চতুর্থ পরিচ্ছেদ
মধুপুর প্রাচীন গ্রাম। বাঁশ, আম, তেঁতুল, গাব, বট, দেবদারু প্রভৃতি সমুচ্চ বৃক্ষরাজিতে পূর্ণ। গ্রামখানি নিম্ন সমতল। আষাঢ়ে পানি আসে—আশ্বিনে শুকায়। গ্রামের চতুষ্পার্শ্বস্থ ক্ষেত্রে প্রচুর পাট জন্মে। গ্রামের অধিবাসী সকলেই মুসলমান। মধুপুর হইতে তিন গ্রাম উত্তরে জামতাড়া; এ-গ্রামের অধিবাসী বার আনা হিন্দু। বেলতা গ্রাম মধুপুর হইতে ১ মাইল পূর্বে একটি অনতি প্রশস্ত স্রোতস্বিনীর তীরে অবস্থিত। এই গ্রামের ৩/৪ টি ভদ্রবংশীয় উচ্চশিক্ষিত মুসলমান গভর্নমেন্টের চাকুরি করেন। বেলগাঁও প্রসিদ্ধ বন্দর; মধুপুর হইতে ৩ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্রোতস্বতী নদীর পশ্চিম তটে অবস্থিত। পাট ও অন্যান্য বাণিজ্য দ্রব্যের জন্য বিখ্যাত। বড় বড় ২/৩ টি জুট কোম্পানি এখানে ব্যবসায়ের অনুরোধে বড় বড় গুদাম কলকারখানা স্থাপন করিয়াছে।
পূর্বকথিত খোরশেদ আলী ভূঞা সাহেব মধুপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও প্রধান ব্যক্তি। পৈত্রিক অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল, ভূ-সম্পত্তিও মন্দ ছিল না, এখনও মধ্যবিত্ত অবস্থা। দেড়শত বিঘা জমি, সাতখানা হাল, নয়জন চাকর, এক পাল গরু। কেবল পাট বিক্রয় করিয়া বৎসরে ৭/৮ শত টাকা পান। বাড়ির ঘর করগেটেড টিনের। ভূঞা সাহেবের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। বর্ণ গৌর, আকৃতি দোহারা, মুখের চেহারা নিতান্ত মন্দ নয়। কৃপণ স্বভাব ও অর্থগৃন্ধু। পিতা-মাতার প্রথম ও আদরের ছেলে ছিলেন বলিয়া অর্ধ শিক্ষিত। তাঁহার বর্তমান অবস্থায় তিনি সন্তুষ্ট নহেন, আর্থিক উন্নতি বিধানে সর্বদা চিন্তিত ও চেষ্টান্বিত। ভূঞা সাহেব নিজ গ্রাম হইতে ৭ ক্রোশ দূরে রসুলপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বংশে বিবাহ করেন। বহু পুণ্যফলে তিনি ফাতেমা জোহরার ন্যায় ধৈর্য্যশীলা রূপবতী পত্নী লাভ করেন! ইঁহার গর্ভে ভূঞা সাহেবের দুইটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। পুত্রদ্বয় অকালে কাল-কবলে পতিত হয়; কন্যা জীবিত আছে। কন্যার ১২ বৎসর বয়সের সময় তাহার মাতা পরলোকগমন করেন; কিন্তু ভূঞা সাহেবের ধর্মশীলা বুদ্ধিমতি জননী এই ১২ বৎসরের কন্যাকে যেভাবে গড়িয়া রাখিয়া গিয়াছেন সচরাচর সেরূপ দেখা যায় না।
কথিত আছে জাফর বিশ্বাস ডাকাতের সর্দার ছিল। শেষ জীবনে পুলিশের চেষ্টায় ধরা পড়িয়া কঠিন পরিশ্রমের সহিত ৮ বৎসরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় এবং সেইখানেই তাহার মৃত্যু ঘটে। তাহার স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা জীবিত থাকে। পুত্রের নাম আজিমুল্লা। সুখের বিষয় যে, পিতার শোচনীয় পরিণাম চিন্তা করিয়া অনেকাংশে সে আত্মসংযমপূর্বক সংসার করিতেছে। কন্যার নাম গোলাপজান। গোলাপজান ভুবনমোহিনী সুন্দরী; ছোটলোকের ঘরে ঈদৃশী সুন্দরী মেয়ের জন্মলাভ খুব কম দেখা যায়।
