» » তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ : রক্তাক্ত বাদশাহি প্রহসন

রক্তাক্ত বাদশাহি প্রহসন? মিলনান্ত নয়—বিয়োগান্ত। অথচ প্রহসন। কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয়নি। একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দিই।

বাহাদুর শা-র মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্রদের মধ্যে অনেক মারামারি, কাটাকাটি ও খুনোখুনি চলল, তারপর ময়ূর সিংহাসনের উপরে চেপে বসলেন তাঁর পুত্র জাহান্দার শা। ঘটা হল, বাজনা বাজল, আলোর মালা দুলল।

তারপর মাস দুই যেতে না যেতেই সকলের বুঝে নিতে দেরি লাগল না যে, ভারতসম্রাটের মুকুট ধারণ করেছেন একটা সিদ্ধিখোর, বদ্ধমাতাল, মাথাপাগলা, বদখেয়ালি আস্ত ভাঁড়।

প্রথমেই তিনি ইমতিয়াজ-মহল উপাধি দিয়ে একটা সাধারণ নাচনাওয়ালিকে সম্রাজ্ঞী সাজিয়ে নিজের পাশে এনে বসালেন। লালকুঁয়ার নামে ইতিহাসে যে কুখ্যাত হয়ে আছে। তাদের উদ্ভট সব কীর্তিকথা বলবার জায়গা এখানে নেই, সংক্ষেপে মাত্র দু-চারটির উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে।

হঠাৎ একদিন লাল-কুঁয়ারের খেয়াল হল জলে ডুবে মরবার সময় লোকে কী করে তা দেখবার জন্যে।

সম্রাট জাহান্দার শা বললেন, ‘এ আর এমন শক্ত কথা কী? এখনি তোমাকে দেখাচ্ছি।’

দুর্গপ্রাসাদের অনতিদূরে প্রবহমানা যমুনা নদী এবং নদীর বুকে নৌকোয় বসে এপার থেকে ওপারে ভেসে চলেছে যাত্রীভরা নৌকোগুলো।

সম্রাট হুকুম দিলেন—’এই সেপাইরা, একখানা নৌকো এখনি ডুবিয়ে দিয়ে আয়!’

সেপাইরা হুকুম তামিল করতে ছুটল। লাল-কুঁয়ারকে নিয়ে সম্রাট লালকেল্লার উঁচু ছাদে গিয়ে উঠলেন—সেই উপভোগ্য দৃশ্য দেখে হেসে গড়াগড়ি দেওয়ার জন্যে! তার পরের দৃশ্য আর বর্ণনা না করাই ভালো।

সম্রাট একদিন রাজপথে বেরিয়ে পড়লেন—ঘোড়ার বা হাতির পিঠে বা তাঞ্জামে চড়ে নয়, দস্তুরমতো হ্যাঁকোচ-প্যাঁকোচ গরুর গাড়িতে চেপে। চললেন কোথায়? সাধারণ সরাবখানায় ঢুকে ছোটলোকদের সঙ্গে মিলেমিশে একেবারে ছোটলোকের মতো মদ্যপান করতে!

একদিন শুঁড়িখানায় মদ খেতে গিয়ে সম্রাট আর ফিরে এলেন না। পরদিন সকালে লালকেল্লায় হুল্লোড় আর হুলুস্থূলু—বাদশা লোপাট, বাদশা লোপাট! সেপাইরা দলে দলে পথে পথে বেরিয়ে পড়ে খোঁজাখুঁজি করতে করতে অবশেষে দেখে, ভারতসম্রাট জাহান্দার শা মদে বেহুঁশ হয়ে একখানা ভাড়াটে গাড়ির মধ্যে দিব্য নিদ্রাসুখ উপভোগ করছেন! ছোটলোক ভবঘুরে ইয়াররাও মাতাল হয়ে তাঁকে গালি দিলে বা লাথি মারলেও সম্রাট রাগ করতেন না!

আর একদিন। দিল্লি শহরের এক জায়গায় একটা উঁচু পাথরের ঢিপি ছিল, তার ঢালু গা খুব তেলা। রাস্তার ছোট ছোট ছেলেরা এই ঢিপির মসৃণ গা বয়ে হড়কে নামতে নামতে চারিদিক আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত করে তুলত।

একদিন শিশু ও বালকরা এমনই আমোদে মেতে আছে। হঠাৎ সচমকে তারা দেখলে, জমকালো পোশাকপরা এক বুড়োখোকা আহ্লাদে আটখানা হয়ে নাচতে নাচতে এসে শিশুদের খেলায় যোগদান করলে। বুড়োখোকার বয়স তখন পঞ্চাশ! তিনিই দিল্লির বাদশাহ শুনে শিশুরা একেবারে হতভম্ব!

দুনিয়ার আর কোনও দেশে এমন আজব বাদশাহ আর কেউ দেখেছে?

ডাকু নাদির শা মর্যাদাহীন ময়ূর সিংহাসন লুটে নিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তার অনেক আগেই হাজার হাজার মানুষের রক্তে দুই হাত ডুবিয়ে এই নৃশংস বুড়ো খোকা ময়ূর সিংহাসনে আরোহণ করে তার সমস্ত গৌরব ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল—এসব প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয় এবং প্রহসনই শেষটা বিয়োগান্ত দৃশ্যে পরিণত হয়েছিল। দিল্লি জাহান্দার শাহকে পুরো এক বৎসরও সহ্য করতে পারেনি—হত্যাকারীরা গলা টিপে ও লাথি মেরে তাঁকে জাহান্নমে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

শেষপর্যন্ত এমনই রক্তাক্ত প্রহসনের ভিতর দিয়েই দিল্লিতে একদিন নকল ময়ূর সিংহাসনের উপরে সাজিয়ে রাখা নকল ও অসার বাদশাহির ঝকমকানি নিঃশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এইবারে ঔরঙ্গজিবের উত্তরাধিকারী মহম্মদ মুয়াজ্জাম বা শা আলম, বাহাদুর শাহের সিংহাসন অধিকারের ব্যাপার নিয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনা করব। তা হলেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন তৈমুরের রোপিত বিষবৃক্ষের ফল কীভাবে বারে বারে সমগ্র মোগল রাজবংশে ছড়িয়ে পড়েছিল—মোগল রাজকুমাররা শুনে বা দেখে বা ঠেকেও কিছুই শিখতে পারেননি—এমনকী এই অভিশপ্ত বংশে জন্মগ্রহণ করে মিষ্টস্বভাব ও দয়ামায়ার অধিকারী হয়েও বাহাদুর শাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও রক্তপ্লাবনে গা ভাসাতে হয়েছিল।