ব্রজেশ্বর যাইতে যাইতে রঙ্গরাজকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমাকে কত দূর লইয়া যাইবে–তোমার রাণীজি কোথায় থাকেন?”

র। ঐ বজরা দেখিতেছ না? ঐ বজরা তাঁর।

ব্র। ও বজরা? আমি মনে করিয়াছিলাম, ওখানা ইংরেজের জাহাজ–রঙ্গপুর লুটিতে আসিয়াছে। তা এত বড় বজরা কেন?

র। রাণীকে রাণীর মত থাকিতে হয়। উহাতে সাতটা কামরা আছে।

ব্র। এত কামরায় কে থাকে?

র। একটায় দরবার। একটায় রাণীর শয়নঘর। একটায় চাকরাণীরা থাকে। একটায় স্নান হয় একটায় পাক হয়। একটা ফাটক। বোধ হয়, আপনাকে আজ সেই কামরায় থাকিতে হইবে।

এই কথোপকথন হইতে হইতে ছিপ আসিয়া বজরার পাশে ভিড়িল। দেবী রাণী ওরফে দেবী চৌধুরাণী তখন আর ছাদের উপর নাই। যতক্ষণ তাহার লোকে ডাকাইতি করিতেছিল, দেবী ততক্ষণ ছাদের উপর বসিয়া জ্যোৎস্নালোকে বীণা বাজাইতেছিল। তখন বাজনাটা বড় ভাল হইতেছিল না–বেসুর, বেতাল, কি বাজিতে কি বাজে–দেবী অন্যমনা হইতেছিল। তার পরে যে ছিপ ফিরিল, দেবী অমনি নামিয়া কামরার ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিল। এদিকে রঙ্গরাজ ছিপ হইতে কামরার দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া, “রাণীজি-কি জয়” বলিল। দ্বারে রেশমী পর্দা ফেলা আছে–ভিতরে দেখা যায় না। ভিতর হইতে দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “কি সংবাদ?”

র। সব মঙ্গল।

দেবী। তোমাদের কেহ জখম হইয়াছে?

র। কেহ না।

দেবী। তাহাদের কেহ খুন হইয়াছে?

র। কেহ না–আপনার আজ্ঞামত কাজ হইয়াছে।

দেবী। তাহাদের কেহ জখম হইয়াছে?

র। দুইটা হিন্দুস্থানী দুই একটা আঁচড় খেয়েছে। কাঁটা ফোটার মত।

দেবী। মাল?

র। সব আনিয়াছি। মাল এমন কিছু ছিল না।

দেবী। বাবু?

র। বাবুকে ধরিয়া আনিয়াছি।

দেবী। হাজির কর।

রঙ্গরাজ তখন ব্রজেশ্বরকে ইঙ্গিত করিল। ব্রজেশ্বর ছিপ হইতে উঠিয়া আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল।

দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে?” দেবীর যেন বিষম লাগিয়াছে–গলার আওয়াজটা বড় সাফ নয়।

ব্রজেশ্বর যেরূপ লোক, পাঠক এতক্ষণে বুঝিয়াছেন বোধ হয়। ভয় কাহাকে বলে, তাহা তিনি বালককাল হইতে জানেন না। যে দেবী চৌধুরাণীর নামে উত্তর-বাঙ্গালা কাঁপিত, তাহার কাছে আসিয়া ব্রজেশ্বরের হাসি পাইল। মনে ভাবিলেন, “মেয়েমানুষকে পুরুষে ভয় করে, এ ত কখনও শুনি নাই। মেয়েমানুষ ত পুরুষের বাঁদী।” হাসিয়া ব্রজেশ্বর দেবীর কথায় উত্তর দিলেন, “পরিচয় লইয়া কি হইবে? আমার ধনের সঙ্গে আপনাদিগের সম্বন্ধ, তাহা পাইয়াছেন–নামে ত টাকা হইবে না।”

দেবী। হইবে বৈ কি? আপনি কি দরের লোক, তাহা জানিলে টাকার ঠিকানা হইবে। (তবু গলাটা ধরা ধরা।)

ব্র। সেইজন্যই কি আমাকে ধরিয়া আনিয়াছেন?

দেবী। নহিলে আপনাকে আনিতাম না।

দেবী পর্দার আড়ালে, কেহ দেখিল না যে, দেবী এই কথা বলিবার সময় চোখ মুছিল।

ব্র। আমি যদি বলি, আমার নাম দুঃখিরাম চক্রবর্তী, আপনি বিশ্বাস করিবেন কি?

