দময়ন্তী
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে পাখির চোখে দেখলে বৃত্তের মতো লাগে। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্রিটিশ স্থাপত্য, সেন্ট্রাল হল। তিনতলা সমান উঁচু বাড়িতে আদতে একটাই তলা। লাল ইটের তৈরি, ঢালু ছাদওয়ালা হলে ঢুকলে উচ্চতার কারণে নিজেকে লিলিপুট মনে হয়। শক্তিরূপা বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্য ও আমেরিকান জিআইদের র্যাশন রাখার জন্য সেন্ট্রাল হল তৈরি হয়েছিল। তাই গুদামঘরের মতো আর্কিটেকচার। দময়ন্তী খোঁড়াতে খোঁড়াতে হলটায় ঘুরছিল।
গোড়ালিতে চোটের কারণে অ্যাঙ্কল স্প্রেন হয়েছে। প্রথমদিন ঠিক সময়ে কলেজে পৌঁছবে বলে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথা না শুনে বেলেঘাটা মেন রোড থেকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যে ঝাঁপ মেরেছিল দময়ন্তী। তার ফল এখনও ভুগছে। প্রথম দিন কোনও অসুবিধে হয়নি। শনিবার পেরিয়ে রবিবার আসতে না আসতেই পা ফুলে ঢোল। অগত্যা হাড়ের ডাক্তারের কাছে যেতে হল। এক্স-রে করানো, ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়ানো, ব্যথার ওষুধ খাওয়া, বিছানায় শুয়ে থাকা—হাজার ঝামেলা। প্রথম দিন নিয়মানুবর্তীতা দেখাতে গিয়ে পরের পাঁচদিন কলেজে আসতে পারেনি দময়ন্তী। আপ্পুর অনুরোধে আজ এল। আজ ফ্রেশার্স ওয়েলকাম।
আইএমসির যাবতীয় প্রোগ্রাম সেন্ট্রাল হলে অনুষ্ঠিত হয়। তার কারণ, কলেজ কর্তৃপক্ষ বেঢপ গুদামকে কীভাবে ব্যবহার করবে বুঝতে না পেরে অডিটোরিয়ামে বদলে দিয়েছে। যে স্থপতির প্ল্যানিং এ এই রূপান্তর ঘটেছে, হেরিটেজের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল। ব্রিটিশ গোডাউন আর সরকারি গণভবনের ভয়াবহ ফিউশন এখানে ঘটেনি। পিছন দিকে স্টেজ ও সামনের দিকে বসার আয়োজন করা ছাড়া অন্য কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাড়িটি কেন্দ্রীয়ভাবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলেও ছাদ থেকে অন্তহীন লম্বা রডে ঝোলানো চার ব্লেডের পাখাগুলো খোলা হয়নি। নতুন রং ও তেল পেয়ে তারা বনবন করে ঘুরছে। দেওয়ালের রং দুধসাদা। ওপর দিকের অজস্র স্কাইলাইট এবং ঘুলঘুলি ফলস রুফিং দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। গাদাগাদা আখাম্বা দরজা জানলা সাউন্ডপ্রূফ মেটিরিয়াল দিয়ে বন্ধ। এই পরিবর্তনের ফলে অডিটরিয়ামের ধ্বনি প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা খুব সুন্দর।
স্টেজের দু’পাশে এবং পিছন দিকে অনেকগুলো ঘর আছে। ছোট এবং কেজো ঘরগুলোর কোনওটা থেকে আলো নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনওটা থেকে শব্দ। সেন্ট্রাল হল রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে একটা ঘর আছে। দময়ন্তী উঁকি মেরে দেখল ঘরটা ঝাঁটা, মপ, ঝুলঝাড়ু, ফিনাইল, ফ্লোর-কিনার, রুম ফ্রেশনারে ঠাসা। সেন্ট্রাল হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে যথেষ্ট অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করা হয়। এই ঘরের পাশের ঘরের দরজায় তালা মেরে বাইরে চেয়ার পেতে যে ছেলেটা সিরিয়াস মুখে বসে আছে, তার নাম লাটু। একটু আগে দময়ন্তীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এই ঘরে মদের বোতল রাখা