ঐতিহাসিক সমগ্র
তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ : জাজাউয়ের যুদ্ধ
অতঃপর যে যুদ্ধ হয় আমরা খুব সংক্ষেপে তা বর্ণনা করব। ব্যাপারটা বিয়োগান্ত হলেও এর মধ্যেও প্রহসনের অভাব নেই।
মুয়াজ্জাম দিল্লি ও আগ্রা দুর্গ দখল করেছেন, এই খবর পেয়েই আজম শাহ যেন খেপে গেলেন। তার উপরে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতুষ্পুত্র এবং বাংলা ও বিহারের সুবাদার মহম্মদ আজিমও বহু সৈন্য ও প্রভূত ধনসম্পত্তি নিয়ে পিতার সঙ্গে যোগদান করেছেন শুনে প্রচণ্ড রাগে তিনি আর সব কথা ভুলে গেলেন।
ভারী ভারী কামান ও অতিরিক্ত যা কিছু মাল পিছনে ফেলে রাখবার হুকুম হল—মুয়াজ্জাম লড়াই করতেই জানে না—মশা মারবার জন্যে কামান পাতবার দরকার কী? মুয়াজ্জামকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে তরবারিই যথেষ্ট! অতএব তাড়াতাড়ি এগুবার জন্যে কতকটা ঝাড়া-হাত-পা হয়ে আজম শাহ প্রাণপণ বেগে ছুটে চললেন।
তিনি স্থির করলেন, যুদ্ধক্ষেত্র হবে সমুগড়ে। এ হচ্ছে সেই ইতিহাসখ্যাত সমুগড় প্রান্তর, বাহান্ন বৎসর আগে যে যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভের ফলে ঔরঙ্গজিব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারার মুণ্ডচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন। গণৎকাররাও তিথি-নক্ষত্র দেখে ভবিষ্যদবাণী করলে—ঠিক, ঠিক। জায়গার মতো জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে, যুদ্ধজয় অবশ্যম্ভাবী!
সমুগড়ে গিয়ে পৌঁছোবার আগেই সৈন্যদের অবস্থা দস্তুরমতো কাহিল হয়ে পড়ল।
একে তো এ অঞ্চলে দুর্ধর্ষ গরম পড়ে, তার উপরে পথে পুকুর কি ইঁদারা পাওয়া গেল না—এক জায়গায় কেবল একটা নালার ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল অব্যবহার্য, নোংরা ও পঙ্কিল জল। সে অস্বাস্থ্যকর জল যে পান করেছিল সেই-ই যাতনায় কাতর হয়ে পড়েছিল। আমির-ওমরাদের ততটা কষ্টভোগ করতে হল না—কারণ তাঁদের সঙ্গে ছিল মশক-ভরতি মিষ্ট জল, বিপদে পড়ল কেবল সাধারণ যুদ্ধব্যবসায়ীরা। বিষম তেষ্টায় তাদের প্রাণ ঠা-ঠা করতে লাগল, অনেকের শুকনো জিভ মুখের বাইরে বেরিয়ে ঝুলে পড়ল, অনেকে তৃষ্ণার জ্বালা সইতে না পেরে মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করলে।
তারপর বিপদের উপর বিপদ—সমুগড়ে পৌঁছে শত্রুর কোনওই পাত্তা পাওয়া গেল না।
মুয়াজ্জাম দূতের মুখে আজম শাহের গতিবিধির সব খবরাখবর পাচ্ছিলেন। তিনি ধীরে সুস্থে ঢোলপুরের নিকটবর্তী জাজাউ প্রান্তরে তাঁবু ফেলে ছোট একদল অগ্রবর্তী রক্ষীসৈন্যকে শত্রুর সন্ধানে প্রেরণ করলেন।
আজম শাহও দৌড় দিলেন জাজাউ প্রান্তরের দিকে।
অগ্রসেনাদল জাজাউ প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছেই আক্রান্ত হল। প্রধান সেনাদল নিয়ে মুয়াজ্জাম নিজে ছিলেন অনেকটা পিছনে, ঘটনাস্থলের বার্তা যথাসময়ে তাঁর কাছে পৌঁছোল না। তিনি নিশ্চিন্তভাবে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়লেন।
আজম শাহের পুত্র বিদার বখত অনেক সৈন্যসামন্ত নিয়ে সেই অগ্রবর্তী শত্রুদলকে তেড়ে গিয়ে আক্রমণ করলেন, তারা খানিক লড়াই করেই অসংখ্য শত্রু দেখে, বুদ্ধিমানের মতো চম্পট দিতে বাধ্য হল।
বিদার বখত আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন—’আমরা জিতে গিয়েছি—আমরা জিতে গিয়েছি—জোরসে বাজাও জয়ডঙ্কা!’
ডিমি ডিমি ডিমি ডিমি রণদামামাগুলো গভীর রবে বাজতে বাজতে বিদায় বখতের বিজয়বার্তা দিকে দিকে প্রেরণ করতে লাগল।
সেই ডঙ্কাগুলোর ঘোর নির্ঘোষ শুনেই আজম শাহ আহ্লাদে আটখানা হয়ে পুত্রের সঙ্গে যোগ দিতে ছুটলেন—কেউ কেউ বাধা দিয়ে বললে, ‘হুজুর, একটু সাবধান হওয়া উচিত—আগে ভালো করে খবরাখবর নেওয়া দরকার।’
আজম শাহ খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘এ সব হচ্ছে মেয়েলি কথা। সৈন্যদল, অগ্রসর হও, অগ্রসর হও!’
