» » তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ : কামবক্সের কারদানি

সম্রাট নাম ধারণ করবার পর থেকেই কামবক্স যথেচ্ছভাবে যে অত্যাচার আরম্ভ করলেন, তার ফলে সকলেরই প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল।

অতিরিক্ত আদর পেয়ে ঔরঙ্গজিবের জীবদ্দশাতেই তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, এখন হাতে ক্ষমতা পেয়ে তিনি ব্যবহার করতে লাগলেন ঘোর উন্মাদগ্রস্তের মতো।

সেসব এখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলবার জায়গা হবে না। যেসব মানী আমির-ওমরাও বিশ্বস্তভাবে তাঁর স্বার্থরক্ষার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের কারুকে তিনি যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করলেন, এবং কারুর সমস্ত সম্পত্তি লুটে নিলেন।

রুস্তম দিল খাঁয়ের কুকীর্তির কথা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে, হতভাগ্য আজম শাহের কাটা মুণ্ডভেট দিয়ে মুয়াজ্জামের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছিলেন পুরস্কারের বদলে তিরস্কার; এখন কামবক্সের অনুগত হয়ে লাভ করলেন চরম দণ্ড প্রাণদণ্ড। আর এক দিক দিয়ে দেখলে বলা যায় এ হচ্ছে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

এমনি সব অত্যাচারের ফলে বহু নিরপরাধ ও প্রধান ওমরাহকে অপঘাতে মারা পড়তে হল, বহু ধনীর সর্বস্ব লুণ্ঠিত হল এবং দলে দলে লোক ধনপ্রাণ বাঁচাবার জন্যে রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হল।

অবশেষে কামবক্স হায়দ্রাবাদ ছেড়ে মুয়াজ্জামের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষার জন্যে সদলবলে বেরিয়ে পড়লেন।

এইবার মুয়াজ্জাম কী করছেন তা দেখা দরকার।

মুয়াজ্জাম বা শা আলম ঔরঙ্গজিবের মৃত্যুর পূর্বেই আসীন ছিলেন তাঁর উত্তরাধিকারী যুবরাজের আসনে, সুতরাং এখন পিতার মৃত্যুর পর তিনি যে সিংহাসন লাভ করলেন সে কথা বলাই বাহুল্য। ‘সম্রাট’ উপাধি তিনি তাঁর দুই ভ্রাতার মতো গায়ের জোরে গ্রহণ করেননি। এবং সম্রাট হয়ে তিনি নিজেকে বাহাদুর শাহ নামে পরিচিত করলেন। অতঃপর আমরাও তাঁকে ওই নামেই ডাকব।

তারপর আজম শাহের সঙ্গে যুদ্ধ ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু।

সম্রাট বাহাদুর শাহ জয়ী হয়ে দেখলেন, তাঁর চারিদিকেই অন্যান্য শত্রুর দল আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে এবং তাদের মধ্যে রাজপুত ও শিখরা ক্রমেই অধিকতর বিপদজ্জনক হয়ে উঠছে। তাই সর্বাগ্রে তিনি রাজপুতানা আক্রমণ করলেন।

সেখানে ছোটখাটো কয়েকটা যুদ্ধে জিতেই তিনি খবর পেলেন, তাঁর ছোট ভাই কামবক্সও ‘সম্রাট’ নামে নিজেকে পরিচিত করে তাঁকে আক্রমণ করবার জন্যে সসৈন্যে অগ্রসর হচ্ছে।

বাহাদুর শাহ, যে ভ্রাতৃবিরোধের পক্ষপাতী ছিলেন না, সেটা আমরা আগেই দেখেছি। এবারেও রক্তপাত না করে ভালোয় ভালোয় সব গোলমাল মিটিয়ে ফেলবার জন্যে তিনি দূত-মারফত কামবক্সকে এই মর্মে জানালেন যে—তুমি যদি বাবার উইলের শর্ত অনুসারে দুটি সুবা নিয়ে তুষ্ট থাকো তাহলে তোমার সঙ্গে আমি কোনও শত্রুতাই করব না। আশা করি তোমার দাদা আজম শাহের পরিণামের কথা তুমি ভুলবে না। মোসাহেবদের কুপরামর্শে ভুলে আমাকে আক্রমণ করে নিজের বিপদকে নিজেই ডেকে এনো না।