জামতাড়া হইতে ৫ মাইল পূর্বে বসন্তবিশুষ্ক বর্ষ প্লাবিত একটি নদীর পশ্চিম তটে আদমদীঘি গ্রামে কাসেম শেখের পুত্র মেহের আলীর সহিত ১০/১১ বৎসর বয়সের সময় এহেন রূপসী গোলাপজানের বিবাহ হয়। কিন্তু জানি না কেন বিবাহের পর হইতে সে স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করিয়া পলাইতে আরম্ভ করে। তাহার শ্বশুর ও স্বামী এজন্য তাহাকে বিধিমত শাসনাদি করিতে থাকে, কিন্তু কিছুতেই তাহার পলায়ন-অভ্যাস দূর হয় না। একবার শ্রাবণের নিশিতে ভরা নদী সাঁতরাইয়া সে বাপের বাড়ি পলাইয়া আসে। সকলে মেয়ের সাহস দেখিয়া অবাক! মেহের আলী অনন্যোপায়ে তালাক দিল। গোলাপজান প্রসিদ্ধ সুন্দরী; সুতরাং এদ্দতকাল অতীতের পূর্বেই নিজ গ্রামের নবীবক্সের সহিত তাহার বিবাহের বন্দোবস্ত হইল। নির্দিষ্ট দিনের শেষে নবীবক্স গোলাপজানের পাণিগ্রহণ করিল। নবীবক্সের সাংসারিক অবস্থা ভাল ছিল। আজিমুল্লা ও তাহার মায়ের শাসনে গোলাপজান এবার শ্বশুরালয় হইতে আর পলাইল না, কিন্তু এ সংসারে আসিয়া তাহার একটি গুণের বিকাশ পাইতে লাগিল।
নবীবক্স গোলাপজানের রূপের মোহে তাহাকে প্রাণাধিক ভালবাসিতে লাগিল। সংসারে বৃদ্ধা শাশুড়ী মাত্র বর্তমান, সুতরাং আদর-সোহাগে গোলাপজান সংসারে সর্বময় কর্ত্রী হইয়া উঠিল। সে এক্ষণে এক একটি করিয়া গোপনে গোপনে নবীবক্সের শ্রমার্জিত ঘটী-বাটী কাপড়-চোপড় ধান চা’ল তেল-তামাক পর্যন্ত অনেক দ্রব্যই ভ্রাতা আজিমুল্লার বাটীতে প্রেরণ করিতে লাগিল। আজিমুল্লা তাহাতে আন্তরিক খুশি ছিল। কিছুদিন পর গোলাপজান এক পুত্র-সন্তান প্রসব করিল। প্রিয়তমা প্রেয়সীর গর্ভে পুত্র-সন্তান লাভ করিয়া নবীব গোলাপজানকে মাথায় তুলিল, এবং বাছিয়া বাছিয়া পুত্রের নাম রাখিল—বাদশা। সুখে- সন্তোসে এইরূপে চারি-পাঁচ বৎসর কাটিল; কিন্তু দিন কাহারও একভাবে যায় না, নবীব কার্তিক মাসের কলেরায় হঠাৎ প্রাণত্যাগ করিল। তিন দিন পর তাহার বৃদ্ধা মাতাও পুত্রের পথানুসরণ করিল। গোলাপজান এখন সংসারে একাকিনী। শিশু পুত্র লইয়া কেমন করিয়া সংসারে থাকিবে? সুতরাং ভ্রাতা আজিমউল্লা তাহাকে নিজ বাড়িতে লইয়া গেল এবং দুই এক করিয়া নবীবক্সের স্থাবরাস্থাবর সম্পত্তি নিজ সম্পত্তির সহিত মিশাইয়া নিজ গৃহস্থালী বড় করিয়া তুলিল। শিশু বাদশা মাতৃসহ মাতুলালয়ে মহাদরে প্রতিপালিত হইতে লাগিল।
