অষ্টম পরিচ্ছেদ
নুরল এসলামের চিকিৎসায়; আল্লার ফজলে, আনোয়ারার জ্বর বন্ধ হইয়াছে, শিরঃপীড়া আরোগ্য হইয়াছে, সে এখন স্বেচ্ছায় উঠা-বসা চলা-ফেরা করিতে পারে, তথাপি নুরল এসলামের ব্যবস্থানুসারে শরীরের বলধারণের জন্য এখনও সে নিয়মিতরূপে ঔষধ সেবন করিতেছে। হামিদা অহঃরহ তাহার কাছে আসে, বসে, প্রাণ খুলিয়া কত কথা বলে; আনোয়ারা কিন্তু অল্প কথায় সই-এর উত্তর দেয়। তাহার স্বভাব-সুলভ সরলতায় গাম্ভীৰ্য্য প্রবেশ করিয়াছে, যোগাভ্যস্তা তাপসবালার ন্যায় সে অধিকতর স্থিরা, ধীরা ও সংযতভাষিণী হইয়া উঠিয়াছে, দূর-ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখের চিন্তায় সে যেন সর্বদা আত্মহারা হইয়াছে; সে এক্ষণে কেবল নির্জনতা চায়, নির্জনে বসিয়া চিন্তা করিতে ভালবাসে। সুখের সংসারে চিরসোহাগে পালিতা অনুঢ়াকুমারী, তাহার আবার নির্জন চিন্তা কি? চিন্তা—নৌকার সেই মুখখানি! সেই সুঠাম সুন্দর প্রশান্ত সৌম্যমূর্তি। সেই প্রেম-পীযুষ বর্ষিণী অনাবিল করুণদৃষ্টি! তেমন সুন্দর, তেমন প্রেম-মাখান—জ্যোতিঃজড়ান শান্তিপ্রদ মুখের চাহনি সে এ পর্যন্ত কখনও দেখে নাই; তাই নির্জনে দেখিয়া সাধ পূর্ণ করিতে চায়, তাই তাহার নির্জনতার এত প্রয়োজন। যখন সে নৌকার কথা মনে করে, তখনই সেই মুখখানি তাহার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে; বালিকা তখন লজ্জায় অবনত আখি হয়। যখন সে ভাবে, তাঁহাকে দেখিতে এত সাধ কেন, আনন্দই বা হয় কেন? বালিকা ফাপরে পড়িয়া আবার ভাবে ভালবাসিলে কি পাপ হয়? লায়লী, শিরি, দময়ন্তী, সাবিত্রী ইহারাও ত’ সতীকুলোত্তমা। বালিকা হর্ষোৎফুল্ল হইয়া আবার ভাবে আহা কি সুন্দর কোরাণ পাঠ, কি মোহন উচ্চারণ! তেমন সুমধুর স্বরে কোরান পাঠ বুঝি আর শুনিতে পাইব না;—ভাবিতে ভাবিতে যুবকের পবিত্র-মূর্তি বালিকার মানসপটে প্রকৃত মূর্তিতে প্রকাশিত হয়, মোনাজাতের বিশ্বজনীন মহত্বে বালিকার ক্ষুদ্র হৃদয় ভরিয়া যায়। তখন সে যুবকের মোনাজাত-ভক্তিতে ভক্তি মিশাইয়া নির্জনে চোখের জলে বুক ভাসাইতে থাকে, আর ভাবে জগৎ মঙ্গলবিধায়ক, এমন ধর্মভাবে পূর্ণ, এমন উদারতার চরম অভিব্যক্তি মোনাজাত, কেবল ফেরেস্তাগণের মুখে শোভাপায়, খোদার প্রতি এমন স্তুতি-ভক্তি কেবল ফেরেস্তারাই করিয়া থাকেন।
বালিকা কখনও ভাবে, যিনি নিঃস্বার্থভাবে এ জীবন রক্ষা করিয়াছেন তাঁহারই চরণতলে প্রাণ উৎসর্গ করিলাম; কিন্তু অযোগ্যজ্ঞানে উপেক্ষা করিলে যে মরমে মরিয়া যাইব। আবার ভাবে—উৎসর্গের বস্তু হেয় হইলে ত’ কেবল ফেলিয়া দেয় না; কিন্তু ফেলিয়া না দিলেও যদি মনঃপুত না হয় তবে, দিয়া লাভ কি? না না, উৎসর্গ করাই ত’ স্ত্রীলোকের ধর্ম, লাভ চাহিব কেন?
