বৃন্দা
‘কী রে, সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এইচওডি-দের ইনট্রো শেষ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মনোসিলেবলে কথা বলছিস কেন? আশে পাশে কেউ আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সিনিয়র?’
‘হ্যাঁ।’
‘ক্যান্টিনে রয়েছিস? র্যা গিং পর্ব চলছে?’
‘আমি পরে কথা বলব।’ কুট করে ফোন কেটে মোবাইল ব্যাগে ঢোকায় বৃন্দা। সে এসএলটি থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে চলেছে। সঙ্গে একগাদা ব্যাচমেট। এখন বাবার সঙ্গে গপপো করা সম্ভব? বাবাটা এত কনট্রোল ফ্রিক না!
আজ সকালবেলা তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বৃন্দার। অন্যদিন সে সকাল সাড়ে সাতটার আগে বিছানা ছাড়ে না। প্লাস টু বা জয়েন্টের প্রিপারেশনের সময় যখন দিনে ষোল থেকে আঠারো পড়াশুনা করতে হতো, তখনও সকাল সাড়ে সাতটার আগে বিছানা ছাড়ত না। রাত জাগতে অসুবিধে না হলেও, ভোরে উঠতে বৃন্দার তীব্র অনীহা। বৃন্দা কখনও সূর্যোদয় দেখেনি। দেখেনি খবরের কাগজওয়ালাকে।
আজ সকালবেলা সূর্যোদয় না দেখলেও কাগজওয়ালাকে দেখতে পেয়েছে বৃন্দা। কেন না আজ ভোর ছটায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। চাদরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা এসির রিমোট হাতড়ে এসি বন্ধ করেছিল। চাদরে মাথা মুড়ি দিয়ে, জোর করে চোখ বুঁজে আরও কিছুক্ষণ ঘুমোনোর চেষ্টা করেছিল।
ঘুম আসেনি। সাইড টেবিলে রাখা ডিজিটাল ক্লকের টকটক শব্দে বোর হয়ে মিনিট খানেকের মধ্যেই ‘ধুত্তেরিকা’ বলে বিছানায় উঠে বসেছিল। বড়সড়ো আড়মোড়া ভেঙে নিজের ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়েছিল।
সমীরণ-মন্দিরার মাস্টার বেডরুমের লাগোয়া বৃন্দার ঘর। কুড়ি বাই কুড়ি ঘরটাকে বৃন্দা মনের মতো সাজিয়েছে। তিনদিকের দেওয়ালের রং বেবি পিঙ্ক। একদিকের দেওয়াল টমেটোর মতো লাল। টমেটো-লাল দেওয়ালের বিশাল জানলার গায়ে তার খাট। দুদিকে পড়ার টেবিল আর বুককেস। মাল্টিফাংশনাল ফারনিচারের রং, দেওয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে, গোলাপি। কাঠের নয়। অদ্ভুত কোনও মেটিরিয়ালে তৈরি। সামান্য স্পর্শেই বুককেসের ঢাকনা ওপরে উঠে যায়, বক্স খাটের নীচের বাক্স বাইরে বেরিয়ে আসে, পোশাকের আলমারির দরজা খুলে যায়।
বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ের চাদর পাট করে খাটের তলার বাক্সয় ঢোকায় বৃন্দা। নানা রঙের প্যাচওয়ার্ক করা বেডকভার বার করে। বেডশিট টানটান করে, ঝাড়ন দিয়ে ঝেড়ে, তার ওপরে বেডকভার পেতে দেয়। বাক্স থেকে বার করে নানা শেপ ও সাইজের একগাদা কুশন। কোনওটা বর্গক্ষেত্র, কোনওটা গোল, কোনওটা হার্ট শেপের। লাল, সাদা ও গোলাপির কম্বিনেশন। খাটের প্রান্তে, দেওয়ালের গায়ে কুশনগুলো সাজিয়ে দূর থেকে একবার দেখে নেয়। ধুস! পছন্দ হচ্ছে না। কাছে এসে কুশনগুলো অন্যভাবে সাজায়। এবারও কি ঠিক হল? কে জানে!
