বস্তুতঃ হরবল্লভ রায় মহাশয় যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু সে ইচ্ছাপূর্বক নহে, ঘটনাবিহীন। প্রথমে বড় ঘেঁষেন নাই। “শৃঙ্গিণাং শস্ত্রপাণিনাং” ইত্যাদি চাণক্যপ্রদত্ত সদুপদেশ স্মরণ করিয়া তিনি সিপাহীদিগের ছিপে উঠেন নাই। একখানা পৃথক ডিঙ্গিতে থাকিয়া, লেফটেনান্ট সাহেবকে বজরা দেখাইয়া দিয়া, অর্ধ ক্রোশ দূরে পলাইয়া গিয়া ডিঙ্গি ও প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। তার পর দেখিলেন, আকাশের বড় ঘনঘটা। মনে করিলেন, ঝড় উঠিবে ও এখনই আমার ডিঙ্গি ডুবিয়া যাইবে, টাকার লোভে আসিয়া প্রাণ হারাইব–আমার সৎকারও হইবে না। তখন রায় মহাশয় ডিঙ্গি হইতে তীরে অবতরণ করিলেন। কিন্তু তীরে সেখানে কেহ কোথাও নাই দেখিয়া বড় ভয় হইল। সাপের ভয়, বাঘের ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়, ভূতের ভয়। হরবল্লভের মনে হইল, কেন এমন ঝকমাবরি করিতে আসিয়াছিলাম। হরবল্লভের কান্না আসিল।
এমন সময়ে হঠাৎ বন্দুকের হুড়মুড়ি, সিপাহী বরকন্দাজের হৈ হৈ শব্দ সব বন্ধ হইয়া গেল। হরবল্লভের বোধ হইল, অবশ্য সিপাহীর জয় হইয়াছে, ডাকাইত মাগী ধরা পড়িয়াছে, নহিলে লড়াই বন্ধ হইবে কেন? তখন হরবল্লভ ভরসা পাইয়া যুদ্ধস্থানে যাইতে অগ্রসর হইলেন। তবে এ রাত্রিকালে, এ অন্ধকারে, এ বন-জঙ্গলের মাঝে অগ্রসর হন কিরূপে? ডিঙ্গির মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁ বাপু মাঝি, –বলি, ওদিকে যাওয়া যায় কিরূপে বলতে্ পার?”
মাঝি বলিল, “যাওয়ার ভাবনা কি? ডিঙ্গিতে উঠুন না, নিয়ে যাচ্ছি। সিপাহীরা মারবে ধরবে না ত? আবার যদি লড়াই বাধে?”
হ। সিপাহীরা আমাদের কিছু বলিবে না। লড়াই আর বাধিবে না–ডাকাইত ধরা পড়েছে। কিন্তু যে রকম মেঘ করেছে, এখনই ঝড় উঠবে–ডিঙ্গিতে উঠি কিরূপে?
মাঝি বলিল, “ঝড়ে ডিঙ্গি কখন ডুবে না।”
হরবল্লভ প্রথমে সে সকল কথায় বিশ্বাস করিলেন না–শেষ অগত্যা ডিঙ্গিতে উঠিলেন। মাঝিকে উপদেশ দিলেন, কেনারায় কেনারায় ডিঙ্গি লইয়া যাইবে। মাঝি তাহাই করিল। শীঘ্র আসিয়া ডিঙ্গি বজরায় লাগিল। হরবল্লভ সিপাহীদের সঙ্কেতবাক্য জানিতেন, সুতরাং সিপাহীরা আপত্তি করিল না। সেই সময়ে “গোইন্দা! গোইন্দা!” করিয়া ডাকাডাকি হইতেছিল। হরবল্লভ বজরায় উঠিয়া সম্মুখস্থ আরদালির সিপাহীকে বলিল, “গোইন্দাকে খুঁজিতেছ? আমি গোইন্দা।”
সিপাহী বলিল, “তোমাকে কাপ্তেন সাহেব তলব করিয়াছেন।”
হ। কোথায় তিনি?
সি। কামরার ভিতর। তুমি কামরার ভিতর যাও।
হরবল্লভ আসিতেছে জানিতে পারিয়া দেবী প্রস্থানের উদ্যোগ দেখিল। “কাপ্তেন সাহেবের জন্য কিছু জলযোগের উদ্যোগ দেখি” বলিয়া ভিতরের কামরায় চলিয়া গেল।
এদিকে হরবল্লভ কামরার দিকে গেলেন। কামরার দ্বারে উপস্থিত হইয়া কামরার সজ্জা ও ঐশ্বর্য, দিবা ও নিশির রূপ ও সজ্জা দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন। সাহেবকে সেলাম করিতে গিয়া, ভুলিয়া নিশিকে সেলাম করিয়া ফেলিলেন। হাসিয়া নিশি কহিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! মেজাজ সরিফ্?”
