দশম পরিচ্ছেদ
এদিকে আনোয়ারা অনেক সময় নির্জনে অশ্রুমোচন করিয়া অনিদ্রায় কাল কাটাইতে লাগিল। ফলত জ্বলন্ত অগ্নির উত্তাপে নববিকশিত কদলিপত্র যেরূপ বিশুষ্ক ও মলিন হইয়া যায়; সৌন্দর্য প্রতিমা বালিকা সেইরূপ নবীভূত ভাবান্তরে কৃশ ও বিবর্ণ হইতে লাগিল। হামিদা সইয়ের মনের ভাব বুঝিয়া আশ্চর্য হইল, নির্জনে তাহাকে নানাবিধ প্রবোধ দিতে লাগিল। আনোয়ারার দাদিমাও পৌত্রীর ভাবান্তর উপলব্ধি করিলেন। তিনি এক সময় পরিহাসচ্ছলে কহিলেন, “কি লো! ডাক্তারের বিচ্ছেদে পাগল হইবি নাকি?” আনোয়ারা মলিন মুখে নিরুত্তর রহিল।
আনোয়ারার পিতামহ আরবি-ফারসি বিদ্যায় প্রসিদ্ধ মুন্সী ছিলেন। বর্তমান সময়ে মৌলভী নামধারী সাহেবেরা জ্ঞান-গরিমায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে সে-সময়ের মুন্সী সাহেবানদের শিষ্যগণের তুল্য-মূল্যও অনেকে বহন করেন না। যাহা হউক, আনোয়ারার দাদিমা, আনোয়ারার বয়সেই মুন্সী সাহেবকে পতিত্বে বরণ করেন। তাঁহাদের বিবাহ পরস্পর পবিত্র প্রণয়সূত্রে সংঘটিত হয়। তাঁহাদের এই বৈবাহিক জীবন যেরূপ সুখের হইয়াছিল, সচরাচর সেরূপ দেখা যায় না। স্বামীর গুণে আনোয়ারার দাদিমা আরবি-ফারসি শিক্ষায় সুশিক্ষিত হন। সুতরাং বিদ্যার অমৃত আস্বাদ তিনি পাইয়াছিলেন। সংসারের অবস্থাও তাহাদের খুব স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু চির-সুখ-সৌভাগ্য কাহারও ভাগ্যে ঘটে না। বৃদ্ধার অর্ধেক বয়সে তাঁহার স্বামী এবং দুই পুত্র ও দুই কন্যা কালের কবলে পতিত হন। কিছুদিন পরে তাঁহার প্রাণাধিক পুত্রবধূ (আনোয়ারার মাতা) লোকান্তরে গমন করেন। কেবল মাত্র পুত্র খোরশেদ আলী ও পৌত্রী আনোয়ারা বৃদ্ধার শেষ জীবনের অবলম্বন হয়। বৃদ্ধা স্বামী, পুত্র, কন্যা ও পুত্রবধূর অসহ্য শোক শান্তির জন্য আনোয়ারাকেই অন্ধের যষ্টির ন্যায় বোধ করেন এবং স্বকীয় উন্নত হৃদয়ের স্নেহরাশি পৌত্রীতে ঢালিয়া দিয়া সুখ-দুঃখের চিরসঙ্গিনী হন। ফলত তাহাকে বৃদ্ধার অদেয় কিছুই ছিল না।
একদিন রাত্রিতে শয়ন করিয়া বৃদ্ধা ডাক্তার সাহেবের প্রতি নাতনীর অনুরাগ প্রকৃত কিনা, পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত ধীরে ধীরে কহিলেন, “আনার শুনিলাম—তোর বাপ ফয়েজ উল্লার সহিত তোর বিবাহ বন্দোবস্ত করিয়াছে। আমি এ বিবাহ ভালই মনে করি। দুই তিন হাজার টাকার সম্পত্তি, পনর শত টাকার গহনা ও নগদ পনর শত টাকা পাবি, ফয়েজ উল্লাও তোর যোগ্য পাত্র হইবে।” আনোয়ারা শুনিয়া কোন উত্তর করিল না, বিরক্তির সহিত পাস ফিরিয়া শয়ন করিল।
বৃদ্ধা। কি লো! বিয়ের কথা শুনিয়া যে মুখ ফিরালি?
আনোয়ারা দেখিল, তাহার সহিত, কথা না বলিলে তিনি মনে আঘাত পাইবেন; তাই সে কহিল, “ও কথা আমি পূর্বেই শুনিয়াছি।”
বৃদ্ধা। কবে, কার কাছে শুনিয়াছিস্?
আনো। যেদিন আমি ব্যারামে পড়ি সেইদিন সইয়ের নিকট শুনিয়াছি।
বৃদ্ধা। তাই শুনিয়াই বুঝি মরিতে বসিয়াছিলি? এতদিন বলিস নাই কেন?