নিজের ওপরে বিরক্ত হয় বৃন্দা। এই হল মুশকিল। কোনটা যে তার ভালো লাগে, আর কোনটা লাগে না, আজও জানা হয়ে উঠল না। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত বাবা নিয়েছেন। কোন স্কুল? মডার্ন হাই। কোন স্ট্রিম? সায়েন্স। জয়েন্ট এনট্রাস কীসে বেশি গুরুত্ব? বায়োলজি। ইঞ্জিনিয়ারিং আর ডাক্তারি দুটোতেই চান্স পাওয়া সত্ত্বেও কোনটা পড়তে হবে? ডাক্তারি। স্যামি বলে দিয়েছেন আর বৃন্দা মেনে নিয়েছে। মেনে নিতে তার কি কোনও অসুবিধে হয়েছে? না। অন্তর থেকে কোনও প্রতিবাদ এসেছে? না। সে জানে, সমীরণ যা করছেন, ভালোর জন্যই করছেন। ফালতু মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?
কিন্তু জীবনের ছোট ছোট জিনিসগুলোতে ডিসিশন নিতে প্রবলেম হলে তো আর স্যামিকে ডাকা যায় না! আজ সে কলেজে স্যামির সঙ্গে গাড়িতে যাবে না বাসে করে যাবে—এইটা একটা প্রবলেম। কুশনগুলো ঠিকমতো সাজানো হল না, এটা আর একটা প্রবলেম। এসি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে গরম লাগতে শুরু করেছে—এটা তিন নম্বর প্রবলেম।
হাই তুলতে তুলতে বৃন্দা বুঝতে পারল, প্রথম সমস্যার সমাধান স্যামি করবেন। দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান করবে ঝুনুর মা। বৃন্দা কলেজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে, প্যাচওয়ার্কের বেডকভার তুলে, বিছানা ঝেড়ে, সারা ঘর ডাস্টিং করে, রুম ফ্রেশনার ছড়িয়ে, এখানে ওখানে পড়ে থাকা বই, আইপড, টেডি বিয়ার, টি-শার্ট, ডায়েট কোকের ক্যান সরিয়ে ঘর সাফ করে দেবে শান্তিধামের উওম্যান ফ্রাইডে। ঝুনুর মা।
তিন নম্বর সমস্যার সমাধান করতে কাচের দরজা সরিয়ে বারান্দায় পা রাখে বৃন্দা। শান্তিধাম এস আর দাস রোডের এপারে। ওপারে রবীন্দ্র সরোবর। চলতি কথায় লেক। সকাল ছ’টার সময় দিব্যি রোদ উঠে গেছে। লেকের বাউন্ডারি বরাবর পোঁতা বট, অশ্বত্থ, জারুল, ছাতিম, কদম গাছের সতেজ সবুজ পাতা রোদ খেয়ে ঝিলমিল করছে। এস পি মুখার্জি রোড দিয়ে গুড়গুড় করে যাচ্ছে ট্রাম। স্টেশনে নেমে রাস্তা আর গলি বরাবর ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মেয়ে-বউয়ের দঙ্গল। শহরের বাবুদের বাড়ির কাজের লোক। চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইসব দেখতে দেখতে হকারকে দেখতে গেল বৃন্দা। সাইকেলের কেরিয়ারে রাখা কাগজের বান্ডিল থেকে একতাড়া কাগজ আর গোটা পাঁচেক ম্যাগাজিন সুলতানের হাতে তুলে দিল ছেলেটা। সাইকেল চালিয়ে মুদিয়ালির ভেতরে ঢুকে গেল।
