দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যুবক মোনাজাত অন্তে পশ্চাৎ ফিরিয়া সযত্নে যুজদানে কোরান শরীফ বন্ধ করিয়া যথাস্থানে রাখিতে নৌকার ভিতরের দিকে আরো সরিয়া গেলেন। বালিকার প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল না। আত্মহারা বালিকাও তাহাকে দেখিতে পাইল না। এই সময় বালিকার পশ্চাদ্দিক হইতে—”সই তুমি এখানে?” বলিয়া আর একটি বালিকা প্রথমা বালিকার দক্ষিণ পার্শ্বে আসিয়া বসিল। আগন্তুক বালিকার বয়স প্রথমা বালিকা অপেক্ষা দুই বৎসরের বেশি হইবে। পরিধানে সাদা সেমিজের উপর নীলাম্বরী শাড়ী, হাতে সোনার বালা, করাঙ্গুলিতে প্রেমের নিদর্শন স্বর্ণাঙ্গুরী। সুতরাং অলঙ্কার পরিচ্ছদের তুলনায় প্রথমাটিকে দ্বিতীয়াটির সহিত তুলনা সম্ভবেনা কিন্তু দেহের বর্ণ ও গঠন বদল করিলে কাহারও ক্ষতি হইবে বলিয়া বোধ হয় না।
সখিত্ব-সম্বন্ধে উভয়ের মনের বিনিময় পূর্বেই হইয়া গিয়াছে। ‘সই’ শব্দ শুনিয়া যুবক নৌকার ভিতর থাকিয়া একটি ক্ষুদ্র জানালার ছিদ্রপথ দিয়া একটু তাকাইলেন। দেখিলেন, দুইটি জীবন্ত-কুসুম পশ্চিম পাড়ে খিড়কীর দ্বারা আলো করিয়া বসিয়া আছে। প্রথমটি বিকাশোন্মুখ গোলাপ, দ্বিতীয়টি পূর্ণবিকশিত শতদলস্বরূপ। ‘সই’ শব্দে প্রথমা বালিকার সুখের ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে পূর্বকথিত যাতনার চিহ্ন তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল সে দ্বিতীয়া বালিকার দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল। দ্বিতীয়া বালিকা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সবিস্ময় দুঃখে কহিল, “সই, তোমার মুখের চেহারা এরূপ হইয়াছে কেন? এমন ত’ কখনও দেখি নাই? রাত্রে কি ঘুমাও নাই?” প্রথম বালিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “গত রাত্রে মা আবার অকথ্য ভাষায় গালি দিয়াছে, তাই জীবনের প্রতি ঘৃণা জন্মিয়াছে; সই, আর বরদাস্ত হয় না।” বলিতে বলিতে কথিকার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল।
দ্বি-বা। কেন গালি দিয়াছিল?