আছে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ডিজে ও মিউজিকের সঙ্গে নাচানাচি হবে। তখন এইসব কাজে লাগবে। দিল্লিতে এইসব দেখে চোখ-কান পচে গেছে দময়ন্তীর। নাচগানের আগে আছে ‘মিস্টার ও মিস আইএমসি কনটেস্ট’। এটা এই কলেজের পুরনো সংস্কৃতি। আশির দশক থেকে চলে আসছে। তখনও সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স হননি, ঐশ্বর্য রাই মিস ওয়ার্ল্ড হননি, বিপাশা বসু তিলোত্তমা হননি। বিউটি কন্টেস্টের কালচারটাই বাঙালিদের মধ্যে ছিল না। অল ইন্ডিয়া এনট্রান্স এক্সামিনেশানে চান্স পেয়ে দিল্লি ও মুম্বইয়ের যে সব ছেলেমেয়েরা কলকাতায় পড়তে আসত, তারা এটা চালু করে। সেই ট্র্যাডিশন দিব্যি চলছে।
দেড়শো জন ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে পাঁচজন ছেলে ও পাঁচজন মেয়ে প্রতিযোগী বেছে নেওয়ার কাজটা কারা করেছে, কোন প্যারামিটারের ভিত্তিতে করেছে, সেটা দময়ন্তীর অজানা। গত তিনদিন ধরে আপ্পু তাকে ফোনে অনুরোধ করেছে আজ আসার জন্য। কেন না সে একজন কনটেস্ট্যান্ট। মোবাইলে দময়ন্তী আপ্পুকে বুঝিয়েছিল, পায়ের চোটের কারণে তার পক্ষে ফ্রেশার্স ওয়েলকামে আসা বা মিস আইএমসিতে যোগদান করা অসম্ভব। আপ্পু নাছোড়বান্দা। গতরাতে গোলমহলে গিয়ে হাজির। শক্তিরূপা আর ড্যানিয়েলের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে দময়ন্তীর বাড়ি ছাড়ার পারমিশান জুটিয়ে ফেলেছে। অগত্যা আসতে হয়েছে!
দময়ন্তীকে বাদ দিলে বাকি চারজন মেয়ে প্রতিযোগী হল শ্রীপর্ণা, বৃন্দা, জেমসি আর সাবিনা। বৃন্দার সঙ্গে গত শনিবার আলাপ হয়েছিল। বাকি তিনজনকে দময়ন্তী চেনে না। সেন্ট্রাল হলে ঢোকার আগে আপ্পুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পায়ে ক্রেপ বাঁধা অবস্থায় দময়ন্তীকে আসতে দেখে বলল, ‘আট্টাগার্ল! স্টেজে উঠে ব্লন্ড বিমবোর মতো আচরণ করিস। ইউ উইল বি দ্য পারফেক্ট আন্ডারডগ।’
‘আন্ডারবিচ বলতে পারো।’ মুচকি হেসে বলেছিল দময়ন্তী, ‘তোমার কথা মতো ব্যাগে করে শাড়ি নিয়ে এসেছি। আমি কিন্তু শাড়ি হ্যান্ডল করতে পারি না। স্টেজে খুলে গেলে কেলেঙ্কারি হবে।’
‘তাহলে মিস আইএমসির ক্রাউন তোর জন্য বাঁধা।’ চোখ টিপে বলেছিল আপ্পু। ‘বাই দ্য ওয়ে, বাকি কনটেস্ট্যান্টদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?’
‘গত শনিবার বৃন্দার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।’
‘শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি ব্যারাকপুরের মেয়ে। আর্মি স্কুলে পড়াশুনো। জেমসি ডিসুজা গোয়ার মেয়ে। অল ইন্ডিয়া এনট্রান্স দিয়ে কলকাতায় চান্স পেয়েছে। সাবিনা কৈরালা নেপালের মেয়ে। রয়্যাল ব্লাড আছে। অল আর ড্যাম গর্জাস।’
‘মেয়ে নিয়ে আমার কোনও ফ্যাসিনেশান নেই। চিকনাগুলো কেমন বলো।’
‘আচ্ছা? কলেজে সদ্য ঢুকেই চিকনার খোঁজ?’ টক করে চোখ মারে আপ্পু, ‘আমাদের কলেজের ট্রাডিশন হল, মিস্টার আইএমসির ক্রাউন নিয়ে যায় নর্থ ইন্ডিয়ার ছেলেরা। আর মিস আইএমসির খেতাব পায় বাংলার মেয়েরা। এইবারে মেয়েদের ক্ষেত্রে কী হবে বলা শক্ত, তবে ছেলেদের মধ্যে মুম্বইয়ের সুরজ মলহোত্র ন্যাশনাল লেভেলের ম্যানহান্ট কম্পিটিশনে নাম দেওয়ার মতো চিকনা। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম, ওয়েল গ্রুমড।’
‘অন্য ছেলেগুলো কে?’