শান্তিধামে অনেক কাগজ আসে। নার্সিংহোমের প্রতি কেবিনে কাগজ দেওয়া হয়। সিস্টার, আরএমও, অন্যান্য স্টাফেদের জন্যও কাগজ আসে। বিলি বন্দোবস্ত হওয়ার পরে চারতলায় পৌঁছয় দুটো ইংরিজি কাগজ, তিনটি বাংলা কাগজ এবং অজস্র পত্রিকা। স্যামি ইংরিজি কাগজের ফ্রন্ট পেজ আর খেলার পাতায় চোখ বোলান। পাঁচটা কাগজ সারা দিন ধরে শেষ করেন মন্দিরা। এছাড়াও বাংলা ভাষায় যত রকমের পত্রিকা বেরোয় তা মন্দিরার হাতে চলে আসে। অবসরপ্রাপ্ত নায়িকা চূড়ান্ত গ্রন্থপ্রেমিক।
বৃন্দা দুটো ইংরিজি কাগজ আর একটা বাংলা কাগজ পড়ে। এটাও স্যামির নির্দেশ। ‘ইংরিজি কাগজের ট্যাবলয়েড সেকশন পড়া লো আই কিউ ইউথ’ স্যামির পছন্দ নয়। সুতরাং বৃন্দা আগাপাশতলা কাগজ পড়ে। একাধিক কাগজ পড়ে বলে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা আছে।
হকার ছেলেটির বয়স বৃন্দার আশেপাশে। জিনস আর সলিড চেকসের শার্ট পরা। পায়ে কাবলি জুতো। চারতলা থেকে উচ্চতা বোঝা যায় না। তবে সাইকেলের ক্যারিয়ারে যে পরিমাণ কাগজ রাখা ছিল, তার যা হাইট, ছেলেটার হাইট তার সমান। অ্যারাউন্ড পাঁচ আট হবে। এই ছেলেটাকে এতদিন বৃন্দা কেন দেখেনি কে জানে?
বারান্দায় বেতের তৈরি একটা দোলনা আছে। আরাম করে বসার জন্য কুশন পাতা। সেখানে বসে আপনমনে কয়েকবার ঘুরপাক খেল বৃন্দা। আজ মনটা উড়ুউড়ু লাগছে। মনে হচ্ছে, আজ একটা কিছু হবে। একটানা ঘুরপাক খেতে থাকে সে।
ঝুনুর মা চা নিয়ে এসেছে। রঙিন পাথর বসানো কাঠের ট্রেতে বড় এক চা আর একটা কুকি। আর্চিজের স্টল থেকে কাপটা নিজে পছন্দ করে কিনেছিল বৃন্দা। হালকা গোলাপি রঙের কাপে গাঢ় লাল দিয়ে স্মাইলি আঁকা। দোলনার পাশের টেবিলে ট্রে রেখে ঝুনুর মা বলল, ‘অনেকক্ষণ উঠেছ নাকি? অন্যদিন তো ঘুম থেকে তোলার জন্য দশবার ডাকতে হয়।’
‘কুকি নিয়ে যাও। এখনও মুখ ধুইনি।’ ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলে বলল বৃন্দা, ‘হ্যাঁ, আজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। তখন হকার আমাদের কাগজ দিচ্ছিল।’
‘হকার?’ মুখে আঁচল গুঁজে একচোট হেসে নেয়ে নেয় ঝুনুর মা। ‘ওটা তো আমার ছেলে। ঝুনু!’
‘তাই?’ অবাক হতে গিয়ে নিজেও হেসে ফেলে বৃন্দা। ঝুনুর মা তাদের বাড়িতে থাকে। দু’সপ্তাহে একদিন বাড়ি যায়। সাউথ লাইনে গোচারণ নামের একটা স্টেশনে তার বাড়ি। ঝুনুর মায়ের যে নিজস্ব কোনও নাম থাকতে পারে, এটা কখনও মনে হয়নি। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলে, ‘ঝুনুর মা, তোমার আসল নাম কী?’
