সপ্তম পরিচ্ছেদ
পাঠক অবগত আছেন আনোয়ারার পীড়ার কথা প্রসঙ্গে বড়বাবু কহিলেন, “একবার দেখা আবশ্যক।” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “তবে মেহেরবাণী করিয়া বাড়ির ভিতরে চলুন।” তখন বড়বাবু ভূঞা সাহেব ও তালুকদার সাহেবের সহিত আনোয়ারার শয়নকক্ষে উপস্থিত হইলেন। বালিকার দাদিমা তৎপূর্বেই তাহাকে মশারি দ্বারা পরদায় আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। ঘরে যে লোকজন প্রবেশ করিয়াছে, বালিকা তাহা টের পায় নাই; সে দুর্বিষহ শিরঃপীড়ায় অস্থির হইয়া এই সময় মশারি উল্টাইয়া ফেলিয়া দিল। তাহার দাদিমা, “পোড়ামুখী সব ফেলিয়া দিল” বলিয়া পুনরায় তাহাকে পর্দাবৃত করিতে চেষ্টা করিলেন। বড়বাবু কহিলেন, “আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করুন, আমি শীঘ্রই পীড়ার অবস্থা বুঝিতে পারিব।” এই বলিয়া তিনি বালিকার মুখের দিকে তাকাইলেন। দৃষ্টিমাত্র বিস্ময়ে তাঁহার অন্তর আলোকিত হইয়া উঠিল; কিন্তু প্রচণ্ডবেগে ঘূণিত পৃথিবীর গতি যেমন অনুভব করা যায় না, সেইরূপ বাহিরের অবস্থায় বড়বাবুর ভাবান্তর অন্য কেহ টের পাইলেন না। তিনি বুঝিলেন, এই বালিকাই শেষে খিড়কীর দ্বার হইতে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। এই সময় বালিকা একবার চক্ষু উন্মীলন করিল। তাহার রক্তচক্ষু দেখিয়া বড়বাবু একান্ত বিমর্ষ হইলেন; এবং সত্বর মাথায় জলপট্টি দেওয়া আবশ্যক মনে করিয়া কাঁচি ও সূক্ষ্ম বস্ত্রখণ্ড চাহিলেন। ভূঞা সাহেব তাহা আনিবার জন্য কক্ষান্তরে গমন করিলেন। বড়বাবু থার্মোমিটার দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, জ্বর ১০৫ ডিগ্রী। তিনি ব্যাকুলভাবে হাত ধরিয়া নাড়ী দেখিলেন। দেখিয়া বুঝিলেন সান্নিপাতিক জ্বর, বড়বাবু হতাশচিত্তে পুনরায় বালিকার মুখের দিকে চাহিলেন এবং অস্ফুটস্বরে কহিলেন, “দয়াময়! তুমি ইহাকে রক্ষা কর।” এই সময় আনোয়ারা জ্ঞানশূন্যভাবে পুনরায় চক্ষু উন্মীলন করিয়া পার্শ্ব পরিবর্তন করিল এবং প্রলাপের বাক্যে কহিল, “ইনি কি তিনি?”
