🕮
যে রাত্রে দুর্লভ চক্রবর্ত্তী প্রফুল্লকে তাহার মাতার বাড়ী হইতে ধরিয়া লইয়া যায়, দৈবগতিকে ব্রজেশ্বর সেই রাত্রেই প্রফুল্লর বাসস্থানে দুর্গাপুরে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। ব্রজেশ্বরের একটি ঘোড়া ছিল, ঘোড়ায় চড়িতে ব্রজেশ্বর খুব মজ্বুাত। যখন বাড়ীর সকলে ঘুমাইল, ব্রজেশ্বর গোপনে সেই অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া অন্ধকারে দুর্গাপুরে প্রস্থান করিলেন। যখন তিনি প্রফুল্লের কুটীরে উপস্থিত হইলেন, তখন সে ভবন জনশূন্য, অন্ধকারময়। প্রফুল্লকে দস্যুতে লইয়া গিয়াছে। সেই রাত্রে ব্রজেশ্বর পাড়াপড়শী কাহাকেও পাইলেন না যে, জিজ্ঞাসা করেন।

ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে না দেখিতে পাইয়া মনে করিল যে, প্রফুল্ল একা থাকিতে না পারিয়া কোন কুটুম্ববাড়ী গিয়াছে। ব্রজেশ্বর অপেক্ষা করিতে পারিল না। বাপের ভয়, রাত্রিমধ্যেই ফিরিয়া আসিল। তার পর কিছু দিন গেল। হরবল্লভের সংসার যেমন চলিতেছিল, তেমনি চলিতে লাগিল। সকলে খায় দায় বেড়ায়–সংসারের কাজ করে। ব্রজেশ্বরের দিন কেবল ঠিক সে রকম যায় না। হঠাৎ কেহ কিছু বুঝিল না–জানিল না। প্রথমে মা জানিল। গৃহিণী দেখিল, ছেলের পাতে দুধের বাটিতে দুধ পড়িয়া থাকে, মাছের মুড়ার কেবল কণ্ঠার মাছটাই ভুক্ত হয়, “রান্না ভাল হয় নাই” বলিয়া, ব্রজ ব্যঞ্জন ঠেলিয়া রাখে। মা মনে করিলেন, ছেলের মন্দাগ্নি হইয়াছে। প্রথমে জারক লেবু প্রভৃতি টোট্কাষর ব্যবস্থা করিলেন, তার পর কবিরাজ ডাকিবার কথা হইল। ব্রজ হাসিয়া উড়াইয়া দিল। মাকে ব্রজ হাসিয়া উড়াইয়া দিল, কিন্তু ব্রহ্মঠাকুরাণীকে পারিল না। বুড়ী ব্রজেশ্বরকে এক দিন একা পাইয়া চাপিয়া ধরিল।

“হ্যাঁ রে ব্রজ, তুই আর নয়ানবৌয়ের মুখ দেখিস না কেন?”

ব্রজ হাসিয়া বলিল, “মুখখানি একে অমাবস্যার রাত্রি, তাতে মেঘ ঝড় ছাড়া নেই–দেখিতে বড় সাধ নেই।”

ব্রহ্ম। তা মরুক গে, সে নয়ানবৌ বুঝবে–তুই খাস নে কেন?

ব্রজ। তুমি যে রাঁধ!

ব্রহ্ম। আমি ত চিরকালই এমনই রাঁধি।

ব্রজ। আজকাল হাত পেকেছে।

ব্রহ্ম। দুধও বুঝি আমি রাঁধি? সেটাও কি রান্নার দোষ?

ব্রজ। গরুগুলোর দুধ বিগ্ ‍ড়ে গিয়াছে।

ব্রহ্ম। তুই হাঁ করে রাতদিন ভাবিস কি?

