প্রভাতে উঠিয়া প্রফুল্ল ভাবিল, “এখন কি করি? কোথায় যাই? এ নিবিড় জঙ্গল ত থাকিবার স্থান নয়, এখানে একা থাকিব কি প্রকারে? যাই বা কোথায়? বাড়ী ফিরিয়া যাইব? আবার ডাকাইতে ধরিয়া লইয়া যাইবে। আর যেখানে যাই, এ ধনগুলি লইয়া যাই কি প্রকারে? লোক দিয়া বহিয়া লইয়া গেলে, জানাজানি হবে, চোর-ডাকাইতে কাড়িয়া লইবে। লোকই বা পাইব কোথায়? যাহাকে পাইব, তাহাকেই বা বিশ্বাস কি? আমাকে মারিয়া ফেলিয়া টাকাগুলি কাড়িয়া লইতে কতক্ষণ? এ ধনের রাশির লোভ কে সম্বরণ করিবে?”
প্রফুল্ল অনেক বেলা অবধি ভাবিল। শেষে সিদ্ধান্ত এই হইল, “অদৃষ্টে যাহাই হৌক, দারিদ্র্য-দুঃখ আর সহ্য করিতে পারিব না। এইখানেই থাকিব। আমার পক্ষে দুর্গাপুরে আর এ জঙ্গলে তফাৎ কি? সেখানেও আমাকে ডাকাইতে ধরিয়া লইয়া যাইতেছিল, এখানেও না হয় তাই করিবে।”
এইরূপ মনস্থির করিয়া প্রফুল্ল গৃহ-কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইল। ঘর-দ্বার পরিষ্কার করিল। গোরুর সেবা করিল। শেষ, রন্ধনের উদ্যোগ। রাঁধিবে কি? হাঁড়ি, কাঠ, চাল-দাল, সকলেরই অভাব। প্রফুল্ল একটি মোহর লইয়া হাটের সন্ধানে বাহির হইল। প্রফুল্লের যে সাহস অলৌকিক, তাহার পরিচয় অনেক দেওয়া হইয়াছে।
এ জঙ্গলে হাট কোথায়? প্রফুল্ল ভাবিল, “সন্ধান করিয়া লইব।” জঙ্গলে পথের রেখা আছে, পূর্বই বলিয়াছি। প্রফুল্ল সেই রেখা ধরিয়া চলিল।
যাইতে যাইতে নিবিড় জঙ্গলের ভিতর একটি ব্রাহ্মণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। ব্রাহ্মণের গায়ে নামাবলি, কপালে ফোঁটা, মাথা কামান। ব্রাহ্মণ দেখিতে গৌরবর্ণ, অতিশয় সুপুরুষ, বয়স বড় বেশী নয়। ব্রাহ্মণ প্রফুল্লকে দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইল। বলিল, “কোথায় যাইবে, মা?”
প্র। আমি হাটে যাইব।
ব্রাহ্মণ। এ দিকে হাটের পথ কোথা?
প্র। তবে কোন্ দিকে?
ব্রা। তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?
প্র। এই জঙ্গল হইতেই।
ব্রা। এই জঙ্গলে তোমার বাস?
প্র। হাঁ।
ব্রা। তবে তুমি হাটের পথ চেন না?
প্র। আমি নূতন আসিয়াছি।
ব্রা। এ বনে কেহ ইচ্ছাপূর্বক আসে না। তুমি কেন আসিলে?
প্র। আমাকে হাটের পথ বলিয়া দিন।
ব্রা। হাট এক বেলার পথ। তুমি একা যাইতে পারিবে না। চোর-ডাকাইতের বড় ভয়। তোমার আর কে আছে?
প্র। আর কেহ নাই।
ব্রাহ্মণ অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রফুল্লের মুখপানে চাহিয়া দেখিল। মনে মনে বলিল, “এ বালিকা সকল সুলক্ষণযুক্তা। ভাল, দেখা যাউক, ব্যাপারটা কি?” প্রকাশ্যে বলিল, “তুমি একা হাটে যাইও না। বিপদে পড়িবে। এইখানে আমার একখানা দোকান আছে। যদি ইচ্ছা হয়, তবে সেখান হইতে চাল দাল কিনিতে পার।”
প্রফুল্ল বলিল, “সেই হলে ভাল হয়। কিন্তু আপনাকে ত ব্রাহ্মণপণ্ডিতের মত দেখিতেছি।”
ব্রা। ব্রাহ্মণপণ্ডিত অনেক রকমের আছে। বাছা! তুমি আমার সঙ্গে এস।
এই বলিয়া ব্রাহ্মণ প্রফুল্লকে সঙ্গে করিয়া আরও নিবিড়তর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল। প্রফুল্লের একটু একটু ভয় করিতে লাগিল, কিন্তু এ বনে কোথায় বা ভয় নাই? দেখিল, সেখানে একখানি কুটীর আছে–তালাচাবি বন্ধ, কেহ নাই। ব্রাহ্মণ তালাচাবি খুলিল। প্রফুল্ল দেখিল,-দোকান নয়, তবে হাঁড়ি, কলসী, চাল, দাল, নুন, তেল যথেষ্ট আছে। ব্রাহ্মণ বলিল, “তুমি যাহা একা বহিয়া লইয়া যাইতে পার, লইয়া যাও।”
এই বলিয়া ব্রাহ্মণ প্রফুল্লকে সঙ্গে করিয়া আরও নিবিড়তর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল। প্রফুল্লের একটু একটু ভয় করিতে লাগিল, কিন্তু এ বনে কোথায় বা ভয় নাই? দেখিল, সেখানে একখানি কুটীর আছে–তালাচাবি বন্ধ, কেহ নাই। ব্রাহ্মণ তালাচাবি খুলিল। প্রফুল্ল দেখিল,-দোকান নয়, তবে হাঁড়ি, কলসী, চাল, দাল, নুন, তেল যথেষ্ট আছে। ব্রাহ্মণ বলিল, “তুমি যাহা একা বহিয়া লইয়া যাইতে পার, লইয়া যাও।”
প্রফুল্ল যাহা পারিল, তাহা লইল। জিজ্ঞাসা করিল, “দাম কত দিতে হইবে?”