‘মাধবী!’লজ্জায় বেগুনি হয়ে কুকি সমেত ট্রে নিয়ে বারান্দা থেকে পালাল ঝুনুর মা।
আজ সকালে নানান নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে তো! ফিকফিক করে হাসে বৃন্দা। তাদের বাড়িতে যে কাগজ দেয় তার নাম ঝুনু। তাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার নাম মাধবী। এবং মাধবীই ঝুনুর মা। এতগুলো তথ্য সে জানত না। আশ্চর্য!
চা খেতে খেতে মাধবী নামটা নিয়ে সামান্য ভাবে বৃন্দা। মাধবীর সূত্র ধরে এসে গেল চারুলতা। মন্দিরা এই সিনেমাটা সুযোগ পেলেই ডিভিডিতে দেখেন। ছবিটার ইংরিজি নাম ‘দ্য লোনলি ওয়াইফ’। এই নামটা মন্দিরাকে দিব্যি মানায়। টালিগঞ্জ কাঁপানো অভিনেত্রী এখন লোনলি ওয়াইফ ছাড়া আর কী?
মায়ের যখন একটা নাম হল, তখন বাবারও একটা নাম দেওয়া জরুরি। এটা নিয়ে বিশেষ ভাবতে হল না। মনে মনে বৃন্দা বাবাকে ‘কনট্রোল ফ্রিক’ বলে ডাকে। যেমন ঝুনুর মাকে ‘উওম্যান ফ্রাইডে’ নামে ডাকে। ঝুনুর কোনও নাম দেওয়া যায় কি? অনেক ভেবেচিন্তে বৃন্দা ঝুনুর একটা বাংলা নাম রাখল। ‘সুপ্রভাত’। সকালে যে খবরের কাগজ সাপ্লাই করে ঘুম ভাঙায়, তার পক্ষে উপযুক্ত নাম।
বৃন্দার নামকরণ প্রকল্প থামিয়ে দিয়ে বারান্দায় এলেন মন্দিরা। বলল, ‘কাল রাতে তুই জিজ্ঞাসা করেছিলি কখন বেরোবি। তোর বাবা রাউন্ডে যাওয়ার আগে বলে গেছে রেডি হয়ে থাকতে। ও আজ সওয়া নটার সময় বেরোবে।’
খালি চায়ের কাপ মন্দিরাকে ধরিয়ে বৃন্দা বলে, ‘এখন সাতটাই বাজেনি।’
‘না বাজুক। তুই স্নান সেরে ফেল। প্রথম দিন কী পরে কলেজে যাবি? কিছু ভেবেছিস?’
‘কী পরব?’ গালে হাত দিয়ে ভাবে বৃন্দা। ‘রোজই তো জিনস আর টপ পরি। আজ অন্য কিছু পরতে যাব কেন?’
‘তোর বাবা বলছিল সালওয়ার কামিজ পরতে। খুব গডি কিছু না। সোবার টাইপের।’
‘বাবা যখন বলে দিয়েছে, তখন কী পরব এটা জিজ্ঞাসা করার কী দরকার ছিল?’ মৃদু প্রতিবাদ করে নিজের ঘরে ফিরে আসে বৃন্দা।
তিনটে কাগজ পড়ে, ল্যাদ খেয়ে, আর এককাপ চা খেয়ে বাথরুম ঢুকল বৃন্দা। তার বাথরুম বেশ বড়। বাথটাব আছে, তবে সেটা বছরে এক-দুবারের বেশি ব্যবহার করে না। বড্ড জল নষ্ট হয়। মুখ ধোওয়া থেকে শুরু করে স্নানপর্ব চুকোতে সময় লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। চুল শুকোতে মিনিট পনেরো লাগবে। ততক্ষণে খেয়ে নেওয়া যাক। সালওয়ার কামিজ গলিয়ে, মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে খাবার টেবিলে বসে বৃন্দা। স্যামি আর মন্দিরা চা খাচ্ছেন।