ব্রজ। কবে তোমায় গঙ্গায় নিয়ে যাব।

ব্রহ্ম। আর তোর বড়াইয়ে কাজ নাই! মুখে অমন অনেকে বলে! শেষে এই নিমগাছের তলায় আমায় গঙ্গায় দিবি–তুলসী গাছটাও দেখতে পাব না! তা তুই ভাব না যা হয়–কিন্তু তুই আমার গঙ্গা ভেবে ভেবে এত রোগা হয়ে গেলি কেন?

ব্রজ। ওটা কি কম ভাবনা?

ব্রহ্ম। কাল নাইতে গিয়ে রানায় বসে কি, ভাই, ভাব্ত‍ছিলি? চোখ দিয়ে জল পড়ছিল কেন?

ব্রজ। ভাব্ক‍ছিলাম যে, স্নান করেই তোমার রান্না খেতে হবে। সেই দুঃখে চোখে জল এসেছিল।

ব্রহ্ম। সাগর এসে রেঁধে দিবে? তা হলে খেতে পার্‍‍বি ত?

ব্রজ। কেন, সাগর ত রোজ রাঁধিত? খেলা-ঘরে যাও নি কোনও দিন? ধূলা-চড়চড়ি, কাদার সুক্ত, ইঁটের ঘণ্ট–এক দিন আপনি খেয়ে দেখ না? তার পর আমায় খেতে বলো।

ব্রহ্ম। প্রফুল্ল এসে রেঁধে দিবে?

যেমন পথে কেহ প্রদীপ লইয়া যখন চলিয়া যায়, তখন পথিপার্শ্বস্থ অন্ধকার ঘরের উপর সেই আলো পড়িলে, ঘর একবার হাসিয়া আবার তখনই আঁধার হয়, প্রফুল্লের নামে ব্রজেশ্বরের মুখ তেমনই হইল। ব্রজ উত্তর করিল, “বাগদী যে।”
ব্রহ্ম। বাগদী না। সবাই জানে, সে মিছে কথা। তোমার বাপের কেবল সমাজের ভয়। ছেলের চেয়ে কিছু সমাজ বড় নয়। কথাটা কি আবার পাড়ব?

ব্রজ। না, আমার জন্য সমাজে আমার বাপের অপমান হবে–তাও কি হয়?

সে দিন আর বেশী কথা হইল না। ব্রহ্মঠাকুরাণীও সবটুকু বুঝিতে পারিলেন না। কথাটা বড় সোজা নয়। প্রফুল্লের রূপ অতুলনীয়,-একে ত রূপেই সে ব্রজেশ্বরের হৃদয় অধিকার করিয়া বসিয়াছিল, আবার সেই এক দিনেই ব্রজেশ্বর দেখিয়াছিলেন, প্রফুল্লের বাহির অপেক্ষা ভিতর আরও সুন্দর, আরও মধুর। যদি প্রফুল্ল–বিবাহিতা স্ত্রী–স্বাধিকারপ্রাপ্ত হইয়া নয়নতারার মত কাছে থাকিত, তবে এই উন্মাদকর মোহ সুস্নিগ্ধ স্নেহে পরিণত হইত। রূপের মোহ কাটিয়া যাইত, গুণের মোহ থাকিয়া যাইত। কিন্তু তা হইল না। প্রফুল্ল-বিদ্যুৎ একবার চমকাইয়া, চিরকালের জন্য অন্ধকারে মিশিল, সেই জন্য সেই মোহ সহস্র গুণে বল পাইল। কিন্তু এ ত গেল সোজা কথা। কঠিন এই যে, ইহার উপর দারুণ করুণা। সেই সোণার প্রতিমাকে তাহার অধিকারে বঞ্চিত করিয়া, অপমান করিয়া, মিথ্যা অপবাদ দিয়া, চিরকালের জন্য বহিষ্কৃত করিয়া দিতে হইয়াছে। সে এখন অন্নের কাঙ্গাল। বুঝি না খাইয়া মরিয়া যাইবে! যখন সেই প্রগাঢ় অনুরাগের উপর এই গভীর করুণা–তখন মাত্রা পূর্ণ। ব্রজেশ্বরের হৃদয় প্রফুল্লময়–আর কিছুরই স্থান নাই। বুড়ী এত কথাও বুঝিল না। কিছু দিন পরে ফুলমণি নাপিতানীর প্রচারিত প্রফুল্লের তিরোধান বৃত্তান্ত হরবল্লভের গৃহে পৌঁছিল। গল্প মুখে মুখে বদল হইতে হইতে চলে। সংবাদটা এখানে এইরূপ আকারে পৌঁছিল যে প্রফুল্ল বাত-শ্লেষ্মা বিকারে মরিয়াছে–মৃত্যুর পূর্বে তার মরা মাকে দেখিতে পাইয়াছিল। ব্রজেশ্বরও শুনিল।

