প্রফুল্ল সাগরকে দেখিতে চাহিল। ব্রজেশ্বরের ইঙ্গিত পাইয়া গিন্নী সাগরকে আনিতে পাঠাইলেন। গিন্নীরও সাধ, তিনটি বৌ একত্র করেন।

যে লোক সাগরকে আনিতে গিয়াছিল, তাহার মুখে সাগর শুনিল, স্বামী আর একটা বিবাহ করিয়া আনিয়াছেন–বুড়ো মেয়ে। সাগরের বড় ঘৃণা হইল। “ছি! বুড়ো মেয়ে!” বড় রাগ হইল, “আবার বিয়ে?–আমরা কি স্ত্রী নই?” দুঃখ হইল, “হায়! বিধাতা কেন আমায় দুঃখীর মেয়ে করেন নাই–আমি কাছে থাকিতে পারিলে, তিনি হয় ত আর বিয়ে করিতেন না।”

এইরূপ রুষ্ট ও ক্ষুণ্ণভাবে সাগর শ্বশুরবাড়ী আসিল। আসিয়াই প্রথমে নয়ান বৌয়ের কাছে গেল। নয়ান বৌ, সাগরের দুই চক্ষের বিষ; সাগর বৌ, নয়ানেরও তাই। কিন্তু আজ দুই জন এক, দুই জনের এক বিপদ্। তাই ভাবিয়া সাগর আগে নয়নতারার কাছে গেল। সাপকে হাঁড়ির ভিতর পুরিলে, সে যেমন গর্জিতে থাকে, প্রফুল্ল আসা অবধি নয়নতারা সেইরূপ করিতেছিল। একবার মাত্র ব্রজেশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল–গালির চোটে ব্রজেশ্বর পলাইল, আর আসিল না। প্রফুল্লও ভাব করিতে গিয়াছিল, কিন্তু তারও সেই দশা ঘটিল। স্বামী সপত্নী দূরে থাক, পাড়াপ্রতিবাসীও সে কয় দিন নয়নতারার কাছে ঘেঁষিতে পারে নাই। নয়নতারার কতকগুলি ছেলে-মেয়ে হইয়াছিল। তাদেরই বিপদ্ বেশী। এ কয় দিন মার খাইতে খাইতে তাদের প্রাণ বাহির হইয়া গেল।

সেই দেবীর শ্রীমন্দিরে প্রথম সাগর গিয়া দেখা দিলেন। দেখিয়া নয়নতারা বলিল, “এসো, এসো! তুমি বাকী থাক কেন? আর ভাগীদার কেউ আছে?”

সা। কি! আবার না কি বিয়ে করেছে?

ন। কে জানে, বিয়ে কি নিকে, তার খবর আমি কি জানি?

সা। বামনের মেয়ের কি আবার নিকে হয়?

ন। বামন, কি শূদ্র, কি মুসলমান, তা কি আমি দেখতে গেছি?

সা। অমন কথাগুলো মুখে এনো না। আপনার জাত বাঁচিয়ে সবাই কথা কয়।

ন। যার ঘরে অত বড় কনে বৌ এলো, তার আবার জাত কি?

সা। কত বড় মেয়ে? আমাদের বয়স হবে?

ন। তোর মার বয়সী।

সা। চুল পেকেছে?

ন। চুল না পাকলে আর রাত্রি দিন বুড়ো মাগী ঘোমটা টেনে বেড়ায়?

সা। দাঁত পড়েছে?

ন। চুল পাকলো, দাঁত আর পড়ে নি?

সা। তবে স্বামীর চেয়ে বয়সের বড় বল?

ন। তবে শুনচিস কি?

সা। তাও কি হয়?

ন। কুলীনের ঘরে এ সব হয়।

সা। দেখতে কেমন?

ন। রূপের ধ্বজা! যেন গালফুলো গোবিন্দের মা।
সা। যে বিয়ে করেছে, তাকে কিছু বল নি?

