বর-কন্যা আসিয়া পিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়াছে, গিন্নী বরণ করিতেছেন। বৌয়ের মুখ দেখিবার জন্য লোকে ঝুঁকিয়াছে, কিন্তু বৌ বৌগিরির চাল ছাড়ে না, দেড় হাত ঘোমটা টানিয়া রাখিয়াছে, কেহ মুখ দেখিতে পায় না। শাশুড়ী বরণ করিবার সময়ে একবার ঘোমটা খুলিয়া বধূর মুখ দেখিলেন। একটু চমকিয়া উঠিলেন, আর কিছু বলিলেন না, কেবল বলিলেন, “বেশ বউ।” তাঁর চোখে একটু জল আসিল।
বরণ হইয়া গেলে, বধূ ঘরে তুলিয়া শাশুড়ী সমবেত প্রতিবাসিনীদিগকে বলিলেন, “মা! আমার বেটা-বউ অনেক দূর থেকে আসিতেছে, ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর। আমি এখন ওদের খাওয়াই দাওয়াই। ঘরের বউ ত ঘরেই রহিল, তোমরা নিত্য দেখবে; এখন ঘরে যাও, খাও দাও গিয়া।”
গিন্নীর এই বাক্যে অপ্রসন্ন হইয়া নিন্দা করিতে করিতে প্রতিবাসিনীরা ঘরে গেল। দোষ গিন্নীর, কিন্তু নিন্দাটা বধূরই অধিক হইল; কেন না, বড় কেহ মুখ দেখিতে পায় নাই। ধেড়ে মেয়ে বলিয়া সকলেই ঘৃণা প্রকাশ করিল। আবার সকলেই বলিল, “কুলীনের ঘরে অমন ঢের হয়।” তখন যে যেখানে কুলীনের ঘরে বুড়ো বৌ দেখিয়াছে, তার গল্প করিতে লাগিল। গোবিন্দ মুখুয্যা পঞ্চান্ন বৎসরের একটা মেয়ে বিয়ে করিয়াছিল, হরি চাটু্য্যা সত্তর বৎসরের এক কুমারী ঘরে আনিয়াছিলেন, মনু বাঁড়ুয্যা একটি প্রাচীনার অন্তর্জলে তাহার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, এই সকল আখ্যায়িকা সালঙ্কারে পথিমধ্যে ব্যাখ্যাত হইতে লাগিল। এইরূপ আন্দোলন করিয়া ক্রমে গ্রাম ঠাণ্ডা হইল।
গোলমাল মিটিয়া গেল; গিন্নী বিরলে ব্রজেশ্বরকে ডাকিলেন। ব্রজ আসিয়া বলিল,“কি মা?”
গিন্নী। বাবা, এ বৌ কোথায় পেলে, বাবা?
ব্রজ। এ নূতন বিয়ে নয়, মা!
গিন্নী। বাবা, এ হারাধন আবার কোথায় পেলে, বাবা?
গিন্নীর চোখে জল পড়িতেছিল।
ব্রজ। মা, বিধাতা দয়া করিয়া আবার দিয়াছেন। এখন মা, তুমি বাবাকে কিছু বলিও না। নির্জনে পাইলে আমি সকলই তাঁর সাক্ষাতে প্রকাশ করিব।
গিন্নী। তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, বাপ, আমিই সব বলিব। বৌভাতটা হইয়া যাক। তুমি কিছু ভাবিও না। এখন কাহারও কাছে কিছু বলিও না।
ব্রজেশ্বর স্বীকৃত হইল। এ কঠিন কাজের ভার মা লইলেন। ব্রজ বাঁচিল। কাহাকে কিছু বলিল না।
পাকস্পর্শ নির্বিঘ্নে হইয়া গেল। বড় ঘটা পটা কিছু হইল না, কেবল জনকতক আত্মীয়স্বজন ও কুটুম্ব নিমন্ত্রণ করিয়া হরবল্লভ কার্য সমাধা করিলেন।
পাকস্পর্শের পর গিন্নী আসল কথাটা হরবল্লভকে ভাঙ্গিয়া বলিলেন। বলিলেন, “এ নূতন বিয়ে নয়–সেই বড় বউ।”
হরবল্লভ চমকিয়া উঠিল–সুপ্ত ব্যাঘ্রকে কে যেন বাণে বিঁধিল। “অ্যাঁ, সেই বড় বউ–কে বল্লে?”
গিন্নী। আমি চিনেছি। আর ব্রজও আমাকে বলিয়াছে।
হর। সে যে দশ বৎসর হল মরে গেছে।
গিন্নী। মরা মানুষেও কখন ফিরে থাকে?
হর। এত দিন সে মেয়ে কোথায় কার কাছে ছিল?
গিন্নী। তা আমি ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করি নাই। জিজ্ঞাসাও করিব না। ব্রজ যখন ঘরে আনিয়াছে, তখন না বুঝিয়া সুঝিয়া আনে নাই।
হর। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।
গিন্নী। আমার মাথা খাও, তুমি একটি কথাও কহিও না। তুমি একবার কথা কহিয়াছিলে, তার ফলে আমার ছেলে আমি হারাইতে বসিয়াছিলাম। আমার একটি ছেলে। আমার মাথা খাও, তুমি একটি কথাও কহিও না। যদি তুমি কোন কথা কহিবে, তবে আমি গলায় দড়ি দিব।
হরবল্লভ এতটুকু হইয়া গেলেন। একটি কথাও কহিলেন না। কেবল বলিলেন, “তবে লোকের কাছে নূতন বিয়ের কথাটাই প্রচার থাক।”
গিন্নী বলিলেন, “তাই থাকিবে।”
সময়ান্তরে গিন্নী ব্রজেশ্বরকে সুসংবাদ জানাইলেন। বলিলেন, “আমি তাঁকে বলিয়াছিলাম। তিনি কোন কথা কহিবেন না। সে সব কথার আর কোন উচ্চবাচ্যে কাজ নাই।”
ব্রজ হৃষ্টচিত্তে প্রফুল্লকে খবর দিল।
আমরা স্বীকার করি, গিন্নী এবার বড় গিন্নীপনা করিয়াছেন। যে সংসারের গিন্নী গিন্নীপনা জানে, সে সংসারে কারও মনঃপীড়া থাকে না। মাঝিতে হাল ধরিতে জানিলে নৌকার ভয় কি?