তিন মাইল দূরে মুয়াজ্জাম তখন নিকটবর্তী অরণ্যে শিকার খেলা নিয়ে মেতে ছিলেন। আচম্বিতে শত্রু-দামামার বিজয় ঘোষণা শুনে তাঁর মনে পড়ে গেল, অগ্রবর্তী সেনাদের সঙ্গে তাঁর পুত্র আজিম-উসসানও আছেন! পুত্র বিপদে পড়েছে ভেবে প্রধান সেনাদল নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন।
একজন খবর-দার সব দেখেশুনে আজম শাহকে গিয়ে বললে, ‘হুজুর, আসল ফৌজ নিয়ে এইবার মুয়াজ্জাম লড়াই করতে আসছেন।’
আজম শাহ চিরদিনের অভ্যাসমতো বুক ফুলিয়ে জামার আস্তিন গুটাতে গুটাতে ক্রুদ্ধস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘আমার সমুখে কোনও শত্রু আসতে সাহস করবে? আনো আমার হাতি, দাও আমাকে একগাছা লাঠি! আমি মুয়াজ্জামকে শায়েস্তা করব লাঠির চোটেই। মাভৈঃ! আমি আমার বিজয়ী পুত্রের সঙ্গে মুলাকাত করতে যাচ্ছি!’
তখন আসল লড়াই শুরু হয়েছে—মুয়াজ্জামের কামান-শ্রেণি ভৈরব গর্জন ও দীপ্তমুখ থেকে ঘনঘন তপ্ত গোলা উদগার করছিল।
তাতল বালুকাভরা প্রান্তর এবং গ্রীষ্মের তপ্ততাও ভয়াবহ। হু-হু করে লু ছুটছে—ধুলোর ঝড়ে আজম শাহের তৃষ্ণার্ত সেনাদলের প্রাণান্ত পরিচ্ছেদ হয়ে উঠল। সে ঝড়ের বেগ এত তীব্র যে নিক্ষিপ্ত তির আবার ফিরে আসে নিক্ষেপকারীর দিকে! স্বহস্তে নিক্ষিপ্ত তির ফিরে এসে অনেককে বধ করতেও ছাড়লে না!
ব্যাপার দেখে সেনাপতি জুলফিকার খাঁ বুদ্ধিমানের মতো সদলবলে পিছিয়ে এলেন, রাজা জয়সিংহ যোগ দিলেন শত্রুদলের সঙ্গে এবং অন্যান্য অনেক সেনাপতিও জুলফিকারের পথ অবলম্বন করলেন।
যিনি ভালো করে না দেখেশুনে জয়ডঙ্কা বাজাবার হুকুম দিয়ে এই অভাবিত কাণ্ড বাধালেন, আজম শাহের পুত্র সেই বিদার বখতও এক গোলার আঘাতে মারা পড়লেন এবং আহত হলেন তাঁর এক ভ্রাতাও। তা ছাড়া সেই সঙ্গে বহু সেনাপতিকেও মৃত্যুমুখে পড়তে হল।
কিন্তু আজম শাহের ভ্রূক্ষেপ নেই কিছুতেই—যেখানে জোর যুদ্ধ চলছিল সেইদিকে হস্তীচালনা করবার জন্যে মাহুতকে হুকুম দিলেন।
মাহুত হাতজোড় করে বললে, ‘হুজুর, আমার হাতি অনায়াসে একশো মাইল ছুটে পালাতে পারবে। যদি আদেশ করেন—’
মাহুতের ইঙ্গিত বুঝে আজম শাহ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, ‘কী! আমাকে পালাতে বলছিস? তৎক্ষণাৎ তরবারির এক আঘাতে তাকে মাটির উপরে ফেলে দিয়ে নিজেই মাহুতের স্থান অধিকার করে হাতি চালাতে লাগলেন। তাঁর দেহের কয়েক জায়গায় তির বিদ্ধ হল কিন্তু তিনি আমলে আনলেন না। অবশেষে বন্দুকের এক গুলির আঘাতে তাঁর মৃতদেহ হাতির পিঠেই লুটিয়ে পড়ল।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারার ছিন্নমুণ্ড দর্শন করে ঔরঙ্গজিব খুশি হয়েছিলেন। সুতরাং আজম শাহের কাটা মুণ্ড দেখেও মুয়াজ্জাম খুশি হয়ে নিশ্চয়ই পুরস্কার দান করবেন! এই কথা ভেবে পাঠান সেনানি রুস্তম দিল খাঁ হাতির পিঠে চড়ে আজম শাহের মৃতদেহ থেকে মুণ্ডটা কেটে নিয়ে ছুটে গিয়ে মুয়াজ্জামের পায়ের তলায় উপহার দিলেন।
পুরস্কার? বিষম ক্রুদ্ধ হয়ে মুয়াজ্জাম তাঁকে ভীষণ তিরস্কার করতে লাগলেন—রুস্তম খাঁ তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচলেন।
তারপর মুয়াজ্জামের দুই চক্ষু দিয়ে ঝরঝর করে শোকাশ্রু ঝরতে লাগল।
নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করবার পর আজম শাহ তিন মাস দশদিন বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চান্ন বৎসর সাত মাস ছয় দিন। তিনি নিজেই নিজের মৃত্যুর কারণ, এ কথা বললে ভুল বলা হয় না। এ হচ্ছে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের কথা।
কিন্তু আজম শাহের মৃত্যুর পরেও মুয়াজ্জাম হাঁপ ছাড়বার সময় পেলেন না। কারণ তারপর নিজেকে ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে ঘটনাস্থলে এগিয়ে এলেন ঔরঙ্গজিবের প্রিয়তম কনিষ্ঠ পুত্র মহম্মদ কামবক্স। তাঁর নামেও প্রস্তুত হল স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা।
সে আর এক বিয়োগান্ত প্রহসন।