‘কলকাতার তিনটে ছেলে আছে। দীপ সেনগুপ্ত, প্রবাল সান্যাল আর সঞ্জয় ত্রিপাঠি। ত্রিপুরার এক ছোকরা আছে। নাম সবুজ দেববর্মন। দেখতে শুনতে ভালো। এনিওয়ে, আমাকে আর বকাস না। সেন্ট্রাল হলের পিছনে মেয়েদের জন্য একটা রুম অ্যালট করা আছে। ওখানে ব্যাগ রেখে অডিয়েন্সে বোস। ক্রাউন রাউন্ড শুরু হওয়ার একঘণ্টা আগে সাজুগুজু করে নিস।’
সাজুগুজু করার ঘরটা এতক্ষণে দেখতে পেল দময়ন্তী। বাইরে ‘ফর হার’ লেখা রয়েছে। শব্দদুটোর মাথায় ঝকঝকে টায়রা আঁকা। বাইরে এক সিনিয়র দাদা বসে রয়েছে। এর সঙ্গেও আজই আলাপ হল। নাম বান্টি।
সে দময়ন্তীকে দেখে বলল, ‘ভেতরে ব্যাগ রেখে অডিয়েন্সে যা। ঠিক সময়ে চলে আসবি।’
ঘরে ঢুকে দময়ন্তী দেখল পাঁচটা টেবিল আর পাঁচটা চেয়ার পাতা রয়েছে। প্রতিটি টেবিলে একটা আয়না। ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি নেই।
ব্যাগ টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে অডিয়েন্সে এল দময়ন্তী। সেন্ট্রাল হল এখন, ক্রিকেট কমেন্টি^্রর ভাষায়, ‘খচাখচ ভরা হুয়া হ্যায়’। মঞ্চে বসে রয়েছেন এনজি দাস, এএম এবং পিএম। স্বাগত ভাষণ দিচ্ছেন ফরেনসিক মেডিসিনের এইচওডি এবং কলেজের প্রিন্সিপাল ডক্টর রেবতীভূষণ পট্টনায়ক। নাম ও পদবির আদ্যক্ষর জুড়ে এঁকে ছাত্ররা রেপ স্যার নামে সম্বোধন করে। উনি নাকি সেটা জানেনও।
মঞ্চের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিপু আর আপ্পু। দর্শকাসনের সামনের দিকে বসে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা। পিছন দিকে সেকেন্ড আর থার্ড সেমিস্টারের ছেলেমেয়েরা। তাদের থেকে সিনিয়াররা কেউ নেই। তারা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। তবে মোচাপার্টি, ছেঁদোপার্টি আর পিএমএফের পান্ডাদের দেখা যাচ্ছে।
এদিক সেদিক দেখে দময়ন্তী চন্দনের পাশে বসে বলল, ‘দু’জন সিনিয়র মিলে নাকি তোকে বেধড়ক র্যাগ করেছে?’
চন্দন দময়ন্তীর দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অবশেষে বলল, ‘একটা ফালতু ঘটনা নিয়ে বড্ডো ফাটছে।’
‘তোকে নাকি জোর করে গাঁজা খাইয়েছে? তুই নাকি চারতলা বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলি? সুব্রতদা আর বান্টিদা তোকে আটকেছে?’
শুকনো হেসে চন্দন বলে, ‘গাঁজা নয়, সিগারেট। আমি স্কুল লাইফ থেকেই স্মোক করি। কাজেই কোনওরকম জোর খাটানো হয়নি। আর ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার গপপোটা কে রটাল বল তো? আমি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘আমি গত শনিবারের পরে আজই এলাম। এসব আমার জানার কথা নয়। আপ্পুদি বলছিল।’ দময়ন্তীর কথা শেষ হওয়ার আগেই তুমুল হাততালি। প্রিন্সিপালের ভাষণ শেষ হয়েছে। ডক্টর পট্টনায়ক চেয়ারে বসার পরে রিপু তিন এইচওডি-কে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করল। এনজি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আজ আমাদের এখানে থাকা মানে তোমাদের বোর করা। টোকেন প্রেজেন্স দিয়ে গেলাম। তোমরা প্রোগ্রাম শুরু করো।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার!’ পিছন থেকে সেকেন্ড আর থার্ড সেমিস্টার হাততালি দিয়ে সেন্ট্রাল হল কাঁপিয়ে দিল।
পিএম চেয়ার থেকে উঠে বললেন, ‘অ্যাই রিপু, কোনও অসভ্যতা যেন না হয়!’