ক্রমশ মন এইরূপে বালিকাকে স্বর্গীয় প্রেমের পথে টানিয়া লইয়া চলিল। একদিন জোহরের নামাজ বাদ আনোয়ারা শিশি হইতে এক দাগ ঔষধ ঢালিয়া সেবন করিল। শিশির গায়ে লেবেলে লেখা আছে, “প্রাতে, মধ্যাহ্নে ও বৈকালে এক এক দাগ সেবনীয়।” লেখা দেখিয়া আনোয়ারা ভাবিতে লাগিল, ‘এ লেখা নিশ্চয়ই তাহার নিজ হাতের, না হইলে এমন সুন্দর লেখা আর কাহার হইবে? জগতে যাহা কিছু সুন্দর তাহা তাঁহারই।’ আনোয়ারা আত্মহারা হইয়া তখন সেই পবিত্র মূর্তির ধ্যান করিতে লাগিল, হাতের শিশি হাতেই রহিয়া গেল। এই সময় একখানি কেতাব হাতে করিয়া হামিদা আসিয়া তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইল। আনোয়ারার বহির্জগত তখন বিলুপ্ত–সে পার্শ্বে দণ্ডায়মান হামিদাকে দেখিতে পাইল না। হামিদা পূর্বেই রকম-সকমে বুঝিয়াছিল, সই ডাক্তার সাহেবের প্রতি অনুরাগিনী হইয়াছে। এক্ষণে তাহাকে আত্মহারাভাবে দেখিয়া কহিল, “সই, ঘরের ভিতরেও কি নৌকা প্রবেশ করিয়াছে?” আনোয়ারার তখন চমক ভাঙ্গিল। সে হামিদাকে পাশে দেখিয়া লজ্জায় ম্রিয়মান হইয়া হৃদয়ের ভার চাপা দেওয়ার জন্য কহিল, “সই, হাতে ওখানা কি বই?” হামিদা হাসিয়া কহিল, ‘বইয়ের কথা পরে কই, কার ভাবনা ভাবছ সই?” প্রেম-প্রফুল্ল আনোয়ারা তখন লজ্জা দূরে সরাইয়া উত্তর করিল, “কতক্ষণে আসবে সই,—ধ্যান করছি বসে তাই।” হামিদা কহিল, “অনেকক্ষণ ত’ এসেছি সই, তবে কেন সাড়া নেই?” আনোয়ারা কহিল আর চাপিয়া গেলে চলিবে না, তাই সে সইয়ের নিকট দেলের কথা আভাসে জানাইল। হামিদা শুনিয়া কহিল, “সই অজ্ঞাতকুলশীল বিদেশী লোককে ভালবাসিলে কেন? তাঁহার সহিত তোমার বিবাহের সম্ভাবনা কোথায়।” দর্পনে হাঁই দিলে তাহা যেমন সজল ও মলিন হইয়া উঠে, হামিদার কথায় আনোয়ারার মুখের অবস্থা সেইরূপ হইল, তাহার ইন্দ্রবর-নিন্দিত আয়ত আঁখি অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল, সে কোনো উত্তর করিল না। হামিদা দেখিল, একেবারে মজিয়া গিয়াছে, পুষ্প ঘাতও বুঝি আর সহ্য হইবে না, তাই তাহার ভাবান্তর উৎপাদন জন্য বইখানি হাতে দিয়া কহিল, “এখান তুমিই বাবাজানকে আনিতে দিয়াছিলে? আনোয়ারা বই খুলিয়া দেখিল, ‘ওমর চরিত’ ‘মুখে কহিল,–’হাঁ।’
অনন্তর হামিদা কহিল, “সই, মানুষের মত যে মানুষ থাকে, আগে তাহা জানিতাম না। তোমার ডাক্তার সাহেবকে তোমার সয়া মনে করিয়া সেদিন খিড়কীর দ্বার হইতে দৌড়িয়া বাড়ি আসি, মনে নানারূপ সন্দেহ হওয়ায় সঠিক খবর জানিবার নিমিত্ত ভোলার মাকে তখনই নৌকার কাছে পাঠাইয়া দেই। পোড়ামুখী ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘নৌকার আরোহী বেতার দুলামিয়া। কথা শুনিয়া প্রাণ উড়িয়া গেল।’ আনোয়ারা সইয়ের মুখে নিজের প্রিয়তমের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ কথা শুনিয়া এতক্ষণ আকাশ-পাতাল ভাবিয়া স্তব্ধনিঃশ্বাসে চুপ করিয়াছিল। সই-এর এত কথার পর আর কথা না বলিলে সে অসন্তুষ্ট হইতে পারে, তাই পরিহাসচ্ছলে কহিল, “সই, উল্টা কথা কহিলে, স্বামীর আগমন সংবাদে উড়া প্রাণ ত’ আবাসে বসিবার কথা।“
হামিদা। তা ঠিক, কিন্তু এবার তাঁহার কলিকাতা যাইবার সময় ঝগড়া করিয়াছিলাম। আনো। (স্মিতমুখে) লাইলীর সহিত মজনুর বিবাদ। কেন—কি লইয়া?
