পাঁচ বৎসরে অধ্যাপন সমাপ্ত করিয়া, ভবানী ঠাকুর প্রফুল্লকে বলিলেন, “পাঁচ বৎসর হইল, তোমার শিক্ষা আরম্ভ হইয়াছে। আজ সমাপ্ত হইল। এখন তোমার হস্তগত ধন তোমার ইচ্ছামত ব্যয় করিও–আমি নিষেধ করিব না। আমি পরামর্শ দিব,-ইচ্ছা হয় গ্রহণ করিও। আহার আমি যোগাইব না, –তুমি আপনি আপনার দিনপাতের উপায় করিবে। কয়টি কথা বলিয়া দিই। কথাগুলি অনেক বার বলিয়াছি, –আর একবার বলি। এখন তুমি কোন্ পথ অবলম্বন করিবে?”
প্রফুল্ল বলিল, “কর্ম করিব, জ্ঞান আমার মত অসিদ্ধের জন্য নহে।”
ভবানী বলিল, “ভাল ভাল, শুনিয়া সুখী হইলাম। কিন্তু কর্ম, অসক্ত হইয়া করিতে হইবে। মনে আছে ত, ভগবান্ বলিয়াছেন–
‘তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরণ্ কর্ম পরমাপ্লোতি পুরুষঃ।।”
অসক্তো হ্যাচরণ্ কর্ম পরমাপ্লোতি পুরুষঃ।।”
এখন অনাসক্তি কি? তাহা জান। ইহার প্রথম লক্ষণ, ইন্দ্রিয়-সংযম। এই পাঁচ বৎসর ধরিয়া তোমাকে তাহা শিখাইয়াছি এখন আর বেশী বলিতে হইবে না। দ্বিতীয় লক্ষণ, নিরহঙ্কার। নিরহঙ্কার ব্যতীত ধর্মচরণ নাই। ভগবান্ বলিয়াছেন–
‘প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্ম্মাণি সর্বশঃ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।’
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।’
ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা যে সকল কর্ম কৃত তাহা আমি করিলাম, এই জ্ঞানই অহঙ্কার। যে কাজই কর, তোমার গুণে তাহা হইল, কখনও তাহা মনে করিবে না। করিলে পুণ্য কর্ম অকর্মত্ব প্রাপ্ত হয়। তার পর তৃতীয় লক্ষণ এই যে, সর্ব-কর্ম-ফল শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিবে। ভগবান্ বলিয়াছেন–
‘যৎ করোষি, যদশ্নাসি, যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।’
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।’
এখন বল দেখি মা, তোমার এই ধনরাশি লইয়া তুমি কি করিবে?”
প্র। যখন আমার সকল কর্ম শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলাম, তখন আমার এ ধনও শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলাম।
ভ। সব?
প্র। সব।
ভ। ঠিক তাহা হইলে কর্ম অনাসক্ত হইবে না। আপনার আহারের জন্য যদি তোমাকে চেষ্টিত হইতে হয়, তাহা হইলে আসক্তি জন্মিবে। অতএব তোমাকে হয় ভিক্ষাবৃত্ত হইতে হইবে, নয় এই ধন হইতেই দেহ রক্ষা করিতে হইবে। ভিক্ষাতেও আসক্তি আছে। অতএব এই ধন হইতে আপনার দেহরক্ষা করিবে। আর সব শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ কর। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ-পাদপদ্মে এ ধন পৌঁছিবে কি প্রকারে?
প্র। শিখিয়াছি, তিনি সর্বভূতস্থিত। অতএব সর্বভূতে এ ধন বিতরণ করিব।
ভ। ভাল ভাল। ভগবান্ স্বয়ং বলিয়াছেন–
“যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
“সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।
“আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জ্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ১শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৬ অঃ, ৩০-৩২।।”
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
“সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।
“আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জ্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ১শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৬ অঃ, ৩০-৩২।।”
কিন্তু এই সর্বভূতসংক্রামক দানের জন্য অনেক কষ্ট, অনেক শ্রমের প্রয়োজন। তাহা তুমি পারিবে?
প্র। এত দিন কি শিখিলাম?
ভ। সে কষ্টের কথা বলিতেছি না। কখন কখন কিছু দোকানদারি চাই। কিছু বেশবিন্যাস, কিছু ভোগ-বিলাসের ঠাট প্রয়োজন হইবে। সে বড় কষ্ট। তাহা সহিতে পারিবে?
প্র। সে কি রকম?
ভ। শোন। আমি ত ডাকাইতি করি। তাহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি।
প্র। আমার কাছে শ্রীকৃষ্ণের যে ধন আছে, কিছু আপনার কাছে থাক। এই ধন লইয়া ধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত থাকুন। দুষ্কর্ম হইতে ক্ষান্ত হউন।
ভ। ধনে আমারও কোন প্রয়োজন নাই। ধনও আমার যথেষ্ট আছে। আমি ধনের জন্য ডাকাইতি করি না।
প্র। তবে কি?
ভ। আমি রাজত্ব করি।
প্র। ডাকাইতি কি রকম রাজত্ব?