শুনিয়া দিবা বলিল, “বন্দেগী খাঁ সাহেব! আমায় একটা কুর্ণিশ হলো না–আমি হলেম এদের রাণী।”
সাহেব হরবল্লভকে বলিলেন, “ইহারা ফেরেব করিয়া দুই জনেই বলিতেছে, ‘আমি দেবী চৌধুরাণী।’ কে দেবী চৌধুরাণী, তাহার ঠিকানা না হওয়ায়, আমি তোমাকে ডাকিয়াছি। কে দেবী?”
হরবল্লভ বড় প্রমাদে পড়িলেন। ঊর্ধ্ব চতুর্দশ পুরুষের ভিতর কখনও দেবীকে দেখেন নাই। কি করেন, ভাবিয়া চিন্তিয়া নিশিকে দেখাইয়া দিলেন। নিশি খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। অপ্রতিভ হইয়া, ‘ভুল হইয়াছে’ বলিয়া হরবল্লভ দিবাকে দেখাইলেন। দিবা লহর তুলিয়া হাসিল। বিষণ্ণ মনে হরবল্লভ আবার নিশিকে দেখাইল। সাহেব তখন গরম হইয়া উঠিয়া হরবল্লভকে বলিলেন, “টোম বডজাাট–শূয়র! তোম্ পছানটেে নেহি?”
তখন দিবা বলিল, “সাহেব, রাগ করিবেন না। উনি চেনেন না। উঁহার ছেলে চেনে। উঁহার ছেলে বজরার ছাদে বসিয়া আছে, তাহাকে আনুন–সে চিনিবে।”
হরবল্লভ আকাশ হইতে পড়িল, বলিল, “আমার ছেলে!”
দি। এইরূপ শুনি।
হ। ব্রজেশ্বর।
দি। তিনিই।
হ। কোথা?
দি। ছাদে।
হ। ব্রজ এখানে কেন?
দি। তিনি বলিবেন।
সাহেব হুকুম দিলেন, “তাঁহাকে আন।”
দিবা রঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করিল। তখন রঙ্গরাজ ছাদে গিয়া ব্রজেশ্বরকে বলিল, “চল, দিবা ঠাকুরাণীর হুকুম।”
ব্রজেশ্বর নামিয়া কামরার ভিতর আসিল। দেবীর হুকুম আগেই প্রচার হইয়াছিল, দিবার হুকুম পাইলেই ব্রজেশ্বর ছাদ হইতে নামিবে। এমনই দেবীর বন্দোবস্ত।
সাহেব ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি দেবী চৌধুরাণীকে চেন?”
ব্র। চিনি।
সা। এখানে দেবী আছে?
ব্র। না।
সাহেব তখন রাগান্ধ হইয়া বলিলেন, “সে কি, ইহারা দুই জনের একজনও দেবী চৌধুরাণী নয়?”
ব্র। এরা তার দাসী।
সা। এঃ! তুমি দেবীকে চেন?
ব্র। বিলক্ষণ চিনি।
সা। যদি এরা কেহ দেবী না হয়, তবে দেবী অবশ্য এ বজরার কোথাও লুকাইয়া আছে। বোধ হয়, দেবী সেই চাকরাণীটা। আমি বজরা তল্লাশি করিতেছি–তুমি নিশানদিহি করিবে, আইস।
ব্র। সাহেব, তোমার বজরা তল্লাশ করিতে হয়, কর–আমি নিশানদিহি করিব কেন?
সাহেব বিস্মিত হইয়া গর্জিয়া বলিল, “কেঁও বদজাত? তোম গোইন্দা নেহি?”