হামিদা বেপর্দায় বেড়ান লইয়া স্বামীর সহিত যে সকল কথা হইয়াছিল, খুলিয়া বলিল। আনোয়ারা শুনিয়া বলিল, “জয় ত তোমারই, তবে ভয়ের কারণ কি?” হামিদা কহিল, “আমি তোমার ডাক্তার সাহেবকে স্বামী মনে করিয়াছিলাম।” এই বলিয়া সে জিভ কাটিল। কিন্তু কথাটি সইকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে বলিয়া কহিল, “তিনি যখন আমাদের খিড়কী-দ্বারে অনাবৃত মস্তকে তোমার সাথে কথা বলিতে দেখিলেন, তখন ভয় না হইয়া যায় না। বিশেষত বেপর্দায় বেড়াই না বলিয়া বিবাহের দিন তাঁহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাইয়া দিয়াছি, এমতাবস্থায় বেপর্দায় দেখিয়া তিনি নিশ্চয় আমাকে অবিশ্বাস করিবেন, তাই প্রাণ উড়িয়া গিয়াছিল।”
আনোয়ারা স্মিতমুখে কহিল, এদিকে বেপর্দায় চলিয়া—ওদিকে চলি না বলিয়া স্বামীর বিশ্বাস জন্মান কি প্ৰবঞ্চনা নয়?
হামিদা। যদি প্রবঞ্চনা হয়, তবে তুমিও এ প্রবঞ্চনার জন্য দায়ী।
আনো। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে?
হামিদা। তোমাকে এক দণ্ড না দেখিলে, তোমার সহিত কথা না বলিতে পারিলে আমি যে থাকিতে পারি না। সেদিন ভোরে যখন তোমাকে তোমাদের বাড়িতে পাইলাম না তখন খুঁজিতে খুঁজিতে তোমাদের খিড়কীর ঘাটে উপস্থিত হই। তখন হইতেই এ অসুখ, এ অশান্তি।
আনো। এরূপ স্থলে তোমার প্রবঞ্চনা-পাপের অংশভাগিনী হইতে রাজী আছি। কিন্তু সই! বিধির বিধান সেরূপ নয়; তাহা হইলে দস্যু নিজাম আউলিয়া হইতে পারিতেন না।
হামিদা। নিজাম আউলিয়ার কথা কিরূপ?
আনো। তোমার পিতা একদিন আমাদিগকে উক্ত মহাত্মার বিবরণ শুনাইয়াছিলেন। নিজাম প্রথমে ভীষণ দস্যু ছিলেন। তাঁহার প্রতিজ্ঞা ছিল, রোজ একটি করিয়া খুন না করিয়া পানি স্পর্শ করিবেন না। একদিন তিনি শাহ ফরিদকে খুন করিতে উদ্যত হন। তাপসশ্রেষ্ঠ ফরিদ নিজামকে বলেন, “তুমি নরহত্যা করিয়া যাহাদের গ্রাসাচ্ছদন সংগ্রহ করিয়া থাক, তাহাদিগকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া আইস, তাহারা তোমার এই মহাপাপের ভাগী হইবে কি-না? এমন কথা নিজাম জীবনে কখনও শুনেন নাই। হঠাৎ তার ভাবান্তর উপস্থিত হইল, তিনি দ্রুতপদে যাইয়া পরিজনদিগকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন; তাহারা কহিল, একজনের পাপের জন্য অন্যের কি শাস্তি হয়? এই কথায় নিজামের তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হইল। অতঃপর তিনি সৎসঙ্গে থাকিয়া অশেষবিধ পুণ্যানুষ্ঠান দ্বারা ভীষণ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে লাগিলেন।
হামিদা। তবে সই, আমার এই প্রবঞ্চনা-পাপের প্রায়চিত্ত কিরূপে হইবে?
