নবম পরিচ্ছেদ
কয়েক দিবস পর অপরাহ তিন ঘটিকার সময় নুরল এসলাম আনোয়ারাকে পুনরায় দেখিতে আসিলেন। এই সময়ে পুরুষ মানুষ কেহই তাহাদের বাড়িতে ছিল না। বাদশা রামনগর স্কুল হইতে এখনও ফিরে নাই, চাকরাণীরা ঢেঁকি শালে। গতকল্য আজিমুল্লাহ আসিয়া তাহার ভগিণী গোলাপজানকে লইয়া গিয়াছে। এখন কেবল আনোয়ারা ও তাহার দাদিমা উপস্থিত। ভূঞা সাহেব কোথায় গিয়াছেন, কেহই জানে না। আমরা কিন্তু জানি,—পরম স্ত্রৈণ ভূঞা সাহেব আজিমুল্লার বাড়িতে গিয়াছেন। আনোয়ারার সহিত যাহাতে আজিমুল্লার পুত্রের বিবাহ হয়, তাহার পাকাপাকি বন্দোবস্তের নিমিত্ত চতুর আজিমুল্লা ভগিনীকে নিজ বাড়িতে লইয়া গিয়াছে, ভূঞা সাহেবও তথায় উপস্থিত। আজিমুল্লা ভগিণী ও ভগিণীপতিকে নানাবিধ সুখ- সুবিধার প্রলোভনে বশীভূত করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে।
নুরল এসলাম বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়া কহিল, “ভূঞা সাহেব, বাড়ি আছেন?” আনোয়ারার দাদিমা বৈঠকখানা ঘরের আড়ালে থাকিয়া কহিলেন, “আপনি বসুন, খোরশেদ সকাল বেলায় কোথায় গিয়াছে। যাইবার কালে বলিয়া গিয়াছে, আজ ডাক্তার সাহেব আসিতে পারেন। তিনি আসিলে নৌকার লোকজনসহ তাঁহাকে জিয়াফ করিবেন, আমি সত্ত্বর বাড়ি ফিরিব।” এই বলিয়া বৃদ্ধা আবার কহিলেন, “আমার অনুরোধ আপনি মেহেরবানী করিয়া নৌকার লোকজনসহ গরিবখানায় বৈকালে জিয়াফ কবুল করুন।” ডাক্তার সাহেব কহিলেন, “জিয়াফতের আবশ্যক কি? আগে আপনার নাতিনীর কুশল সংবাদ বলেন।” বৃদ্ধা কহিলেন, “আপনার চিকিৎসার গুণে, আল্লার ফজলে নাতিনী আমার সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছে।” এই কথা বলিয়া বৃদ্ধা আনোয়ারার ঘরের সম্মুখে যাইয়া তাহার নাম ধরিয়া ডাকিলেন। আনোয়ারা দাদিমার নিকট আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, ‘ডাকিলেন কেন?’
বৃদ্ধা। ডাক্তার সাহেব আসিয়াছেন, তাঁহাকে বৈকালে জিয়াফ করিলাম, এখন পাকের যোগাড়ে যাও, আজ তোমাকেই রান্না করিতে হইবে।
শিশির-মুক্তাখচিত নববিকশিত প্রভাতকমল বলাকাকিরণোদ্ভিন্ন হইলে যেমন সুন্দর দেখায়, আনোয়ারার মুখ-পদ্ম এই সময় তদ্রূপ দেখাইতেছিল।
প্রবীণা দাদিমা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কি যেন চিন্তা করিলেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক নিমন্ত্রিত হইলে আনোয়ারাকেই পাক করিতে হইত। সে এক্ষণে পাকের কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি রান্না করিব?”
বৃদ্ধা। ঘরের পোলাওয়ের চাল আছে, ঘি-মশলা সবই আছে।
আনো। তরকারি কি দিয়া হইবে?
