পরদাটা থেকে থেকে নড়ে উঠছে। পিছন থেকে কেউ যেন সরাবার চেষ্টা করছে। যে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে তার আলগা মুঠোয় পরদার মাঝখানের কিছু অংশ চলে যাচ্ছে, আবার সরেও আসছে সঙ্গে সঙ্গে।
অদ্ভুত ব্যাপার। কেউ ভিতরে আসছে না, আসবার কথা বলছেও না মুখে। আমার জিদ বাড়ছে, নিজে হতে ডাকব না কিছুতেই। দেখাই যাক না। পরদার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি। ডিমলাইটের আলোয় খয়েরি রঙটা কাল্চে দেখাচ্ছে আমার চোখে। এরকম দেখায় না কোনদিন। আজ ভরসন্ধ্যে থেকে এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যখুনি ওদিকটায় তাকিয়েছি তখুনি রঙ বদলে যেতে দেখেছি। হয়তো কয়েক বছর আগের একটা নৃশংস কালো ছবির ভাবনা সারাদিন ধরে পেয়ে বসেছে বলে।
কালো ছবি। নির্মম মৃত্যু। সুবীরের মৃত্যু। সুবীরের শেষনিশ্বাস ফেলার সময় আমি দেখিনি। ওর কাছে ছিলুম না। তবে মৃত্যু যখন ওর শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে গ্রাস করবার জন্য উদ্গ্রীব, তখন ওর মুমূর্ষু অবস্থা দেখেছিলুম আমি। কথা বন্ধ চোখ বন্ধ। শ্রবণ শক্তিও লোপ পেয়েছিল বোধ হয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জোরে জোরে ডেকেছি নাম ধরে। শুনতে পাওয়ার কোন লক্ষণই প্রকাশ পেতে দেখিনি ওর মুখের কোন জায়গায়। ক্ষীণ নিশ্বাস পড়ছিল। নাড়ার গতিও ভালো নয়। হাত-পা-দেহের কোন অঙ্গই নড়তে দেখিনি। সব একেবারে শক্তি হারা। যেন একটা কাঠের পুতুল পড়ে রয়েছে লাল বাড়ির রকটার ওপর। চব্বিশ বছরের যুবকের অদৃষ্টে লেখা ছিল বোধ হয় এই ভাবে মৃত্যু।
সেদিনকার মতো আজ সকালেও মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে এক প্রস্থ। তফাৎ কেবল এবারে লাল বাড়ির রকে নয়, দক্ষিণ পাশের হলদে রঙের বাড়িটার গেটের সামনে সুবীরের বয়সী তরুণটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে ছিল। শীর্ণকায়। হাড়পাঁজরা গোনা যাচ্ছে এক এক করে। বেচারার প্রাণটা ধুকধুক করছে তখন, বুকের বাঁ পাশটা মৃদু মৃদু কাঁপছে।
আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল। সুবীরের প্রায় এই দশাই দেখেছিলুম। সুবীরের অমন ফর্সা রঙটা সাদা কাগজের মতো দেখাচ্ছিল।
এর কালো রঙটা যেন জমাট নীল। ঠোঁট দুটোও নীলচে হয়ে আসছে। মানুষটা ভিজছে। পাড়ার ছেলেরা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। সুবীরকেও সরিয়ে ফেলেছিল ছেলেরা লাল বাড়ির রক থেকে।
মানুষটা ক’দিন থেকেই এ পাড়ায় ঘোরাঘুরি করছে। বলেছে, ভিখির সে। পেটের দায়ে ভিক্ষে চাইছে। কর্মের সংস্থান করতে পারেনি কোনরকমে বহুদিন শত চেষ্টা করেও। অনাহারে অনাহারে মরতে বসেছে সে।