প্র-বা। মগরেবের বাদ হজরতের জীবনচরিত পড়িতেছিলাম, তাই রান্নাঘরে যাইয়া ভাত খাইতে বিলম্ব হইয়াছিল।
দ্বিতীয় বালিকা বুদ্ধিমতী ও চতুরা। শিক্ষিত স্বামীসহবাসে, সংসারের অনেক বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিয়াছে। সে একটু চিন্তা করিয়া কহিল, ‘সই, তোমার মা ত’ দিনরাতই তোমাকে তিরস্কার করে, তাহাতে তোমাকে কেবল কাঁদিতে দেখি, কিন্তু তোমার চোখ-মুখের এমন অবস্থা ত’ কখনও দেখি নাই। অবশ্যই তোমার মনের কোন বিশেষ ভাবান্তর ঘটিয়াছে? প্রথম বালিকার বিষাদপূর্ণ মুখে একটু বিজলীর আভা স্কুরিল, কিন্তু মুখ ফুটিল না। দ্বিতীয় বালিকা নৌকার দিকে চাহিয়া কহিল, “ওপারে একখানি সুন্দর ছৈ ঘেরা পাসী নৌকা দেখিতেছি, কোথা হইতে আসিয়াছে?” প্রথমা বালিকা সরল মনে কহিল, “জানি না, কিন্তু ঐ, নৌকার ভিতরে কে যেন কোরান শরীফ পড়িতেছিলেন, এমন সুমধুর রবে কোরান শরীফ পড়া আর কখনও শুনি নাই। এতক্ষণ তাই শুনিতেছিলাম।” দ্বিতীয় বালিকা পুনরায় নৌকার দিকে চাহিয়া কহিল, “কই সই, নৌকায় ত কাহারও সাড়া শব্দ নাই।” প্রথমা বালিকাও নৌকার দিকে চাহিল—নৌকা নীরব। যুবক এই সময় পাটের জমাখরচ মিলাইতেছিলেন, তিনি বালিকাদ্বয়ের কথোপকথন শুনিতে পাইলেন।
দ্বিতীয় বালিকা কহিল, “যাক, কাল বিকালে তোমরা যখন স্কুল হইতে চলিয়া আস, তারপর ডাকপিয়ন বাবজানকে একখানি মনিঅর্ডার দিয়া যায়। সেই সঙ্গে আমিও কলকাতার আর একখানি চিঠি পাই। চিঠি লইয়া আমি আমার পড়ার ঘরে বসিয়া চুপ করিয়া পড়িতেছিলাম। একটু পরে বাবজান বাড়ির মধ্যে আসিয়া মাকে বলিলেন, “এই ধর, ১৮টি টাকা, আলাদা করিয়া রাখিয়া দাও। ইহা আনোয়ারার বৃত্তির টাকা। এই টাকা আর তাহার পিতার হাতে দিব না। সে কাপড়ে-চোপড়ে, পুঁথি পুস্তকে মেয়েটিকে যে কষ্ট দেয়, আমি মনে করিয়াছি এই টাকা দিয়া তাহার সে কষ্ট দূর করিব। মা কহিলেন, “ও সব কষ্ট ত’ কিছুই না। মেয়েটাকে তার মায়ে দিনরাত যেভাবে খাটায় আর তিরস্কার করে, তা দেখিলে বুক ফাটিয়া যায়। সৎ-মা অনেক দেখিয়াছি কিন্তু এমন অসৎ সৎ-মা বুঝি ত্রিভুবনে আর নাই। আবার মেয়েটির মত ভাল মেয়েও দেখা যায় না।’
প্র-বা। সই, ওসব কথা থাক্, চল বাড়ির ভিতরে যাই, বড় মাথা ধরিয়াছে।
দ্বি-বা। সই তোমার এক ভয়ানক খবর আছে; তা এখানেই নির্জনে বলি। বাবাজান আর মা, কাল বিকালে তোমার সম্বন্ধে যত কথা বলিয়াছেন—সবই বলিতেছি।
প্র-বা। (উদ্বিগ্নচিত্তে) কি খবর সই?
দ্বি-বা। “মা বলিলেন, অত বড় সেয়ানা মেয়ে, তথাপি সে তার সত্মার অত্যাচার নীরবে সহিয়া তারই আদেশ উপদেশ মত চলে, চুঁটু শব্দটি পৰ্য্যস্ত করে না, ভুলিয়াও সমার নিন্দা করে না; বরং কেহ নিন্দাবাদ করিলে সেখানে হইতে উঠিয়া যায়। ধন্নি মেয়ে।”
প্র-বা। সই, আসল কথা কি তাই বল?