আনো। তুমি সয়ার নিকট কোনো কথা গোপন না করিয়া বা মিথ্যা না বলিয়া সব খুলিয়া বলিবে।
হামিদা। তাহাতেই কি আমার দোষের প্রায়চিত্ত হইবে?
আনো। হাঁ, তাহাই যথেষ্ট।
হামিদা। তিনি যদি তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া আমাকে ঘৃণার চক্ষে দেখেন, বা আমার সহিত কথা না বলেন?
স্বামীর অবহেলা কল্পনা করিয়া মুগ্ধা হামিদার চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।
আনো। তুমি ত’ এমন দোষ কর নাই—যাহাতে তিনি তোমাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতে পারেন বা তোমার সহিত কথা না বলিয়া থাকিতে পারেন।
তথাপি তিনি যদি অবস্থা বুঝিয়া ঐরূপ কোন ভাব প্রকাশ করেন, তাহা হইলে তুমি ধীরে ধীরে তাঁহার নিকট হইতে চলিয়া আসিবে, আর তাঁহার নিকট যাইবে না, কথাও বলিবে না। কিন্তু দূরে থাকিয়া যতদূর পার তাঁহার স্নান, আহার, সেবা-শুশ্রূষায় ত্রুটি করিবে না। এইরূপ করিলে সয়া যখন নির্জনে বসিয়া তোমার অভাব মনে করিবেন, তখন বিবেক তাঁহাকে প্রলুব্ধ করিবে। সামান্য কারণে নিদারুণ উপেক্ষার জন্য অনুতাপ আসিয়া তাঁহার হৃদয়ে কশাঘাত করিতে থাকিবে। তখন উল্টা-পালা আরম্ভ হইবে।
এই বলিয়া আনোয়ারা হাসিতে লাগিল।
হামিদা। লোকে কথায় বলে—’কারো সর্বনাশ, কারো মনে মনে হাস।’ সই, তোমার দেখিতেছি তাই।
আনো। উল্টা পালার ফল মনে ভাবিয়া হাস্য সংবরণ করিতে পারিতেছি না।
হামিদা। সই, উল্টা পালা কেমন?
আনো। অর্থাৎ—তখন তোমার মান ভাঙ্গাইতে সয়ার যে আমার প্রাণান্ত উপস্থিত হইবে!
হামিদা। আমি মান চাই না। তিনি সরল মনে দাসীর সহিত কথা বলিলে হাতে স্বৰ্গ পাইব।
আনো। তর্কস্থলে ঘটনা যতদূর দাঁড়াইল, আসলে ততদূর গড়ান সম্ভব নয়। কারণ, তোমার প্রবঞ্চনা ত’ হৃদয়ের নহে, বাহিরের ঘটনার জন্য। আর বেপর্দা ভাবও ত’ তেমন কিছু হয় নাই। প্রয়োজনবশত আমরা অনেক সময় খিরকীর দ্বারে আসিয়া থাকি। তবে তিনি (ডাক্তার সাহেব) যে আমাদিগকে কিছু অসাবধনভাবে হঠাৎ দেখিয়া ফেলিয়াছেন, তাহাই দোষের কথা হইয়াছে। যাহা হউক, সয়া যদি তোমাকে এ-পর্যন্ত না চিনিয়া থাকেন, তবে তোমাদের উভয়েরই পোড়াকপাল বলিতে হইবে।
হামিদা আনোয়ারার কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া কহিল, “সই, তোমার ত’ বিবাহ হয় নাই, তবে তুমি স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে এত কথা কি করিয়া জান?”
আনো। দাদিমার মুখে গল্প শুনিয়া, আর আমার মা ও মামানীদিগের ব্যবহার দেখিয়া।
এই সময় আনোয়ারার দাদিমা তথায় উপস্থিত হওয়ায় তাহাদের কথোপকথনের স্রোত প্ৰতিহত হইল।