স্যামি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। সপ্তাহে পাঁচদিন রোয়িং করতে যান। ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছ’টা বাজে। স্নান ও ভারি প্রাতঃরাশ সেরে সাতটা থেকে শান্তিধামে ভরতি থাকা রোগীদের দেখাশোনা। সার্জিকাল পেশেন্টদের নানা সমস্যা থাকে। ড্রেসিং চেঞ্জ করা, ইনফেকশান থাকলে আবার কাটাছেঁড়া করে নতুন সেলাই দেওয়া, বিকেলবেলা অপারেশান থাকলে প্রি-অপারেটিভ চেক আপের বন্দোবস্ত করা, অ্যানাসথেটিসটের সঙ্গে যোগাযোগ—এইসব চুকিয়ে ওপরে আসতে সাড়ে আটটা বেজে যায়। এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে যান স্যামি।
আজ রুটিন ঢিলেঢালা। রাউন্ডের দায়িত্ব কুনাল আর তাপসীর ওপরে ছেড়ে দিয়ে স্যামি খাবার টেবিলে বসে রয়েছেন। এখনও স্নান করেননি। দাড়িও কামাননি। গতরাতে মদ্যপান বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে চোখ দুটো লাল টকটক করছে। চোখের নীচে কোহল-পাউচ। দেখে বিরক্ত হল বৃন্দা। স্যামিকে এইরকম হ্যাগার্ড চেহারায় দেখতে সে অভ্যস্ত নয়। মনে মনে স্যামির তিন শিল্পী বন্ধু, সুদিন-বিপিন-মনোতোষের নাম দিল ‘থ্রি উইচেস’। ম্যাকবেথের তিন ডাইনির অনুকরণে। ওঁদের জন্যই স্যামি রোজ রাতে মদ খান। ডাইনিদের শান্তিধামে ঢোকা বন্ধ করতে হবে। বিরক্ত হয়ে বৃন্দা স্যামিকে বলল, ‘চা পরে খাবে। আগে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে এসো।’
স্যামি এইরকম একটা হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আধখাওয়া চা ফেলে বাথরুমে সেঁধোলেন। ঝুনুর মা টেবিলে রেখেছে বৃন্দার ব্রেকফাস্ট। সেদ্ধ সবজি, দুটো স্যাঁকা পাউরুটি আর ডিমসেদ্ধ। খেতে খেতে বৃন্দা মন্দিরার দিকে তাকাল। মন্দিরা মন দিয়ে পূজাবার্ষিকী পড়ছেন। তাঁকে না ঘাঁটিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করল। দেওয়াল ঘড়িতে নটা। এবার বেরোনো উচিত।
নিজের ঘরে ঢোকে বৃন্দা। চুল আঁচড়ে, সামান্য গন্ধ মেখে যখন বেরোয়, ঘড়িতে সওয়া ন’টা। স্যামি হাসপাতাল যাওয়ার জন্য রেডি। সদ্যস্নাত, সদ্য শেভ করা স্যামি আবার আগের চেহারায়। ঝকঝকে, তকতকে, স্মার্ট, ব্যক্তিত্ববান। তাঁকে দেখে থামস আপ করে বৃন্দা।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল স্যামি বৃন্দাকে মৌলালির মোড়ে নামিয়ে দেবেন। শান্তিধাম থেকে বেরোনোর সময় মেয়ের মস্তক-চুম্বন করে মন্দিরা বললেন, ‘প্রথম দিন। ওকে কলেজে ঢুকিয়ে দিও। মেয়েটা কোনও দিন রাস্তাঘাটে একা চলাফেরা করেনি।’
নিজের ক্যাবলামির কথা ভেবে লজ্জা হয়েছিল বৃন্দার। এস আর দাস রোড আর মডার্ন হাই স্কুল গাড়িতে যাতায়াত করা আর মাঝে মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখা ছাড়া সে কলকাতা শহরের রাস্তায় কখনও একা বেরোয়নি। কী লজ্জার ব্যাপার!