পাড়ার লোকেরা—যার যেটুকু ক্ষমতা সাহায্য করেছে প্রতিদিন। তবু ওর ভবিতব্যকে রুখতে পারল না কেউ। পেটের খাবার জুগিয়েও ক্ষীণ প্রাণের শক্তি বাড়াতে পারল না কেউ ওর। পারেনি সুবীরের বেলায়ও।
জাত ভিখিরি ছিল না সুবীর। মুখচোরা মানুষ। কারো কাছে কিছু চাইত না মুখ ফুটে। রোদ্দরে লোকের বাড়ির দোরে বসে বসে পুড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজেছে। কেউ কিছু দিলে, নেয়নি হাত পেতে। ছেঁড়া গামছাটা বিছিয়ে দিয়ে মাথা নত করেছে লজ্জায়।
ওকে দেখে মনে হত, ওর সব কিছুই আছে। ঘরবাড়ি—আত্মীয়-স্বজন, সব। হাজারো প্রশ্ন করেও ওর পেট থেকে কথা বার করতে পারেনি কেউ। কোথা থেকে এসেছে, দেশ-ভিটে কোথায়—কেউ জানতে পারেনি। বেশী জিজ্ঞেস করলে, ওর দু’চোখের কোণ লাল হয়েছে। চিকচিক করে উঠেছে। বোঝা গেছে অভিমানী সুবীর দারুণ ব্যথা বুকে পুষে পথে নেমেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে গোপনে। অনেক দূরে। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে বলে কাজ-কর্ম জানে না কিছু বোধ হয়। তাই খুঁজে পেতেও কোন কাছ যোগাড় করে নিতে পারেনি। শেষে এই পরিণতি। ঘরে না ফেরার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাই এই দুর্গতির কারণ ওর।
আমার ধারণার কথা মাঝে মাঝে বলতুম আমি ওকে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত ও আমার দিকে খানিক। তারপর একটু ম্লান হাসি হেসে বলত, বাবু কি জ্যোতিষ জানেন? আমার ভবিষ্যৎটা একটু বলুন না।
আমি মাথা নেড়ে জানাতুম, জানিনে।
বিশ্বাস করত না ও। হাসতে হাসতে বলত, খারাপ জানলেও ভয় পাব না আমি। আমিও হেসে চলে যেতুম আর কোন জবাব না দিয়ে। চলে গেলেও আসতুম আবার পরের দিন। আবার গল্প করতুম আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। লক্ষ্য করেছি আমি, আমাকে কাছে পেয়ে ও যেন আপনজনকেই ফিরে পেত বুঝি। আমারও ওকে খুব কাছের লোক বলেই মনে হত।
এই কাছের লোকটি চলে গেল একদিন আমায় ছেড়ে। অর্থাৎ আমাদের পাড়া ছেড়ে। ছেলেরা সব সুবীরের কাছে দাঁড়িয়ে জটলা করছিল ওকে সরাবার জন্য। লাল বাড়ির মালিক ছেলেদের শ্মশানে নিয়ে যেতে বলল। মঙ্গলবারের মড়া অমঙ্গলই করবে। আর বাড়ির রকে বলে, তার তো করবেই, আর তাছাড়া পাড়ার কোন লোকের বাড়িই বাদ যাবে না এ অমঙ্গলের আওতা থেকে। এক বাড়ি থেকে মনোমত এক একজনকে নিজের দোসর করে নেবেই নেবে ও। এই অবধি কানে গেছিল। বিশেষ কাজের জন্য দাঁড়াতে পারিনি আর বেশী সময়। চলে গেছিলুম। পরে প্রায় বিকেলের দিকে এসে দেখি, রকটা শূন্য। শুনলুম, ছেলেরাই নাকি সুবীরকে নিয়ে গিয়ে শেষকৃত্য করেছে। ভিতরে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা আমার দাপাদাপি করেছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে!