দেবী। না।

ব্র। আপনি বলেন কি না, দেখিবার জন্য।

ব্র। আমার নাম কৃষ্ণগোবিন্দ ঘোষাল।

দেবী। না।

ব্র। দয়ারাম বক্সী।

দেবী। তাও না।

ব্র। ব্রজেশ্বর রায়।

দেবী। হইতে পারে।

এই সময়ে দেবীর কাছে আর একজন স্ত্রীলোক নিঃশব্দে আসিয়া বসিল। বলিল, “গলাটা ধরে গেছে যে?”

দেবীর চক্ষের জল আর থাকিল না–বর্ষাকালে ফুটন্ত ফুলের ভিতর যেমন বৃষ্টির জল পোরা থাকে, ডাল নাড়া দিলেই ছড়্ ছড়্ করিয়া পড়িয়া যায়, দেবীর চোখে তেমনি জল পোরা ছিল, ডাল নাড়া দিতেই ঝর্ ঝর্ করিয়া পড়িয়া গেল। দেবী তখন ঐ স্ত্রীলোককে কাণে কাণে বলিল, “আমি আর এ রঙ্গ করিতে পারি না। তুই কথা ক। সব জানিস ত?”

এই বলিয়া দেবী সে কামরা হইতে উঠিয়া অন্য কামরায় গেল। ঐ স্ত্রীলোকটি দেবীর আসন গ্রহণ করিয়া, ব্রজেশ্বরের সহিত কথা কহিতে লাগিল। এই স্ত্রীলোকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে–ইনি সেই বামনশূন্য বামনী–নিশি ঠাকুরাণী।

নিশি বলিল, “এইবার ঠিক বলেছ–তোমার নাম ব্রজেশ্বর রায়।”

ব্রজেশ্বরের একটু গোল বাধিল। পর্দার আড়ালে কিছুই দেখিতে পাইতেছিলেন না–কিন্তু কথার আওয়াজে সন্দেহ হইল যে, যে কথা কহিতেছিল, এ সে বুঝি নয়। তার আওয়াজটা বড় মিঠে লাগিতেছিল–এ বুঝি তত মিঠে নয়। যাই হউক, কথার উত্তরে ব্রজেশ্বর বলিলেন, “যদি আমার পরিচয় জানেন, তবে এই বেলা দরটা চুকাইয়া লউন–আমি স্বস্থানে চলিয়া যাই। কি দরে আমাকে ছাড়িবেন?”

নি। এক কড়া কাণা কড়ি। সঙ্গে আছে কি? থাকে যদি, দিয়া চলিয়া যান।

ব্র। আপাততঃ সঙ্গে নাই।

নি। বজরা হইতে আনিয়া দেন।

ব্র। বজরাতে যাহা ছিল, তাহা আপনার অনুচরেরা লইয়া আসিয়াছে। আর এক কড়া কাণা কড়িও নাই।

নি। মাঝিদের কাছে ধার করিয়া আনুন।

ব্র। মাঝিরাও কাণা কড়ি রাখে না।

নি। তবে যত দিন না আপনার উপযুক্ত মূল্য আনাইয়া দিতে পারেন, ততদিন কয়েদ থাকুন।

ব্রজেশ্বর তার পর শুনিলেন, কামররার ভিতরে আর একজন কে–কণ্ঠে সেও বোধহয় স্ত্রীলোক–দেবীকে বলিতেছে, “রাণীজি! যদি এক কড়া কাণা কড়িই এই মানুষটার দর হয়, তবে আমি এক কড়া কাণা কড়ি দিতেছি। আমার কাছে উহাকে বিক্রি করুন।”

ব্রজেশ্বর শুনিলেন, রাণী উত্তর করিল, “ক্ষতি কি? কিন্তু মানুষটা নিয়ে তুমি কি করিবে? ব্রাহ্মণ, জল তুলিতে, কাঠ কাটিতে পারিবে না।”

ব্রজেশ্বর প্রত্যুত্তরও শুনিলেন,–রমণী বলিল, “আমার রাঁধিবার ব্রাহ্মণ নাই। আমাকে রাঁধিয়া দিবে।”

তখন নিশি ব্রজেশ্বরকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “শুনিলেন, –আপনি বিক্রি হইলেন–আমি কাণা কড়ি পাইয়াছি। যে আপনাকে কিনিল, আপনি তাহার সঙ্গে যান, রাঁধিতে হইবে।”

ব্রজেশ্বর বলিল, “কই তিনি?”

নি। স্ত্রীলোক–বাহিরে যাইবে না, আপনি ভিতরে আসুন।

Leave a Reply