» » প্রথম-পর্ব

বর্ণাকার
🕮

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আনোয়ারা যে দুর্বিষহ শিরঃপীড়ায় ও জ্বরাতিশয্যে শয্যাশায়িনী হইয়া ছট্‌ফট্ করিতেছিল ও প্রবাল বকিতেছিল, আমরা আনুষঙ্গিক কথা-প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত তাহার কোন তত্ত্ব লই নাই; এক্ষণে আসুন, আমরা ভূঞা সাহেবের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া একবার সেই পর্দানশীল আনোয়ারাকে দেখিয়া আসি। ঐ শুনুন, “মাথা গেল—মাথা গেল!” বলিয়া বালিকা চিৎকার করিতেছে। স্নেহশীলা দাদী-মা তাহার পিঠের কাছে বসিয়া চোখের জলে বুক ভাসাইতেছে।

এমন সময় ভূঞা সাহেব একবার ঘরের দ্বারে আসিয়া উঁকি মারিয়া কহিলেন “মা, রাত্রিতে মেয়ের কি কোন অসুখ করিয়াছিল, হঠাৎ এরূপ হইবার কারণ কি?” জননী চোখের পানি মুছিয়া কহিলেন, “কি জানি বাছা, রাত্রিতে মেয়ের ভাত খাইতে যাওয়ায় একটু বিলম্ব হইয়াছিল বলিয়া বৌ তাহাকে বাপান্ত করিয়া গালাগালি করিয়াছিল, তাই বাছা আমার, ঘেন্নায় ভাত-পানি ত্যাগ করিয়া ঘরে আসিয়া শোয়। শেষ রাত্রিতে যখন আমি তাহাজ্জদের নামাজ পড়িতে উঠি, তখন মেয়ে ঘুমের ঘোরে দুই-তিন বার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে শেষে ‘মা, মা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠে। ভোরে হাত-মুখ ধুইয়া ঘরে আসিয়াই তাহার এ দশা হইয়াছে। নাক-চোখ-মুখ জবাফুলের মত লাল হইয়াছে, গা দিয়া আগুন ছুটিতেছে, থাকিয়া থাকিয়া প্রলাপ বকিতেছে। হামিদার মা দেখিয়া কহিল, “মেয়ের অবস্থা ভাল নয়। সত্বর ডাক্তার দেখান। “

ভূঞা সাহেব তখন ঘরে উঠিয়া স্বচক্ষে মেয়ের পীড়ার অবস্থা দেখিয়া চিন্তিত হইলেন এবং ধীরে ধীরে কহিলেন, “এখন কি করা যায়? ভাল ডাক্তার নিকটে নাই, টাকা-পয়সাও হাতে নাই, পাটগুলি খরিদ্দার অভাবে বিক্রয় হইতেছে না, এখন উপায় কি?”–এই বলিয়া তিনি ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। ছেলের কথা শুনিয়া মা ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। এই সময় দক্ষিণদ্বারী ঘরের বারান্দায় বসিয়া গোলাপজান মাতা পুত্রের কথাবার্তা উৎকর্ণ হইয়া শুনিতেছিল। ভূঞা সাহেব প্রাঙ্গণে পর্দাপণ করিবামাত্র সে কুপিতা-বাঘিনীর মত গর্জিয়া উঠিল, কহিল “আমার গালির চোটে তোমাদের সোনার কমল শুকাইতে বসিয়াছে, এখন আর কি, পালের বড় গরুটা বেচিয়া তাহার জন্য ডাক্তার আনা হউক। তা যাহাই করা হোক, ফরেজ (আজিমুল্লার পুত্র) কাল টাকার জন্য আসিয়াছিল, তাহাদের খুব ঠেকা। আমি বলিয়া দিয়াছি, পাট বিক্রয় হইলেই তোমাদের টাকা দেওয়াইব। আমি ভাল মুখে বলিতেছি, আমার ভাইয়ের বিনা সুদের হাওলাতি টাকা শোধ করিয়া, যাহা মনে চায়, তাহাই যেন করা হয়।” এই বলিয়া গোলাপজান ঘৃণার সহিত মুখ নাড়া দিয়া সবেগে রান্নাঘরের আঙ্গিনার দিকে চলিয়া গেল। ভূঞা সাহেব অপরাধী মানুষের মত চুপটি করিয়া বাহির বাড়িতে আসিলেন। এই সময়ে আনোয়ারা পুনরায় প্রলাপ বকিয়া উঠিল, “মাগো, আমাকে কাছে লইয়া যাও, আমি আর এখানে থাকিব না।”

বেলা এক প্রহর অতীত হইয়াছে; একখানি পাসী ভূঞা সাহেবের বাহির বাড়ির সম্মুখ দিয়া পশ্চিম মুখে চলিয়া যাইতেছিল। নৌকার মাঝি ভূঞা সাহেবকে দেখিয়া কহিল, আপনাদের পাড়ায় পাট পাওয়া যাইবে?” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “হ্যাঁ, আমার বাড়ি এবং আরও অনেক বাড়িতে পাট মজুদ আছে।” মাঝি নৌকার গতিরোধ করিয়া তাঁহার ঘাটে নৌকা বাঁধিল। একটি ভদ্রলোক ও তাঁহার পিছনে পিছনে আর একটি লোক পাট দেখিবার নিমিত্ত ভূঞা সাহেবের বাড়ির উপর নামিলেন। ভূঞা সাহেব ভদ্রলোকটিকে দেখিয়া কেমন যেন এক ধাঁধায় পড়িয়া অনেকক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাদের নৌকা কোথাকার?” সঙ্গীয় লোকটি বলিল, “বেলগাঁও জুট কোম্পানির।” ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “ইনিই সেই কোম্পানির বড়বাবু।” ভূঞা সাহেবের ধাঁধা কাটিয়া গেল। বেলগাঁও বন্দরে সকলেই ভদ্রলোকটিকে ‘বড়বাবু’ বলিয়া সম্ভাষণ করিয়া থাকে। বড়বাবু কোম্পানির আদেশে পাটের অবস্থা দেখিয়া যান এবং নমুনস্বরূপ ২/৪ নৌকা বোঝাই করিয়া পাট লইয়া থাকেন। এবারও তিনি সেই উদ্দেশ্যেই মফঃস্বলে আসিয়াছেন।

