হেমচন্দ্র ত উপবনগৃহে সংস্থাপিত হইলেন। আর মৃণালিনী? নির্বাসিতা, পরপীড়িতা, সহায়হীনা মৃণালিনী কোথায়?

সান্ধ্য গগনে রক্তিম মেঘমালা কাঞ্চনবর্ণ ত্যাগ করিয়া ক্রমে ক্রমে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিল। রজনীদত্ত তিমিরাবরণে গঙ্গার বিশাল হৃদয় অস্পষ্টীকৃত হইল। সভামণ্ডলে পরিচারকহস্তজ্বালিত দীপমালার ন্যায়, অথবা প্রভাতে উদ্যানকুসুমসমূহের ন্যায়, আকাশে নক্ষত্রগণ ফুটিতে লাগিল। প্রায়ান্ধাকার নদীহৃদয়ে নৈশ সমীরণ কিঞ্চিৎ খরতরবেগে বহিতে লাগিল। তাহাতে রমণীহৃদয়ে নায়কসংস্পর্শজনিত প্রকম্পের ন্যায়, নদীবক্ষে তরঙ্গ উত্থিত হইতে লাগিল। কূলে তরঙ্গাভিঘাতজনিত ফেনপুঞ্জে শ্বেতপুষ্পমালা গ্রথিত হইতে লাগিল। বহু লোকের কোলাহলের ন্যায় বীচিরব উত্থিত হইল। নাবিকেরা নৌকাসকল তীরলগ্ন করিয়া রাত্রির জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করিতে লাগিল। তন্মধ্যে একখানি ছোট ডিঙ্গি অন্য নৌকা হইতে পৃথক এক খালের মুখে লাগিল। নাবিকেরা আহারাদির ব্যবস্থা করিতে লাগিল।

ক্ষুদ্র তরণীতে দুইটিমাত্র আরোহী। দুইটিই স্ত্রীলোক। পাঠককে বলিতে হইবে না, ইহারা মৃণালিনী আর গিরিজায়া।

গিরিজায়া মৃণালিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “আজিকার দিন কাটিল।”

মৃণালিনী কোন উত্তর করিল না।

গিরিজায়া পুনরপি কহিল, “কালিকার দিনও কাটিবে-পরদিনও কাটিবে-কেন কাটিবে না?”

মৃণালিনী তথাপি কোন উত্তর করিলেন না; কেবলমাত্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণি! এ কি এ? দিবানিশি চিন্তা করিয়া কি হইবে? যদি আমাদিগের নদীয়া আসা কাজ ভাল না হইয়া থাকে, চল, এখনও ফিরিয়া যাই।”

মৃণালিনী এবার উত্তর করিলেন। বলিলেন, “কোথায় যাইবে?”

গি। চল, হৃষীকেশের বাড়ী যাই।

মৃ। বরং এই গঙ্গাজলে ডুবিয়া মরিব।

গি। চল, তবে মথুরায় যাই।

মৃ। আমি ত বলিয়াছি, তথায় আমার স্থান নাই। কুলটার ন্যায় রাত্রিকালে যে বাপের ঘর ছাড়িয়া আসিয়াছি, কি বলিয়া সে বাপের ঘরে আর মুখ দেখাইব?

গি। কিন্তু তুমি ত আপন ইচ্ছায় আইস নাই, মন্দ ভাবিয়াও আইস নাই। যাইতে ক্ষতি কি?

মৃ। সে কথা কে বিশ্বাস করিবে? যে বাপের ঘরে আদরের প্রতিমা ছিলাম, সে বাপের ঘরে ঘৃণিত হইয়াই বা কি প্রকারে থাকিব?

গিরিজায়া অন্ধকারে দেখিতে পাইল না যে, মৃণালিনীর চক্ষু হইতে বারিবিন্দুর পর বারিবিন্দু পড়িতে লাগিল। গিরিজায়া কহিল, “তবে কোথায় যাইবে?”

মৃ। যেখানে যাইতেছি।

গি। সে ত সুখের যাত্রা। তবে অন্যমন কেন? যাহাকে দেখিতে ভালবাসি, তাহাকে দেখিতে যাইতেছি, ইহার অপেক্ষা সুখ আর কি আছে?