ভূঞা সাহেব কাঁচি ও বস্ত্রখণ্ড লইয়া পুনরায় তথায় আসিলেন। বড়বাবু তাঁহাকে কহিলেন, “আপনি রোগিনীর ঠিক মাথার মাঝখানের একগোছা চুল কাটিয়া দিন”। ভূঞা সাহেব কহিলেন, “আমার কাটা ঠিক হইবে না, আপনি কাটুন।” বড়বাবু তখন বালিকার মাথার একগোছা চুল কাটিয়া ফেলিলেন। কর্তিত কেশগুলি এত চিক্কণ ও দীর্ঘ যে, তিনি ঐরূপ কেশ আর কখনও দেখেন নাই। ইতস্তত করিয়া তিনি আর চুল কাটিলেন না। কর্তিত স্থানের আশে পাশের চুল সরাইয়া মাথায় জলপটী বসাইয়া দিলেন। এই প্রক্রিয়ায় বালিকার অসহ্য শিরঃপীড়া অল্প সময়ে অনেকটা উপশমিত হইল। ভূঞা সাহেব বড়বাবুকে বিজ্ঞ ডাক্তার বলিয়া জ্ঞান করিলেন। বড়বাবু সকলের অজ্ঞানে ক্ষিপ্রহস্তে কর্তিত কেশগুলি অঙ্গুলিতে জড়াইয়া নিজ পকেটস্থ করিলেন।
অতঃপর সকলে উঠিয়া বহির্বাটীতে আসিলেন। বড়বাবু নৌকা হইতে ঔষধের বাক্স আনাইয়া দুই প্রকার দুই শিশি ঔষধ দিলেন। ক্ষুধা পাইলে দুধ-বার্লি পথ্যের কথা বলিয়া দিলেন। পাটের দর-দস্তর করিতে আর কথা খরচ কোন পক্ষেই হইল না। ভূঞা সাহেব ১৩০ মণ ও তালুকদার সাহেব ২৭ মণ পাট ৫ টাকা দরে বিক্রয় করিলেন। পাটের মূল্য মিটাইয়া দিয়া নৌকায় উঠিবার সময় ভূঞা সাহেব পাঁচটি টাকা দর্শনী স্বরূপ বড়বাবুকে দিতে উদ্যত হইলেন। বড়বাবু কহিলেন, “আমি টাকা লইয়া চিকিৎসা করি না, যেভাবে যতটুকু পারা যায়, মানুষই মানুষের উপকার কেিবন, এই মনে করিয়া চিকিৎসা করিয়া থাকি।” এই বলিয়া তিনি টাকা গ্রহণ করিলেন না। যাইবার সময় আরও বলিয়া গেলেন, “আমি স্থানান্তরে পাট দেখিয়া অপরাহ্ণ ৩/৪ টার সময় পুনরায় আপনার কন্যাকে দেখিয়া যাইব। আপনারা সাবধানে পর্যায়ক্রমে ঔষধ সেবন করাইবেন।” বেলা তখন প্ৰায় ১২ টা।
তালুকদার সাহেব পাট বিক্রয় করিয়া নিজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলে হামিদার মা কহিলেন, “তুমি এতক্ষণে বাড়ির মধ্যে আসিলে? আমার যে উৎকণ্ঠায় প্রাণ বাহির হইবার মত হইয়াছে?”
তা-সা। কেন, কি হইয়াছে?
হা-মা। দামাদ মিঞা (জামাতা) কোথায়?
তা-সা। সে-কি! এমন সংবাদ তোমাকে কে দিল?
হা-মা। তবে কি মিথ্যা কথা? ভোলার মা শশব্যন্তে আসিয়া আমাকে বলিল, “দুলামিয়া ভূঞা সাহেবের বাড়িতে পাট কিনিতেছেন।” আমি ত শুনিয়া অবাক!
তালুকদার সাহেব হাসিতে লাগিলেন। এই সময় ভোলার মা তথায় আসিয়া তালুকদার সাহেবকে কিহল, “বাবজান, কৈ দুলামিঞাকে বাড়ির মধ্যে আনিলেন না?” তালুকদার সাহেব তখন উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন এবং পরিহাস করিয়া ভোলার মাকে কহিল, “দামাদ মিঞাকে তুমি ডাকিয়া না আনিলে, তিনি আসিবেন না বলিয়াছেন।” ভোলার মা কহিল, “তবে আমি যাই, তাঁহাকে আদর করিয়া লইয়া আসি।” এই বলিয়া বৃদ্ধা গমনোদ্যত হইল। রহস্য বুঝিয়া তখন হাসির চোটে তালুকদার সাহেবের পেটে ব্যথা ধরিল। হামিদার মা স্বামীর হাসির ভাবে বুঝিলেন, ভোলার মা অন্য লোককে দামাদ মিঞার মত মনে করিয়াছে। তাই তিনি মুচকি হাসিয়া ভোলার মাকে কহিলেন, “দূর হতভাগী, চোখের মাথা কি একেবারেই খাইয়া বসিয়াছ?” ভোলার মার তখন কতকটা জ্ঞান হইল। সে কহিল, “তবে কি বুবুজানও খাইয়া বসিয়াছেন?” ভোলার মা হামিদাকে বুবুজান বলিয়া থাকে।
হামি-মা। ওমা! সে কি কথা? তাই বুঝি মেয়ে আমার ভাত-পানি ছাড়িয়া বসিয়াছে?