বাহাদুর শাহের কথা কামবক্স কানেও তুললেন না, মোসাহেবদেরই মত মেনে নিয়ে তিনি সগর্বে বললেন—’আমি যুদ্ধ করব। সৈন্যগণ! প্রস্তুত হও, অস্ত্র নাও, দিল্লি চলো!’

কিন্তু কোথায় সৈন্যদল? বিরাট এক বাহিনী নিয়ে বাহাদুর শাহ এগিয়ে আসছেন শুনে কামবক্সের অধিকাংশ সৈন্য দলে দলে পলায়ন করল এবং অনেকে যোগ দিলে বাহাদুর শাহের দলেই।

কামবক্স কিন্তু একটুও দমলেন না, বললেন, ‘কী দরকার আমার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে? আমার সহায় আল্লাহ,—তিনি আমার মঙ্গলই করবেন!’

চাটুভাষী গণৎকাররাও ভবিষ্যদবাণী করলে—’হুজুর, নিশ্চিন্ত থাকুন, আল্লাহ আশ্চর্যভাবে আপনাকে রক্ষা করবেন, যুদ্ধে আপনার জয়লাভ অনিবার্য!’

তিনি তাদের কথাই বিশ্বাস করলেন এবং কপাল ঠুকে তিন-চারশো মাত্র অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বাহাদুর শাহের লক্ষাধিক যোদ্ধাকে ঠেকাবার জন্যে বেরিয়ে পড়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

তারপর যুদ্ধের নামে যা হল তা প্রায় একতরফা হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়—এক পক্ষ মারলে, আর এক পক্ষ প্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেলে, ভূমিতলে বইতে লাগল বীভৎস রক্তবন্যা! বিপুল বাদশাহি বাহিনীকে অঙ্গুলাগ্রে গণনীয় কামবক্সের কয়েকজন সৈনিক ঠেকাতে পারবে কেন? অনেকে মরল, অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল, নিতান্ত বিশ্বাসী কয়েকজন মাত্র তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লড়তে ও মরতে লাগল।

শাজাহানের রাজত্বকালে, অন্যান্য রাজপুত্রদের সঙ্গে তরুণ ঔরঙ্গজিব একবার একটা খ্যাপা হাতির সামনে গিয়ে পড়েছিলেন। বড় ভাইরা অর্থাৎ দারা, সুজা ও মুরাদ বুদ্ধিমানের মতো সরে পড়ে বিপদ থেকে নিস্তারলাভ করলেন, কিন্তু ঔরঙ্গজিব পালাবার নাম মুখেও আনলেন না, তরোয়াল খুলে সেই মত্তমাতঙ্গের সামনে একাই রুখে দাঁড়ালেন। এই সাহস ও বীরত্বের জন্য ঔরঙ্গজিব পরে পিতার কাছ থেকে প্রভূত প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

সম্রাট হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও কামবক্স যে কত বড় ‘বাপকো বেটা’, সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তার জ্বলন্ত নজির দিলেন।

নিজের অধিকাংশ সৈন্য হত বা আহত, সম্মুখে নিশ্চিত পরাজয় বা মৃত্যু জেনেও কামবক্স একবারও পশ্চাৎপদ হলেন না, যেখানে শত্রুরা দলে ভারি সেইখানেই মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তিরধনুক নিয়ে প্রাণপণে লড়াই করতে লাগলেন। তাঁর নিজের দেহের কয়েক জায়গা আহত হয়ে দরদর ধারে রক্ত ঝরতে লাগল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে তিনি ধনুক থেকে বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করে শত্রু বধ করতে লাগলেন—পরে পরে তাঁর দুটো তূণ খালি হয়ে গেল—বাহশাহি সৈন্যরা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে সাহস পেলে না—অনেকে মারাত্মক চোট খেয়ে মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ল—অনেকে তাঁর মারমূর্তি দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল—তিনি একাই যেন একশো! তাঁর অসমসাহস ও বীরত্ব দর্শন করে শত্রুপক্ষের সবাই বিপুল বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল!