ভূঞা সাহেব বড় বাবুকে সম্মানের সহিত নিজের বৈঠকখানায় বসিতে দিলেন। তাঁহার একজন চাকর একতাড়া পাট আনিয়া বড়বাবুর সম্মুখে রাখিল। সঙ্গীয় লোকটি পাট খুলিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিল। এই সময় তালুকদার সাহেবও পাট বিক্রয় মানসে তথায় আসিলেন। তিনিও প্রথমে বড়বাবুকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন। আবার এই সময় আমাদের ভোলার মা কার্যোপলক্ষে বহির্বাটিতে আসিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির মধ্যে যাইয়া, হামিদার মাকে কহিল, “মা-জান, মজার কাণ্ড—দুলামিয়া যে পাটের বেপারী।” হামিদার মা কহিলেন,

“তুমি বল কি?” ভোলার মা কহিলেন, “আমার চোখের কসম, সত্যি বলিতেছি দুলামিয়া ভূঞা সাহেবের বৈঠকখানায় বসিয়া পাঠ কিনিতেছেন!” হামিদার মা কহিলেন, “উনি কোথায় গেলেন?” ভোলার মা কহিল, “তিনি দুলামিয়ার কাছে গিয়াছেন।” হামিদার মা তখন ভোলার মাকে কহিলেন, ‘তুমি এখন যাও, তাঁহাকে বাড়িতে ডাকিয়া আন।” ভোলার মা পুনরায় বহির্বাটীর দিকে চলিল। এবার মা ও মেয়ে উভয়ে সন্দেহের দোলায় ঘুরপাক খাইতে লাগিলেন।

এদিকে বহির্বাটীতে পাটের দর-দস্তুর চলিতেছে; এমন সময় ভূঞা সাহেবের অন্তঃপুরে অস্ফুটস্বরে ক্রন্দনের রোল উঠিল। তালুকদার সাহেব কহিলেন, “বাটীর ভিতরে কাঁদে কে?”

ভূ-সা। বোধ হয় মা।

তালু। কেন! কি হইয়াছে?

ভূ-সা। মেয়েটি ভয়নাক কাতর হইয়া পড়িয়াছে।

তালুকদার সাহেব “বল কি!” বলিয়া বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলেন; কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া ভূঞা সাহেব কহিলেন, “তোমার মত নির্দয় লোক ত আর দেখা যায় না। তুমি আসন্নমৃতা কন্যাকে ঘরে রাখিয়া পাট বিক্রয় করিতেছ! সত্বর ডাক্তার ডাক।”

এই সময় বড়বাবুর সঙ্গীয় লোকটি আড়ালে যাইয়া তামাক খাইতেছিল। সে বাবুর সাক্ষাতে তামাক খায় না। এ ব্যক্তি পাটের যাচনদার, বড়বাবুর সঙ্গে থাকে। যাচনদার পীড়ার কথা শুনিয়া ভূঞা সাহেবকে ছোট ছোট করিয়া কহিল, “আমাদের বড়বাবু খুব ভাল ডাক্তার, বাক্সভরা ঔষধপত্র ইহার নৌকায় আছে। ইহার মত জনতিহৈষী লোক আমরা দেখি না। পীড়িতের প্রাণরক্ষার জন্য ইনি নিজের প্রাণ তুচ্ছ জ্ঞান করেন। এমন কি চিকিৎসার জন্য কাহারও নিকট টাকা-পয়সা লন না। আপনি ইহার দ্বারা আপনার কন্যার চিকিৎসা করাইতে পারেন।” কৃপণস্বভাব ভূঞা সাহেব বিনা টাকায় চিকিৎসা হইতে পারিবে মনে করিয়া আশ্বস্ত হইলেন; কিন্তু কন্যা বয়স্থা মনে করিয়া ইতস্তত করিতে লাগিলেন। অবশেষে তালুকদার সাহেবকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলায় তিনি বলিলেন “যে অবস্থা, তাহাতে পর্দার সম্মান রক্ষা অপেক্ষা এক্ষণে চেষ্টা করিয়া মেয়ের প্রাণ রক্ষা করাই সুসঙ্গত মনে করি; আমাদের হাদিসেও এইরূপ বিধান আছে।

ভূঞা সাহেব তখন আর দ্বিধাবোধ না করিয়া বড়বাবুকে যাইয়া কহিলেন, “জনাব! শুনিলাম আপনি একজন ভাল চিকিৎসক। আমার একটি কন্যা প্রাণসংশয়াপন্ন কাতর; আপনি মেহেরবাণীপূর্বক তাহার চিকিৎসা করিলে সুখী হইতাম।” বড়বাবু কহিলেন, ‘আমি চিকিৎসক নহি, তবে নিজের প্রয়োজনবশত ঔষধপত্র সঙ্গে রাখি, সময় ও অবস্থাবিশেষে অন্যকেও দিয়া থাকি।” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “তা যাহাই হউক, এই আসন্ন বিপদে আমার উপকার করিতেই হইবে।” বড়বাবু তখন পীড়ার অবস্থা শুনিয়া শিষ্টাচার জানাইয়া কহিলেন, “তবে একবার দেখা আবশ্যক।”