ভ। যাহার হাতে রাজদণ্ড, সেই রাজা।
প্র। রাজার হাতে রাজদণ্ড।
ভ। এ দেশে রাজা নাই। মুসলমান লোপ পাইয়াছে। ইংরেজ সম্প্রতি ঢুকিতেছে–তাহারা রাজ্য শাসন করিতে জানেও না, করেও না। আমি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করি।
প্র। ডাকাইতি করিয়া?
ভ। শুন, বুঝাইয়া দিতেছি।
ভবানী ঠাকুর বলিতে লাগিলেন, প্রফুল্ল শুনিতে লাগিল।
ভবানী, ওজস্বী বাক্যপরম্পরার সংযোগে দেশের দুরবস্থা বর্ণনা করিলেন, ভূম্যধিকারীর দুর্বিষহ দৌরাত্ম্য বর্ণনা করিলেন, কাছারির কর্মচারীরা বাকিদারের ঘরবাড়ী লুঠ করে, লুকান ধনের তল্লাসে ঘর ভাঙ্গিয়া, মেঝ্যা খুঁড়িয়া দেখে, পাইলে এক গুণের জায়গায় সহস্র গুণ লইয়া যায়, না পাইলে মারে, বাঁধে, কয়েদ করে, পোড়ায়, কুড়ুল মারে, ঘর জ্বালিয়া দেয়, প্রাণবধ করে। সিংহাসন হইতে শালগ্রাম ফেলিয়া দেয়, শিশুর পা ধরিয়া আছাড় মারে, যুবকের বুকে বাঁশ দিয়া দলে, বৃদ্ধের চোখের ভিতর পিঁপড়ে, নাভিতে পতঙ্গ পূরিয়া বাঁধিয়া রাখে। যুবতীকে কাছারিতে লইয়া গিয়া সর্বসমক্ষে উলঙ্গ করে, মারে, স্তন কাটিয়া ফেলে, স্ত্রীজাতির যে শেষ অপমান, চরম বিপদ্, সর্বসমক্ষেই তাহা প্রাপ্ত করায়। এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রাচীন কবির ন্যায় অত্যুন্নত শব্দচ্ছটাবিন্যাসে বিবৃত করিয়া ভবানী ঠাকুর বলিলেন, “এই দুরাত্মাদিগের আমিই দণ্ড দিই। অনাথা দুর্বলকে রক্ষা করি। কি প্রকারে করি, তাহা তুমি দুই দিন সঙ্গে থাকিয়া দেখিবে?”
প্রফুল্লের হৃদয় প্রজাবর্গের দুঃখের কাহিনী শুনিয়া গলিয়া গিয়াছিল। সে ভবানী ঠাকুরকে সহস্র সহস্র ধন্যবাদ করিল। বলিল, “আমি সঙ্গে যাইব। ধনব্যয়ে যদি আমার এখন অধিকার হইয়াছে, তবে আমি কিছু ধন সঙ্গে লইয়া যাইব। দুঃখীদিগকে দিয়া আসিব।”
ভ। এই কাজে দোকানদারি চাই, বলিতেছিলাম। যদি আমার সঙ্গে যাও, কিছু কিছু ঠাট সাজাইতে হইবে, সন্ন্যাসিনীবেশে এ কাজ সিদ্ধ হইবে না।
প্র। কর্ম শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিয়াছি। কর্ম তাঁহার, আমার নহে। কর্মোদ্ধারের জন্য যে সুখ দুঃখ, তাহা আমার নহে, তাঁরই। তাঁর কর্মের জন্য যাহা করিতে হয়, করিব।
ভবানী ঠাকুরের মনস্কামনা সিদ্ধ হইল। তিনি যখন ডাকাইতিতে সদলে বাহির হইলেন, প্রফুল্ল ধনের ঘড়া লইয়া তাঁহার সঙ্গে চলিল। নিশিও সঙ্গে গেল।
ভবানী ঠাকুরের অভিসন্ধি যাহাই হৌক, তাঁহার একখানি শাণিত অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। তাই প্রফুল্লকে পাঁচ বৎসর ধরিয়া শাণ দিয়া তীক্ষ্ণাধার অস্ত্র করিয়া লইয়াছিলেন। পুরুষ হইলেই ভাল হইত, কিন্তু প্রফুল্লের মত নানাগুণযুক্ত পুরুষ পাওয়া যায় নাই–বিশেষ এত ধন কোন পুরুষের নাই। ধনের ধার বড় ধার। তবে ভবানী ঠাকুরের একটা বড় ভুল হইয়াছিল–প্রফুল্ল একাদশীর দিন জোর করিয়া মাছ খাইত, এ কথাটা একটু তলাইয়া বুঝিলে ভাল হইত। যাহা হৌক, এখন আমরা প্রফুল্লকে জীবনতরঙ্গে ভাসাইয়া দিয়া আরও পাঁচ বৎসর ঘুমাই। প্রফুল্লের অন্য শিক্ষা হইয়াছে। কর্মশিক্ষা হয় নাই। এই পাঁচ বৎসর ধরিয়া কর্মশিক্ষা হৌক।