“নেহি।” বলিয়া ব্রজেশ্বর সাহেবের গালে বিরাশী সিক্কার এক চপেটাঘাত করিল।
“করিলে কি? করিলে কি? সর্বনাশ করিলে?” বলিয়া, হরবল্লভ কাঁদিয়া উঠিল।
“হুজুর! তুফান উঠা।” বলিয়া বাহির হইতে জমাদ্দার হাঁকিল।
সোঁ সোঁ করিয়া আকাশপ্রান্ত হইতে ভয়ঙ্কর বেগে বায়ু গর্জন করিয়া আসিতেছে শুনা গেল।
কামরার ভিতর হইতে ঠিক সেই মুহূর্তে–যে মুহূর্তে সাহেবের গালে ব্রজেশ্বরের চড় পড়িল–ঠিক সেই মুহূর্তে আবার শাঁক বাজিল। এবার দুই ফুঁ
বজরার নোঙ্গর ফেলা ছিল না–পূর্বেই বলিয়াছি, খোঁটায় কাছি বাঁধা ছিল, খোঁটার কাছে দুই জন নাবিক বসিয়াছিল। যেমন শাঁক বাজিল, অমনি তাহারা কাছি ছাড়িয়া দিয়া লাফাইয়া বজরায় উঠিল। তীরের উপরে যে সিপাহীরা বজরা ঘেরাও করিয়াছিল, তাহারা উহাদিগরে মারিবার জন্য সঙ্গীন উঠাইল–কিন্তু তাহাদের হাতের বন্দুক হাতেই রইল, পলক ফেলিতে না ফেলিতে একটা প্রকাণ্ড কাণ্ড হইয়া গেল। দেবীর কৌশলের এক পলক মধ্যে সেই পাঁচ শত কোম্পানির সিপাহী পরাস্ত হইল।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, প্রথমাবধিই বজরার চারিখানা পাল খাটান ছিল। বলিয়াছি যে, মধ্যে নিশি ও দিবা আসিয়া, নাবিকদিগকে কি উপদেশ দিয়া গিয়াছিল। সেই উপদেশ অনুসারেই খোঁটার কাছে লোক বসিয়াছিল। আর সেই উপদেশ অনুসারে পালের কাছির কাছে চারি জন নাবিক বসিয়াছিল। শাঁকের শব্দ শুনিবা মাত্র তাহারা পালের কাছি সকল টানিয়া ধরিল। মাঝি হাল আঁটিয়া ধরিল। অমনি সেই প্রচণ্ড বেগশালী ঝটিকা আসিয়া চারিখানা পালে লাগিল। বজরা ঘুরিল–যে দুই জন সিপাহী সঙ্গীন তুলিয়াছিল, তাহাদের সঙ্গীন উঁচু হইয়া রহিল–বজরার মুখ পঞ্চাশ হাত তফাতে গেল। বজরা ঘুরিল–তার পর ঝড়ের বেগে পালভরা বজরা কাত হইল, প্রায় ডুবে। লিখিতে এতক্ষণ লাগিল–কিন্তু এতখানা ঘটিল এক নিমেষ মধ্যে। সাহেব ব্রজেশ্বরের চড়ের প্রত্যুত্তরে ঘুঁষি উঠাইয়াছেন মাত্র, ইহারই মধ্যে এতখানা সব হইয়া গেল। তাঁহারও হাতের ঘুষি হাতে রহিল, যেমন বজরা কাত হইল, অমনি সাহেব টলিয়া মুষ্টিবদ্ধহস্তে দিবা সুন্দরীর পাদমূলে পতিত হইলেন। ব্রজেশ্বর খোদ সাহেবের ঘাড়ের উপর পড়িয়া গেল–এবং রঙ্গরাজ তাহার উপর পড়িয়া গেল। হরবল্লভ প্রথমে নিশিঠাকুরাণীর ঘাড়ের উপর পড়িয়াছিলেন, পরে সেখান হইতে পদচ্যুত হইয়া গড়াইতে গড়াইতে রঙ্গরাজের নাগরা জুতায় আটকাইয়া গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন যে, “নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে, আমরা সকলে মরিয়া গিয়াছি, এখন আর দুর্গানাম জপিয়া কি হইবে!”
কিন্তু নৌকা ডুবিল না–কাত হইয়া আবার সোজা হইয়া বাতাসে পিছন করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ছুটিল। যাহারা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারা আবার খাড়া হইয়া দাঁড়াইল–সাহেব আবার ঘুঁষি তুলিলেন। কিন্তু সাহেবের ফৌজ, যাহারা জলে দাঁড়াইয়াছিল, বজরা তাহাদের ঘাড়ের উপর দিয়া চলিয়া গেল। অনেকে জলে ডুবিয়া প্রাণরক্ষা করিল; কেহ দূর হইতে বজরা ঘুরিতেছে দেখিতে পাইয়া পলাইয়া বাঁচিল; কেহ বা আহত হইল; কেহ মরিল না। ছিপগুলি বজরার নীচে পড়িয়া ডুবিয়া গেল–জল সেখানে এমন বেশী নহে–স্রোত বড় নাই–সুতরাং সকলেই বাঁচিল। কিন্তু বজরা আর কেহ দেখিতে পাইল না। নক্ষত্রবেগে উড়িয়া বজরা কোথায় ঝড়ের সঙ্গে মিশিয়া চলিল, কেহ আর দেখিতে পাইল না। সিপাহী সেনা ছিন্নভিন্ন হইল। দেবী তাহাদের পরাস্ত করিয়া পাল উড়াইয়া চলিল, লেফটেনান্ট সাহেব ও হরবল্লভ দেবীর নিকট বন্দী হইল। নিমেষমধ্যে যুদ্ধ জয় হইল। দেবী তাই আকাশ দেখাইয়া বলিয়াছিল, “আমার রক্ষার উপায় ভগবান করিতেছেন।”