ঐতিহাসিক সমগ্র
তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ : সাবধানি ঔরঙ্গজিব
ঔরঙ্গজিবের পাপী মন, পাছে স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিজেকেই ভোগ করতে হয়, সেই ভয়ে সর্বদাই উদবিগ্ন হয়ে থাকত। একে পিতৃদ্রোহের ধাক্কা মৃত্যুর অনেক আগেই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল, তার উপরে তিনি নিজের পিতাকেও যে ভাবে আগ্রা দুর্গে বহুকালের জন্যে বন্দি করে রেখেছিলেন, তাঁর নিজের পুত্রদেরও কেউ তাঁর সঙ্গে যদি সেই রকম অসদাচরণ করে, সেই ভয়ে পুত্রদের কারুকেই কাছে না রেখে তিনি দূরে দূরান্তরে থাকতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি তাঁর কোনও পুত্রকেই বিশ্বাস করতেন না—যদিও ছোট ছেলে কামবক্সের উপরে তাঁর প্রাণের টান ছিল একটু বেশি মাত্রায়। থাক প্রাণের টান, তবু সাপের বাচ্চা তো!
তাঁর সন্তানসংখ্যা দশ—পাঁচ ছেলে, পাঁচ মেয়ে। মেয়েদের কথা ধরব না, ঔরঙ্গজিবের মৃত্যুর সময়ে দুই পুত্রও বর্তমান ছিল না। বড় ছেলে মহম্মদ সুলতান যৌবনসীমা পার হয়েই অপুত্রক অবস্থায় মারা পড়েন এবং চতুর্থ পুত্র আকবর বিদ্রোহী হয়ে প্রথমে রাজপুতদের সঙ্গে যোগ দেন, তারপর শিবাজির পুত্র শম্ভুজির দলে ভিড়ে সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে পারস্য দেশে পালিয়ে যান ও পারস্যপতির অন্নদাস হয়ে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ঔরঙ্গজিব পুত্রদের অকারণে সন্দেহ করতেন না। আকবরের পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ও যুবরাজরূপে বিবেচিত মহম্মদ মুয়াজ্জামও (পরে বাহাদুর শাহ) পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে প্রায় সাত বৎসরকাল বন্দিজীবন যাপন করে পরে মুক্তিলাভ করেন। পিতার মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন সুদূর কাবুলের শাসনকর্তা।
তৃতীয় পুত্র আজম শাহ কারাগারে নিক্ষিপ্ত না হলেও কোনও কোনও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁরও যোগসাজস ছিল। তবু নারাজ মনেও ঔরঙ্গজিব তাঁকে কতকটা নিজের কাছাকাছি থাকতে দিয়েছিলেন।
ছোট ছেলে মহম্মদ কামবক্স নিজেকে পিতার প্রিয়পাত্র জেনে বয়সে প্রৌঢ় হয়েও ব্যবহার করতেন আদুরে দুলালের মতো। তিনি বিজাপুরের সুবাদারের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দূরে দূরে তিন ভ্রাতার অবস্থান, কারুর সঙ্গে কারুর ঝগড়া করবার বিশেষ সুবিধা নেই।
নিজের মৃত্যর পর যাতে ভ্রাতৃবিরোধ না হয় সেজন্যেও ঔরঙ্গজিব অল্প মাথা ঘামাতেন না—কারণ কথিত আছে, তিনি নিজের সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন সুবায় বা প্রদেশে বিভক্ত করে তিন পুত্রকে দান করে গিয়েছিলেন। এই উইলখানি ঔরঙ্গজিবের মৃত্যুর পর তাঁর উপাধানের তলায় পাওয়া যায়। সাম্রাজ্য ভাগ হয়েছিল এই ভাবে : যুবরাজ মুয়াজ্জাম পাবেন উত্তর-পশ্চিমের বারোটি প্রদেশ এবং দিল্লি হবে তাঁর রাজধানী। আজম শাহ পাবেন দক্ষিণের ছয়টি প্রদেশ এবং আগ্রা হবে তাঁর রাজধানী। বিজাপুর ও হায়দ্রাবাদ দুটি প্রদেশ নিয়ে কামবক্স যদি খুশি থাকেন, তা হলে কেউ যেন তাঁর উপরে কোনও তম্বিতাম্বি না করেন।
কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি ঔরঙ্গজিবকে ক্ষমা করলে না, জীবনে যত মহাপাপ তিনি করেছিলেন, মৃত্যুর পরেও তাঁর পরলোকগত আত্মার উপরে সেসব অনাচার ও দুষ্কৃতি চেপে বসেছিল দুঃসহ বোঝার মতো।
ঔরঙ্গজিব শেষ শয্যা গ্রহণ করলেন। পিতা সাজাহানের রোগশয্যাকে পুত্র হয়েও তিনি কেমন করে বন্দিশালার মধ্যে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ঔরঙ্গজিব তা ভুলতে পারেননি। নিজের অন্তিমকালে পাছে তারই পুনরাভিনয় হয়, সেই ভয়ে নিকটস্থ পুত্র আজম শাহকে তিনি মালোয়ার বিদ্রোহ দমনের অছিলায় দূরে যাত্রা করতে হুকুম দিলেন।