এদিকে আনোয়ারার বার বৎসর বয়সের সময় তাহার মাতা পরলোকগমন করেন। খোরশেদ আলী ভূঞা সাহেব বিপত্নীক হইয়া দারান্তর গ্রহণের অভিলাষী হন। জামতাড়া গ্রামের আজিমুল্লা সম্প্রতি অবস্থাপন্ন লোক। গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় লেখাপড়া শিখিয়া কিছু শিক্ষিতও হইয়াছিল। অবস্থা ভাল হইলে এবং তৎসঙ্গে কিছু শিক্ষা-দীক্ষা পাইলে নানা দিক দিয়া লোকের খেয়াল উচ্চ হয়। আজিমুল্লা নিচ বংশের সন্তান হইলেও কৌলিক মর্যাদা লাভের আশা এক্ষণে তাহার হৃদয়ে বলবতী হইয়াছে। সে ভূঞা সাহেবকে বিপত্নীক দেখিয়া, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তাহার সহিত বিধবা ভগ্নী গোলাপজানের পুনরায় বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব করিল। ভূঞা সাহেব ডাকের সুন্দরী গোলাপজানকে পূর্বেই দেখিয়াছিলেন। এক্ষণে সাধা বিবাহের প্রস্তাবে উল্লসিত হইলেন; কিন্তু কুলের দোহাই দিয়া কহিলেন, “নজরানা না পাইয়া কি করিয়া কার্য হয়? আজিমুল্লা তিনশত টাকা সেলামী দিতে স্বীকার করিল।
এই বিবাহে ভূঞা সাহেবের মাতা ‘নাম যাইবে, জাতি যাইবে, কুলে কলঙ্ক রটিবে’ বলিয়া অনেক আপত্তি করিয়াছিলেন। ভূঞা সাহেব গোলাপজানের রূপের মোহে মাতার কথায় কর্ণপাত করিলেন না। গ্রামের পাঁচজনকে দিয়া মাতাকে বুঝাইলেন, অবশেষে বিবাহ হইয়া গেল। নির্দিষ্ট দিনে প্রাণাধিক পুত্র বাদশাকে সঙ্গে করিয়া গোলাপজান তৃতীয় স্বামী ভূঞা সাহেবের ভবনে পদার্পণ করিল। বাদশা এখানে আসিয়া রামনগর মাইনর স্কুলে পড়িতে লাগিল। বাদশাকে বাদশাজাদার মতই সুন্দর দেখাইত! ভূঞা সাহেব আনন্দে তাহার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিতে লাগিলেন।
গোলাপজানের রূপে কি যেন এক মাদকতাশক্তি ছিল। ভূঞা সাহেব কিছুদিন মধ্যেই সেই রূপে কায়মনপ্রাণ উৎসর্গ করিলেন। আনোয়ারার মা বাঁচিয়া থাকিতে ভূঞা সাহেবের মা সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী ছিলেন। তাহার আদেশ উপদেশানুসারে আনোয়ারার মা সংসারের সমুদয় কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতেন; শাশুড়ীকে মায়ের অধিক ভক্তি করিতেন; উপযুক্ত সময়ে তাঁহার স্নানাহারের তত্ত্ব লইতেন। আনোয়ারা তখন হামিদাদিগের আঙ্গিনায় তাহার সহিত বালিকা-স্কুলে পড়িত। ৪টি চাকরাণী বাহিরের কাজ-কর্ম নিরুত্তরে সম্পন্ন করিত। স্বামী-সোহাগ-গর্বিনী গোলাপজান অল্প দিনেই এ বন্দোবস্ত উল্টাইয়া নিজ হস্তে সংসারের ভার লইল। এরূপ করিবার তাহার দুইটি প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল; প্রথম উদ্দেশ্য সংসারের ভার নিজ হাতে থাকিল ইচ্ছামত জিনিসপত্র মা-ভাইয়ের বাড়ি পাঠান যাইবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য আরও মারাত্মক!