বৃদ্ধা নাতিনীর মন বুঝিবার জন্য কহিলেন, “তোর টগর-জবা দুইটা দে। তোর বাপ বাড়ি আসিলে কিছু দাম লইয়া দিব।” টগর ও জবা আনোয়ারার স্নেহপালিত দুইটি খাসি মোরগের নাম। আনোয়ারা স্মিতমুখে কহিল, “দাম যদি দাও তবে পঁচিশ টাকার কম লইব না।” বৃদ্ধা সুযোগ পাইয়া কহিলেন, “যিনি বিনামূল্যে প্রাণ রক্ষা করিলেন, তাঁহারই জন্য মোরগ চাহিলাম, সেই মোরগের দাম অত টাকা চাহিলি? এই বুঝি লেখাপড়া শিক্ষার ফল উপকারীর উপকার স্বীকার করা বুঝি এইরূপেই শিখিয়াছিস?” আনোয়ারা কহিল, “তুমিই ত প্রথম দাম দিতে চাহিয়াছ। নচেৎ দুই-দশ মোরগ কেন, উপকারীর প্রত্যুপকারে জান দিতে পারি।” আনোয়ারা নবানুরাগে আত্মহারা হইয়া এই প্রথম অসাবধানে কথা কহিল। বৃদ্ধা কটাক্ষ করিয়া কহিলেন, “হাঁ বুঝিয়াছি, এখন পাকের যোগাড়ে যাও।” আনোয়ারার তখন চৈতন্যোদয় হইল, সে দাঁতে জিভ কাটিয়া সরমে মরমর হইয়া গেল। দাদি-নাতনীর কথা- বার্তা অনুচ্চরবে হইতেছিল—তথাপি নুরল এসলাম তাহা শুনিতে পাইলেন। আনোয়ারার শেষ কথা তাঁহার কর্ণে অমৃত বর্ষণ করিয়া হৃদয়ের অন্তস্থল অভিষিক্ত করিয়া তুলিল। তিনি অনাস্বাদিতপূর্ব সুখরস সিঞ্চনে বিভোর হইয়া ধীরে ধীরে নৌকায় গিয়া উপস্থিত হইলেন।
সন্ধ্যার পূর্বে ভূঁইয়া সাহেব বাড়ি আসিলেন। আনোয়ারার মোরগদ্বয় জবেহ করিয়া পোলাওয়ের আয়োজন হইল; তালুকদার সাহেবকেও দাওয়াত করা হইল। রাত্রিতে নৌকার লোকজনসহ নুরল এসলাম ভূঁইয়া সাহেবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিলেন। তৃপ্তির সহিত সকলের ভোজন ক্রিয়া শেষ হইল। আহারান্তে গল্পগুজব চলিল। তালুকদার সাহেব ও নুরল এসলামের পরস্পর বাক্যালাপে আনোয়ারার দাদিমা বাড়ির মধ্য হইতে নুরল এসলামের যাবতীয় পরিচয় ও অবস্থা জানিতে পারিলেন এবং জানিয়া তিনি যেন এক ভবিষ্যৎ আশার আলোক সম্মুখে দেখিতে পাইলেন।
আহারান্তে নুরল এসলাম নৌকায় আসিলেন। পাচক নৌকায় যাইয়া কহিল, “পাকের বড়াই আর করিব না এমন পোলাও-কোর্মা জন্মেও খাই নাই। আকবরী পোলাওয়ের নাম গল্পে শুনিয়াছিলাম; আজ তাহা পেটে গেল।” যাচনদার কহিল, “খুব বড় আমীর ওমরাহ লোকের বাড়িতেও এমন পাক সম্ভবে না।” নুরল এসলাম কহিলেন, “তোমাদের কথা অতিরঞ্জিত বলে বোধ হয় না; পাক বাস্তবিকই অনুপম হইয়াছিল।
প্রাতে নামাজ ও কোরান পাঠ শেষ করিয়া নুরল এসলাম বিদায়ের জন্য ভূইঞা সাহেবের বাড়ির উপরে আসিলেন। ভূইঞা সাহেব ১৫টি টাকা তাহার হাতে দিতে উদ্যত হইয়া কহিলেন; “আপনার চিকিৎসার মূল্য দেওয়া আমার অসাধ্য। কিন্তু ঔষধের মূল্যবাবদ এই সামান্য কিছু গ্রহণ করুন।” নুরল এসলাম কহিলেন, “আমি চিকিৎসা করিয়া টাকা লই না, পূর্বেই বলিয়াছি।” ভূইঞা সাহেব কহিলেন, “ইহা না লইলে মনে করিব অযোগ্যজ্ঞানে গ্রহণ করিলেন না। তাহা হইলে আমার অসুখের সীমা থাকিবে না। নুরল এসলাম কহিলেন, “আপনি টাকা দিলে আমি শতগুণে অসন্তুষ্ট হইব।” ভূইঞা সাহেব অগত্যা নিরস্ত হইলেন। ভূইঞা সাহেব ও তাঁহার মাতাকে সালাম জানাইয়া নুরল এসলাম বিদায় গ্রহণ করিলেন। যাইবার সময় তালুকদার সাহেবকেও সালাম করিয়া গেলেন।