স্যামি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের গেটের ভিতরে গাড়ি ঢুকিয়ে মেয়েকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। ঢোকার মুখেই সেন্টিনারি বিল্ডিং। ছ’তলা বাড়ি জুড়ে গাইনিকলজি আর অবস্টেট্রিক্স ডিপার্টমেন্ট। গর্ভবতী মায়েদের জন্য অপেক্ষারত বাড়ির লোকের ভিড়ে গেটটা মেছোবাজার হয়ে আছে। বৃন্দা গাড়ি থেকে নামার আগে স্যামি বলেছিলেন, ‘খানিকটা হেঁটে গেলেই এলএলটি। একা যেতে পারবি তো?’
ভয়ে বুক ধুকপুক করছিল। তাও বৃন্দা বলেছিল, ‘তুমি বাড়াবাড়ি কোরো না তো! আমার এখন আঠারো বছর বয়স। আমি এখন অ্যাডাল্ট।’
এখন, অন্য ব্যাচমেটদের সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বৃন্দার মনে হল, সিনিয়রদের হুকুমে ক্যান্টিনে তো যাচ্ছে! ওখানে র্যাগিং-এর নামে টর্চার হবে না তো? সমীরণের মুখে শুনেছে, মেডিক্যাল কলেজে র্যাগিং হয় না। সিনিয়ররা জুনিয়রদের সামান্য লেগপুল করে। যার অফিসিয়াল নাম ইন্ট্রো । সে তো যে কোনও জায়গাতেই নতুনদের নিয়ে মজা করা হয়। কলেজ বা অফিস আলাদা কিছু না। এখানেও সেইরকম কিছু হবে? না হিন্দি সিনেমায় বা বাংলা সিরিয়ালে যেমন দেখায়, সেইরকম আজেবাজে কাজ করতে বলবে? ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ সিনেমার র্যাগিং সিকোয়েন্সটা মনে পড়ে গেল বৃন্দার। জাঙিয়া পরা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেগুলো ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ গানের সঙ্গে নাচছিল। একটা মোটকা ছেলের ভুঁড়ি নাচানো দেখে খুব হেসেছিল বৃন্দা। আজ গিলটি ফিলিং হচ্ছে। এটাও মনে হচ্ছে, সিনেমায় ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেগুলোকে বাঁচাতে মামু ওরফে মুন্নাভাই এনট্রি নিয়েছিল। এখানে কোনও সঞ্জয় দত্ত নেই।
ক্যান্টিনের দরজায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে রিপুদমন কর। আঙুলের ইশারায় পুরো দলটাকে ডাকল। সঙ্গে কে কে এল খেয়াল না করে বৃন্দা রিপুর সামনে দাঁড়াল। রিপু বলল, ‘ভেতরে গিয়ে বোস।’
বৃন্দা ক্যান্টিনে ঢুকল। হিন্দি সিনেমায় যেমন ঝাঁ চকচকে, রঙিন, আর্চির কমিক স্ট্রিপ মার্কা ক্যান্টিন দেখা যায়, তার সঙ্গে এই ক্যান্টিনের কোনও মিল নেই। পুরনো দিনের দেওয়ালে হালকা হলুদ রং করা। অল্প কয়েকটা টিউবলাইটের মিটমিটে আলোয় অন্ধকার কাটেনি। দুটো ঘর জুড়ে ক্যান্টিন। ভিতরের ঘরের দেওয়াল চৌকো করে কেটে কাউন্টার বানানো হয়েছে। সেই কাউন্টার থেকে খাবার সাপ্লাই হচ্ছে। কাউন্টারের ওপারের রান্নাঘরটি কুচকুচে অন্ধকার। সেখানে কী সাপব্যাং রান্না হচ্ছে কে জানে! কাউন্টারের পাশে, ঢকঢকে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে রয়েছে মাঝবয়সি এক বুড়ো। প্যান্টশার্ট পরা বুড়ো বৃন্দাকে দেখে বলল, ‘ফার্স্ট ইয়ার? আমার নাম জীবনদা। এই ক্যান্টিনের নাম জীবনদার ক্যান্টিন। কী খাবে বলো।’
