায়। ২০১৬। সালে তার অকালমৃত্যু পর্যন্ত সে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে ভিক্টোরিয়ান সাহিত্য, রোমান্টিক সাহিত্য ও শেক্সপিরিয়ান সাহিত্য পড়াত।

জীবনের ছোট গণ্ডি: আমার একমাত্র সন্তান নেহরীন খান তার আত্মজীবনীর খসড়ায় লিখেছে, ‘My parents also doted on me but now as I remember my childhood I think I was being protected as well as being spoilt. I had no friends at that age. My friends were my grandparents, my father and my mother.’ বয়স বাড়লে সে তার নিজের বয়সী বন্ধুদের পরিবারের মধ্যেই খুঁজে পায়। তার বন্ধু ছিল হামীমের খালাতো বোন লিনেটের মেয়ে ফারাহ। হামীমের ছোট মামা মাহমুদ হাসান (যিনি অগ্রণী ব্যাংকের এজিএম ছিলেন)। তার দুই মেয়ে টুইংকেল এবং টিনা ও হামীমের মেজ মামা শামসুল আলম (যিনি ছিলেন চট্টগ্রামের চা ব্যবসায়ী) তার মেয়ে নীলা ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ ছাড়া প্রতিবছর আমার ছোট ভাই জসীম এক মাসের জন্য ছুটিতে তার দুই মেয়ে জারা ও জেবাকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে আসত। তা ছাড়া ঢাকায় ছিল আমার ছোট ভাই কবীরের বড় মেয়ে তিথি। এরা একসঙ্গে খেলত। তবে পরিবারের বাইরে তার কোনো বন্ধু ছিল না।

সারা জীবনই নেহরীন তার বাবা এবং মাকে সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন তার বাবা প্রতিদিন তাকে সকালে স্কুলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন এবং রাতে ক্লাস থাকলে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। একবার ওয়াশিংটন ডিসিতে গুপ্তঘাতকের প্রকোপ দেখা দেয়। এই সময়ে নেহরীন খানের পিতা তাকে সব সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন এবং নিয়ে আসতেন। একবার তারা যখন বাসায় ফিরছিলেন, তখন পুলিশ তাদের সামনে দিয়ে ঘাতকের গাড়ি তাড়িয়ে নিয়ে যায়। নেহরীন পিতার সাহচর্য খুবই পছন্দ করত। যেদিন সে মারা যায়, সেদিন সকালে সে তার পিতার কপালে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছিল। তার পিতা তাকে জিজ্ঞেস করেন কী হয়েছে, মা? সে জবাবে বলল যে তার পিতা সজাগ আছে কি না সেটা দেখছে। তার মৃত্যুর পর তার পিতার মনে হয় সে তার বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে।

নেহরীনের বিশ্বাস ছিল, তার মা তাকে যেকোনো বিপদ বা অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন। ছোটবেলায় তাকে একটি গল্প শোনানো হতো, গল্পটি ছিল এ রকম–একটি হাতির বাচ্চাকে দুষ্ট লোকেরা চুরি করে। নেহরীন এ গল্প বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে সে প্রশ্ন করে, ‘হাতির মা কী করল?’ তার বিশ্বাস ছিল যে হাতির বাচ্চার মা-বাবা নিশ্চয় তাকে রক্ষা করবে। এ ধারণাটি অবশ্যই ভুল। নেহরীন তার জীবন দিয়ে শিখে গেল বাবা-মা সব সময় তাঁর সন্তানকে রক্ষা করতে পারেন না।

নেহরীনের অসমাপ্ত গবেষণা: নেহরীন তার স্বল্পস্থায়ী জীবনে তিনটি বিষয়। নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রথম বিষয়টি হলো ইংরেজিতে যাকে বলে Home, বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে ঘর। নেহরীন সারা জীবন ঘর খুঁজে বেড়িয়েছে। জন্ম তার কানাডায়। প্রায় দেড় বছর বয়সে কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসে। আবার ১০ বছর বয়সে চার বছরের জন্য পিতার তত্ত্বালীন কর্মস্থল আমেরিকাতে চলে যায়। চার বছর আমেরিকায় থাকার পর দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরে এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি শেষ করার আগে আবার ২০০২ সালে তিন বছরের বেশি সময়ের জন্য পিতার কর্মস্থল আমেরিকাতে যায় এবং বছর তিনেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। বাংলাদেশ, কানাডা এবং আমেরিকায়। বারবার যাওয়া-আসার ফলে তার অভিবাসী সাহিত্যের ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে। ভারতী মুখার্জি, ঝুম্পা লাহিড়ী, মণিকা আলী প্রমুখ ছিল তার প্রিয় লেখক। অভিবাসীদের সত্তাসংকট বা Identity crisis ছিল তার আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার বিষয়। নেহরীন লক্ষ করে যে অভিবাসীদের মধ্যে ঘরে ফেরার একটি প্রচণ্ড ঝোঁক রয়েছে কিন্তু অর্থাভাবে তারা কম বয়সে দেশে ফিরতে পারে না। যখন তাদের অর্থাভাব দূর হয়, তখন তারা দেশে ফিরতে চায়; কিন্তু দেশে ফিরে দেখতে পায়, যে দেশ ছেড়ে তারা গিয়েছিল, সে দেশ আর নেই। কালের বিবর্তনে সে দেশ হারিয়ে গেছে এবং এখন যে দেশ, সে দেশকে সে চেনে না। এ প্রসঙ্গে সে লিখেছে :