ব্রা। এক আনা।
প্র। আমার নিকট পয়সা নাই।
ব্রা। টাকা আছে? দাও, ভাঙ্গাইয়া দিতেছি।
প্র। আমার কাছে টাকাও নাই।
ব্রা। তবে কি নিয়া হাটে যাইতেছিলে?
প্র। একটি মোহর আছে।
ব্রা। দেখি।
প্রফুল্ল মোহর দেখাইল। ব্রাহ্মণ তাহা দেখিয়া ফিরাইয়া দিল; বলিল, “মোহর ভাঙ্গাইয়া দিই, এত টাকা আমার কাছে নাই। চল, তোমার সঙ্গে তোমার ঘরে যাই, তুমি সেইখানে আমাকে পয়সা দিও।”
প্র। ঘরেও আমার পয়সা নাই।
ব্রা। সবই মোহর! তা হৌক, চল, তোমার ঘর চিনিয়া আসি। যখন তোমার হাতে পয়সা হইবে, তখন আমায় দিও। আমি গিয়া নিয়া আসিব।
এখন “সবই মোহর” কথাটা প্রফুল্লের কাণে ভাল লাগিল না। প্রফুল্ল বুঝিল যে, এ চতুর ব্রাহ্মণ বুঝিয়াছে যে প্রফুল্লের অনেক মোহর আছে। আর সেই লোভেই তাহার বাড়ী দেখিতে যাইতে চাহিতেছে। প্রফুল্ল জিনিসপত্র যাহা লইয়াছিল, তাহা রাখিল। বলিল, “আমাকে হাটেই যাইতে হইবে। আমার কাপড়-চোপড়ের বরাৎ আছে।”
ব্রাহ্মণ হাসিল। বলিল, “মা! মনে করিতেছ, আমি তোমার বাড়ী চিনিয়া আসিলে, তোমার মোহরগুলি চুরি করিয়া লইব? তা তুমি কি মনে করিয়াছ, হাটে গেলেই আমাকে এড়াইতে পারিবে? আমি তোমার সঙ্গ না ছাড়িলে তুমি ছাড়িবে কি প্রকারে?”
সর্বনাশ! প্রফুল্লের গা কাঁপিতে লাগিল।
ব্রাহ্মণ বলিল, “তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণা করিব না।-আমাকে ব্রাহ্মণপণ্ডিত মনে কর, আর যাই মনে কর, আমি ডাকাইতের সর্দ্দার। আমার নাম ভবানী পাঠক।”
প্রফুল্ল স্পন্দহীন। ভবানী পাঠকের নাম সে দুর্গাপুরেও শুনিয়াছিল। ভবানী পাঠক বিখ্যাত দস্যু। তাহার ভয়ে বরেন্দ্রভূমি কম্পমান। প্রফুল্লের বাক্যস্ফূর্ত্তি হইল না।
ভবানী বলিল, “বিশ্বাস না হয়, প্রত্যক্ষ দেখ।”
এই বলিয়া ভবানী ঘরের ভিতর হইতে একটা নাগরা বা দামামা বাহির করিয়া তাহাতে গোটাকতক ঘা দিল। মুহূর্তমধ্যে জন পঞ্চাশ ষাট কালান্তক যমের মত জওয়ান লাঠি সড়কি লইয়া উপস্থিত হইল। তাহারা ভবানীকে জিজ্ঞাসা করিল, “কি আজ্ঞা হয়?”
ভবানী বলিল, “এই বালিকাকে তোমরা চিনিয়া রাখ। ইহাকে আমি মা বলিয়াছি। ইহাকে তোমরা সকলে মা বলিবে এবং মার মত দেখিবে। তোমরা ইহার কোন অনিষ্ট করিবে না, আর কাহাকেও করিতে দিবে না। এখন তোমরা বিদায় হও।” এই বলিবামাত্র সেই দস্যুদল মুহূর্তমধ্যে অন্তর্হিত হইল।
প্রফুল্ল বড় বিস্মিত হইল। প্রফুল্ল স্থিরবুদ্ধি; একেবারেই বুঝিল যে, ইহার শরণাগত হওয়া ভিন্ন আর উপায় নাই। বলিল, “চলুন, আপনাকে আমার বাড়ী দেখাইতেছি।”
প্রফুল্ল দ্রব্যসামগ্রী যাহা রাখিয়াছিল, তাহা আবার লইল। সে আগে চলিল, ভবানী পাঠক পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। তাহারা সেই ভাঙ্গা বাড়ীতে উপস্থিত হইল। বোঝা নামাইয়া ভবানী ঠাকুরকে বসিতে, প্রফুল্ল একখানা ছেঁড়া কুশাসন দিল। বৈরাগীর একখানি ছেঁড়া কুশাসন ছিল।