দ্বি-বা। আমি দুই কানে যা শুনিয়াছি তাহাই বলিতেছি।
এই বলিয়া দ্বিতীয়া বালিকা আবার বলিতে লাগিল, “বাবজান কহিলেন, মেয়েটি দেখিতে যেমন সুন্দর, তার স্বভাবটিও তেমনিই মনোহর, আবার পড়াশুনায় আরোও উত্তম। আনোয়ারার স্মরণশক্তি অসাধারণ; স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ভূগোলপাঠ, ভারতের ইতিহাস আদ্যন্ত মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। চারুপাঠ, সীতার বনবাস, মেঘনাদবধ কাব্য, পদ্যপাঠ প্রভৃতি সাহিত্য পুস্তক সুন্দররূপে বুঝাইয়া লিখিতে পারে, হাতের লেখা চমৎকার। জামা-সেলাই— নীলাম্বরী কাপড়ে ফুলতোলা দেখিয়া সেদিন ইনস্পেক্টর সাহেব তাহাকে যে ১০ টাকা পুরস্কার দিয়া গিয়াছেন তাহা ত’ বোধ হয় জান? মেয়ে পড়ার বই ছাড়া, ২০/২৫ খানি স্ত্রী পাঠ্য পুস্তক—আমি যাহা নির্দেশ করিয়া দিয়াছি, তাহা সুন্দররূপে আয়ত্ত করিয়াছে। মেয়ের জ্ঞান- পিপাসা দেখিয়া আমি বাস্তবিকই বিস্মিত হইয়াছি। ইহার মধ্যে আবার আমাকে হযরত ওমরের জীবন চরিত আনিতে টাকা দিয়াছে। আনোয়ারার কোরান পাঠ শুনিলে আমি অশ্রুসংবরণ করিতে পারি না।’
মা কহিলেন, “তা যেন হইল, মেয়ে যে বড় হইয়া গেল তাহার কি হইবে? তাহার বাপ ত’ এ বিষয়ে লক্ষ্যই করিতেছে না।’ শেষে মা বাবাজানকে, তোমার সয়ার মত নিৰ্গুণ কদাকার একটা বরের হাতে তোমাকে সমর্পণ করিতে অনুরোধ করিলেন। এই বলিয়া সে একটু মুচকিয়া হাসিল, তারপর কহিল, ‘বিশেষ করিয়া বলিলেন, ‘যেমন মেয়ে তেমন উপযুক্ত পাত্র না হইলে সবই বিফল হইবে। বাবাজান শুনিয়া বিশেষ দুঃখের সহিত বলিলেন, ‘বিফল হইবে বলিয়াই বোধ হইতেছে।’ তখন মা চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, “ সেকি বাবাজান কহিলেন, “তিন হাজার টাকার কাবিন, পনর শত টাকার গহনা এবং পনর শত টাকা নগদ লইয়া জাফর বিশ্বাসের নাতির সহিত ভূঞা সাহেব মেয়ে বিবাহ দিবেন বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন—শুনিলাম। মা উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, ‘তুমি বল কি? জাফর বিশ্বাস ডাকাত ছিল, শেষবার ধরা পড়িয়া জেল খাটিয়া মরিয়া গিয়াছে। ভূঞা সাহেব হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া রূপে মজিয়া জাফর চোরের মেয়েকে বিবাহ করিয়াছেন বলিয়াই কি আনোয়ারার মত বেহেস্তের হুরকে তাহাদেরই ঘরে বিবাহ দিবেন? আমার হামিদা আনোয়ারার সহিত ‘সই’ বন্ধন করিয়াছে, উভয়ের মধ্যে যেরূপ ভাব, তাহাতে এ সম্বন্ধ যাবজ্জীবন অচ্ছেদ্য। আনোয়ারার বিবাহ চোরের ঘরে হইলে, হামিদা যে সরমে মরিয়া যাইবে, আমরা যে কোথাও মুখ পাইব না? বিশেষত আনোয়ারা সেয়ানা মেয়ে, শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সব বুঝিয়া উঠিয়াছে, সে শুনিলে যে কি ভাবিবে বলিতেই পারি না।