ন। দেখতে পাই কি? দেখতে পেলে হয়। মুড়ো ঝাঁটা তুলে রেখেছি।

সা। আমি তবে সে সোণার প্রতিমাখানা দেখে আসি।

ন। যা, জন্ম সার্থক করগে যা।

নূতন সপত্নীকে খুঁজিয়া, সাগর তাহাকে পুকুর-ঘাটে ধরিল। প্রফুল্ল পিছন ফিরিয়া বাসন মাজিতেছিল। সাগর পিছনে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁ গা, তুমি আমাদের নূতন বৌ?”

“কে সাগর এয়েছ?” বলিয়া নূতন বৌ সমুখ ফিরিল।

সাগর দেখিল, কে। বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দেবী রাণী?”

প্রফুল্ল বলিল, “চুপ্! দেবী মরিয়া গিয়াছে।”

সা। প্রফুল্ল?

প্র। প্রফুল্লও মরিয়া গিয়াছে।

সা। কে তবে তুমি?

প্র। আমি নূতন বৌ।

সা। কেমন করে কি হল, আমায় সব বল দেখি।

প্র। এখানে বলিবার জায়গা নয়। আমি একটি ঘর পাইয়াছি, সেইখানে চল, সব বলিব।

দুই জনে দ্বার বন্ধ করিয়া, বিরলে বসিয়া কথোপকথন হইল। প্রফুল্ল সাগরকে সব বুঝাইয়া বলিল। শুনিয়া সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “এখন গৃহস্থালিতে কি মন টিকিবে? রূপার সিংহাসনে বসিয়া, হীরার মুকুট পরিয়া, রাণীগিরির পর কি বাসনমাজা ঘরঝাঁট দেওয়া ভাল লাগিবে? যোগশাস্ত্রের পর কি ব্রহ্মঠাকুরাণীর রূপকথা ভাল লাগিবে? যার হুকুমে দুই হাজার লোক খাটিত, এখন হারির মা, পারির মার হুকুম-বরদা রি কি তার ভাল লাগিবে?”

প্র। ভাল লাগিবে বলিয়াই আসিয়াছি। এই ধর্মই স্ত্রীলোকের ধর্ম; রাজত্ব স্ত্রীজাতির ধর্ম নয়। কঠিন ধর্মও এই সংসারধর্ম; ইহার অপেক্ষা কোন যোগই কঠিন নয়। দেখ, কতকগুলি নিরক্ষর, স্বার্থপর, অনভিজ্ঞ লোক লইয়া আমাদের নিত্য ব্যবহার করিতে হয়। ইহাদের কারও কোন কষ্ট না হয়, সকলে সুখী হয়, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। এর চেয়ে কোন্ সন্ন্যাস কঠিন? এর চেয়ে কোন্ পুণ্য বড় পুণ্য? আমি এই সন্ন্যাস করিব।

সা। তবে কিছু দিন আমি তোমার কাছে থাকিয়া তোমার চেলা হইব।

যখন সাগরের সঙ্গে প্রফুল্লের এই কথা হইতেছিল, তখন ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে ব্রজেশ্বর ভোজনে বসিয়াছিলেন। ব্রহ্মঠাকুরাণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বেজ, এখন কেমন রাধি?”

ব্রজেশ্বরের সেই দশ বছরের কথা মনে পড়িল। কথাগুলি মূল্যবান–তাই দুই জনেরই মনে ছিল।

ব্রজ। “বেশ্।”

ব্রহ্ম। এখন গোরুর দুধ কেমন? বেগড়ায় কি?

ব্রজ। বেশ্ দুধ।

ব্রহ্ম। কই, দশ বৎসর হলো–আমায় ত গঙ্গায় দিলি না?

ব্রজ। ভুলে গিছিলেম।

ব্রহ্ম। তুই আমায় গঙ্গায় দিস নে। তুই বাগদী হয়েছিস।

ব্রজ। ঠান্ই‍দিদি! চুপ! ও কথা না।

ব্রহ্ম। তা দিস, পারিস ত গঙ্গায় দিস। আমি আর কথা কব না। কিন্তু ভাই, কেউ যেন আমার চরকা-টরকা ভাঙ্গে না।

Leave a Reply