প্রথম অধ্যায়
প্রথম খণ্ডের রূপরেখা

প্রথম খণ্ডে ১৫টি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পূর্বাভাসে আত্মজীবনী লেখার বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এসব সমস্যা সত্ত্বেও আমি শেষ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া এ অধ্যায়ে প্রথম খণ্ডের রূপরেখা সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।

আত্মজীবনীর প্রথমেই পূর্বপুরুষদের শিকড়ের সন্ধান করার রীতি রয়েছে। আমার ক্ষেত্রে এ রীতি পালন করার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। আমার পিতৃবংশ রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির ইতিহাস একটু ভিন্ন ধরনের। বেশির ভাগ অভিজাত মুসলমান পরিবার গর্ববোধ করে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মধ্যপ্রাচ্যের শরিফ গোষ্ঠীর বংশধর। সামান্য কিছু পরিবার দাবি করে যে তারা এ দেশে উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবার থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়িও এ ধরনের দাবি করে থাকে। এ সম্পর্কে কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবে এই ইতিহাস শোনা ইতিহাস (Oral history), বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ইতিহাসের সমর্থনে কোনো দলিল-দস্তাবেজ নেই। দ্বিতীয় অধ্যায়ে শোনা ইতিহাসের ভিত্তিতে রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস রচনার চেষ্টা করা হয়েছে। উপরন্তু এ অধ্যায়ে আমার মায়ের বংশ কণিকাড়া চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে।

রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির অনেক কৃতী পুরুষ জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা রসুল্লাবাদের জীবনকেও সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য, তাঁদের বর্ণনা তৃতীয় অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

আমার বংশের সন্তানেরা নবীনগর থানায় মানুষ হয়েছে। খাঁ বাড়ির সদস্যদের জীবনের বিবর্তন বুঝতে হলে আমাদের বিশ শতকে নবীনগরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণার প্রয়োজন রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে তাই নবীনগরের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

সরকারের নথিপত্রে আমার জন্মতারিখ ২ আগস্ট ১৯৪৪। এ জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে আমার শৈশব এবং কৈশোর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৫৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত আমার স্মৃতি পঞ্চম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

১৯৫৯ সালে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। গ্রাম থেকে শহরে আমার উত্তরণ ঘটে। ঢাকা কলেজে অনেক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ছিলেন অধ্যাপক, তাঁদের সংস্পর্শে আসি। ঢাকায় অনেক বড় বড় পাঠাগারে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। কলেজে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল স্কুলের তুলনায় ব্যাপক। ঢাকা কলেজে আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়। যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, তাদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমৃত্যু এবং যারা বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে এখনো সম্পর্ক বজায় রেখেছি। ঢাকা কলেজের স্মৃতি ষষ্ঠ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

১৯৬১ সালে আমার ঠাঁই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া যেমন শিখেছি, তেমনি জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে চার বছর ছিলাম। এ সময়ে প্রথম সামরিক আইনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর আমি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই এবং ১৯৬৭ সালে মেধার ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে চাকরি পাই। সপ্তম অধ্যায়ে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমার উল্লেখযোগ্য স্মৃতিসমূহ লিপিবদ্ধ করেছি।

১৯৬৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ মাস আমি লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সে সময়ে আমাদের কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি এবং পেশোয়ারের পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে প্রশিক্ষণ হয়। এ ছাড়া আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে, মধ্যাঞ্চল এবং পাঠান অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তিনটি সফরের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় তিন মাস কোয়েটা জেলায় জেলা প্রশাসন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সংযুক্ত ছিলাম। এ সময়ের অভিজ্ঞতা অষ্টম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

১৯৬৮ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসি এবং রাজশাহী জেলায় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (প্রশিক্ষণরত) হিসেবে কাজ শুরু করি। এ সময়ে প্রায় তিন মাসব্যাপী আমাদের জরিপ এবং ভূমি বন্দোবস্তের প্রশিক্ষণ রাজশাহী জেলাতেই অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে আমরা দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষাসফর এবং দুই সপ্তাহের জন্য সচিবালয়ের কাজকর্ম দেখার জন্য ঢাকায় থাকি। এ সময়ের অভিজ্ঞতা নবম অধ্যায়ে লেখা হয়েছে।

১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর আমি হবিগঞ্জ মহকুমার দায়িত্ব গ্রহণ করি। মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমাকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে আমি দশম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। সবশেষে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যেসব প্রশ্ন দেখা দেয় এবং যা থেকে পরবর্তীকালে আমি মিত্রপক্ষের গুলি হামটি ডামটি ব্যামো ও অন্যান্য সমস্যা সম্বন্ধে লিখেছি, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

একাদশ অধ্যায়ে ৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত সময়পর্বে মুক্ত হবিগঞ্জের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেছি। ৩০ এপ্রিল আমি হবিগঞ্জ থেকে আগরতলা চলে যাই।

দ্বাদশ অধ্যায়ে আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস আমি আগরতলায় ছিলাম। এরপর আমি কলকাতায় চলে যাই।

ত্রয়োদশ অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারে আমার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এ ছাড়া কলকাতায় অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব ভাবনা মনে এসেছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি বাংলাদেশ সচিবালয়ে চাকরি শুরু করি। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করি। এ সময়ে সরকারে আমার কাজের অভিজ্ঞতা চতুর্দশ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

পঞ্চদশ অধ্যায়ে রয়েছে উপসংহার। আমার জীবনের প্রথম ২৯ বছরের। অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমি যা শিখেছি, সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। আমি শুধু আত্মজীবনীই লিখিনি, আমি আত্মজীবনী লেখার সময়। আত্মবীক্ষণেরও চেষ্টা করেছি।