ব্রজেশ্বর আপনার নৌকায় আসিয়া গম্ভীর হইয়া বসিল। সাগরের সঙ্গে কথা কহে না। দেখিল, দেবীর বজরা পাল তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল। তখন ব্রজেশ্বর সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বজরা কোথায় গেল?”
সাগর বলিল, “তা দেবী ভিন্ন আর কেহ জানে না। সে সকল কথা দেবী আর কাহাকেও বলে না।”
ব্র। দেবী কে?
সা। দেবী দেবী।
ব্র। তোমার কে হয়?
সা। ভগিনী।
ব্র। কি রকম ভগিনী?
সা। জ্ঞাতি।
ব্রজেশ্বর আবার চুপ করিল। মাঝিদিগকে ডাকিয়া বলিল, “তোমরা বড় বজরার সঙ্গে যাইতে পার?” মাঝিরা বলিল, “সাধ্য কি! ও নক্ষত্রের মত ছুটিয়াছে।” ব্রজেশ্বর আবার চুপ করিল। সাগর ঘুমাইয়া পড়িল।
প্রভাত হইল, ব্রজেশ্বর বজরা খুলিয়া চলিল।
সূর্যোদয় হইলে সাগর আসিয়া ব্রজেশ্বরের কাছে বসিল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “দেবী কি ডাকাতি করে?”
সা। তোমার কি বোধ হয়?
ব্র। ডাকাতির সমান ত সব দেখিলাম–ডাকাতি করিলে করিতে পারে, তাও দেখিলাম। তবু বিশ্বাস হয় না যে, ডাকাতি করে।
সা। তবু কেন বিশ্বাস হয় না?
ব্র। কে জানে। ডাকাতি না করিলেই বা এত ধন কোথায় পাইল?
সা। কেহ বলে, দেবী দেবতার বরে এত ধন পাইয়াছে; কেহ বলে, মাটির ভিতর পোঁতা টাকা পাইয়াছে; কেহ বলে, দেবী সোণা করিতে জানে।
ব্র। দেবী কি বলে?
সা। দেবী বলে, এক কড়াও আমার নয়, সব পরের।
ব্র। পরের ধন এত পাইল কোথায়?
সা। তা কি জানি।
ব্র। পরের ধন হলে অত আমিরি করে? পরে কিছু বলে না?
সা। দেবী কিছু আমিরি করে না। খুদ খায়, মাটিতে শোয়, গড়া পরে। কাল যা দেখলে, সে সকল তোমার আমার জন্য মাত্র, –কেবল দোকানদারি। তোমার হাতে ও কি?
সা। দেবী কিছু আমিরি করে না। খুদ খায়, মাটিতে শোয়, গড়া পরে। কাল যা দেখলে, সে সকল তোমার আমার জন্য মাত্র, –কেবল দোকানদারি। তোমার হাতে ও কি?
সাগর ব্রজেশ্বরের আঙ্গুলে নূতন আঙ্গটি দেখিল।
ব্রজেশ্বর বলিল, “কাল দেবীর নৌকায় জলযোগ করিয়াছিলাম বলিয়া দেবী আমাকে এই আঙ্গটি মর্যাদা দিয়াছে।”
সা। দেখি।
ব্রজেশ্বর আঙ্গটি খুলিয়া দেখিতে দিল। সাগর হাতে লইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখিল। বলিল, “ইহাতে দেবী চৌধুরাণীর নাম লেখা আছে।”
ব্র। কই?
সা। ভিতরে–ফারসীতে।
ব্র। (পড়িয়া) এ কি এ? এ যে আমার নাম–আমার আঙ্গটি? সাগর! তোমাকে আমার দিব্য, যদি তুমি আমার কাছে সত্য কথা কও না কও। আমায় বল, দেবী কে?
সা। তুমি চিনিতে পার নাই, সে কি আমার দোষ? আমি ত এক দণ্ডে চিনিয়াছিলাম।
ব্র। কে! কে! দেবী কে?
সা। প্রফুল্ল।
আর ব্রজেশ্বর কথা কহিল না। সাগর দেখিল, প্রথমে ব্রজেশ্বরের শরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল, তার পর একটা অনির্বচনীয় আহ্লাদের চিহ্ন–উচ্ছলিত সুখের তরঙ্গ শরীরে দেখা দিল। মুখ প্রভাময়, নয়ন উজ্জ্বল অথচ জলপ্লাবিত, দেহ উন্নত, কান্তি স্ফূর্তিময়ী। তার পরই আবার সাগর দেখিল, সব যেন নিবিয়া গেল; বড় ঘোরতর বিষাদ আসিয়া যেন সেই প্রভাময় কান্তি অধিকার করিল। ব্রজেশ্বর বাক্যশূন্য, স্পন্দনহীন, নিমেষশূন্য। ক্রমে সাগরের মুখপানে চাহিয়া চাহিয়া ব্রজেশ্বর চক্ষু মুদিল। দেহ অবসন্ন হইল; ব্রজেশ্বর সাগরের কোলে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল। সাগর কাতর হইয়া অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিল। কিছুই উত্তর পাইল না; একবার ব্রজেশ্বর বলিল, “প্রফুল্ল ডাকাত! ছি!”