সারাটা দিন ছটফট করেছি আমি সুবীরের জন্য। শেষ সময় আসবার চেষ্টা করেও আটকে পড়লুম আরও বেশী করে। আসতে পারিনি।
বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
পরদাটা বড্ড বেশী নড়ে উঠল। আকাশ ফাটানো কড়কড় আওয়াজের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। চোখ ধাঁধানো এক ঝলক আলো ঠিকরে পড়ল ঘরে।
পরদা সরিয়ে সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকল সুবীর। আমি ভীতবিস্মিত চোখে দেখছি মৃত সুবীরকে জীবন্ত মানুষের মতো। সুন্দর দেখতে হয়েছে সুবীর। দেহটা বেশ ভারী হয়েছে। গোলগাল চেহারা। সুবীর ধবধবে দাঁত বার করে হাসছে। ভরাট গালে লাল গোলাপের আভার মাঝে টোল পড়ছে।
এসব কি দেখছি আমি। স্বপ্ন না সত্যি? বারদুয়েক চোখ বুজলুম চোখ চাইলুম। মাথাটা ঠিক আছে কি না জানবার জন্য ঝাঁকিয়ে নিলুম একবার। মাথা ঠিকই আছে। ঠিকই দেখছি। ঘুমিয়ে নয়, জেগেই।
খালি চেয়ারটার সামনে এগিয়ে এল ধীরে ধীরে সুবীর। বসল না। দাঁড়িয়ে রইল পাশে। দেখছে আমাকে একদৃষ্টে। ওর দু’চোখ অনেক কথাই বলতে চাইছে যেন। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠছে।
বিদেহী এসেছে দেহ ধরে। অতৃপ্ত আত্মা এসেছে ঘুরে ফিরে আবার পুরনো জায়গায়। যা বলতে এসেছে, বলুক ও। ভয় পেলে চলবে না। কান পেতে শুনতে হবে। আমারই ডাকে ও এসেছে হয়তো। আমারই অস্থিরতা দূরের আত্মাকে কাছে এনে ফেলেছে বোধহয়।
কথা বলতে শুরু করল সুবীর।—লাল বাড়ির রকে আমি মারা যাইনি। সে সময় মারা গেলে আর একটা নিদারুণ অপঘাত মৃত্যুকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত না তাহলে আমার জন্য।
শিউরে উঠল আমার সর্বশরীর। সুবীরের মৃত্যু তাহলে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। হয়েছে অপঘাতে। প্রেতাত্মা শোনাতে এসেছে তার মৃত্যু রহস্য!
আচমকা প্রেতাত্মার মুখখানা খুব কঠিন হয়ে উঠল। গলার স্বরে উত্তেজনা ফেটে পড়তে লাগল। নিজেই নিজের নাম ধরে বলল, সুবীরের ওপর পাড়ার ছেলেরা ভয়ানক নির্দয় ব্যবহার করেছে। ওকে হাসপাতালে না দিয়ে, মৃত ঘোষণা করে, শ্মশানে নিয়ে যাবার নামে নিয়ে গেছিল হাওড়া ময়দানে। ময়দানের পূর্ব দিকটায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গা ঢাকা দিল ওরা। জনমানবশূন্য ময়দানে মাটিতে মুখ গুজে পড়ে রইল একা সুবীর।
বিকেলে বল খেলতে এল ওখানে কোন্ পাড়ার ছেলেরা কে জানে। তারা তাদের খেলার জায়গায় মড়াটাকে পড়ে থাকতে দিতে একদম নারাজ। সকলে মিলে মড়াটাকে ময়দান থেকে বিদায় করবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। সুবীরের দেহে ছেড়া চট জড়িয়ে ঘাড়ে করে তুলে নিল দুটি ছেলে। তারপর ছেলের দল সেই মড়া ঘিরে স্টেশনের দিকে চলল। পিছনের গেট দিয়ে লুকিয়ে স্টেশনের ভিতরে ঢুকে, যে ট্রেনটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল, তার একটা কামরায় বেঞ্চির তলায় সুবীরকে ঠেলে দিয়ে নেমে পড়ল ওরা।
সুবীর মরেনি তখনো। ছেড়া চটের ফাঁক দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। সব বুঝতে পারছে, সব জানতে পারছে। ছেলেদের শলা-পরামর্শ, তাকে নিয়ে কৌতুক করাকরি, সমস্ত শুনেছে স্বকর্ণে। ট্রেনে রেখে আসার জন্য ছেলেদের মধ্যে কার কত হিম্মত নিয়ে বাজি ফেলাফেলির কথাও শুনেছে।