আনো। বলিবার কথা হইলে বলিতাম।
বৃদ্ধা। ও বিবাহে তবে তোর মত নাই?
আনোয়ারা নিরুত্তর। বৃদ্ধা আবার কহিলেন, “আচ্ছা তোর বাপ ত’ ঐ বিবাহ দেওয়াই ঠিক করিয়াছে। এখন তুই কি করিবি?”
আনোয়ারার কন্ঠনালী শুষ্ক হইয়া আসিতেছে, সে অনেক কষ্টে ঢোক গিলিয়া মৃদুস্বরে কহিল,” তুমি বাধা দিবে না?”
বৃদ্ধা। তোর বাপ ত, আমার কথা শুনে না। বাদশার মা যা বলে তাই সে করে।
আনোয়ারা কহিল, “আর একজন ঠেকাইবে।“
বৃদ্ধা। কে সে?
আনোয়ারা। আমরা ওজু করিয়া এক্ষণে যার নাম করিলাম।
দাদি-নাতনী এশার নামাজ পড়িয়া শয়ন করিয়াছিলেন। পুণ্যশীলা বৃদ্ধা আনোয়ারাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “আনার, আজ তোর কথায় আমার দেল ঠাণ্ডা হইল। যার নাম করিয়াছিস্ বলিলি, তাঁর প্রতি চিরদিন যেন তোর এইরূপ ভক্তি থাকে; সময়ে অসময়ে সকল অবস্থায় তিনিই তোকে রক্ষা করিবেন; তিনিই তোর সহায় হইবেন, তিনিই তোর মনোবাসনা পূর্ণ করিবেন।
এইরূপ বলিয়া বৃদ্ধা পুনরায় প্রকাশে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, ডাক্তার সাহেবের সহিত তোর বিবাহের প্রস্তাব করিলে কেমন হয়?”
আনোয়ারা ইহাতেও কোন উত্তর করিল না, কিন্তু ডাক্তার সাহেবের নামে তাহার ঘন ঘন শ্বাস পড়িতে লাগিল। আরাধ্য প্রিয়জন প্রতি অকৃত্রিম-প্রেম-প্রযুক্ত তাহার হৃদয়তন্ত্রী বাজিয়া উঠিল; কন্ঠনালী জড়ীভূত হইয়া আসিল; তাহার গোলাপ গণ্ডদ্বয়ে ও ইন্দ্রবর-নিন্দিত নয়নদ্বয় লজ্জার আভা প্রতিফলিত হইয়া অপূর্ব শোভা বিস্তার করিল। অস্পষ্ট দীপালোকে বৃদ্ধা নাতিনীর এই বিদ্যালাবণ্যময়ী মূর্তি স্পষ্টরূপে দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু তাহার সঘন নিশ্বাস ত্যাগে ও জড়সড় ভাবে বুঝিতে পারিলেন, ডাক্তার সাহেবের নামে মেয়ের হৃদয়ের অন্তস্থল আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছে। তাই তিনি পরিহাস করিয়া কহিলেন, “কি লো, ডাক্তার সাহেবের নাম শুনিয়াই যে দশা ধরিল। কথা বলিস্ না কেন?”
আনোয়ারা জড়িতকণ্ঠে কহিল, “কি বলিব?”
বৃদ্ধা। ডাক্তারের সহিত বিবাহ দিলে তুই সুখী হইবি?
আনোয়ারা বাহিরের দিকে চাহিয়া কহিল, “দাদিমা, দেখ, জানালার পাশে কি সুন্দর চাঁদের আলো আসিয়াছে।” ঐ সময় সওয়ালের চাঁদের কিরণে রাত্রি দিনের মত দেখাইতেছিল। প্রবীণা বৃদ্ধা পৌত্রীর চতুরতা বুঝিয়া কহিলেন, “আ-লো! চাঁদের আলো যদি ডাক্তার হইত, তাহা হইলে বুঝি হাত ধরিয়া ঘরে তুলিতি।” আনোয়ারা মৃদুহাস্যে বৃদ্ধার গা টিপিয়া দিল। এইরূপ রসালাপ-প্রসঙ্গে বৃদ্ধা তন্দ্রাভিভূতা হইয়া পড়িলেন। আনোয়ারাও নিদ্রিত হইল।
বৃদ্ধা, নুরল এসলামকে উপযুক্ত পাত্রজ্ঞানে এবং নাতিনী তাঁহার প্রতি অনুরক্ত হইয়াছে বুঝিয়া ভাবিলেন, ‘এইরূপ অবস্থায় পাত্র বিবাহ স্বীকার করিলে, এই বিবাহে নাতিনী আমার চিরসুখী হইতে পারিবে!’ এ নিমিত্ত তিনি এই বিবাহ সংঘটনমানসে অতঃপর বিধিমত চেষ্টায় উদ্যোগী হইলেন।