ঐতিহাসিক সমগ্র
তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ : আজম শাহের শম্বুকগতি
কিন্তু সাপের বাচ্চা সাপ ছাড়া আর কিছু হয় না। পিতার ছল ধরে ফেলতে আজম শাহের বিলম্ব হল না। তিনি বুঝতে পারলেন, পিতার শেষদিনের আর দেরি নেই। লোকদেখানো হুকুম তামিল করবার জন্যে তিনি যুদ্ধযাত্রা করলেন বটে, কিন্তু শম্বুকগতিতে। চার দিনে মোট চল্লিশ মাইল!
গোদাবরী নদীর তীরে তাঁবু ফেলবার পর আজম শাহ খবর পেলেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ তারিখে অর্ধ শতাব্দীর উপর রাজত্ব ভোগ করবার পর ঔরঙ্গজিব রাজদণ্ড ফেলে দিয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত—কে আর এখন বোকার মতো যুদ্ধযাত্রা করে, নিজের আখের ভুললে চলবে না।
মন্ত্রীরাও আজম শাহকে পিতার শেষকৃত্য করবার জন্যে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার জন্যে অনুরোধ করলেন।
আজম শাহের দেরি হল না। পিতৃহারা পুত্র চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে পিতার মৃত্যুর পরের রাত্রেই মৃত্যুশয্যার পাশে এসে পড়লেন এবং সাধারণ লোকের মতোই অশ্রুজড়িত ভগ্নস্বরে ‘পিতা! পিতা!’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন। সবাই বলাবলি করতে লাগল—’ওঃ, রাজপুত্র কী পিতৃভক্ত!’
শেষকৃত্যের তোড়জোড় করতে করতে আজ শাহ কিন্তু নিজের কাজ গোছাতে ভুললেন না! পিতার দেহ সমাধিস্থ করেই তিনি নিজেকে গোটা হিন্দুস্থানের ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে দিলেন। প্রকাশ্যভাবে রাজমুকুট ধারণ করে নিজের নাম গ্রহণ করলেন—’আবুল-ফয়েজ, কুতবউদ্দিন, মহম্মদ আজম শা, গাজি।’ উপস্থিত সমস্ত প্রধান প্রধান রাজকর্মচারী তাঁর আনুগত্য স্বীকার করলেন—তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সেনাপতি জুলফিকার খাঁ পর্যন্ত।
আজম শাহের নামে যে সব মুদ্রা প্রস্তুত হল তার উপরে লেখা রইল—সম্রাট আজম শাহ।
মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন, আগে কামবক্সকে দমন করা হোক।
আজম শাহ বললেন, ‘উহুঁ’, আগে মুয়াজ্জাম। যদিও সে নয় দারাশেকো, তাকে শায়েস্তা করতে হলে একগাছা যষ্টিই যথেষ্ট, তবু আগে তার লম্ভঝম্প বন্ধ করা দরকার। চল হিন্দুস্থানের দিকে।’
আজম শাহ আমেদনগর থেকে সসৈন্যে যাত্রা করলেন হিন্দুস্থানের পথে।
মুয়াজ্জামের সমস্ত গতিবিধির খবর আজম শাহের কাছে এসে পৌঁছোতে লাগল। সর্বাগ্রে তাঁর নজর গেল আগ্রার দিকে। তিনি ছুটলেন আগ্রা দুর্গ দখল করবার জন্যে।
এর কারণও ছিল। তাঁর বা মুয়াজ্জাম, কারুর হাতেই উচিতমতো টাকাকড়ি ছিল না। আগ্রা দুর্গের ভাণ্ডারে রক্ষিত আছে কয়েকজন মোগল সম্রাটের রাজত্বকালে সঞ্চিত কোটি কোটি টাকা মূল্যের বিপুল ধনরত্ন। যে আগে সেই ধনরত্নের ভাণ্ডার দখল করতে পারবে, কেউ পারবে না তার অগ্রগতি রোধ করতে।
অতএব আগ্রা চলো, আগ্রা চলো!