হা-পি। সে দেখিল কিরূপে?
ভো-মা। বুবুজানই ত’ তার সইদিগের আঙ্গিনা হইতে দেখিয়া আসিয়া পহেলা আমাকে বলিয়াছেন।
তালুকদার সাহেব ঘটনার রহস্য আদ্যন্ত বুঝিয়া হাসিতে হাসিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। হামিদা কক্ষান্তরে থাকিয়া সরমে মরমে মরিয়া যাইতে লাগিল।
অতঃপর, হামিদার পিতা স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “ঘটনা যেরূপ দাঁড়াইয়াছে তাহাতে সকলেরই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। আমি এ বয়সে এমন এক চেহারার দুইজন লোক কোথাও কখন দেখি নাই। যিনি পাট কিনিতে আসিয়াছেন, তাঁহার সহিত দামাদ মিঞাকে বদল করা চলে। অন্যের কথা দূরে থাকুক, দামাদ মিঞা বলিয়া প্রথমে আমারই ভ্রম হইয়াছিল।” পিতার মুখে প্রকৃত অবস্থা শুনিয়া হামিদা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। বলা বাহুল্য, আমাদের প্রাতঃকালে দৃষ্ট নৌকাস্থ যুবক, হামিদার ভ্রম-কল্পিত স্বামী, ভোলার মা’র দুলামিঞা, যাচনদারের বড়বাবু, আনোয়ারার চিকিৎসক ও আমাদের পূর্ববর্ণিত নুরল এসলাম একই ব্যক্তি। অতঃপর আমরা ইহাকে নাম ধরিয়া ডাকিব।
নুরল এসলাম অপরাহ্ চারটায় ফিরিয়া আসিয়া ভূঞা সাহেবের সহিত তাঁহার রোগীণীকে পুনরায় দেখিলেন। জ্বর কমিয়া ১০২ ডিগ্রীতে নামিয়াছে, চক্ষের লালিমা অনেকটা কমিয়াছে। তিনি ঔষধ বদলাইয়া দিয়া সে রাত্রি ভূঞা সাহেবের বাড়ির ঘাটেই নৌকা বাঁধিয়া অবস্থান করিলেন। মঙ্গলমত রাত্রি প্রভাত হইলে পুনরায় তিনি রোগীণীকে দেখিতে বাড়ির মধ্যে গেলেন। দেখিলেন, স্ফুটনোন্মুখ গোলাপ-কলিকা যেমন মধ্যাহ্নিক রবিকরতাপে বিবর্ণ ও কুঞ্চিত হইয়া যায়, নিদারুণ জ্বরোত্তাপে বালিকা সেইরূপ মলিন ও কৃশ হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু সুখের বিষয় তাহার জ্বর ও চক্ষুর রক্তাভ ভাব ছুটিয়া গিয়াছে। নুরল এসলাম বহির্বাটিতে আসিয়া রোগীণীর জ্বর-প্রতিষেধক বলকারক ঔষধ পথ্যের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন এবং কহিলেন, “আমি পাটের অবস্থা দেখিতে কিছুদিন এ অঞ্চলে আছি, ২/৩ দিন পরে আবার আসিয়া ঔষধ বদলাইয়া দিয়া যাইব।” ভূঞা সাহেব নুরল এসলামের ব্যবহারে ও মহত্বে একান্ত মুগ্ধ হইলেন।