বিধবা হইবার পর ভ্রাতার বাড়ি অবস্থানকালে গোলাপজান যখন সীমন্তিনীসোহাগ তৈলে সুগন্ধীকৃত তাহার দীর্ঘ কেশপাশ বিচিত্ররূপে খোঁপা বাঁধিয়া কুন্দদন্ত মঞ্জন রচিত করিয়া আয়ত আঁখি শোভিত করিয়া প্রতিবাসিগণের বাটীতে ভ্রমণে বহির্গত হইত তখন অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা তাহার ভুবন-ভুলান রূপ দেখিয়া অনিমেষ-লোচনে তাকাইয়া থাকিত। কোন কোন মুখরা সরলা মুখ ফুটিয়া বলিত—”বাদশার মায়ের যেমন রূপ এমন আর কোথাও দেখি না।” বাদশার মা তখন মনে করিত তার মত সুন্দরী আর বুঝি নাই। কিন্তু যখন সে তৃতীয় স্বামী ভূঞা সাহেবের বাটীতে পদার্পণ করিয়া বার বৎসরের মেয়ে আনোয়ারাকে দর্শন করিল তখন তাহার রূপের গর্ব একেবারে চূর্ণ হইয়া গেল। বাস্তবিক বালারুণ-রাগরঞ্জিত বিকাশোন্মুখ পদ্মিনীর সহিত যেমন কীটগর্ভ শ্লথদল-দলিত জবার তুলনা সম্ভবে না, সেইরূপ সৌন্দর্য-প্রতিমা সরলা বালা আনোয়ারার সহিত যৌবনোত্তীর্ণা বিকৃতসুন্দরী গোলাপজানের উপমাই হয় না। কিন্তু না হইলেও গোলাপজান নিজ রূপের সহিত সতীন-কন্যার রূপের তুলনা করিয়া হিংসায় জ্বলিয়া উঠিল। স্বামী সোহাগে সে এক্ষণে গৃহের কর্ত্রী; সুতরাং সে নানা প্রকারে তাহার এই বিজাতীয় বিদ্বেষবিষে আনোয়ারাকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিল।
সে প্রথমে আনোয়ারার পড়াশুনা বন্ধ করিয়া দিল এবং নানা ছলনায় অশ্রাব্য অকথ্য কটুক্তির সহিত তাহাকে দাসীগণের কার্যে সহায়তা করিতে বাধ্য করিল। বালিকা ভয়ে ভয়ে বিমাতার আদেশ পালনে প্রবৃত্ত হইল, ইহাতে তাহার নিয়মিত রূপে স্কুলে পড়া আর চলিল না। আনোয়ারার দাদীমা বিদূষী রমণী ছিলেন। নাতিনীর পড়া বন্ধ হওয়ায় তিনি যারপরনাই দুঃখিত হইলেন। পরন্তু তিনি মেয়েকে দাসীর কার্যে প্রবৃত্ত দেখিয়া আর সহ্য করিতে পারিলেন না।
একদিন তিনি গোলাপজানকে কহিলেন, “ বৌ, তুমি সংসারের কর্ত্রী হইয়াছ, তাহাতে আমি খুশি হইয়াছি; কিন্তু তোমার একি ব্যবহার? মেয়ে আজন্ম নিজ হাতে যাহা কখনও করে নাই, আমরা দাসীর দ্বারা যে সকল কাজ করাইয়া থাকি তুমি কোন্ আক্কেলে সেই সব কাজ আমার সোহাগের নাতনী দ্বারা করাইতেছ! তোমার জুলুমে নাতনীর আমার পড়াশুনা বন্ধ হইয়াছে। যাহা হউক ইহার পর তুমি আমার নাতনীকে যে-সে সাংসারিক কাজে কখনও ফরমাইশ করিতে পারিবে না। আমি কাল হইতে তাহাকে পড়িতে পাঠাইব।” বৃদ্ধার কথায় গোলাপজানের হৃদয়ে হিংসানল অনিবার্য বেগে জ্বলিয়া উঠিল; সে বাড়িময় তোলপাড় করিয়া উচ্চকন্ঠে নানাবিধ অকথ্য বাক্যে পঞ্চমুখে দাদী-নাতনী উভয়কে দগ্ধ করিতে লাগিল।
সেই রাত্রিতে আহারান্তে ভূঞা সাহেব তাঁহার দক্ষিণদ্বারী শয়ন-গৃহে খাটে বসিয়া পৈত্রিক রৌপ্য-ফরসীতে চিন্তিতমনে তামাক সেবন করিতে করিতে স্ত্রীকে কহিলেন, “দেখ, আজ সকালে তুমি যে কেলেঙ্কারী করিয়াছ, তাহাতে আমার কোন স্থানে মুখ দেখাইবার উপায় নাই।” গোলাপজান শুনিবামাত্র ক্রোধ কটাক্ষে গ্রীবা উন্নত করিয়া কহিল, “কি করিয়াছি?” ভূঞা সাহেব যতটুকু বিরক্ত হইয়া কথাটি পাড়িয়াছিলেন, গোলাপজানের ক্রোধ- কটাক্ষ দর্শনে ততটুকু থামিয়া গেলেন। এটকু সুর নরম করিয়া কহিলেন, “মা ও মেয়েকে বাপান্ত করিয়া গালা-গালি করিয়াছ কেন?” গোলাপজান গর্বভরে নিঃসঙ্কোচে কহিল, “বেশ করিয়াছি, আরও করিব।” ভূঞা সাহেব দুঃখিত স্বরে কহিলেন, “কথা বলিলেই তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠ, তোমাকে আর কি বলিব?”