বলতেও বিস্ময়, ভাবতেও বিস্ময়। ট্রেনের শেষ গন্তব্যস্থল অবধি দীর্ঘ পথ একই ভাবে পড়ে রইল সুবীর। কিন্তু কারো কোন লক্ষ্যই পড়ল না তার দিকটায়। ট্রেনটার যাত্রাপথ শেষ হল বোম্বে এসে। যাত্রীরা নেমে গেল পরপর। সব কামরাই ফাঁকা। ঝাঁড়ুদাররা অন্য কামরার মতো সুবীরের কামরায় এসেও হাজির হল। সাফ করবে। বেঞ্চির তলা পরিষ্কার করতে গিয়ে একজন অন্য জনকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে ‘মিলা’ বলে চিৎকার করে উঠল।
ওরা ভেবেছিল বুঝি ওদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। চটে মোড়া জিনিস-পত্তর আছে ওদেরই প্রাপ্য এসব। কিন্তু চট খুলতেই বুঝতে পারল বিধি বাম ওদের ওপর। মুরদা দেখে আঁতকে উঠল দু’জনে। দু’জনের মধ্যে বুড়ো ঝাঁড়ুদার সুবীরকে মিটমিট করে চাইতে দেখে, পালাতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর বোম্বের হাসপাতালে সুবীরকে ওরাই ভর্তি করে দেয়। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল সুবীর সেখানে।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার আগেই সুবীর মনস্থির করে ফেলল—দেশে ফিরবে না জীবনে। বাংলার কোনখানেও না। তাই খুব শিক্ষা হয়েছে। আপন-পর সকলকেই চিনেছে ভালো করে।
প্রেতাত্মার মর্মব্যথা শুনতে শুনতে ব্যথাকাতর হয়ে উঠেছি আমি। সুবীরের অতীত দুরবস্থার দৃশ্য যথার্থ প্রত্যক্ষ করছি যেন। শুধু প্রত্যক্ষই নয়, তখনকার পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে চলেছি আমিও।
প্রেতাত্মা বলছে, হাসপাতালে থাকতেই দিনমজুর মতিলালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সুবীরের। বেরুবার পর রুটির যোগাড় করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে ওকে। কথা রেখেও ছিল মতিলাল। বোম্বেতে কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি বটে, তবে তার জানা শোনা লোকের সঙ্গে কাডিপাণিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
পাহাড় আর শালগাছ ঘেরা কাডিপাণি। কারিপাণির কোন কোন পাহাড়ের স্তরে স্তরে লুকিয়ে রয়েছে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড। সাহেবদের নির্দেশে মজুররা পাহাড় কেটে পাথরের চাই বার করে। চাঁইয়ের বুক পিষে থেঁতলেই বাইরে বার করে নিয়ে আসা হয় শেষে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড।
কাডিপাণির পাহাড় কাটা মজুরের কাজ পেল সুবীর মতিলালের বন্ধুর সহযোগিতায়। বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনি একাজে। অমানুষিক খাটুনি। অনভ্যস্ত হাতে শাবল-গাঁইতি চালিয়ে পাথর কাটতে কাটতে অবশ হয়ে আসত হাত দুটো। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠত। টলে উঠত দু’পা। মনে হত, পাশের লোকটার শাবলের মুখে ওর দেহটা লুটিয়ে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে বুঝি এখুনি।
সহকর্মীদের অনেকের সহানুভূতি ছিল যে তার ওপর যথেষ্ট—একথা স্বীকার না করলে, মস্ত বড় অন্যায় করা হবে। সুবীরের শোচনীয় অবস্থা বুঝতে পারা মাত্র, ওরা তাকে ধরে বসিয়ে দিত। তার কাজ ওরাই করে দিত খানিক সময়। এতে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেত অন্যান্য সহকর্মীরা। সুবীরের মতো রূপ নেই তাদের। নেই অপরকে বশীভূত করে, নিজের কাজ করিয়ে নিয়ে আরামে বসে বসে মৌজ করা আর মুফতে মজুরির টাকা লোটা। এরকম লোককে কি কেউ বরদাস্ত করতে পারে–না পারা উচিত? মোটেই নয়। পাহাড়ের তলায় ফেলে বুকে পাথর চেপে ধরে হাড় পাজরাগুলো গুড়িয়ে গুড়ো করে দিলে, তবে তাদের বুকের জ্বলুনি ঠাণ্ডা হবে। একথা দিনের ভিতর চার-পাঁচ বার করে শুনতে হয়েছে সুবীরকে ঠকঠক করে পাথর কাটা আওয়াজের এরকম সঙ্গে সঙ্গে।