‘না ম্যাডাম। আমরা খুব লক্ষ্মী স্টুডেন্ট। আপনার কথা মনে রাখব। বয়েজ অ্যাট দ্য টপ অ্যান্ড গার্লস অ্যাট দ্য বটম।’ বিনয়ের সঙ্গে মাইকে ঘোষণা করল রিপু। সেকেন্ড আর থার্ড সেমিস্টারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুনরাও এবার হাততালি দিল।
‘ফ্রেশার্স ওয়েলকাম বলতে পারিস, নবীন বরণ বলতে পারিস, ইন্ট্রো বলতে পারিস। হোয়াটস ইন আ নেম? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই কথা বলে গেছেন।’ মাইকে ঘোষণা করল রিপু। তার ঠোঁটের কোণে মিচকেমির হাসি।
‘রবীন্দ্রনাথ না। ওটা ওয়র্ডসওয়র্থ বলেছেন।’ সংশোধন করে আপ্পু। তার ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসি।
‘সব ভালো ভালো কথাই ওয়ার্থলেস সাহেবরা বলবে নাকি? আমি তো বললাম, ‘হোয়াটস ইন আ নেম’? মোদ্দা কথা হল, আজ এখানে তোদের স্টেজে তুলে ব্যাপক মুরগি করা হবে। অ্যালফাবেটিকাল অর্ডারে ডাকব। তোরা এক এক করে আসবি। তোদের একটা টপিক দেওয়া হবে। তার ওপর না ভেবে তোদের এক মিনিট ভাটাতে হবে। যে পারবে না, সে বেদম আওয়াজ খাবে। সেকেন্ড আর থার্ড সেম পচা টমেটো আর ডিম কিনে রেখেছে। সেগুলো ছুঁড়ে মারবে। আর যে ভালো বলবে, তার জন্য টাটকা টমেটো আর ডিম আছে। যে দশজন ছেলেমেয়ে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিস আইএমসি’ খেতাবের জন্য লড়বে, তারা এই গ্রিলিং-এর বাইরে। কেন না তাদের জন্য আলাদা সেশন আছে।’
দর্শকাসনের সামনের দিকে নীরবতা। পিছন দিকে থেকে বেদম হাততালি। রিপু বলল, ‘দেড়শো জনকে মুরগি করা ইজ নট অ্যান ইজি জব। একদম সময় নষ্ট নয়। ফটাফট চলে আয়। নাম্বার ওয়ান, অভিজ্ঞান লাহিড়ী।’
সামনের সারি থেকে অভি মঞ্চে উঠল। পরনে জিনস, টি-শার্ট আর কনভার্স শু। টি-শার্টে লেখা, ‘আই হেট মেসেজ টি-শার্টস!’ রিপু টিশার্ট দেখে বলল, ‘শুরুতেই এই জিনিস! ব্রাভো! তোর টপিক হল, ”শেক ওয়েল আফটার ইউজ”। স্টার্ট।’
অভি টপিকটা বুঝতে দশ সেকেন্ড সময় নিল। সেকেন্ড সেমের গোটা দশেক ছেলে মঞ্চের একদম সামনে চলে এসেছে। তারা হাতে টমেটো নিয়ে গর্জন করছে, ‘বল! তাড়াতাড়ি বল! না হলে তোর টি-শার্ট ভোগে পাঠাব।’
অভি মিনমিন করে বলল, ‘ইয়ে… মানে… ওষুধের শিশি।’
‘কী?’ গর্জন করে রিপু, ‘ওষুধের শিশির গায়ে লেখা থাকে ‘শেক ওয়েল বিফোর ইউজ’। তোর টপিক হল ‘শেক ওয়েল আফটার ইউজ’। ব্যবহারের পর কোন জিনিস ভালো করে ঝাড়িস?’
‘না…মানে…থার্মোমিটার।’ তড়বড় করে বলে অভি, ‘থার্মোমিটার আমরা টেম্পারেচার মাপতে ব্যবহার করি। মাপা হয়ে গেলে পারদকে নামাতে থার্মোমিটার ঝেড়ে নিই।’
‘আর কোনও উদাহরণ? বাথরুমের জন্য?’ আপ্পু পাশ থেকে ফুট কাটে। অভি এখন আর একটু সাবলীল। সে বলে, ‘গামছা। বাথরুমে স্নান করে গা মোছার পর ভিজে গামছা ঝাড়তে হয়।’
‘গুড।’ অভির পিঠ থাবড়ে রিপু বলে, ‘দ্যাট ওয়াজ অভিজ্ঞান লাহিড়ী ফ্রম হাওড়া। এবার আসবে অপলক বিশ্বাস…’
দময়ন্তী বেজায় বোর হচ্ছে। এই জাতীয় ‘জাস্ট আ মিনিট’ বা ‘জ্যাম’ সেশন সে ক্লাস ফাইভ থেকে করে এসেছে। ভীষণ বোকা বোকা লাগে। অধিকাংশ ছেলে আনস্মার্ট। তারা তুতলোচ্ছে। অধিকাংশ মেয়ে বোকা। তারা ন্যাকামি দিয়ে ম্যানেজ করছে। পাশে বসে থাকা চন্দন মঞ্চে ওঠার আগে থরথর করে কাঁপছিল। তাকে রিপু টপিক দিল, ‘তুমি না, একটা ইয়ে!’ চন্দন প্রাথমিক ভাবে ধ্যাড়ালেও ম্যানেজ দিল চমৎকার। ইয়েকে ‘ই-এ’ অর্থাৎ ‘এক্সেপশনাল অ্যানিম্যাল’-এর অ্যাব্রিভিয়েশান বানিয়ে কথা বলা মেয়ে বাঁদরের সঙ্গে নিজের ফুলশয্যার কথা বলল। দাঁত খিঁচুনি থেকে লেজ নাড়া, হুপহাপ করা থেকে লম্ফ দিয়ে খাটে ওঠা—সব অভিনয় করে দেখাল। সেকেন্ড আর থার্ড সেম হাততালি আর শিস দিয়ে অভিনন্দন জানাল।