অবশেষে যা হওয়ার তাই হল। ক্রমাগত রক্তপাতের ফলে কামবক্স নির্জীবের মতো হাতির হাওদার ভিতরে শুয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

বাদশাহি সেপাইরা তখন চারিদিক থেকে তাঁর হস্তীকে ঘিরে ফেলেছিল। কামবক্সের অচেতন দেহ পালকিতে তুলে বাহাদুর শাহের সামনে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করা হল।

এই রণক্ষেত্রে হাজির ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাফি খাঁ। তিনি নিজে গুণে দেখেছিলেন, কামবক্সের হাতির চারপাশে বাষট্টি জন বাদশাহি সৈন্যের মৃতদেহ পড়ে আছে!

তৎক্ষণাৎ বড় বড় চিকিৎসককে ডেকে তাঁদের হাতে কামবক্সের জীবনরক্ষার ভার দেওয়া হল। সম্রাট বাহাদুর শাহ নিজে এসে ভ্রাতার ক্ষতস্থানগুলি সযত্নে ধুয়ে এবং তাঁর রক্তাক্ত পোশাক বদলে দিলেন। নিজের গা থেকে শাল খুলে সস্নেহে ঢেকে দিলেন ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ।

তারপর করুণস্বরে বললেন, ‘ভাই, তোমাকে যে এমন অবস্থায় দেখতে হবে এটা আমি কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি।’

কামবক্স বললেন, ‘সকলই ভগবানের ইচ্ছা।’

‘কেন এমন মরিয়া হয়ে লড়তে গেলে?’

‘আমি মরে দেখাতে চাই যে আমি ভীরু নই, আমার দেহে আছে মহাবীর তৈমুরের রক্ত!’

কামবক্স কিছু খেতে চাইছিলেন না, বাহাদুর শাহ জোর করে তাঁর মুখে স্বহস্তে কয়েক চামচ খাবার তুলে দিলেন।

কামবক্স কাতরস্বরে বলে উঠলেন, ‘উঃ, বড় তেষ্টা!’

বাহাদুর শাহ তাড়াতাড়ি তাঁর মুখের সামনে গোলাপজল মেশানো পানীয়ের পাত্র তুলে ধরলেন।

সেই রাত্রেই কামবক্স অন্তিমশ্বাস ত্যাগ করলেন।

পিতা ঔরঙ্গজিব বিদ্রোহের ভয়ে পুত্রদের দূরে দূরে প্রেরণ করেছিলেন। তবু বিদ্রোহী হয়ে পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন তাঁর চতুর্থ পুত্র আকবর। এবং মুয়াজ্জাম ও আসফ শাহও পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন বলে ঔরঙ্গজিবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।

কিন্তু সাম্রাজ্য লাভ করে বাহাদুর শাহ পিতার নীতি মানেননি। তিনি পুত্রদের দূরে দূরে না পাঠিয়ে নিজের কাছে কাছেই রেখেছিলেন এবং তাঁর নীতিই সফল হয়েছিল; কারণ বাহাদুর শাহের জীবনকালে তাঁর কোনও পুত্রই বিদ্রোহাচরণ করেনি।

তবে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্ররা পরস্পরের সঙ্গে মারামারি কাটাকাটি করেছিল বটে, কিন্তু সেটা হচ্ছে মোগল রাজবংশের চিরাচরিত রীতি।

এবং সে রীতির মূলে ছিল পূর্বপুরুষ তৈমুর রোপিত বিষবৃক্ষের বিষফলের প্রভাব। মোগল রাজবংশ লুপ্ত হওয়ার আগে সে বিষক্রিয়ার জের মেটেনি। অভিশপ্ত বংশ!