ক্যান্টিনের দেওয়ালে কালো স্লেটপাথর বসানো। তাতে চক দিয়ে আজকের মেনু লেখা। চাউমিন, ফ্রায়েড রাইস, পিজা—তিনরকম খাবারের ছটা করে ভ্যারিয়েশন। ভেজ, এগ, চিকেন, মাটন, এগ-চিকেন এবং এগ-মাটন। এছাড়া ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, পোনা মাছের কালিয়া আর চিলি চিকেন রয়েছে। চা, কফি, কোল্ড ড্রিংক্স, মিনারেল ওয়াটারের কথা বোর্ডে লেখা না থাকলেও সেগুলো দৃশ্যমান। এবং অবশ্যই সিগারেট। বসার জায়গা বলতে সানমাইকা লাগানো চেয়ার এবং বড় বড় টেবিল। দেখেশুনে বৃন্দার ভক্তি হল না। সে জীবনদাকে বলল, ‘এখন খাব না।’
জীবনদা অন্য লোকের অর্ডার নেওয়ায় ব্যস্ত। কথা কানে গেল না। বৃন্দা টুকটুক করে বাইরের ঘরটায় এল। এখানে কাউকে একটা খোরাক করা হচ্ছে। সিনিয়র দাদাদিদিরা বড় টেবিল জুড়ে গোল হয়ে বসে বেঁটে, কালো এক ফার্স্ট ইয়ারকে ব্যাপক রগড়াচ্ছে। একে চেনে বৃন্দা। একটু আগেই আলাপ হয়েছে। ‘বোমা বস’ ওরফে চন্দন।
আপ্পু চা খেতে খেতে হাঁক পাড়ল, ‘এই বৃন্দা, শোন এদিকে।’
বৃন্দা টেবিলের পাশে দাঁড়াল। রিপু চন্দনকে বলল, ‘একটা নন ভেজ জোক বল। মাইন্ড ইট, কোনও নোংরা কথা যেন না থাকে। তাহলে ক্যাল খাবি।’
চন্দন বলে, ‘একটা হোমো মরার পরে নরকে গেছে।’
‘অ্যাই! হোমো বললি কেন?’ চোখ পাকায় আপ্পু।
‘তাহলে সমকামী বলি?’ নিরীহ মুখে প্রশ্ন করে চন্দন।
‘ঠিক হ্যায়। আগে বাড়।’ রিপু ধমক দেয়।
‘হোমোকে দেখে যমরাজ বলল, ”পৃথিবীতে তোমার কিত্তিকলাপ তো সাংঘাতিক হে। চিত্রগুপ্ত, একে টগবগে গরম তেলে ভাজো।” চিত্রগুপ্ত বলল, ”আচ্ছা যমরাজ।” যমরাজ অন্য পাতকিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারঘণ্টা পরে, সব কাজ চুকিয়ে চিত্রগুপ্তর কাছে এসে যমরাজ দেখে, সে এখনও উনুনই ধরায়নি। যমরাজ খচে ফায়ার হয়ে বলল, ”কী ব্যাপার চিতু? এখনও তেল গরম হল না? হোমোটাকে ভাজবে কখন?” চিত্রগুপ্ত কাপড়চোপড় ঠিক করতে করতে বলল, ”তেল গরম করা অনেক দূরের ব্যাপার যমরাজ। হোমোটার জন্য আমি সামনে ঝুঁকে উনুনে কাঠ গুঁজতে পর্যন্ত পারছি না”।’
সিনিয়াররা হোহো করে হাসছে। বৃন্দাও একপ্রস্ত হেসে নিল। আপ্পু বলল, ‘বৃন্দা, এদিকে আয়।’ বৃন্দা আপ্পুর পাশে দাঁড়াল। এই টেবিলের চারদিকে কোনও বসার জায়গা নেই। সব বেঞ্চি এবং চেয়ার ভরতি।