ঘণ্টাখানেক এইসব সহ্য করার পরে অডিয়েন্স থেকে উঠল দময়ন্তী। বোকাবোকা অনুষ্ঠান দেখার থেকে মিস আইএমসির জন্য রেডি হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
‘ফর হার’ লেখা রুম ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরে বান্টি আর বসে নেই। দরজায় নক করল দময়ন্তী।
‘কে?’ ভেতর থেকে আওয়াজ এল। গলার আওয়াজ শুনে দময়ন্তী আন্দাজ করল এটা বৃন্দা।
‘আমি দময়ন্তী।’
‘ও! হাই!’ দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাল বৃন্দা। বাকি সবাই চলে এসেছে। দময়ন্তী একে একে আলাপ করল শ্রীপর্ণা, জেমসি এবং সাবিনার সঙ্গে। এই কনটেস্টে কে ফার্স্ট হবে সেটা বোঝা না গেলেও কে লাস্ট হবে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল দময়ন্তীর কাছে। সে নিজে। বাকি চারজন সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্বে তার থেকে অনেক যোজন এগিয়ে। বৃন্দা ‘গার্ল নেক্সট ডোর’ টাইপ। শ্রীপর্ণা টিপিক্যাল ‘বেঙ্গলি বমশেল’। সাবিনার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি সারল্য। তবে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দরী হল জেমসি ডিসুজা। কালো শিফনের শাড়ি, লাল ব্যাকলেস চোলি, চোখের পাতায় ধেবড়ে দেওয়া কোহল, পার্লারে গিয়ে স্ট্রেট করা চুল—’সেক্সি’ শব্দটা জেমসিকে ভেবেই তৈরি হয়েছে। দময়ন্তী ভাবল, আপ্পুর ভবিষ্যদবাণী মিথ্যে প্রমাণিত হবে। মিস আইএমসির ক্রাউন এবার বাংলায় থাকবে না।
দময়ন্তী জানে সে সুন্দরী। বাবা-মায়ের সঙ্গে চিত্রশিল্প এবং সাংবাদিকতার হাই প্রোফাইল সার্কেলে ঘোরাঘুরি করে কোন অনুষ্ঠানে কী রকম পোশাক পরতে হয়ে বা সাজতে হয়, এটা খুব ভালো করে জানে। সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে সে ভালো করে মুখ ধুয়ে নিল। স্কিন কালারের সঙ্গে মিলিয়ে মুখে, ঘাড়ে, গলায় আর দু’হাতে হালকা ফাউন্ডেশান লাগাল। ফাউন্ডেশান শুকিয়ে যাওয়ার পরে ভিজে স্পঞ্জ দিয়ে থুপে নিল। বাকি মেকআপ পরে করা যাবে। আপাতত পোশাক বদলানো থাক।
মায়ের কালেকশান থেকে মভ রঙা একটা শাড়ি নিয়ে এসেছে দময়ন্তী। জেজে ভালায়া-র ডিজাইন। ডিজাইনারের গুরুত্ব এখানে কেউ বুঝবে না। শাড়িটা দময়ন্তীর পছন্দ, কেন না দিল্লিওয়ালাদের পছন্দসই হেভি এমব্রয়ডারির কাজ শাড়িটায় নেই। পাড়ে আর আঁচলে হালকা ভার্টিকাল এমব্রয়ডারি। এইরকম প্লেন শাড়ির সঙ্গে পরার জন্য সে নিয়ে এসেছে সাদা কালো ব্লক প্রিন্টের স্লিভলেস জ্যাকেট। চোখ ধাঁধিয়ে যাবে কম্পিউটারাইজড প্রিন্ট দেখলে।
প্যাডেড ব্রায়ের ওপরে জ্যাকেট পরে ওপরের তিনটে বাটন খুলে রাখল দময়ন্তী। পায়ে গলাল চার ইঞ্চির ব্ল্যাক স্টিলেটা। বাঁ হাতে পরল অক্সিডাইজড সিলভারের একগাদা চুড়ি। কানে ড্যাঙ্গলার। চুলটা ঘুরিয়ে এক দিকে ফ্রেঞ্চ রোল করে অক্সিডাইজড সিলভারের বড় পিন লাগল। পোশাক পরা কমপ্লিট। এবার মেকআপ।
ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক লাগিয়ে চোখটা যত্ন করে আঁকল। গালে সামান্য রুজ আর গ্লিটার। চশমা খুলে সি-গ্রিন কনট্যাক্ট লেন্স পরে নিল। সাজ কমপ্লিট। এবার বাইরে যাওয়া যাক।
বাকি চারজন দময়ন্তীকে দেখে চিল চিৎকার জুড়ল। শ্রীপর্ণা চেঁচাল, ‘ওরে বাপরে! এই রকম কম্পিটিটর আছে জানলে আমি নাম দিতাম না।’
বৃন্দা বলল, ‘মরে যাই! মরে যাই!’