বাবজান কহিলেন, “যার মেয়ে সে যদি বিবাহ দেয়, আমরা কি করিব?” মা কহিলেন, “এ বিবাহ যাহাতে না হয়, সেজন্য তোমরা দশজনে মিলিয়া শক্ত করিয়া বাধা দাও।” বাবজান কহিলেন, “আজিমুল্লা (জাফর বিশ্বাসের পুত্র) এই বিবাহের জন্য আবুল কাশেম তালুকদার, নুরউদ্দিন মুন্সি, মীর ওয়াজেদ আলী প্রভৃতি প্রধানদিগকে একশত টাকা করিয়া ঘুষ দিয়াছে, সুতরাং এ বিবাহ আর নিবারণ করা চলিবে না। এখন খোদাতায়ালার ইচ্ছা, আর মেয়ের কপাল।’ এই বলিয়া বাবজান বাহির বাড়িতে চলিয়া গেলেন; মা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “হামি, তোর সইয়ের বিবাহের কথা শুনিয়াছিস?” আমি ত’ গোপনে তাহাদের কথাবার্তা সবই শুনিয়াছি, তবু মার মুখের দিকে তাকাইলাম। আমি কাল বিকালেই তোমাকে বলিতে আসিতাম, কিন্তু কলিকাতার পত্রের উত্তর লিখিতে বিলম্ব হইল, আর ভাবিলাম, এ সংবাদ শুনিলে রাত্রে তোমার ঘুম হইবে না, তাই আসি নাই; কিন্তু তোমার মুখের চেহারায় বুঝিতেছি যে, এ সংবাদ তোমার কানে আগেই গিয়াছে। “
আনোয়ারা কহিল, “না সই, তোমার মুখে এই প্রথম শুনিলাম।” হামিদা আনোয়ারার মুখের দিকে চাহিল, দেখিল—তাহার রুক্ষ মুখ অধিকতর রুক্ষ হইয়াছে। ডাগর চক্ষু দুইটি নীহার-সিক্ত ফুটন্ত জবার ন্যায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। সে হামিদার কথার আর কোন উত্তর করিল না, কেবল মৃদুস্বরে কহিল, “সই বড় মাথা ধরিয়াছে, চল–বাড়ির ভিতরে যাই।” এই বলিয়া আনোয়ারা উঠিয়া দাঁড়াইল, হামিদাও তাহার সঙ্গে অন্দরমুখী হইল।
এই সময়ে নৌকা হইতে প্রয়োজনবশত অবতরণকালে যুবক পেটকাটা ছৈ মধ্যে দাঁড়াইয়া কাশিয়া উঠিল। হামিদা ফিরিয়া তাকাইয়া চমকিয়া উঠিল এবং ব্যাকুলভাবে ঘোটা টানিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। আনোয়ারাও ফিরিয়া চাহিল, চারি চক্ষের মিলন হইল। কিন্তু কল্পিত স্বপ্নদৃষ্ট হৃদয়ের সামগ্রী প্রত্যক্ষ করিলে লোকে যেমন আশ্চর্যবোধে চম্কিয়া উঠে, যুবকের প্রতি দৃষ্টিপাত মাত্র বালিকা সেইরূপ শিহরিয়া উঠিল। যুবকও কি যেন ভাবিয়া হর্ষ-বিষাদ পরিমিশ্রিত প্রশান্ত-সৌম্য-বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে করুণ দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। বালিকার আয়ত আঁখি লজ্জায় মুকুলিত হইল। পরন্ত সে ভাবিল ইনিই বুঝি নৌকার ভিতর মধুকন্ঠে কোরান শরীফ পাঠ ও মোনাজাত করিয়াছেন। ঝঞ্ঝাবাত সমুখানে তটিনীর বক্ষ যেরূপ প্রবল উচ্ছ্বাসে তরঙ্গায়িত হইতে থাকে, সুখ দুঃখের সংমিশ্রিত ভাবাবেগে তাহার সুকোমল ক্ষুদ্র হৃদয়খানি তখন সেইরূপ আন্দোলিত হইতে লাগিল এবং তৎসঙ্গে তাহার মাথার বেদনা আরও বাড়িয়া উঠিল। সে ধীরপদে অন্দরে প্রবেশ করিল। কেবল অস্ফুটস্বরে কহিল, “তবে ইনিই কি তিনি? মা তোমার কথা যেন সত্য হয়, আমি একমাস নফল রোজা রাখিব।”