গো-জান। সাধে কি জ্বলিয়া উঠিতে হয়!
ভূ-সা। মা ও মেয়ে তোমার কি অনিষ্ট করিয়াছিল?
গো-জান। না, তাহারা আর অন্যায় করিবে কি? তাহারা পীর-মোরশেদের মত শুইয়া- বসিয়া খাইলে কোন দোষ নাই? আর আমি রাত-দিন আগুনের তাতে চুলার গোড়ে বসিয়া বাঁদী-দাসীর মত খাটুনী খাটিয়া তাহাদিগকে দু’একটা কাজের কথা বলিলেই যত দোষ।
ভূ-সা। কাজের কথা ছোট গলায় আদরের সহিত বলিলে দোষ হয় না। কিন্তু বাজারে- স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় পাড়া মাথায় করিয়া অকথ্য-বাক্যে গালাগালি করিলে জাত-মান থাকে না। আমাদের ঘরে বৌ-ঝি অমন করিয়া গলাবাজী ও ইতরামী করিলে সমাজের নিকট আমাদের মুখ দেখান ভার হয়।
গো-জান (ক্রোধ-কম্পিত আননে)। হ্যাঁ, আমি বাজারে স্ত্রীলোক—আমি ইতর। এই বলিয়া অতি রোষে ঝট্কা দিয়া খাট হইতে নামিয়া পড়িয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। ভূঞা সাহেব ভাবিলেন, যদি এ সময় ঘর হইতে চলিয়া যায় তবে মহাবিভ্রাট ঘটাইবে। হয় রাতারাতি জামতাড়া চলিয়া যাইবে, না হয় কুস্থানে রাত কাটাইয়া আমার মুখে চুন-কালি দিবে। এ নিমিত্ত তিনি হুকার নল ফেলিয়া থাবা দিয়া তাহার বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া ফেলিলেন। কিন্তু গোলাপজানের সক্রোধ বল প্রকাশে তাহার অবগুন্ঠন খুলিয়া গেল। ভূঞা সাহেব দেখিলেন, গোলাপজানের দুধে-আলতা-মাখান দেহলাবণ্য ভিত্তিগাত্র সংলগ্ন সুশুভ্র কাচ কাঞ্চনরশ্মি-প্রভায় জুলেখার সৌন্দর্যকে পরাভূত করিয়াছে। এই অপরূপ সৌন্দর্যসন্দর্শনে ভূঞা সাহেবের মস্তিষ্ক ঘুরিয়া গেল; তিনি গোলাপজানের হাত ধরিয়া বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, “প্রিয়ে! আমাকে ত্যাগ করিয়া কোথায় যাইতেছ? তোমার অভাবে যে আমি দশ দিক অন্ধকার দেখি। রাগের মাথায় দু’কথা বলিয়াছি বলিয়াই কি ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতে হয়? এঘর-সংসার, গরু-বাছুর, চাকর-চাকরাণী সবই যে তোমার, সকলকেই যে তোমার হুকুম মত চলিতেই হইবে।” স্বামী এই সামান্য ঘটনায় অমন ভাবে অপরাধ স্বীকার করিলে, অতি দুর্জন স্ত্রীলোকের মনও অনেকটা কোমল হইয়া আসে। গোলাপজানের মনও নরম হইল, সে ক্রন্দনের স্বরে বলিল, “আমি কি তোমার গৃহস্থালীর লোকসান দেখিতে পারি? তোমারই সংসারের আয়-উন্নতির নিমিত্ত শরীর মাটি করিতেছি। আর তোমার কলাগাছের মত মেয়ে কেবল ফুলের সাজি হইয়া শুইয়া বসিয়া কাল কাটাইবে তাহাকে তোমারই সংসারের কাজে এক-আধটুকু ফরমাইস করিলে তোমার মা মুখে যা আসে তাই বলিয়া আমাকে গালিগালাজ করে, পারে ত’ ধরিয়া