জেমসি কড়া গলায় বলল, ‘ইউ হ্যাভ গট নো রাইট টু বি সো সেক্সি।’
বিনা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় আপ্পু ঘরে ঢুকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি স্টেজের বাঁ পাশে গিয়ে দাঁড়া। তোদের প্রোগ্রাম এক্ষুনি শুরু হবে।’
মঞ্চের বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে উইংসের আড়াল থেকে অন্য দিকে তাকাল দময়ন্তী। এখান থেকেই ডান দিকের উইংসের আড়ালে দাঁড়ানো সুরজ মলহোত্রকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। ছেলেটার হাইট অন্তত ছ’ফুট দু’ইঞ্চি। মডেলদের মতো গুড লুকিং। সুরজের আড়ালে দীপ, প্রবাল, সঞ্জয় আর সবুজকে দেখা যাচ্ছে না।
এই অনুষ্ঠানের এমসি বা মাস্টার অব সেরিমনি টিনটিন। ছেলেটা বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি, তিনটে ভাষাতেই সাবলীল। দুর্দান্ত সেন্স অব হিউমার। কথা বলে ভীষণ ভালো। গানের গলা চলনসই। মঞ্চে ওঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যে অডিয়েন্সের পালস হাতের মুঠোয়।
দময়ন্তীর ভয় ছিল যে আর পাঁচটা বিউটি কনটেস্টের কায়দায় ক্যাটওয়াক করতে হবে। টিনটিনের ইনট্রোডাকশানে ভুল ভাঙল। অনুষ্ঠানটির নামেই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার ছায়া। আসলে সেজেগুজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইনট্রো দেওয়া আর কিছু একটা পারফর্ম করা—এর ওপরে ভিত্তি করে মিস্টার অ্যান্ড মিস আইএমসি-র ক্রাউন মাথায় ওঠে।
টিনটিনের আহ্বানে বাঁদিক থেকে মঞ্চে এন্ট্রি নিল পাঁচ মেয়ে। আপ্পু হাইটের হিসেবে ওদের সাজিয়েছে। সাবিনা সবচেয়ে বেঁটে। সে ঢুকল প্রথমে। তারপর যথাক্রমে শ্রীপর্ণা, দময়ন্তী, বৃন্দা এবং জেমসি। হাততালির চোটে কানে তালা লাগার জোগাড়। অনেক কষ্টে অডিয়েন্সকে থামিয়ে টিনটিন ছেলেদের ডাকল। একে একে মঞ্চে এল সবুজ, প্রবাল, দীপ, সঞ্জয় এবং সুরজ। আবার কান-ফাটানো হাততালি।
মুখে প্লাস্টিকের হাসি সেলাই করে, চড়া আলোর মধ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী খেয়াল করল, মঞ্চের ঠিক সামনে টেবিল পেতে তিন বিচারক বসে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় স্কোরশিটে টিক মারছে। আপ্পু, রিপু এবং লাটু। মনটা হালকা হল দময়ন্তীর। এটা খুব চাপের কোনও ব্যাপার নয়!
প্রথম রাউন্ডে সকলের ইনট্রো হয়ে গেল মসৃণভাবে। দ্বিতীয় রাউন্ডে পারফরম্যান্সের পালা।
সাবিনা গিটার বাজিয়ে গান গাইল, ‘মুসু মুসু হাসি দেও মা লাই লাই…’ মেয়েটার গিটারের হাত চমৎকার। গানটাও মন্দ গায় না। মাথা নিচু করে তিন বিচারক নম্বর লিখল। টিনটিন প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা সাবিনা, তুই বল দেখি, হাসব্যান্ড তার প্রেগন্যান্ট স্ত্রীকে নিয়ে নার্সিংহোমে না গিয়ে পিৎজা হাটে গেল কেন?’
‘জানি না।’ সামান্য চিন্তা করে হাল ছেড়ে দেয় সাবিনা।
টিনটিন বলে, ‘উত্তরটা হল, ফ্রি ডেলিভারির জন্য। এনিওয়ে, তুই একপাশে দাঁড়া। শ্রীপর্ণা আয়। বল, তুই কী করবি?’