মৃ। নদীয়ায় আমার সহিত হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না।

গি। কেন? তিনি কি সেখানে নাই?

মৃ। সেইখানেই আছেন। কিন্তু তুমি ত জান যে, আমার সহিত এক বৎসর অসাক্ষাৎ তাঁহার ব্রত। আমি কি সে ব্রত ভঙ্গ করাইব?

গিরিজায়া নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী আবার কহিলেন, “আর কি বলিয়াই বা তাঁহার নিকট দাঁড়াইব। আমি কি বলিব যে, হৃষীকেশের উপর রাগ করিয়া আসিয়াছি, না, বলিব যে, হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছে?”

গিরিজায়া ক্ষণেক নীবর থাকিয়া কহিল, “তবে কি নদীয়ায় তোমার সঙ্গে হেমচন্দ্রের সাক্ষাৎ হইবে না?”

মৃ। না।

গি। তবে যাইতেছ কেন?

মৃ। তিনি আমাকে দেখিতে পাইবেন না। কিন্তু আমি তাঁহাকে দেখিব। তাঁহাকে দেখিতেই যাইতেছি।

গিরিজায়ার মুখে হাসি ধরিল না। বলিল, “তবে আমি গীত গাই,

চরণতলে দিনু হে শ্যাম পরাণ রতন।
দিব না তোমারে নাথ মিছার যৌবন।।
এ রতন সমতুল, ইহা তুমি দিবে মূল,
দিবানিশি মোরে নাথ দিবে দরশন।।

ঠাকুরাণি, তুমি তাঁহাকে দেখিয়া ত জীবধারণ করিবে। আমি তোমার দাসী হইয়াছি, আমার ত তাহাতে পেট ভরিবে না, আমি কি খেয়ে বাঁচিব?”

মৃ। আমি দুই একটি শিল্পকর্ম জানি। মালা গাঁথিতে জানি, চিত্র করিতে জানি, কাপড়ের ফুল তুলিতে জানি। তুমি বাজারে আমার শিল্পকর্ম বিক্রয় করিয়া দিবে।

গিরি। আর আমি ঘরে ঘরে গীত গায়িব। “মৃণাল অধমে” গাইব কি?

মৃণালিনী অর্ধহাস্য, অর্ধ সকোপ দৃষ্টিতে গিরিজায়ার প্রতি কটাক্ষ করিলেন।

গিরিজায়া কহিল, “অমন করিয়া চাহিলে আমি গীত গায়িব।” এই বলিয়া গায়িল,

“সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।
কে আছে কাণ্ডারী হেন কে যাইবে সঙ্গে।।”

মৃণালিনী কহিল, “যদি এত ভয়, তবে একা এলে কেন?”

গিরিজায়া কহিল, “আগে কি জানি।” বলিয়া গায়িতে লাগিল,

“ভাস্‌ল তরী সকাল বেলা, ভাবিলাম এ জলখেলা,
মধুর বহিবে বায়ু ভেসে যাব রঙ্গে।
এখন – গগনে গরজে ঘন, বহে খর সমীরণ,
কূল ত্যজি এলাম কেন, মরিতে আতঙ্গে।।”

মৃণালিনী কহিল, “কূলে ফিরিয়া যাও না কেন?”

গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,

“মনে করি কূলে ফিরি, বাহি তরী ধীরি ধীরি
কূলেতে কণ্টক-তরু বেষ্টিত ভুজঙ্গে।”

মৃণালিনী কহিলেন, “তবে ডুবিয়া মর না কেন?”

গিরিজায়া কহিল, “মরি তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু” বলিয়া আবার গায়িল,

“যাহারে কাণ্ডারী করি, সাজাইয়া দিনু তরী,
সে কভু না দিল পদ তরণীর অঙ্গে।।”

মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, এ কোন অপ্রেমিকের গান।”

গি। কেন?

মৃ। আমি হইলে তরী ডুবাই।

গি। সাধ করিয়া?

মৃ। সাধ করিয়া।

গি। তবে তুমি জলের ভিতর রত্ন দেখিয়াছ।