হরবল্লভ শৌচ স্নান করিলেন, কিন্তু শ্রাদ্ধাদি নিষেধ করিলেন। বলিলেন, “বাগদীর শ্রাদ্ধ বামনে করিবে?” নয়নতারাও স্নান করিল–মাথা মুছিয়া বলিল, “একটা পাপ গেল–আর একটার জন্য নাওয়াটা নাইতে পার্লে্ই শরীর জুড়ায়।” কিছু দিন গেল। ক্রমে ক্রমে শুকাইয়া শুকাইয়া, ব্রজেশ্বর বিছানা লইল। রোগ এমন কিছু নয়, একটু একটু জ্বর হয় মাত্র, কিন্তু ব্রজ নির্জ্জীব, শয্যাগত। বৈদ্য দেখিল। ঔষধপত্রে কিছু হইল না। রোগ বৃদ্ধি পাইল। শেষ ব্রজেশ্বর বাঁচে না বাঁচে।

আসল কথা আর বড় লুকান রহিল না। প্রথমে বুড়ী বুঝিয়াছিল, তার পর গিন্নী বুঝিলেন। এ সকল কথা মেয়েরাই আগে বুঝে। গিন্নী বুঝিলেই, কাজেই কর্তা বুঝিলেন। তখন হরবল্লভের বুকে শেল বিঁধিল। হরবল্লভ কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “ছি ! ছি ! কি করিয়াছি! আপনার পায়ে আপনি কুড়ুল মারিয়াছি!” গিন্নী প্রতিজ্ঞা করিলেন, “ছেলে না বাঁচিলে আমি বিষ খাইব”। হরবল্লভ প্রতিজ্ঞা করিলেন, “এবার দেবতা ব্রজেশ্বরকে বাঁচাইলে, আর আমি তার মন না বুঝিয়া কোন কাজ করিব না।”

ব্রজেশ্বর বাঁচিল। ক্রমে আরোগ্যলাভ করিতে লাগিল–ক্রমে শয্যা ত্যাগ করিল। এক দিন হরবল্লভের পিতার সাংবৎসরিক শ্রাদ্ধ উপস্থিত। হরবল্লভ শ্রাদ্ধ করিতেছেন, ব্রজেশ্বর সেখানে কোন কার্য্যোপলক্ষে উপস্থিত আছেন। তিনি শুনিলেন, শ্রাদ্ধান্তে পুরোহিত মন্ত্র পড়াইলেন–
“পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।”

কথাটি ব্রজেশ্বর কণ্ঠস্থ করিলেন। প্রফুল্লের জন্য বড় কান্না আসিত, তখন মনকে প্রবোধ দিবার জন্য বলিতেন–

“পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।।”

এইরূপে ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে ভুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ব্রজেশ্বরের পিতাই যে প্রফুল্লের মৃত্যুর কারণ, সেই কথা মনে পড়িলেই ব্রজেশ্বর ভাবিতেন–
“পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।”

প্রফুল্ল গেল, কিন্তু পিতার প্রতি তবুও ব্রজেশ্বরের ভক্তি অচলা রহিল।

Leave a Reply