শ্রীপর্ণাও গান গাইল। একটা নয় তিনটে। কারাওকে চালিয়ে আশা ভোঁসলের তিনটে গানের মিশ্রণ। তিনটেই ক্যাবারে নাম্বার। হাততালি আর শিস বুঝিয়ে দিল দর্শক শ্রীপর্ণাকে পছন্দ করেছে।
এবার প্রশ্নের পালা। টিনটিন বলল, ‘ছেলেদের সঙ্গে টিভি কমার্শিয়ালের মিল কোথায়?’
‘একটা কথাও বিশ্বাস করা যায় না।’ একগাল হেসে বলে শ্রীপর্ণা।
টিনটিন বলল, ‘আমাদের নিয়ম হল তোকে আউট না করা পর্যন্ত প্রশ্ন করে যেতে হবে। এবার তুই বল, হোয়াট কমন বিটুইন মেগা সিরিয়ালস অ্যান্ড গার্লস?’
‘দুজনেই শুরু করলে থামতে চায় না। বোথ গো অন অ্যান্ড অন অ্যান্ড অন…’
‘এটাও পেরে গেলি। তাহলে বল, ছেলেদের সঙ্গে ব্যাটারির তফাত কোথায়?’
‘ব্যাটারির পজিটিভ সাইড আছে।’ তুরন্ত উত্তর শ্রীপর্ণার।
টিনটিন বিরক্তির অভিনয় করে বলল, ‘বড্ড ফুটেজ খাচ্ছিস। এবার তোকে ফোটাব। বল, একটা বোকা মেয়ে কিছু না পরে অতিথিদের খাবার পরিবেশন করছিল কেন?’
অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শ্রীপর্ণা হাল ছেড়ে দিল। টিনটিন বলল, ‘যাওয়ার আগে উত্তরটা শুনে যা। রান্নার বইতে লেখা ছিল, ”সার্ভ উইদাউট ড্রেসিং”।’
হাততালির মধ্যে শ্রীপর্ণা সরে দাঁড়াল। এবার দময়ন্তীর পালা। সে গান জানে না। নাচও জানে না। ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছে। রিপু বিচারকের আসন থেকে মাইক্রোফোনে বলল, ‘তোকে পারফর্ম করতে হবে। ধরে নে তুই আমাদের হাসপাতালের হেল্পলাইনের টেলিফোন অপারেটার। তোর কাছে ফোন আসছে। তুই কী ভাবে ডিল করবি?’
একটু ভেবে দময়ন্তী বলল, ‘সাইকায়াট্রির হেল্পলাইন হলে হবে?’
‘হবে। অ্যান্ড ইয়োর টাইম স্টার্টস নাও।’
‘মানসিক রোগের বিভাগে আপনাকে স্বাগতম।।’ এয়ার টাইম প্রোভাইডারদের হেল্পলাইনে ফোন করলে রেকর্ডেড ভয়েস যেভাবে কথা বলে, অবিকল সেই কায়দায় বলতে থাকে দময়ন্তী, ‘আপনি যদি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারের রোগী হন, তা হলে এক নম্বর বাটন বারবার টিপতে থাকুন। আপনি যদি মানসিক ভাবে অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হন বা ”কো-ডিপেন্ডেন্ট” হন তা হলে কাউকে বলুন দু’নম্বর বাটন টিপে দিতে। আপনি যদি মালটিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের রোগী হন, তা হলে তিন, চার, পাঁচ এবং ছয় নম্বর বাটন টিপুন।’
অডিয়েন্স হো-হো করে হাসছে। একদম পিছনের সিটে বসে সব্যসাচী আর বিলুও হাসছে। সব্যসাচী বলল, ‘এটা পুরনো জোক। মেয়েটার কমন পড়ে গেছে।’
বিলু বলল, ‘ভালোই তো। ঠিক জায়গায় ব্যবহার করছে।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু ইনটেলিজেন্স বা উইট দিয়ে মিস আইএমসি জেতা যায় না। যে বেশি লাজুক হবে, ফ্লার্ট করবে, ব্রেনলেস বিউটির অ্যাক্টিং করবে, সে ফার্স্ট হবে।’
বিলু সব্যসাচীর কথা শুনছে না। সে একদৃষ্টিতে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটা দেখতে ভালো। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ আছে। পারসোনালিটিও স্ট্রং। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্মার্টলি যান্ত্রিক গলায় বকে চলেছে, ‘আপনি যদি প্যারানয়েড হন, তা হলে জেনে রাখুন যে আপনি এখন কোথায় আছেন সেটা কিন্তু আমরা জানি। আপনি কী করছেন, সেটাও জানি। আপনি ওখানেই থাকুন। আমরা আপনাকে খুঁজে নেব।’
আবার হাততালি। দয়মন্তী বলছে, ‘আপনি যদি স্কিতসোফ্রেনিক হন, তা হলে মন দিয়ে শুনুন। একটা সরু কণ্ঠস্বর আপনাকে নির্দেশ দেবে, কোন বাটনটা টিপতে হবে। আপনি যদি ম্যানিক ডিপ্রেসিভ হন তা হলে কোনও বাটন টিপে লাভ নেই। কেউ আপনার কল গ্রহণ করবে না। আপনি যদি ডিসলেক্সিক হন তা হলে ছয়নয়ছয়নয়নয়ছয়নয়নয়ছয় টিপুন।’
সব্যসাচী পেটে হাত চেপে বলল, ‘এই মেয়েটা কে রে? হাসতে হাসতে পেট ফেটে গেল।’
সব্যসাচীর কথায় বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল বিলু। মহা ঝামেলা তো! শুনতেও দেবে না!