মারে। এমনভাবে আমি আর তোমার সংসার করিতে চাই না। তুমি আমাকে আমার ভাইয়ের বাড়িতে পাঠাইয়া দাও, সুন্দরী বিবি আনিয়া সংসার কর।” ভূঞা সাহেব দেখিলেন, তাঁহার প্রেয়সীর নয়নযুগল অশ্রুপ্লাবিত হইয়াছে; মনও খুব কোমল হইয়া আসিয়াছে। তখন তিনি প্রিয়তমার হস্ত ত্যাগ করিয়া তাহার স্খলিত অঞ্চলযোগে গলিত-নয়নবারি মুছাইয়া দিয়া কহিলেন, “প্রাণাধিকে! আর রাগ করিও না। তোমার ইচ্ছামত সংসার চালাও, আমি আর কিছুই বলিব না।” এই বলিয়া তিনি আদর পূর্বক তাহাকে খাটে তুলিলেন। সে রাত্রির পালা এইরূপেই শেষ হইল।
ভূঞা সাহেব গোলাপজানকে বিবাহ করিয়া শেষ জীবনে এইরূপ অভিনয় আরও অনেকবার দেখাইয়াছেন এবং ‘দেহ পদপল্লবমুদারম্’ বলিয়া পটক্ষেপ করিয়াছেন।
এস্থলে আমি মধুপুরের আর একটি ভদ্র পরিবারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধৈর্যশীল প্রিয় পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দিয়া আবদ্ধ পরিচ্ছেদ শেষ করিব।
এই ভদ্র পরিবারের অভিভাবকের নাম—ফরহাদ হোসেন তালুকদার। ইনি আমাদের হামিদার পিতা ও বালিকা-বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভূঞা সাহেবের বাড়ির সহিত সংলগ্ন পশ্চিমাংশে ইহার বাটী। নিজ বাটীতেই বিদ্যলয়। বিদ্যালয়ে পর্দার সুন্দর বন্দোবস্ত। বিবাহিতা অবিবাহিতা অনেক মেয়ে এই স্কুলে অধ্যয়ন করে। মধুপুরে তালুকদার সাহেবেরা বনিয়াদী ঘর। কালচক্রে তালুকের অনেকাংশে পরহস্তগত হইয়াছে; অবশিষ্ট তালুকের বার্ষিক আয় তিনশত টাকা মাত্র। তালুকদার সাহেবের খামারে তিন খাদা জমি। জমি বর্গা বা আধি দিয়া যে শস্যাদি প্রাপ্ত হন, তদ্বারা তাঁহার সংসার-খরচ চলিয়া যায়। পরিবারের মধ্যে স্ত্রী, কন্যা, এক শিশুপুত্র, এক চাকরানী ও একটি রাখাল চাকর। তালুকদার সাহেবের স্ত্রী শিক্ষিতা; কন্যা হামিদাকে তাঁহারা নিজ হাতে শিক্ষা পূর্বোল্লিখিত বেতা গ্রামে একটি সম্ভ্রান্তবংশীয় যুবকের সহিত বিবাহ দিয়াছেন। হামিদার স্বামী বি. এ. পাস করিয়া এক্ষণে কলিকাতার ল-ক্লাশে পড়িতেছেন। ফরহাদ হোসেন তালুকদার সাহেবের ন্যায় আত্মপ্রসাদী সুখী লোক অতি বিরল। ভূঞা সাহেবের সহিত তালুকদার সাহেবের বংশগত কোন আত্মীয়তা নাই; কিন্তু বহুকাল একত্র একস্থানে বাস করিয়া উভয় পরিবারে আত্মীয়তা অপেক্ষাও অধিকতর ঘনিষ্টতা জন্মিয়া গিয়াছে। ভূঞা সাহেব অপেক্ষা তালুকদার সাহেব বয়সে বড়, জ্ঞানে প্রবীন, স্বভাবে শ্রেষ্ঠ ও ধর্মে উন্নত। ভূঞা সাহেব সংসারের গুরুতর বিষয় তালুকদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা না করিয়া সম্পন্ন করেন না।