‘বোস।’ বলল আপ্পু।
‘কোথায় বসব?’ সন্তর্পণে প্রশ্ন করে বৃন্দা।
‘কোথায় বসবি? ঠিক কথা…’ চিবুকে আঙুল দিয়ে টকটক শব্দ করে আপ্পু। বলে, ‘তুই বরং তোর প্রেমিকের কোলে বোস।’
কথাটা শুনে বৃন্দার কান গরম হয়ে গেল। এ আবার কী ধরনের নোংরামি? তবে এখন রাগ করলে বিপদ। ঠান্ডা মাথায় ডিল করতে হবে। নিরীহ গলায় সে বলল, ‘আমাদের নতুন প্রেম। প্রথমেই কোলে বসব না। বরং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে বসি।’
‘এখানে ভিক্টোরিয়া পাব কোথায়?’ চোখ পাকায় আপ্পু।
‘তুমি আমার জন্যে একটা প্রেমিক বানিয়ে দাও, আমি তোমাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বানিয়ে দেব।’ মুচকি হেসে বলে বৃন্দা।
‘আচ্ছা?’ আবার চিবুকে আঙুল দিয়ে টকটক শব্দ করে আপ্পু। সাদা সালোয়ার কামিজ পরা বিশাল বপু দুলিয়ে বলে, ‘এই চন্দন ছেলেটা তোর প্রেমিক। নে, আমি তোর প্রেমিক বানিয়ে দিলাম। এবার তোর ডিউটি।’
বৃন্দা চন্দনের কাছে গিয়ে বলল, ‘চন্দন, প্রাণাধিকেষু, চলো আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় বসে লুডো খেলি।’
চন্দন আঁতকে উঠে বলল, ‘লুডো? সে তো বুলাদি খেলে।’ তার মুখের ভঙ্গি দেখে টেবিলের চারিদিকে বসে থাকা সিনিয়ররা হাসিতে ফেটে পড়ল।
‘তা হলে চলো, আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় বসে সাপসিঁড়ি খেলি।’ চন্দনকে হ্যাঁচকা টানে বেঞ্চি থেকে তোলে বৃন্দা। হাত ধরে টানতে টানতে আপ্পুর পাশে নিয়ে আসে। আর এক হ্যাঁচকায় চন্দনকে মেঝেতে বসিয়ে, নিজেও আপ্পুর পায়ের কাছে বসে পড়ে।
‘কী হল?’ আঁতকে উঠে বেঞ্চিতে পা তুলে বসে আপ্পু। ‘পাগল হয়ে গেলি নাকি?’
‘আসলে…’ মিনমিন করে বৃন্দা বলে, ‘আমি তোমাকে বলেছিলাম যে ”তুমি আমার জন্যে একটা প্রেমিক বানিয়ে দাও, আমি তোমাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানিয়ে দেব।” তুমি তোমার কথা রাখলে, তাই আমিও আমার কথা রাখলাম। তোমাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানিয়ে দিলাম। সাদা, বড়, গোল… তোমাদের দুজনের মধ্যে অনেক মিল আছে।’
আপ্পু হোহো করে হাসতে হাসতে বেঞ্চি থেকে পা নামাল। টেবিলের চারদিকে বসে থাকা সিনিয়ররা চটরপটর হাততালি দিচ্ছে। চন্দন বলল, ‘প্রাণাধিকেষু বৃন্দা, আমি এবার ভিক্টোরিয়ার দোতলায় উঠতে চাই।’
‘ওরেববাস! এ ছোকরা মহা বদ তো!’ আপ্পু বেঞ্চির ওপরে পা তুলে নিয়েছে।
মেঝে থেকে উঠে সালোয়ার কামিজের পিছন দিকটা ঝেড়ে নেয় বৃন্দা। র্যাগিং অথবা ইন্ট্রো পর্ব শেষ!