‘আপনি যদি ডিলিউসনাল হন তা হলে সাত টিপুন। আপনার কল অন্য গ্রহের স্পেসশিপে ট্রান্সফার করা হচ্ছে। আপনি যদি অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাংজাইটিতে ভোগেন, তা হলে টেলিফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করুন। আমাদের প্রতিনিধি আপনাকে খুঁজে নেবেন। আপনি যদি বাই-পোলার ডিজঅর্ডারের রোগী হন, তা হলে ”বিপ” শোনার পরে আপনার বক্তব্য জানান, অথবা ”বিপ” শোনার আগে আপনার বক্তব্য জানান, অথবা ”বিপ”-এর জন্য অপেক্ষা করুন।’
‘ন’নম্বর বাটনটা বাকি আছে।’ বিচারকের আসন থেকে চেঁচাল রিপু। মিষ্টি হেসে রিপুর দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বাটন টিপুন।’
‘এটা বোঝা গেল না।’ চ্যাঁচাল আপ্পু।
যান্ত্রিক গলায় দময়ন্তী বলতে লাগল, ‘আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বোতাম টিপুন। আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বোতাম টিপুন। আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বোতাম টিপুন…’
অডিয়েন্স হাসিতে ফেটে পড়ছে। রিপু হাসতে হাসতে বলল, ‘উফফ! এবার শেষ কর।’
দময়ন্তী অডিয়েন্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যদি ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের রোগী হন, তা হলে অবিলম্বে ফোন রেখে এখান থেকে কেটে পড়ুন। আপনাকে নিয়ে আমরা ফালতু সময় নষ্ট করব না।’
টিনটিন এগিয়ে এসে বলল, ‘তুইও প্রচুর ফুটেজ খেয়েছিস। তোর জন্য কোনও প্রশ্ন নেই। একপাশে সরে দাঁড়া। বৃন্দা এদিকে আয়। তুই কী করবি?’
সবাই হাততালি দিচ্ছে। বৃন্দা মঞ্চের মাঝখানে আসছে। সেদিকে না তাকিয়ে বিলু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে দময়ন্তীর দিকে। কোনও মেয়েকে দেখে আজ পর্যন্ত সে এতটা পাগল-পাগল হয়নি। এই অনুভূতি প্রথম। একে কি ভালোলাগা বলে? একে কি ভালোবাসা বলে? এই কি প্রেম?
নাঃ! আপন মনে মাথা ঝাঁকায় বিলু। এটা পাগলামি। থিয়োরিটিক্যালি সে এই মেয়েটির প্রতি সেক্সুয়ালি অ্যাট্রাকটেড। তার লেখাপড়া শেখা শিক্ষিত মন যৌন আকর্ষণকে প্রেম বলে চালাবার চেষ্টা করছে। দাবাং সিনেমায় ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানের সঙ্গে মালাইকা অরোরাকে নাচতে দেখে তার যেমন প্রেম পেয়েছিল, দময়ন্তীকে দেখে তেমনই প্রেম পাচ্ছে।
তাই কি? নিজেকে প্রশ্ন করে বিলু। উত্তর না পেয়ে সেন্ট্রাল হল থেকে বেরিয়ে আসে। বেশ রাত হয়েছে। এবার এখানে টিনটিনের লেখা ‘ফিফটি ফিফটি’ নাটকটা হবে। তারপরে মোচ্ছব শুরু হবে। তার আগে হোস্টেলে ফেরা যাক। বেশি রাতে আবার আসতে হবে। মাল খেয়ে ছেলেমেয়েগুলো এখানে ওখানে পড়ে থাকবে। তাদের পাঁজাকোলা করে হস্টেলে পৌঁছে দিতে হবে অথবা ট্যাক্সি ধরিয়ে দিতে হবে। পিএমএফের সদস্য ও নেতা হিসেবে এটা তার কর্তব্য।
হাঁটতে হাঁটতে আবার দময়ন্তীর মুখটা মনে পড়ে বিলুর। ধুস! কী যে হচ্ছে!