আমার চোখের সামনে যেন সুবীরের অপঘাত মৃত্যুকে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে দেখছি। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ঘাড়ের ওপর।
আমার মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে এক হিমপ্রবাহ বয়ে গেল যেন। তার জীবিতকালের ভয়াবহ শেষ নিদারুণ কথা শোনাবে এবার প্রেতাত্মা। তটস্থ হয়ে বসে আছি আমি। সুবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিনে, অথচ চোখ নামাতেও পারছিনে। মনে ভীষণ ভয় চেপে রয়েছে। শুধু ভয় আর ভয়। কি জানি সুবীরের এমন সুন্দর মুখখানা হয়তো নিমেষে কেমন হয়ে যাবে। বীভৎস—অকল্পনায় বীভৎস।
হাসছে প্রেতাত্মা।–সুবীর কাডিপাণি ডুংগার অর্থাৎ কাডিপাণি পাহাড় ছেড়ে যাবেই বা কোথায়? শত্রু বাড়ে বাড়ুক। মরতে হয় মরবে এখানে, বাঁচতে হয় বাঁচবে এখানে।
এই সর্বনেশে জিদের শেকলে বাঁধা পড়ল সুবীর। আটকে পড়ল কাডিপাণির পাহাড়-ভূমিতে। প্রতিদিন কাজ সেরে, ক্লান্ত দেহে ফিরে যেত মজুরদের সঙ্গে ওদের লতাপাতায় তৈরী ঝুপড়িতে। এই ঝুপড়ি থেকে আসা-যাওয়া পথের দু’সারি শালগাছের পিছনে পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একদিন কয়েকটি যমদূত। বাগে পেলে, আটকে ফেলবে সুবীরকে। যে কোন মানুষ—যত শক্তিই ধরুক কেন সে, বেরুতে পারে না ওদের কবল থেকে। সে তুলনায় সুবীর তো শিশু।
তাদের এই যমদূতের মতো মানুষদের কাছে সুবীর সন্দেহভাজন ব্যক্তি। নিশ্চয় জাসুস—পুলিশের টিকটিকি। তাদের চুরি-ডাকাতির গন্ধে এসে হাজির হয়েছে এই দুর্গম জায়গায়। মজুর সেজে খুঁজে বার করতে এসেছে লুকনোর গুপ্তস্থান। লোকটার হাবভাবে চেহারায় মনে হয় তাই। তারা যখন ডেরায় ফেরে, লোকটা তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে যেন কি দেখে। চাউনিটাও বিশেষ সুবিধের বলে মনে হয় না।
সত্যিই সুবীর লোকগুলোকে দেখত। একটা নতুন জায়গায় এসেছে, স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করবার বাসনা যে তার মনে জাগেনি, তা নয়। জেগেছিল। ওদের সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছে হত রোজ। ওদের ধারণা ভুল। সুবীর কোন সময়ের জন্য সন্দেহের চোখে দেখত না, জানত না ওরা ডাকাত। ভেবেছিল স্থানীয় লোক। সুবীর খারাপকে ভেবেছে ভালো আর ডাকাতরা ভালোকে ভেবেছে খারাপ।
এই ভুল ভাবার দরুণই ওরা সুবীরের জীবন সংশয় করে তুলতে চেয়েছিল। সুবীরকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছিল ওরা। কোন পালাবার পথ দেখতে পায়নি সুবীর কোনদিক দিয়েই। একসঙ্গে অনেকগুলো বলিষ্ঠ কালো হাতের বর্শা-তলোয়ার উঁচিয়ে রয়েছে তার চোখের ওপর মুখের ওপর বুকের ওপর। মুখ বন্ধ চোখ বন্ধ প্রাণ যাবার লক্ষণ।
ওদের বৃত্তের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে নিয়ে যেতে লাগল ওরা কোথায় কে জানে। অসহায়-নিরুপায় সুবীর মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এসেও আবার মৃত্যুগহ্বরের দিকেই এগুচ্ছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। স্বাভাবিক মৃত্যু থেকে বেঁচে গেছিল বোধ হয় নিশংসভাবে মরবে বলে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মারবে এরা। এদের বদ্ধমূল ধারণা—সুবীরই এদের পথের বিষাক্ত কাঁটা। নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে একে কালবিলম্ব না করে।