The immigrants imagine that their old home is like Keats’s Grecian Urn where nothing changes. The returning immigrants discover to their utter surprise that their dear and near ones have either passed away or changed. The new inhabitants in their homeland are unknown. The homeland that is vivid in their mind does not exist any longer.

তার গবেষণার দ্বিতীয় বিষয় ছিল মোনালিসা। ১৯৯৮ সালে নেহরীন আমার সঙ্গে প্যারিস লুভ জাদুঘরে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসার ছবি দেখতে যায়। ছবিটি দেখে সে লেখে :

One thing that struck me as I looked on was how alive and real she looked. This picture portrays an actual woman of flesh and blood. She had lustreous almond shaped eyes with a watery sheen on them. She had quite visible eyebrows and eyelashes. It was so clear a picture that even the hair ends from her forehead could be seen. She looks so much alive that she seem to look back at the onlooker. Even the shadow of her nose was visibles and the fleshy inside of her nostrils were visible. Her lips curved into a pleasing smile though her face wore a melancholy look. Leonardo da Vinci copied every little cletail and every little line bring the portrait to life.

মোনালিসাকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে সে আমাদের ঘরের মধ্যেই তার এক দোসর খুঁজে পায়। এ দোসরের নাম হলো লিপি। লিপি নেহরীনের ফুফাতো বোন। সে কানে শুনত না এবং কথা বলতে পারত না। অথচ সে সুন্দরী ছিল, চটপটে ছিল এবং জীবনকে ভালোবাসত। তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার একটি ছেলে, একটি মেয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামী, ছেলেমেয়ে তাদের কারোর সঙ্গেই তার পুরোপুরি সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মোনালিসার সঙ্গে তুলনা করে সে লিখেছে :

Mona Lisa has a smile like her but Mona Lisa does not say anything and she is just a painting. But my cousin is a real human being. Mona Lisa will always remain smiling and she can never change her expression but my cousin can because she is capable of all emotions and can express them all. I dreamt of speaking to Mona Lisa because it is easy to do so but it is not at all easy to dream of speaking to Lipi. I wanted to hear Mona Lisa’s voice and I did in my dreams but I cannot hear my cousin speak. I would do anything to make her say a full sentence.

তার অসমাপ্ত নোটগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সে মোনালিসা, লিপি এবং হেলেন কেলারকে নিয়ে একটি গল্প লেখার চেষ্টা করছিল। তিন নায়িকা সম্বন্ধেই আলাদা আলাদাভাবে অনেক কিছুই লিখেছে। এগুলো একত্র করলে হয়তো একটি সুন্দর গল্প রচিত হতে পারত।

নেহরীনের তৃতীয় গবেষণার বিষয় ছিল ভারতে মহিলাদের অবস্থান। নেহরীন শুধু ভারতীয় মহিলাদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়েই চিন্তিত ছিল না, সে ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক দুরবস্থা নিয়েও অনেক বেশি চিন্তিত ছিল। এ জন্য প্রয়োজন মহিলাদের চেতনার সম্প্রসারণ। এ সম্পর্কে লেখার জন্য সে আরও পড়াশোনা করছিল। নেহরীন খান কোনো লেখাই শেষ করে যেতে পারেনি। তবে তার লেখার জন্য যেসব নোট সে করেছিল, তা পড়লে বোঝা যায় যে তার অনেক সুন্দর লেখার সম্ভাবনা ছিল। এ লেখাগুলো পড়লে রবীন্দ্রনাথের উক্তি মনে পড়ে :

‘যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে

যে নদী মরু পথে হারালো ধারা

জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।’