সুবীরের কাছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ভয়ঙ্কর থেকে আরো ভয়ঙ্কর। আরো আরো আরো—
সুবীরকে নিয়ে এসে যে জায়গায় থামল দুবৃত্তরা—সেখানে দিনের বেলাও রাতের অন্ধকার। ওপরের দিকটায় পাহাড়ে পাহাড়ে ঠেকাঠেকি। সূর্যের আলো প্রবেশ করে না জায়গাটায়।
সুবীরের অর্ধমৃতের মত অবস্থা।
দুবৃত্তদের কেউ কেউ এই ধূর্ত জাসুসকে উচিত মতো শিক্ষা দেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠল। তলোয়ারের এক কোপে ধড় থেকে ছিন্ন করে মাথাটাকে নামিয়ে দিতে চাইল কেউ। কেউ চাইল বর্শার খোঁচায় হৃৎপিণ্ডটাকে ক্ষত বিক্ষত করে তার উষ্ণ রক্তে স্নান করতে। আবার কেউ চাইল চোখ দুটো প্রথমে উপড়ে নিয়ে দগ্ধে দগ্ধে মারতে।
কারো কোন মতলবই কার্যকরী হল না শেষ পর্যন্ত ওদের মধ্যেকার সর্দারগোছের লোকটার নির্দেশে।
লোকটার বজ্রগম্ভীর স্বরে পাহাড়ভূমি কেঁপে উঠল।…জিওতো দাটি দইস।…জ্যান্ত কবর দাও লোকটাকে।
কথাটার অর্থ বোঝেনি সুবীর। ভেবেছিল, তাকে মুক্তি দিতে বলছে বুঝি। কিন্তু পরে মানুষ-প্রমাণ মাটি খোঁড়াখুড়ি করতে দেখে, লোকটার কথার মর্ম বুঝতে কোন অসুবিধে হয়নি তার।
হঠাৎ কি হল কিছু বুঝে উঠতে পারল না সুবীর। একবার গর্তের দিকে আর একবার তার দিকে ঘন ঘন চাইছে সকলে। সুবীরের মনে হচ্ছে, তাকে মাটির তলায় চাপা দেওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে সে মাটি-পাথর চাপা দেবার পর। সে এ দুনিয়ায় দাঁড়িয়েও অন্য দুনিয়ার। তার প্রেতাত্মা দেখছে ওদের। দেখছে গর্তটাকে।
গর্তের ভিতর একটা কঙ্কাল। বিস্ফারিত চোখে দেখছে ওরা কঙ্কালটার মাথার খুলির কাছে দুটো পেতলের হাঁড়ি ভর্তি সোনার কত কি রয়েছে!
মুখ তুলে সুবীরের দিকে তাকাতেই ওরা তার মধ্যে হঠাৎ কি দেখল কে জানে। মনে হল যেন ভূতই দেখল সবাই। সভয়ে সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ওরা।
সুবীরের দু’পাশে দু’হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল দু’জন। ওরা সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়ে, উল্টোদিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল। অন্যেরা পড়িমরি করে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্যই যেন ছুটে পালাল।
সবাই চলে যেতে ‘মরে গেছি’ ভাবটা কেটে গেছে সুবীরের। সচেতন হয়ে উঠেছে। ফিরে যাচ্ছিল, কে যেন তার ভিতর থেকে নিতে বলল হাঁড়ি দুটো। কার জিনিস, কে রেখেছে, সোনাদানাগুলোই বা সৎ উপায়ের না অসৎ উপায়ের —নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব তোলপাড় করতে লাগল সুবীরের মনে।
কিন্তু সুবীর যতবারই ফেলবার জন্য পা বাড়িয়েছে, ততবারই ভিতরের অকাট্য যুক্তির কথা শুনেছে।—নাও। অন্যায় হবে না। এ নিয়ে ব্যবসা করলে অনেক—অনেক টাকা আসবে। এখন যা নেওয়া হয়েছে, তার দ্বিগুণ দিয়ে দিলেই তো হবে অনাথ-আতুরদের সেবায়।
ভিতরের কথা শুনে বড় ব্যবসাদার হয়েছে সুবীর আজ। সত্যিই অনেক টাকা উপায় করেছে। তাই আতুরদের সেবায় ভিতরের কথামতো কাজ করতে পেরে ঋণমুক্তও হয়েছে।
সব শুনে স্তম্ভিত আমি। সুবীর বেঁচে আছে। আসেনি সুবীরের প্রেতাত্মা আমার কাছে। এসেছে সুবীর স্বয়ং। এসেছে তার জীবনের আশ্চর্য রহস্য কাহিনী শোনাতে।